জ্বলদর্চি

জাপানের লোকগল্প (চাঁদের জন্ম) / চিন্ময় দাশ

জাপানের লোকগল্প

চিন্ময় দাশ

চাঁদের জন্ম 

(জাপানকে বলা হয়- উদিত সূর্যের দেশ। জাপানের প্রবীন মানুষেরা বলেন, চাদেরও জন্ম হয়েছিল তাঁদের দেশেই। ছােট্টবেলায় চাঁদের জন্মের সেই কাহিনী তাঁরা শোনান নাতি-নাতনিদের। আজ এখানে সেই গল্পই শােনাব আমরা।)

  অনেক অনেক কাল আগের গল্প এটা। বলা যেতে পারে, পৃথিবী তৈরি হওয়ার একেবারে গােড়ার দিকের সময়ের কথা। সেই হিসাবে, পৃথিবীর প্রথম গল্প বলা হয় এটাকে।

  সবে তখন পৃথিবী তৈরি হয়েছে। তার সাথে, গোল আকারের একটা সূর্য বানিয়ে আকাশে ঝুলিয়ে দিয়েছেন বিধাতা পুরুষ। চাঁদ বলে কিছু তৈরিই হয়নি। একা সূয্যি মামাই সারাদিন ঝুলে থাকে আকাশে। ঝুলে থাকে, আর আলাে দেয়। আলাে দেওয়ার কোন বিরাম নাই তার।

  সূয্যিমামা ডােবে না কখনও। তাই রাত কী জিনিষ, তা জানেই না কেউ। মাথার উপর গনগনে সূর্যটা জ্বলছে, তাে জ্বলছেই। আলাে আছে, তাই সারাটা সময় খেটে মরে লােকে। কখন একটু জিরিয়ে নিতে হবে, তা জানাই নাই কারও। 
একদিন বিধাতা পুরুষ এলেন পৃথিবীটা ঘুরে দেখতে। পৃথিবী তৈরি করবার পর থেকে, একবারও আসা হয়নি তাঁর। মানুষজন কেমন আছে, নিজের চোখে একবার দেখা দরকার।

  বিধাতা যখন এলেন, লােকেরা খেতে কাজ করছিল। সটান সেখানে চলে এলেন বিধাতা। একজনকে ডেকে বললেন-- শেষ কবে জল দিয়েছ তােমার জমিতে? 
লোকটা বলল-- কবে আবার দেব? আজই দিয়েছি।
বিধাতা তখন আর একজনকে শুধােলেন-- বাগানে চারাগুলাে পুতেছ কবে?

 ঘামে ভেজা লােকটা বলল-- কেন, আজই পুঁতেছি।
পাশ থেকে আরও একজন সায় দিয়ে বলল-- হ্যা, আজই তাে!

  লােকটা বলল-- অবশ্যই আজ। সারাটা সময়ই রােদ জ্বলছে। তাহলে, আজই তাে করেছি কাজটা। তাই না?
একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার মা। বিধাতা তাকে জানতে চাইলেন-- হ্যাঁগাে মেয়ে, কবে জন্মাল তােমার ছেলেটি ?
-- আজই তাে! অবলীলায় জবাব দিল মেয়েটি।

  এবার বিধাতা পুরুষ বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা। সময়ের কোনও ধারণাই নাই পৃথিবীর এই লােকেদের। দিন আর রাতের ফারাক জানে না বেচারারা। কাজই করে চলেছে অবিরাম। তখন বিধাতার মনে হল, এভাবে চলতে পারে না। কিছু একটা বিহিত করা দরকার।

  সূর্যকে ডেকে বললেন-- লাগাতার আকাশে ঝুলে থেকে আলাে দিতে হবে না তােমাকে। তােমারও তাে বিশ্রামের দরকার। তাছাড়া, ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকো কেন ? খানিকটা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে পারাে তাে। এক কাজ করাে, কিছু সময় আলাে দিয়ে, তুমি ঘুমােতে চলে যাও। যতটা সময় আলাে দেবে, ঘুমাবেও ততটা সময়। তার ঠিক ততটা সময় পরে, আবার উঠে আসবে আকাশে, নিজের জায়গাটিতে।

  সূর্য এমন কথা শুনে একটু ভড়কেই গেল। আমতা আমতা করে বলল-‘কোনও কষ্টই তাে হচ্ছে না আমার! বিধাতা বললেন-- শুধু নিজের কথাই ভাবলে চলবে? অন্যদের কথাও ভাবতে হয়। মানুষগুলাের অবস্থা দেখেছ? তুমি ঘুমােতে গেলে, আলাে নিভে যাবে। দিন আর রাতকে চিনতে পারবে ওরা। তখন লােকগুলােও জিরিয়ে নিতে পারবে কাজ ছেড়ে।

  আর কথা না বাড়িয়ে, সূর্যও রাজি হয়ে গেল।

  হিসেব মত সময়ে, সূর্য চলে গেল ঘুমিয়ে নেবে বলে। অমনি ঝুপ করে আঁধার নেমে এল চারদিকে। তাতে ভারি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল লােকগুলাে। এমনটা তাে আগে কখনও ঘটেনি। যেদিকেই চেয়ে দেখতে চায়, নিকষ কালােয় ঢাকা সবকিছু।

  ভারি ভয় ধরে গেল সবার মনে। এদিক ওদিক দৌড়তে শুরু করল। এ ওর গায়ে ধাক্কা খায়। কেউ গর্তে পড়ে চেঁচিয়ে ওঠে। কেউ গাছে ঠোক্কর খায়। এমন অবস্থা আগে কখনাে হয়নি। কেউ বুঝেই উঠতে পারছে না, কী করা যেতে পারে।

  তখন মােড়ল আর মুরুব্বিরা মিলে একটা রাস্তা বের করল-- যে যেখানে আছাে, সেখানেই মাটিতে গা এলিয়ে দাও। ঘুমিয়ে পড় সবাই। বেশ খানিকটা বিশ্রাম হয়ে যাবে এই সুযােগে। শরীর জুড়ােবে তাতে। দেখা যাক, আলা কখন ফোটে। আলাে ফুটবে যখন আবার, তখন উঠে পড়া যাবে না হয়।

  বিশ্রাম সেরে, পরদিন সূর্য উঠে এল আকাশে। সােনার মত ঝলমলে আলাে ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীতে। লােকগুলাে ধড়মড় করে জেগে উঠল।

  দারুণ অবাক হয়ে গেল সবাই। বেশ তরতাজা লাগছে নিজেদের। শরীর মন দুইই বেশ ঝরঝরে। আনন্দে কাজে লেগে গেল আবার। সেই থেকে তাদের কাছে দিনটা হােল কাজের সময়। রাতটা হয়ে গেল জিরিয়ে নেওয়ার, ঘুমিয়ে নেওয়ার সময়।

  এখন বেশ সুখেই দিন কাটে সকলের। কাজ সারবার পর বিশ্রাম হয়, ঘুম হয়। কাজেও উৎসাহ পাওয়া যায় তাই। কিন্তু একটা ঝামেলা রয়েই গেছে। সূয্যি ডুবে গেলেই, অমনি নিকষ অন্ধকার। কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না। এটায় ওটায় ধাক্কা খেতে হয়। খানা-খন্দে পড়ে, পাথরে ঠোক্কর খায়। কোন জিনিষটা কোথায় রাখা আছে, দেখা যায় না। হাত পা লেগে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। যাকে বলে একোরে নাজেহাল অবস্থা।

  দিন কয়েক বাদে, বিধাতা এসে হাজির হলেন আবার। বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে তাঁকে--  কী, এবার সবাই সুখে আছাে তাে ?

  খুশিতে ডগমগ হয়ে লোকগুলো বলল-- হ্যাঁ, ঠাকুর। বেশ সুখে আছি এখন। সারা রাত ধরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাই। সকালে ঘুম ভেঙে যখন উঠি, শরীর মন এক্কেবারে তরতাজা লাগে। নতুন করে ফুর্তিতে কাজে লেগে পড়তে পারি সবাই।
  কিন্তু তাদের মােড়ল এগিয়ে এল বিধাতার সামনে-- কিন্তু একটা ঝামেলা রয়েই যাচ্ছে। সূর্য ডুবে গেলেই, চারদিক ঘণ অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। ধাক্কাধাক্কি, আছাড় খাওয়া, জিনিষপত্তর ভাঙা। হয়রানির একশেষ। এর কিছু একটা বিহিত করে দাও তুমি।

  বিধাতাও বুঝলেন সমস্যাটা। সত্যিই অসুবিধার ব্যাপার। কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। এবার অন্যদের গলাতেও কথা ফুটল-- কেবল রাতের বেলায় একটু আলাের জোগাড় করে দাও তুমি। আর কিছু চাই না তােমার কাছে। কিচ্ছুটি না।

  মােড়ল বলল-- আচ্ছা ঠাকুর, রাতের বেলা কিছু সময়ের জন্য একবার সূয্যিটাকে পাঠিয়ে দিতে পারাে না তুমি?
-- না। তা হবে না। তবে চিন্তা কোর না, অন্য একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সূর্যের মতই হবে সেটা। তাছাড়া, তার আলাে হবে অনেক মােলায়েম। তেজও কম হবে সূর্যের চেয়ে। সে আলাের মধ্যে সব কিছুই দেখতে পাবে তােমরা। ঘুমােতেও পারবে সেই মিষ্টি আলােয়। ভালই লাগবে তােমাদের।

 তখনই বিধাতা চাঁদ বানিয়ে দিলেন পৃথিবীর জন্য। লােকজন যারপরনাই খুশি। রাতের বেলাতেও দেখতে পেল তারা সবকিছু। ঠোক্কর খেতে হয় না কোন কিছুতে। চাঁদের মিষ্টি আলাের নীচে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।

  চাঁদ নিজেও কম খুশি নয়। রাত শেষ হয়ে এলে, সূর্য চলে আসে আকাশে। তখন চাঁদ ছুটি পেয়ে যায়। তার চেয়েও বড় কথা, তেজহীন মিষ্টি আলোর জন্য, সবাই ভালবাসে চাঁদকে। সূর্যের চেয়েও তাকেই যেন একটু বেশিই ভালবাসে মানুষজন।

  সেই থেকে চাঁদও রয়ে গেছে আকাশে।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments