জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-২১/অনিন্দ্যসুন্দর পাল

ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য


"একবিংশ পর্ব- "সাহিত্য ১০"

ভিনটারনিটসের ভাষায় ভারত গল্প ও অখ্যায়িকার দেশ। ম্যাকডোনেলের মতে ভারতের মতো এত বড় আর কেউ গল্পসাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে নি। বলা আছে, শুধু সমস্ত এশিয়াখন্ড নয়, ইউরোপের গল্পসাহিত্য- বিশেষত জার্মান সাহিত্য আমাদের গল্পসাহিত্য দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছে। বেশকিছু আরব্যোপন্যাস আমাদের গল্প অনুকরণে রচিত। মহাভারত অসংখ্য অখ্যায়িকার পাশাপাশি উপনিষদেও বেশ কিছু মুল্যবান বিষয়েরও বর্ণনা আছে। শুধু, খৃষ্ট পূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পালি ভাষায় রচিত বৌদ্ধ জাতকের গল্পভান্ডার নয়, খৃষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর ভারতে বৌদ্ধ স্তূপের উপর অঙ্কিত চিত্র যা যা বিষয় নীরবে বর্ণনা করে, তা যে সেইসময়কার ইতিহাসে কতটা অভাবনীয়, তার বিস্তার, ও তার পরিচয় মিলবে এই সবের প্রতি গভীর দৃষ্টি রাখলেই। যেমন ধরা যাক, বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্র, যদিও এই গ্রন্থটির রচনাকাল ঠিক মতো বলা না গেলেও, আনুমানিক খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে এর খ্যাতি দেশে ও বিদেশে এতটাই লাভ করেছিল যে, তৎকালীন পারস্য সম্রাট নৌসরবনের আদেশে তৎকালীন পারস্যের ভাষা পহ্লবী ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। তাই এই পঞ্চতন্ত্রের ব্যাপারে ম্যাকডোনেলর মত- পঞ্চতন্ত্র জগতের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাইবেল ভিন্ন জগতের অন্য কোনো বই-ই এত ভাষায় অনূদিত হয় নি, অন্ততঃ ধর্মশাস্ত্র নয় এমন কোনো গ্রন্থ তো নিশ্চয়ই হয় নি। পঞ্চতন্ত্র নিয়ে বিশেষ আলোচনায় যাব না। তবে, পঞ্চতন্ত্র অবলম্বনে লিখিত 'হিতোপদেশ'ও খুব জনপ্রিয় একটি বই। এতদ্ব্যতীত বেতাল পঞ্চবিংশতি, কাশ্মীরী কবি সোমদেবের কথা-সরিৎসাগর প্রভৃতিও উল্লেখযোগ্য। বলে রাখা ভালো, গল্পের বই সাধারণত কথ্যভাষায় লিখিত হলেও, এই সমস্ত বই আসলে সংস্কৃত ভাষায় নির্মিত। উল্লেখ্য, কথা-সরিৎসাগর শালিবাহন রাজমন্ত্রী কবি গুণাঢ্যের পৈশাচী ভাষায় রচিত 'বৃহৎকথা' অবলম্বনে লিখিত, কিন্তু পৈশাচী ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থ বর্তমানে পাওয়া যায় না।

  সূত্র হিন্দুদের একটি অত্যাশ্চর্য্য সৃষ্টি সেটা আমি আলোচনার শুরুর দিকে সাহিত্য বিভাগ নিয়ে আলোচনা করার সময়ই বলেছিলাম। ভারতবর্ষে ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করে তা মুখে মুখে সংক্ষেপে বর্ণনার দ্বারা শিক্ষালাভ করার একটা প্রথা ছিল, যার সূত্র ধরেই সৃষ্টি হয় সূত্র-সাহিত্যের। উল্লেখ্য, প্রচলিত ছিল, সূত্রকারগণ যদি একটি বাক্য থেকে স্বরবর্ণেরও সংক্ষেপ করতে পারতেন, তবে নাকি তাদের পুত্রলাভের আনন্দ উপভোগ করার ক্ষমতা লাভ করতেন। একটু ভালো করে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, কথাটা হাস্যকর মনে হলেও, কথার ভাবনার মধ্যে যথেষ্ট অধ্যাবসা লুকিয়ে আছে, তাই সূত্রগুলি রাসায়নিক সঙ্কেতের মতো সংক্ষিপ্ত অথচ যিনি তার অর্থ ঠিকঠাক বুঝবেন, তিনি একমাত্র উপলব্ধি করতে পারবেন ভাব ও মাত্র কিভাবে মিলেমিশে একটা সুমধুর স্বরধ্বনির সৃষ্টি হয়। বলাইবাহুল্য, ভারতবর্ষের অনেক বিখ্যাত পুস্তক সূত্রের সমষ্টি যথা- পাণিনির ব্যাকরণ, পতঞ্জলির যোগশাস্ত্র ও বাদরায়নের ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শন।

  আমার একটি বই থেকে শিক্ষা প্রাপ্ত, ব্রহ্মসূত্র থেকে একটি সূত্র উদ্ধৃত করে কিছুটা বোঝাবার চেষ্টা করছি-
'অথাতো ব্রমজিজ্ঞাসা'- এটি ব্রহ্মসূত্রের প্রথম সূত্র। আচার্য শঙ্কর এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখানে 'অথ' অর্থে অনন্তর, এখন প্রশ্ন এই যে কার অনন্তর; -নিত্য কি, অনিত্য কি, এর জ্ঞান, পার্থিব ও স্বর্গীয় সুখভোগে বৈরাগ্য শম দমাদি সাধন সম্পদ এবং মুক্ত হওয়ার ইচ্ছা হলে পর। 'অথ' পরে 'অতঃ'- অর্থ সেই হেতু, অর্থাৎ স্বর্গাদির অনিত্যতা ও ব্রহ্মবিজ্ঞানের পরম পুরুষার্থ সাধনতা হেতু। ব্রহ্মজিজ্ঞাসা অর্থ ব্রহ্মকে জানবার ইচ্ছে। সবশেষে এই সূত্রের অর্থ এই যে, সাধনসম্পন্ন মুমুক্ষু ব্যক্তি জগতকে অনিত্য এবং ব্রহ্মকে পরম পুরুষার্থ মনে করে ব্রহ্মকে জানবার জন্য চেষ্টা করবে।
  আলোচনার পরবর্তীতে স্বীকার করতেই হয়, সংস্কৃত ভাষা অমরসিংহ ও পাণিনির কাছে যেরকম ঋণী, তাঁদের কথা এবং লিপী সমন্ধে কিছু না উল্লেখ করে সংস্কৃত সাহিত্য আলোচনার ইতি টানা যুক্তিযুক্ত নয় বলেই মনে করি। সংস্কৃত সাহিত্যের ধারণা, অভিধান বা কোষ প্রত্যেক ভাষার শ্রীবৃদ্ধির অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ স্বরূপ। কালিদাসের সমসাময়িক অমরসিংহ প্রণীত 'নামলিঙ্গানুশাসন'ই সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ অভিধান- সাধারণত 'অমরকোষ' নামে বিখ্যাত। প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বে এই ধরনের অভিধান সৃষ্টি একপ্রকার অদ্ভুত কীর্তি বলে মানতেই হবে। মাথায় রাখতে হবে সংস্কৃত বৈজ্ঞানিক করার কাজটি পাণিনির নিজের হাতে নিষ্ঠার সাথে করেছিলেন। তাই তাঁকে জগতে শ্রেষ্ঠ বৈয়াকরণিক বলা হয়। তাঁর ব্যাকরণের নাম 'শব্দানুশাসন', আর এটি আট অধ্যায়ে বিভক্ত বলেই একে সাধারণতঃ 'অষ্টাধ্যায়ী' বলা হয়, এককথায় ওনাকেই ভাষাবিজ্ঞানের মূল স্রষ্টা হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পাণিনির দ্বারা উল্লিখিত তাঁর পূর্ববর্তী চৌষট্টিজন বৈয়াকরণিকের মধ্যে যে দশ জনের কারোর কোনো লেখা বা গ্রন্থ উদ্ধার সম্ভব হয় নি, তাই অগত্যা, পাণিনির পর সংস্কৃত ভাষা তাঁর ব্যাকরণ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বর্তমানে সংস্কৃত যে লিপিতে লিখিত হয় সেটিকে দেবনাগরী অক্ষর বলা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, প্রাচীনকালে যে ব্রাহ্মী লিপি প্রচলিত ছিল, সেই ক্রমে ক্রমে পরিবর্তীত হয়ে তা দেবনাগরী হরফে পরিণত হয়েছে। এমনকি সম্রাট অশোকের অধিকাংশ শিলালিপি ব্রাহ্মী অক্ষরে লিখিত।

  তবে এই লিপির লিখন পদ্ধতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেবদত্ত ভান্ডারকর থেকে শুরু করে বহু প্রাশ্চাত্য পন্ডিত তথা ডাক্তার বিউহলারের যুক্তি ও মন্তব্য প্রকাশ করলেও, শেষপর্যন্ত অযৌক্তিক প্রমাণিত হয়েছে। কেননা জানা যায় পশ্চিম এশিয়ার ফিনিসীয় জাতিরা ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লিখতেন ভারতীয়রা তার ঠিক বিপরীত, অর্থে বাঁ দিকে থেকে ডান দিক। ফিনিসীয়দের মধ্যে ২২টি অক্ষরের প্রচলন থাকলেও পাণিনির সংস্কৃতে কিন্তু ৪৬টি অক্ষরের সন্ধান মেলে। অতএব বিউহলারের ফিনিসীয় লিপি আমদানী সম্পর্কিত যা মত, তা থেকে বলা যায় পাণিনি খৃষ্ট পূর্ব সপ্তম শতাব্দীর লোক হওয়ায়, তাঁর সময় আর আমদানীর সময়ের মধ্যে পার্থক্য দুই কিংবা এক শত বছর। তাই এই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ২২টি অক্ষর ৪৬টি পরিণত হয়ে যাওয়া, লিখন পদ্ধতি পাল্টে যাওয়া, শুধু তাই নয়,স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের নুতন তারতম্য নির্মাণ একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তাঁদের যুক্তিতর্ক অচিরেই নির্মূল হয়ে যায়।

  শেষে বিশেষভাবে জানিয়ে রাখা ভালো, সংস্কৃত ভাষায় ব্যঞ্জনবর্ণের যেরূপ কন্ঠ, তালব্য, দন্ত্য বর্ণ প্রভৃতি হিসাবে পৃথক পৃথক ভাবে লিখিত হয় তা আর অন্যকোনো ভাষায় নেই। এমনকি উচ্চারণের দিক দিয়েও সর্বাপেক্ষা বৈজ্ঞানিক। তাই রমেশচন্দ্র দত্তের মতে ডাক্তার বিউহলার নয় পাণিনির বহু শতাব্দী পূর্বেই লিপিজ্ঞানের প্রচলন ছিল এটাই সত্য।।

( ক্রমশ.......)
পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments