জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৯/ শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৯

শুভদীপ বসু

বিষয়- বিরতি

সঠিক সময় নীরবতা সংলাপের চেয়েও বেশি বাঙ্ময়। অভিনয়ের সময় বাক্যে অর্থানুসারে ছেদ ছাড়াও চেতনানুভূতি অনুসারেও বিরতি ব্যবহার করা হয়। অর্থানুসারে বিরতি হলো logical pause, এর সঙ্গে বুদ্ধির সম্পর্ক। চেতনানুভূতিজাত রসভাব সমন্বিত বিরতিকে psychological pause বলে। এর সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক, অনুভূতি সম্পর্ক।

  ছেদ ও যতি: ছেদ একপ্রকার বিরতি।অর্থ গ্রহণ ও শ্বাস গ্রহণের সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে ছেদ ব্যবহার করা হয়। যতিও একপ্রকার বিরতি। কিন্তু ছেদ ও যতি মধ্যে পার্থক্য আছে।যতি ব্যবহার করা হয় কবিতার ছন্দে নির্দিষ্ট রূপকল্প অনুসারে। এতেও শ্বাস গ্রহণের সুবিধে হয়। যতির সঙ্গে অর্থগ্রহণের কোন যোগ নেই।ছেদ পড়ে প্রধানত অর্থ গ্রহণের সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে। অনেক সময় ছেদ ও যতি যে মিল হয় তা আকস্মিক।যেমন-
"তুমি যদি,দেবী,/ লহ করো পাতি-/
আপনার হাতে /রাখ মালা গাঁথি,/
নিত্য নবীন/ রবে দিন রাতি/সুবাসে ভাসি;/
সফল করিবে/জীবন আমার/ বিফল বাসনা/ রাশি।।"(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্রা)
এই কবিতাংশে কতগুলো জায়গায় ছেদ ও যতি মিলে গেছে অর্থাৎ একই জায়গায় ছেদ ও যতি ব্যবহার হয়েছে। আবার কতগুলো জায়গায় যতির ব্যবহার আছে কিন্তু ছেদের ব্যবহার নেই।

নানা প্রকার ছেদ চিহ্ন:

১)পূর্ণচ্ছেদ (Full stop)- ।
২)অর্ধচ্ছেদ (Semicolon)-  ;
৩)পাদচ্ছেদ (Comma)-      ,
৪)দৃষ্টান্তচ্ছেদ(Colon)-         :
৫)যোগ চিহ্ন( Hyphen)-      -
৬)দীর্ঘ যোগ চিহ্ন (Dash)-   --
৭)লোপ চিহ্ন(Apostrophe)- '
৮)উদ্ধৃতি চিহ্ন(Inverted commas)- "
৯) বর্জন চিহ্ন (Omission)-  ...
১০)জিজ্ঞাসা চিহ্ন(note of interrogation)-  ?
১১)বিস্ময় চিহ্ন(note of exclamation)-  !
ইতিহাসে বিরাম চিহ্ন:

অষ্টাদশ শতকের  মধ্যভাগে চিঠিপত্র, নথিপত্রে, জমির বিল পত্রে বাংলা গদ্যের নমুনা পাওয়া যায়।
উনিশপ্রথম দশকে রামরাম বসু রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র প্রকাশের সময় এক ও দুই দাঁড়ি বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের কথা ভাবেন।এরপর উইলিয়াম কেরির কথোপকথন গ্রন্থে ইংরেজি বাক্যের বিরাম চিহ্নের অনুসরণ করে বাক্যের শেষে দাঁড়িয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রামমোহন রায় প্রথমদিকে এক ও দুই দাঁড়ি বিরাম চিহ্নের ব্যবহার করলেও, পরে 1833 সালের গৌড়ীয় ব্যাকরণ গ্রন্থে সাহসী ও পরিণত ভাবে বিরাম চিহ্নের প্রয়োগ করেন। বাংলা গদ্য কে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম সরল ও গতিময় করে তোলে বিরাম চিহ্নের প্রয়োগে। তার অবদান ভুলে যাওয়ার নয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বিস্ময় চিহ্ন, ড্যাশ ইত্যাদি চিহ্ন বিদ্যাসাগর মহাশয় সাহসিকতার সাথে ব্যবহার করেছেন।

  এরপরে বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যে বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে। রবি ঠাকুরের পরে রাজ শেখর বসু বুদ্ধদেব বসুর নাম বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনভাবে উল্লেখ করতে হয়। কমা, সেমিকোলন, ঊর্ধ্ব কমা সম্পর্কে রাজ শেখর বসু বুদ্ধদেব বসুর মতামত সুস্পষ্টভাবে জানা যায় তাদের গদ্য গুলি থেকে। তবুও যেহেতু বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের স্থিরীকৃত রূপ নেই, তাই এইসব কীর্তিমান গদ্য লেখকদের লেখাতেও বিরাম চিহ্ন ব্যবহারের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বুদ্ধদেব বসু ও আবু সয়ীদ আইয়ুব এর লেখায় উর্ধ্বক্রমর প্রয়োগ রয়েছে প্রচুর আবার বুদ্ধদেব বসুর রচনা কমার বহুল প্রয়োগ রয়েছে। রাজশেখর বসু একজাতীয় বিশেষ্য বিশেষণ শব্দের পর বিবৃতিতে কমা ব্যবহার করতেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন সেমিকোলন ব্যবহার করছেন ওই জায়গায় রাজ শেখর বসু ব্যবহার করছেন দাঁড়ি। বাংলা ভাষার ইতিহাসে বিরাম চিহ্ন সত্যিই একটি ইতিহাস যার সুনির্দিষ্ট ব্যবহার এখনও সঠিক রূপ লাভ করেনি।
ছেদ চিহ্নের জন্য বিরতি ছাড়াও পাঠের বা অভিনয়ের সময় ভাব অনুযায়ী বাক্যকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে নানারকম বিরতি ব্যবহার করা হয়-
১) যুক্তিসংগত বিরতি
২) মনস্তাত্ত্বিক বিরতি
৩) বাতাস নেবার জন্য বিরতি
৪) শব্দের উপর জোর দেওয়ার জন্য বিরতি
৫) ভাবের পরিবর্তনের জন্য বিরতি
৬) ব্যাখ্যামূলক বিরতি
৭) সক্রিয় বিরতি
৮) ছন্দময় বিরতি

বিরাম চিহ্নের প্রয়োজনীয়তা:

১)বিরাম চিহ্নের প্রথম কাজ শ্বাস বিরতির জায়গা দেখিয়ে দেওয়া।
২) বিরাম চিহ্ন বাক্যের অর্থ প্রধান সহায়ক।
৩)বাক্যের শব্দগুলির অর্থাৎ পদগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝাতে সাহায্য করে।তাদের অন্বয় কে স্পষ্ট করে তোলে।
৪) অযথা অতিরিক্ত বিরাম চিহ্ন কাম্য নয়।
৫) আবার প্রয়োজনীয় বিরাম চিহ্নের ব্যবহারে কৃপণতাও কাম্য নয়।

বিরাম চিহ্নের সমস্যা:

১) বিরাম চিহ্নের সঠিক কোন নীতি সুনির্দিষ্টভাবে নেই।যতক্ষণ নীতি ওমান বিধিবদ্ধ না হচ্ছে ততক্ষণ ভাষা ব্যবহারকারীরা অসুবিধার সম্মুখীন হবেন।
২) অনেক সময় দেখা যায় দুটি বা তিনটি চিহ্নের মধ্যে কোনটি উপযুক্ত সে সম্পর্কে সংশয় থাকে। বাক্যে কমা,সেমিকোলন বা ড্যাশ কোনটি ব্যবহার করা হবে তা লেখকেরা বুঝে উঠতে পারেন না।
৩)বহু লেখক বিরাম চিহ্নের ব্যবহার বিষয়ে তাদের নিজেদের বোধ এবং রুচির ওপর নির্ভর করে থাকেন। ইংরেজি লেখক G.V Careyবলেন-' I should define punctuation as being governed two-thirds by rule and one-third by personal taste.'
মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন-'জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল'এই বিরতি অনুভবকে ব্যক্ত করতে সাহায্য করে,বোধের জাগরণ ঘটায়।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments