জ্বলদর্চি

বাংলা ভাষা কি বিপন্ন?/সুদর্শন নন্দী

বাংলা ভাষা কি বিপন্ন?

সুদর্শন নন্দী  
  
ভাষা  জনগোষ্ঠীর ভাব বিনিময়ের মাধ্যম। একটি জাতির সংস্কৃতি ও বিবর্তনের সাক্ষী হল তার ভাষা। সেই ভাষা বিপন্ন হতে পারে দুদিক থেকে।  প্রথমত নিজেদের দিক থেকে।  দ্বিতীয়ত বাইরের আক্রমণ। কিন্তু বাইরের আক্রমণ বা আধিপত্যের পিষণ থেকে বাংলা ভাষা নিজেকে মুক্ত করেছে তা আমরা অন্য রাষ্ট্র, অন্য রাজ্য এবং নিজের রাজ্যের গর্বিত লড়াই থেকে বুঝেছি। এনিয়ে সংক্ষেপে একটু জানা প্রয়োজন নব বঙ্গবাসী ও বঙ্গভাষীদের কাছে। 
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাংলার জনমানসকে আবেগমথিত করেছিল, শহিদের  রক্তে লাল হয়েছিল বাংলার মাটি। ভাষা প্রেমিকদের সেই রক্তদান বিফল হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলা ভাষা সেখানকার স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা।বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।  শহিদের রক্ত রাঙা ভাষা আন্দোলন আজও দুই বাংলার মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। 

   আমরা ভুলিনি অসমে ১৯৬১ সালর ১৯ মে এই ভাষা আন্দোলনে ১১ জন শহিদ হন। ফলে, অসম সরকার ১৯৬০ সালের ভাষা আইন সংশোধন করে ১৯৬১ সালে বরাকের জন্য বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। 

   আবার পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের চার দশক আগে ১৯১২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত মানভূমে সংগঠিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথাও আমরা জানি। ১ নভেম্বর ১৯৫৬ সৃষ্টি হল পুরুলিয়া জেলা। পুরুলিয়ার বাংলায় অন্তর্ভুক্তি বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জয়। সেভাবে গুরুত্ব না পেলেও ঐ দিনটির গুরুত্বও ২১শ ফেব্রুয়ারির মতোই। 
   কিন্তু বাইরের আক্রমণ থেকে বাঁচলেও ভেতরদিক থেকে আমরা নিজেরাই এই ভাষাকে বাঁচাতে আগ্রহী নই ততটা।  এর একটি কারণ অন্যভাষার আভিজাত্য দেখাতে গিয়ে, স্ট্যাটাস ধরে রাখতে গিয়ে মাকে কাজের মাসি হিসেবে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দিচ্ছি আমরা। অন্য ভাষার প্রতি আগ্রহের একটা কারণ অবশ্যই রয়েছে জীবিকার জন্য।  যেহেতু বাংলাভাষার ব্যবহার সব রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় অপ্রতুল (অন্য আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) তাই সর্বভারতীয় বাঙালি চাকুরীজীবি, ব্যবসায়ীরা বাংলার থেকে হিন্দী এবং ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু যাদের সেই সমস্যা নেই তারাও কি বাংলা ভাষার মর্যাদা রাখতে পারছি? অস্বীকার করার উপায় নেই যে শুধু সাহিত্য নয়, ব্যবহারিক জীবনেও আমরা আমাদর ভাষাকে ঠিকমতো ধরে রাখতে পারিনি। সঠিক চর্চার অভাব, অবহেলা, না জানা বা শেখার আগ্রহ, ভুল ভাষা প্রয়োগ বাংলাভাষার আয়ুষ্কালকে কমিয়ে দিচ্ছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য উল্লেখ করি।  ১৯৭১ সালর ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলা একাডেমিতে এসে বক্তৃতায় বলেছিলেন,ভাষা আন্দোলন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস, আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করব......মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না...।’
প্রশ্ন হল বাংলা ভাষা কি টিকবে? এর উত্তর দিতে গিয়ে দেখছি কত ভাষা যে পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে!
    ইউনাইটড নেশনস এডুকশন সায়ন্টিফিক এন্ড কালচারাল অর্গানাইজশন (ইউনেস্কো) থেকে জানা যাচ্ছে যে  পৃথিবীতে ২৫০০ থেকে প্রায় ৬০০০ ভাষা বিপদে রয়েছে। 

   ইউনেস্কোর নয়া রিপোর্টেও ভারতের  ৪২টি বিপন্ন ভাষা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের চিরতরে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কে উদ্বগ প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে যেমন  রয়েছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গ্রেট আন্দামানিজ, জারোয়া, লুরো, মুয়োট, ওঙ্গ, পু, সানন্যিও, সন্টিলিজ, শম্পন  তেমনি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের টোটো উপজাতিদের কথ্য ভাষা। সারভাইবেল অফ দি ফিটেস্ট থিয়োরি শুধু প্রাণীদের ক্ষেত্রেই নয়, ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই বাংলাকেও সেই থিয়োরি মেনেই বেঁচে থাকতে হবে। তাই যে কারণে বিভিন্ন ভাষা লুপ্ত হচ্ছে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হলে তার বিলুপ্তির বিষয় ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। আর এই ভাষা যদি না টেকে তবে ক্ষতি কি? উত্তরে বলি আমার বিশ্বাস যে না টেকার সেরকম অবস্থা হবে না। বাংলা ভাষার প্রতি স্বাভিমান, মর্যাদা, তাকে বিকশিত করার আত্মপ্রয়াস এই বাংলাভাষাকে দীর্ঘতর করবে বলেই মনে করি। 

 পেজ-এ লাইক দিন👇
  আরও পড়ুন    

Post a Comment

0 Comments