জ্বলদর্চি

বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ভবিষ্যৎ/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

"যখন আপনি কোনো ভাষায় কাউকে কিছু বলেন, তা তার মস্তিষ্কে পৌঁছায়, তা সে বুঝতে পারে। কিন্তু যখন তার নিজের  ভাষায় বলেন, তখন তা হৃদয়ে পৌঁছায়।"---- নেলসন ম্যান্ডেলা। 

বাংলা ভাষা আন্দোলন ও ভবিষ্যৎ

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শিশু জন্মের পর তার মায়ের কাছ থেকে শুনে যে ভাষায় কথা বলে, সেটাই হলো তার মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষা হল বাংলা। বর্তমানে বাংলা ভাষায়  কথা বলা মানুষের সংখ্যা ৩০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সংখ্যার বিচারে পৃথিবীতে চতুর্থ, মতান্তরে পঞ্চম। এবং ভারতের দ্বিতীয় স্থানাধিকারী বাংলা ভাষার এখন নাভিশ্বাস উঠছে। 

  এই ভাষা দিবস এলে আমরা একটু গা নাড়া দিয়ে উঠি। যেমন কুকুর দীর্ঘক্ষণ ছাইয়ের গাদায় শুয়ে টেনে একঘুম মারার পর, হঠাৎ মৃত গরুর কথা মনে পড়ে গেলে যেমন গা- ঝাড়া দিয়ে ওঠে। আর আমরা কবিতা গল্প উপন্যাস লিখছি, আর সন্তানের সাথে কথা বলছি ইংরেজিতে। সন্তানকে শেখাচ্ছি ড্যাডি ম্যামি বলতে। পড়াচ্ছি ইংলিশ মিডিয়ামে। তাহলে আমরা লিখছি কাদের জন্য? লিখছি তাদের জন্য, যাদের বাবা মা ইংরেজিতে পড়াতে পারছে না। যারা গরীব গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। এই মুহুর্তে বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সংকটে না পড়লেও ভবিষ্যত যথেষ্ট অন্ধকার। এর কারণ সমাজের ক্ষমতাবানদের বাংলা ভাষা পরিত্যাগ। একক ভাষা হিসেবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের দিকে ঝোঁক বৃদ্ধি। তার ফলে বাংলা পড়া ও কথা বলার লোকজন কমে যাচ্ছে। সংবাদপত্র বিভিন্ন লেখায় ইংরেজি হিন্দির দেদার ব্যবহার। উপর থেকে অলিখিত নির্দেশ আসছে, ইংরেজি শেখো আর শেখাও। তার ফলে টিভি রাস্তাঘাটে এমনকি সরকারি দফতরেও চলছে বিকৃত বাংলায় বিজ্ঞাপন। অবাক হই যখন দেখি বাংলায় ডক্টরেট কিংবা ডি. লিট- দের বাংলা বানান ভুলে ভরা। তাই যতই দেখি অবাক হই। আজকের ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথকে চেনে না। অথচ রবীন্দ্রনাথের গান বাজে মোড়ে মোড়ে। 

  আশার কথা একটাই বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হবে না।কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এখনো "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি" বাংলাদেশের মানুষের নিছক উচ্চারণ নয়, এটা তাদের হৃদয়ের শপথ। তাঁদের মাতৃভাষা রবীন্দ্রনাথের ভাষা, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণ দিয়েছে বরকত রফিক শফিউর-সহ আরও অনেকে। তাই এদিনে তাদের না স্মরণ করলে, বাঙালী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার যোগ্যতা হারাবো।

  ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার যে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়, তার পূর্বাপর ঘটনা প্রবাহকে ভাষা আন্দোলন বলে। জনগণের বৈষয়িক ও আত্মিক কাজকর্মই হচ্ছে, সেই জাতির সংস্কৃতি। সংস্কৃতিই একটি জাতির প্রাণ। সেই সংস্কৃতিকে ধারণ করে বাঁচিয়ে রাখে ভাষা। ভাষাও ঐ জাতির দীর্ঘ পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। সুতরাং ভাষার উপর আঘাত পুরো জাতি এবং তার সংস্কৃতির ওপর আঘাতের সামিল। বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত করা হয়েছিল। অতএব বাংলাভাষী মানুষের ও প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ জোরালো। 

  ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙালির জাগরণের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক নানা কারণ। জগৎ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দুটি প্রধান ও মৌলিক মতবাদের একটি ভাববাদ অপরটি বস্তুবাদ। মানুষের চেতনা বিকাশের আদিকাল থেকেই দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত ভাববাদী জীবন সৃষ্টির বিপরীতে বা বস্তুবাদী জীবনদর্শনের জাগরণ। একটির দৃষ্টি একটি ভাষাকে পবিত্র, সম্ভ্রান্ত ও সার্বজনীন বলে ধরে নেওয়া, অপরটি চিন্তা যৌক্তিক, জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে যাচাই করার প্রবনতা। দুটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাতই মূলত ভাষা-আন্দোলনে ক্রিয়াশীল ছিল। বাংলায় ইংরেজ শাসনের ফলে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ব্যক্তিবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণা জাগ্রত হয়। বিভিন্ন সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। হিন্দু সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের ভূমিকা; মুসলিম সমাজ সংস্কার- হাজী মহম্মদ মুহসীন,নওয়াব আবদুল লতিফ, মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি, সৈয়দ আমির আলি, হাজী শরীতুল্লাহ, দুদুমিয়া প্রমুখের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিংশ শতকে এসে বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন প্রভৃতির মাধ্যমে বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক  চেতনার বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়। রাষ্ট্রভাষা সমস্যা, স্বাধীন পাকিস্তানের সমস্যা। মানুষের জাগরণ, বিপ্লব-বিদ্রোহ বা উত্থানের পেছনে থাকে কোনো না কোনো প্রেরণাদায়ী শক্তি। কিছু মানুষের চিন্তার আলো পথ দেখায় কোনো সমাজ জনগোষ্ঠীকে, তৈরি হয় নতুন সমাজ-সভ্যতা। ভাষাকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠার পশ্চাতেও নিশ্চয়ই ক্রিয়াশীল ছিল কিছু মানুষ ও তাদের চিন্তা-কর্মকাণ্ড।

  ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ভাষা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস সকল ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্বেও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে প্রায় এক হাজার মাইলেরও বেশি ব্যবধানে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করে এই অসম রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়। এই রাষ্ট্রের কর্ণধাররা প্রথমই শোষন ও বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলাকে। অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় পাকিস্তানের ভাষাগত জনসংখ্যা একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬০% বাংলা, ২৮.০৪% পাঞ্জাবি, ৫.৮% সিন্ধি, ৭.১% পশতু, ৭.২% উর্দু  এবং বাকি অন্যান্য ভাষাভাষী নাগরিক। এর থেকে দেখা যায় উর্দু ছিল পাকিস্তানি ভাষাভাষীর দিক থেকে ৩য় স্থানে। অন্যদিকে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার ৪.৪০ কোটির মধ্যে ৪.১৩ কোটি ছিল বাংলা ভাষাভাষী। এখানে ৯৮% বাংলা এবং মাত্র ১.১% ছিল উর্দু ভাষী। অথচ বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বেশ কিছু পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু সংগ্রামের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি জাতি মাতৃভাষার ওপর এ আঘাতের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। 

  পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে ভাষা বিতর্ক দেখা দেয়। ১৯০৬ সালে যখন নিখিল ভারত মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লিগের অধিবেশনেও এই ভাষার প্রশ্ন ওঠে। তবে তখন পর্যন্তও সমস্যাটি তত প্রকট হয়নি। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের একটি উদ্যোগ নিলে, ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। তৎকালীন বাংলা সরকারের সময়ও ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। ১৯৪০ সালে লাহোরের প্রস্তাবের প্রাক্কালে এই বিতর্ক মৃদুভাবে দেখা দেয়। কংগ্রেস নেতারা হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে পাল্টা ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ উর্দু ভাষাকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে খুব ক্ষুদ্র হলেও বাংলার পক্ষে দাবি ওঠে। তবে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন ভাষা বিতর্ক নতুন রুপ নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছাড়াও বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন। পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পত্র পত্রিকায় মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন। এসময় পূর্ববঙ্গে গঠিত বিভিন্ন সংগঠন ও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখে। 
পাকিস্তানের মতে বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ঐক্য বন্ধন সৃষ্টির জন্য, একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজনীয়তা প্রথম থেকেই শাসকগোষ্ঠী অনুভব করেন। পাকিস্তান রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা থেকে শুরু করে প্রভাবশালী বড় অংশ ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের উচ্চ পদধারীরা ছিলেন উর্দুভাষী মোহাজের।  মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তার উত্তরসূরী লিয়াকত আলীর মন্ত্রীসভাকে তাই 'মোহাজের মন্ত্রীসভা'  বলা হতো। এক হিসেবে দেখা যায় ১৯৪৭-৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট ২৭ জন গভর্নর জেনারেল/ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন মোহাজের। এদের আবার অধিকাংশ ভাষা ছিল উর্দু।
তবে পূর্ববাংলায় এর প্রতিবাদ ওঠে। কারণ পূর্ববাংলায় কখনোই উর্দু চর্চা হয়নি৷ বাঙালিরা গণতন্ত্র, জনসংখ্যাধিক ইত্যাদি কারণে  ৫৬% বাংলাভাষীদের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করেছে। এর সাথে জড়িত ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। সব যুক্তি উপেক্ষা করে প্রশাসন, অর্থনীতির কেন্দ্রসহ পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রের রাজধানী স্থাপিত হয় করাচিতে। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী অংশের সেখানে অবস্থানের ফলে স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান সমৃদ্ধ এলাকা এবং পূর্ববঙ্গ অবহেলিত এলাকায় পরিণত হয়। বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগের ব্যবহার, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বড় অংশ পশ্চিমে সম্পাদনের ফলে বঞ্চিত পূর্ববঙ্গবাসীদের বুঝতে হয়নি যে, পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে শুধু শাসকের বদল হয়েছে। ব্রিটিশ শোষণের বদলে পাকিস্তান শোষকের আবির্ভাব হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনীতি, প্রশাসনসহ চাকরি ও পদের ক্ষেত্রে বাঙালিদের বঞ্চিত করার নীতি। উর্দুকে সরকারি ভাষা ঘোষণা, গণমাধ্যমে ব্যাপক উর্দুর ব্যবহার, সরকারি কর্মকাণ্ডে যেমন মানি অর্ডার ফর্ম, টেলিগ্রাম ফর্ম, ডাকটিকিট, মুদ্রায় উর্দু ব্যবহার শুরু এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উর্দু ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হলে, শিক্ষিত বাঙালিরা এর প্রতিবাদ জানায়। প্রথম থেকেই তাই বাঙালী ছাত্র ও নেতৃবৃন্দের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, দাবি-দাওয়াতে বাংলা ভাষাকেও সরকারি মর্যাদা দানের দাবি তোলা হয়। এভাবে বাংলা ভাষার দাবি পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের রুপ নেয়।

  জুলাই মাসে কামরুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় 'গণআজাদী লীগ' নামে একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। এই সংগঠন স্পষ্টভাবে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করে। পরের মাসে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা বিতর্ক আরো প্রকাশ্য রুপ লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় 'তমদ্দুন মজলিস' সভা সমিতি ও লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। এই সংগঠনের উদ্যোগ ডিসেম্বর মাসে গঠিত হয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'  যার আহ্বায়ক মনোনীত হন নূরুল হক ভূঁইয়া। পরবর্তীকালে এ উদ্দেশ্য কয়েকটি কমিটি গঠিত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিসের গঠিত প্রথম সংগ্রাম পরিষদটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ বিভিন্ন সভা ও স্মারকলিপির মাধ্যমে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

  ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী কংগ্রেস পরিষদীয় দলের নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হন শামসুল আলম। ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করেন। আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে ৪৮ সালের ১৫ মার্চ আলোচনায় বসতে বাধ্য হন এবং সেখানে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে দুবার ২১ মার্চ এবং ২৪ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোঃ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে, তার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বাংলা ভাষাকে আরবিকরণের উদ্যোগ নিলে নতুন করে উত্তেজনা দেখা যায়। এভাবেই ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আন্দোলন চলছিল। 
১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে খাজা নাজিমুদ্দিনের একটি উক্তি থেকে নতুন করে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ২৭ জানুয়ারি নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।" সুতরাং নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম ৩০ জানুয়ারি সভা ও ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করেন। ঐদিনের সভায় ৪ ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হয়। ৩১ জানুযারি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরীতে সর্বদলীয় সভার মাধ্যমে ধর্মঘট সমর্থন এবং ২১ ফেব্রুয়ারী প্রদেশব্যাপী হরতাল ডাকা হয়। বার লাইব্রেরীর কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। 
  এ সময় অবজারভার পত্রিকা বাংলা ভাষার পক্ষে ভূমিকা রাখে। এ অভিযোগ ১২ ফেব্রুয়ারী অবজারভার নিষিদ্ধ হয়। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১২ ফেব্রুয়ারী কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রস্তুতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ২০ ফেব্রুয়ারী ছিল পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন। দু পক্ষের প্রস্তুতির ভিতর আকস্মিক ভাবে ২০ ফেব্রুয়ারী সরকার স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এর মাধ্যমে ঢাকায় কোন প্রকার সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারি এই ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে ঢাকা শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত ছাত্ররা সরকারি এই সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

  ছাত্রদের তীব্র উত্তেজনা এবং প্রস্তুতির ভিতর দিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারী রাত পেরিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারী ভোর উপস্থিত হয়। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সকালেই সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাকা পুলিশ কর্ডন করে ফেলে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতারা রাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করছিল। নেতৃবৃন্দের নির্দেশ সংবলিত চিরকূট জাহানারা লাইজু এবং নিজাম (গাজীউল হকের ছোট ভাই) নামের ২ জন বালক ও বালিকা ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেন। এবং নেতৃবৃন্দের নির্দেশ অনুসারে দুজন করে লোক জমায়েত হতে হতে সভাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এ সময় শামছুল আলম ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে অভিমত দেন। 

  কিছুক্ষণ পর শহীদুল্লাহ্ কায়সার (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) এবং তোয়াহা সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে সত্যাগ্রহের আকারে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে অভিমত দেন। বেলা ১১ টায় আমতলায় সভা শুরু হয়। পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুসারে এম. আর. আখতার মুকুলের প্রস্তাবে এবং কামরুদ্দিন শাহদের সমর্থনে গাজীউল হক সভাপতিত্ব করেন। সমাবেশে সামছুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান প্রমুখ বক্তব্য দিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে মত ব্যক্ত করেন। কিন্তু আবদুল মতিনের নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন।

  প্রথম দিকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী কিছু ছাত্র গ্রেফতার হন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্ররা আত্মরক্ষার্থে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশের পাল্টা হামলায় ছাত্রদের একটি বড় অংশ মেডিকেল কলেজের কাছে সমবেত হন। মেডিক্যালে সমবেত ছাত্রদের ওপর পুলিশ আকষ্মিকভাবে গুলিবর্ষণ করে। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী গুলির নির্দেশ দিয়েছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বার ঘটনাস্থলে নিহত হন। আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল মেডিকেল কলেজে মারা যান। এদিকে ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোজাফফর চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী সহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক পুলিশী কর্মকাণ্ডের নিন্দা জাপন করেন। উপাচার্য সৈয়দ মোজ্জাযেম হোসেন তিনদিনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন। ২২ ফেব্রুয়ারী ঢাকা পরিণত হয় মিছিল, বিক্ষোভ আর শোকের সমন্বয়ে এক উত্তাল নগরীতে। মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে লক্ষ মানুষের ঢল নামে। ২১ ফেব্রুয়ারী হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের প্রতিবাদে, ঢাকা শহরে ২৩ ফেব্রুয়ারী হরতাল পালিত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারী পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফুলার রোডে একজন কিশোর নিহত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় হরতাল পালন করা হয়। সেদিন দশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের ভবনে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ২৫ ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।  ঢাকার এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। জেলা, মহকুমা শহর অতিক্রম করে প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে তা ছড়িয়ে পড়ে। নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, চট্রগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, সিলেট ও সুনামগঞ্জে ২২ ফেব্রুয়ারী প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়। এসব জেলায় ২৩ অথবা ২৪ ফেব্রুয়ারী ধর্মঘট পালিত হয়। 

  ২১ ফেব্রুয়ারী গুলিতে ঠিক কতজন মারা গিয়েছে তা নিয়ে পরবর্তীকালে নানা রকমের মতভেদ দেখা দিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারী গুলি লেগে কেউ আবার পরে মৃত্যুবরণ করেছেন। শেষপর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে ভাষার কারণে ৬ জন শহীদ হয়েছিলেন। শহীদ রফিকউদ্দিন আই.কম. পড়তেন। তাঁর বয়স উনিশ/বিশ ছিল। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জ। আবুল বরকত ১৯২৭ সালের ১৬ জুন জন্মগ্রহণ এবং ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি পাকিস্তানে আসেন। তাঁর পিতার নাম শামসুজ্জোহা। শহীদ শফিউর রহমান ছিলেন হাইকোর্টের কর্মচারী। ১৯১৮ সালের ২৪ জানুয়ারী তার জন্ম। এদের তিনজনকেই আজিমপুরে শেষকৃত্য করা হয়। শহীদ আব্দুল জব্বার ছিলেন পেশায় দর্জি। গফরগাঁওয়ের পাচাইয়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। শহীদ অলিউল্লার বয়স ৮/৯ বছর। তিনি রাজমিস্ত্রী হাবিবুর রহমানের ছেলে। আবদুস সালাম ২১ ফেব্রুয়ারী গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ এপ্রিল মারা যান। তিনি পেশায় পিয়ন ছিলেন।
আর এই আন্দোলন আর শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। যারা ছেলেমেয়েদের গলায় নেকটাই ঝুলিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছেন পড়ান ক্ষতি নেই। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বাংলা ও শেখান।বাংলায় তাদের সাথে কথা বলুন। বাংলা সম্পর্কে আপনার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের ও আগ্রহ বাড়ান। আর তা যদি না করি রবীন্দ্রনাথের লেখা, গান, আমাদের পশ্চিমবাংলায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তে বাধ্য।  তখন কি আমরা বলতে পারবো, রবীন্দ্রনাথ আমাদের।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments