জ্বলদর্চি

বিপন্ন বাংলাভাষা: সময়ের আলোচনা/গৌতম বাড়ই

বিপন্ন বাংলাভাষা: সময়ের আলোচনা

গৌতম বাড়ই 

"মোদের গরব, মোদের আশা। আ মরি! বাংলাভাষা।"

  বিপন্ন বাংলাভাষা- এই শিরোনামেই শুরু করলাম আজকের অর্থাৎ সাম্প্রতিক কালের বহু আলোচিত এই দুটি শব্দ নিয়ে। সত্যি কি বাংলাভাষা বিপন্ন? তাহলে আমাদের বাংলাভাষার একটু উৎস সন্ধানে যেতে হয়। 

  বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রায় ১২০০ -১৩০০ বছরের পুরনো। ইতিহাসবিদ্- র মতেও তাই। কারণ, বাংলা সাহিত্যের সূচনা হয় খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে। আবার কিছু ঐতিহাসিকদের মতে ৯৫০ খ্রিষ্টীয় শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের সূচনা হয়।
  সেই হিসেবে বাংলাভাষা বা সাহিত্যের ইতিহাস খুব একটা প্রাচীন নয়। ভারতবর্ষে ঘটনাচক্রে পূর্ব দিক হতে কলকাতাকে কেন্দ্র করে ইওরোপীয় বিশেষ করে ইংরেজ সাম্রাজ্যের সূচনা হয় ১৭৫৭- সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা- কে পরাজিত করে। আর তাদের শাসন ব্যাবস্থা টিকিয়ে রাখবার তাগিদে যে পশ্চিমী শিক্ষাধারার প্রচলন হয় তার আলোক পায় এখানকার দেশীয় শিক্ষাধারা। এরজন্য ইতালী র‌্যনেশাঁসের প্রভাব পড়ে বাংলাদেশে। আর এই নবজাগরণের অগ্রদূত হিসেবে রাজা রামমোহন রায়, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীদের উল্লেখ করতেই হয়। বাংলা শিল্প, সংস্কৃতি আর সাহিত্যের পীঠস্থান হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে। তারও পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে আজ বাংলাভাষা শত বিপন্নতার মাঝেও আন্তর্জাতিক ভাষা রূপে স্বীকৃত। 

  তবে এই বিপন্নতা এর আগেও এসেছে। বাংলাভাষা কিন্তু হারিয়ে যায়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দীকে বাংলা সাহিত্যের "অন্ধকার যুগ" বলে অবহিত করা হয়। বাংলা সাহিত্যের ১২০১-১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কে “অন্ধকার যুগ” বা “বন্ধ্যা যুগ” বলে কেউ কেউ মনে করেন। ড. হুমায়ুন আজাদ তার “লাল নীল দীপাবলী” গ্রন্থে (পৃ. ১৭) লিখেছেন- “১২০১ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত কোন সাহিত্য কর্মের পরিচয় পাওয়া যায়না বলে এ-সময়টাকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। পণ্ডিতেরা এ-সময়টাকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন, অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে পারেন নি। এ সময়টির দিকে তাকালে তাই চোখে কোন আলো আসেনা, কেবল আঁধার ঢাকা চারদিক।”

  নেপালের রাজ- দরবার থেকে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের বৌদ্ধ দোঁহা সংকলন চর্যাপদের আবিষ্কার বা উদ্ধার বাংলাসাহিত্যেকে প্রাচীনতায়  এক লহমায় কয়েক'শ শতাব্দীর  তকমা দেয়। চর্যাপদের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের  "হাজার বছরের পুরাতন বাংলা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোঁহা" আরও তিনটি গ্রন্থের সাথে চর্যাগানের সঙ্কলন নামে একটি গ্রন্থ সম্পাদিত করেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ছিল মূলতঃ কাব্যপ্রধান। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে বাংলাসাহিত্য আধুনিকতার ছোঁয়াচ পায় আর ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলার নবজাগরণের যুগে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নতুন যুগের সূচনা হয়। মধ্যযুগের এই মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত পদাবলী, পীর সাহিত্য বা রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ এবং ধর্মীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্যের চর্চা ছেড়ে এই নতুন যুগে দেখা গেল মানবের মনস্তত্ত্ব, মানুষ ও মানবতা নিয়ে সাহিত্যে বিপুলভাবে প্রতিফলন হতে। ধর্মীয় বিষয় ক্রমে গৌণ হতে থাকল সাহিত্যের এই নতুন যুগের পদার্পণে। শ্রীচৈতন্যের প্রভাব আর এখানে এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা করছি না। ১৯৪৭-  সালে দেশভাগের পর বাংলা সাহিত্য পরিষ্কার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটি কলকাতা শহর কেন্দ্রীক আর একটি ঢাকা শহর কেন্দ্রীক। আর এই ঢাকা শহর কেন্দ্রীক বাংলাভাষা এবং ভাষা নিয়ে উদ্দীপনা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিল। বাংলাদেশ। তাদের সেই ২১- শে ফেব্রুয়ারীর আত্মবলিদান আজ শুধু মাতৃভাষা দিবস নয়, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। 

  এ কথাগুলো না বললে, এ লেখা অসম্পূর্ণ থাকে তাই একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম বাংলাভাষা নিয়ে। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ বহুধা ভাষায় বিভক্ত। প্রত্যেকটি ভাষার ঐতিহ্য স্বতন্ত্র, ইতিহাস স্বতন্ত্র। কোন ভাষায় কথা  বলে কোটি কোটি লোক আবার কোন ভাষায় মাত্র কয়েক লক্ষ।কোন ভাষা অতি প্রাচীন তেমন তামিল, আবার কোন ভাষার বয়স হাজার বছরের চেয়ে কম। কোন কোন ভাষা, যেমন সংস্কৃত বা পালি আজ আর সাধারণের মধ্যে প্রচলিত নয়। কিন্তু বহু মানুষের ধর্ম জীবনে আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার কোন ভাষা আছে ভারতে যে ভাষার লিখিত সাহিত্য নেই, আছে শুধু মৌখিক সাহিত্য। তারাও ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যে এখনও বিদ্যমান। তারা টিকে আছে যখন, তখন সাহিত্যে সংস্কৃতিতে এক অতি সমৃদ্ধশালী ভাষা বাংলাও তার স্বীয় মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
  বাংলাভাষা তাই ছিল আছে এবং থাকবে চিরকাল। বিপন্নতা তো সাময়িক। ভাষা অনবরত গ্রহন এবং বর্জনে এগিয়ে চলবে আধুনিকতায়। ভাষা গড়ে তোলে একতা। ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। যখন কৃষ্টি সংস্কৃতিকে বিপন্নতা গ্রাস করতে থাকে তখন মানুষ নিজের ভাষার আধারে মুক্তির পথ খুঁজবেই। এর আগেও বাংলাভাষায় এরকম সঙ্কটকাল এসেছে এবং বাংলাভাষা স্বমহিমায় আবার জেগে উঠেছে। ইংরেজী বা হিন্দী কেউ কখনও বাংলাভাষাকে গ্রাস করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। বরং বাংলাভাষা উত্তরোত্তর নিজেকে আধুনিকতার পরশে নিজেকে উচ্চমহিমায় তুলে ধরেছে। তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় সবসময় আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো এবং রাজনৈতিক পরিবেশ  আমাদের অনেকটা এই বিপন্নতা বোধে আচ্ছন্ন করে ঠিকই এবং আমদের তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কী উপযুক্ত পদক্ষেপ নেব? এর জন্য সুধী সমাজ আর সমাজসংস্কারক  এবং বাংলাদেশের বিদগ্ধ ব্যাক্তিবর্গকে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাঁদের জন্যই প্রশ্নটি তুলে রাখলাম। 
  আজ যখন ২১শে- ফেব্রুয়ারীকে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে এপার বাংলা, ত্রিপুরা , আসামের এক বৃহত্তর অঞ্চল একাত্ম করে নিয়েছি, তখন এই কোটি- কোটি বাঙালীর একাত্ম বোধেই বাংলাভাষা বিশ্বের ভাষার গগণে উজ্জ্বল তারা হয়েই জ্বলজ্বল করে থাকবে চিরকাল। বিপন্নতা আমাদের বোধের, এরসঙ্গে বাস্তবের আসমান- জমিন ফারাক। আমার তাই মনে হয় কোন বিপন্নতা নেই, আমরা আরও অবিরত বাংলাভাষা চর্চা করি। যতই কঠিনতা থাকুক তার অক্ষরে তার ভাষার বিন্যাসে, অবিরত ব্যাপক চর্চায় মাতৃভাষাই মানুষকে সবসময় সঠিক পথের দিশা দেখায়। মহান করে তোলে একটা জাতিকে। সে জার্মানি হোক, চিনা কিংবা জাপানি ভাষা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

  কোন বিপন্নতা নয়, শিলচর হোক বা ঢাকা আমাদের আজও মন কাঁদে বাঙালি বলে ঐ আত্মত্যাগের বলিদানে। তাই " আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী" আমাদের সবার। যে ফেব্রুয়ারী জন্ম দিয়েছিল একটি স্বাধীন দেশ, যে দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। 

  তাই ভাষা দিবসের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আমাদের শপথ হোক ঐ বিপন্নতাকে দূরে সরিয়ে নিরন্তর বাংলাভাষা চর্চা আর প্রীতি উপহারে বাংলাভাষার বইকে আবার সংযোজন করা। আমি বিপন্ন বাংলাভাষা বলতে তাই পারিনা এখনও। 

তাই বলি শুরুর কথা শেষে আবার একটি বার -- 

মোদের গরব, মোদের আশা। আ মরি! বাংলাভাষা।"

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments