বাংলাভাষা আজও বিপন্ন
বিমল মণ্ডল
বিপন্ন! বিপন্ন! বিপন্ন! — কি বিপন্ন? প্রশ্ন জাগে। আসলে সারাবছর ধরে বাংলা ভাষার গায়ে কলঙ্ক আঁকা। আর সেই বাংলা ভাষার কথা মনে পড়ে মহাধুমধাম হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসে। সে আবার ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে উদযাপনে বিশেষ দিনে। কিন্তু প্রশ্ন যে এই দিন কেন বাংলাভাষাকে মনে পড়ে? এই দিন ছাড়া সারাবছর তো এমনই চলে যায়। তখন তো এমন প্রশ্ন আসে না? এখন আমার প্রশ্ন যে এই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী? সত্যিই কি এই ভাষা আজ বিপন্ন?এই সব প্রশ্ন আজ সারা বিশ্বজুড়ে। কারণ প্রতিদিন পৃথিবী থেকে প্রতি পনের দিনে একটা করে ভাষা লোপ পেলেও এই ভাষার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এই ভাষার ব্যবহারকারী আমাদের দেশের পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই বাংলা ভাষা নদীর মতো বহতা,তার পরিবর্তন নিয়মিত ঘটে, গ্রহণ- বর্জনের মধ্য দিয়ে এই ভাষার সমৃদ্ধি হয়। তবুও এই ভাষার বিপন্নতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমাদের দেশ বহুভাষাভাষীর দেশ আর বহু ভাষার।
আমরা আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে মান্যতা দিলেও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাভাষার কদর কিন্তু খুবই কম। বর্তমানে বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সত্যিই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্র বা সমাজ এখন বাংলা চর্চা ত্যাগ করে ইংরেজিমুখি হয়ে পড়েছে। যদি এই দুটো ভাষার প্রতি সমান গুরুত্ব দিত তাহলে তেমন কোন অসুবিধা হতো না। ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও রমরমিয়ে চলত। কিন্তু চিত্রটা আলাদা। যার ফলে বাংলা ভাষা ব্যবহারে সীমিত হয়ে পড়ছে।বাংলাভাষা একদিকে উপভাষাগত দিক থেকে আঞ্চলিক ভাবে যেমন পীড়িত তেমনি অন্যদিকে বাংলাভাষার সাথে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে অপপ্রয়োগ। আর সেই কারনেই বাংলাভাষা আজ ভারাক্রান্ত।
বর্তমান যন্ত্র বিজ্ঞানের যুগে মোবাইল , রেডিও, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি এই মাধ্যমগুলিতে বাংলা ভাষা নানা ভাবে বিপন্ন হচ্ছে। এখন ইংরেজি ভাষা ছাড়া এই সব মাধ্যমগুলিতে বাংলা ভাষা কম ব্যবহার হয়। যতই রাষ্ট্র বা সমাজ বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বলুক না কেন। ততই কিন্তু বাংলা ভাষা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে।
আমরা যদি এক নজরে দেখি দেখতে পাবো পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত আঞ্চলিক ভাষাগুলি উপভাষায় একটামাত্র ধারায় সীমাবদ্ধ নয়- তা কয়েকটি ধারায় বিভক্ত। আর যে বাংলা ভাষাটি এতকাল প্রমিত বাংলা ভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে,সেটি আসলে একটা বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। তবে এই উক্ত ভাষাগুলি অঞ্চল ভিত্তিক বদলে যায়। ফলে প্রমিতকরণের সমস্যা থেকে যায়। আর এই ভাষা তো কেবলমাত্র মুখের ভাষার একমাত্র সংযোগের বাহন নয়। এই ভাষা বাংলা সাহিত্যকে যেমন তরান্বিত করে তেমনি ভাব বিনিময়েও এই ভাষা প্রকাশের মাধ্যম। বর্তমানে এই ভাষা আজ অস্তিত্বের সংকটে। রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি শাসক, বিরোধী সমস্ত স্তরে বাংলা ভাষা খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার হচ্ছে। তাই এই যেন বিপন্ন ভাষায় পরিনত হচ্ছে বলে আমাদের উৎকন্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মানব সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানুষের প্রমিতভাষা।এর ফলে বিভিন্ন দিক যেমন - কথাবার্তা, চালচলন,পোশাক,খাওয়া- দাওয়া ,নাচ, গান প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম হয়ে থাকে এর কারণে মানব মনে বাংলা ভাষা জীবন্ত ভাষা থাকছে না। ফলে ভাষা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু ভাষায় পরিণত হতে থাকে।
আবার যদি অন্যদিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন আর বাংলা ভাষার উচ্চারণের দুরবস্থা। ফলে মাতৃভাষা আর মাতৃভাষার স্বরূপে পরিনত না হয়ে অন্তজ বিপন্নতায় পরিনত হয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির মুখে মুখে সচরাচর যে সব ভাষা মুখে মুখে ব্যবহার হয়,তা যেন বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এই বাংলাভাষা কিন্তু বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সাক্ষী রেখে যাবে। সেটা কতটা ভালো আর কতটা খারাপ তা ভবিষ্যতে নির্ণীত হবে। আর এখন অর্থাৎ বর্তমানে যে ভাবে বাংলা ভাষা ক্রমশ বিপন্ন হচ্ছে তা কতটা ভবিষ্যত আছে তা আমাদের ভাবায়।
এখন কতশত সৃজনশীল রচনায় কিংবা মননশীল রচনাতে এই বাংলা ভাষা বিপন্ন হচ্ছে। আজকের দিনে তরুণ প্রজন্মের মুখের ভাষা কিংবা লিখিত ভাষা যেন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ভাবতে হয় যে বাংলা ভাষা কি সত্যিই বিপন্ন হয়ে পড়েছে? ইংরেজি স্কুল গুলোতেও আজকাল বাংলা শেখানো তো দূরের কথা বাংলায় কথা বলাও বারন। সেক্ষেত্রে আমরা বাঙালি হয়ে নিজেরাই বাংলা ভাষাকে সব দিক থেকে নষ্ট করে দিচ্ছি। তাই আজ বাংলা ভাষায় অজস্র কলঙ্কের দাগ লেগে। তবুও আমরা সমবেত হয়ে এই ভাষাকে বাঁচাতে সে কথ্যভাষা হোক কিংবা সৃজনশীল রচনা হোক সর্বক্ষেত্রে দৃঢ় প্রয়াস নিতে হবে। তার জন্য সবাইকে শপথ নিতে হবে যে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই মাতৃভাষার চর্চাকে অব্যাহত রেখে বিপন্নতা থেকে মুক্ত করে বাংলা ভাষা বিকাশের সচেষ্ট হতে হবে।
আসুন আমরা আজ এই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিই। বিপন্নতা থেকে এই ভাষাকে বাঁচানোর দৃঢ় প্রয়াসই হোক এটাই আজ আমাদের একমাত্র সমবেত ধ্বনি।
পেজ-এ লাইক দিন👇
2 Comments
প্রাসঙ্গিক
ReplyDelete,ভালো বক্তব্য
ReplyDelete