জ্বলদর্চি

পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা-২২ / বিমল মণ্ডল

Spoken language of the fishing community of East-Medinipur district / Bimal Mondal
পূর্বমেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কথ্যভাষা
পর্ব-২২ চতুর্থ অধ্যায়

বাক্যতত্ত্ব (Syntax) 

৩. বিশেষণ পদের ব্যবহার রীতি
 
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষায়  বিশেষ্যের বিশেষণ, বিশেষণের বিশেষণ, সংখ্যাবাচক বিশেষণ, ক্রিয়া বিশেষণ ও সম্বন্ধ বিশেষণের প্রয়োগ দেখা যায়। মান্য চলিতে বিশেষ্যের পরে বিশেষণ বসে। কিন্তু  এখানে অনেক সময় বাক্য মধ্যে বিশেষণ প্রথমে বসে তার পরে বসে বিশেষ্য। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার   মৎস্যজীবীদের কথ্যভাষার এটি একটি বিশিষ্ট দিক। যেমন-

ক.ভাজা মাচ দুবা। ( মাছ ভাজা দেবো।) 
খ.পুড়া আউ খাবু?(  আলু পুড়া খাবি?)
গ. নম্বা নৌকাটা। ( নৌকাটা লম্বা) 


এছাড়া বাকি ক্ষেত্রে  ক্রিয়াপদ এবং বিশেষ্যের আগে বসে। তবে বিশেষণের বিশেষণের ক্ষেত্রে বিশেষ্যের  পরেও কখনও কখনও বসে। এছাড়া স্থানবাচক, কালবাচক, গুণবাচক, পরিমাণ বাচক, ধ্বন্যাত্মক বিশেষণের ব্যবহার দেখা যায়।
যেমন —

৩.১ বিশেষ্যের বিশেষণঃ

ক.পুড়া ঘরে অরকুম করিয়া রই। ( পোড়া ঘরে এমন করে থাকি।) 
খ.থান্দা বাতাসে এঠিটা বুসোনি গো। (ঠাণ্ডা হাওয়ায় এখানে বসো না।) 
গ.গরোম ভাত দুবা দাড়া। ( গরম ভাত দেবো দাঁড়া।) 
ঙ. পচা জএ মাচ ধরবু? ( নষ্ট জলে মাছ ধরবি?) 

৩.২. বিশেষণের বিশেষণঃ      

ক. লোকটা খুব চুথিয়া। ( লোকটা খুব কৃপণ।) 
খ.খুব তাড়াহুড়া করবুনু। ( খুব তাড়াতাড়ি করবি না।) 
গ.নুজু মাঝি পচুর রাগি যায়। ( নজু মাঝি ভীষণ রেগে যায়।) 
ঘ. তুই বেশ বড়ো মাচ ধত্তে পারু। (তুই বেশ বড়ো মাছ ধরিস।) 
ঙ.গাড়িটা আইজ খুব জোরে যা টে। ( গাড়িটা আজ খুব জোরে যাচ্ছে।) 

৩.৩. ক্রিয়া বিশেষণঃ

ক. ভঁ করিকি যাবু আর ভঁ করিকি আসবু। ( তাড়াতাড়ি যাবি আর তাড়াতাড়ি আসবি।) 
খ.কাজে যাবু তো ঝটপট কর।  (,কাজে   যাবি তো তাড়াতাড়ি কর।) 
গ. পট করিয়া আসবু। ( তাড়াতাড়ি আসবি।) 
ঘ.গড়গড় করিয়া পড়। ( চিৎকার করে পড়।) 
ঘ. চট করিয়া লিয়্যা যা। (তাড়াতাড়ি নিয়ে যা।) 
ঙ. ধপাস করিকি পড়িছে। ( শব্দ করে পড়ে গেছে।) 

৩.৪  গুণবাচক বিশেষণঃ   
ক.লয়া  নৌকা নামব্বে। ( নতুন নৌকা নামবে।) 
খ. মেল্যা ধুরনু বড়ো বড়ো জাহাজ আইসেটে। ( অনেক দূর থেকে বড়ো বড়ো জাহাজ আসছে।) 
গ.খুব বিশাল জাল এটা। ( খুব বড়ো জাল এটি।) 
ঘ. কনকনে বাতাস। ( ঠাণ্ডা বাতাস।) 
ঙ.  তোনকের  ভোদ্র খাতির দেখলি। ( তোদের ভদ্র ব্যবহার দেখলাম।) 

৩.৫. কালবাচক বিশেষণঃ            
 
ক. কবি খাবাইবু  তুই। (কবে খাবাবি তুই।) 
খ.কবিনু ধার লিছু। ( কবে থেকে ধার নিয়েছিস।) 
গ.মাছের হাট কি বারনু বন্দ রইবে?  ( মাছের বাজার কি বারে বন্ধ থাকবে।) 
ঘ. মা কবি মরিছে ক। ( মা কবে মরে গেছে বল।) 
ঙ.দাক্তার গুরবার দিন আসবে কইছে। ( ডাক্তার বৃহস্পতি বার আসবে বলেছে।) 

৩.৬ অবস্থাবাচক বিশেষণঃ   
ক.কালনু উতরা বাতাস ব টে, শীত ঘুরবে। ( কাল থেকে উত্তরে হাওয়া বইছে, শীত আসবে।) 
খ.ফুটিয়া ফুটিয়া জলটা মরিয়ালো। (ফুটে ফুটে জল শুকিয়ে গেল।) 
গ.রাইতনু  জলেটে সউ আলোটা। ( রাত থেকে সেই আলোটা জ্বলছে।) 
ঘ. গাঙের ধারনু গরম বাতাস আইসেটে। ( সমুদ্রের ধার থেকে গরম বাতাস আসছে।) 
ঙ. সে তো অখুঁই  সুসথ হইছে। ( সে তো এখন সুস্থ হয়েছে।) 

৩.৭. পরিমাণবাচক বিশেষণঃ   
  
ক.  মাসের পইলানু মাচ ধত্তে যাবা। ( মাসের প্রথমে মাছ ধরতে যাব।) 
খ. কালনু কি খাবা তা ঠিক নেই। ( কাল থেকে কি খাবো তা ঠিক নেই।) 
গ.বারো মাস নৌকা লিয়া  গাঙে পড়িরই। ( বারো মাস নৌকা নিয়ে সমুদ্রে থাকি।) 
ঘ.বেজায় শীত পড়িছে। ( খুব শীত পড়ছে।) 
ঙ.দু'পাসো মাচ মাচ আনবু।( দু-পাঁচশ মাছ আনবি।) 

৩.৮. উপাদান বাচক বিশেষণঃ  
   
   ক. আমাহারে এ্যকটা  মাটির ঘর আছে। ( আমাদের একটা মাটির ঘর আছে।) 
খ. আইজ কোলাপাতায় ভাত খাতলি। ( আজ কলাপাতায় ভাত খেয়ে ছিলাম।) 
গ. কাদু দিকি ঠাকুর হয়। ( কাদা দিয়ে ঠাকুর তৈরি হয়।) 
ঘ.মা সঁকাউ গমাই দিয়া দাবা মুছে। ( মা সকালে গোবর দিয়ে উঠান মোছে।) 
ঙ. মোর ঘরে খড়ে রাঁধা হয়। ( আমার ঘরে খড়ে রান্না হয়।) 

৩.৯.স্থানবাচক বিশেষণঃ            
 
 ক. তাকে কায়ও খুজিয়া পাইনি। ( তাকে কোথাও খুঁজে পাইনি।) 
খ.তুই উমা আসবু। ( তুই এদিকে আসবি।) 
গ.  নৌকাটা বহুদুরনু আইসেটে। ( নৌকাটা অনেকদূর থেকে আসছে।) 
ঘ.তুমাকে এঠিটা ডাকেটে। ( তোমাকে এখানে ডাকছে।) 
ঙ.কালনু সৌঠিটা যাবা। ( কাল থেকে সেখানে যাব।) 

৩.১০ সংখ্যাবাচক বিশেষণঃ       
 
 ক.দুট্টা নৌকা ডুবিয়ালো। ( দুটি নৌকা ডুবে গেল।) 
খ. পাঁসসের মাচ লিকি হাটে যা। ( পাঁচ কেজি মাছ নিয়ে হাটে যা।) 
গ.দুট্টা ভাত খেয়া যা। ( অল্প করে ভাত খেয়ে যা।) 
ঘ. যুমা সুমা দিয়া দু'তিন দিন হই যাবে। (যেদিক সেদিক করে দুই তিন কেটে যাবে।) 
ঙ. মেইঝিটাকে এ্যকশ ভুজা দুবো। ( মেয়েটিকে একশো গ্রাম মুড়ি দেবে।) 

৩.১১.ধ্বন্যাত্মক বিশেষণঃ                                      

 ক.তারে ম্যায়াটা ফড়ফড় করিয়া কথা কয়। ( তাদের মেয়েটি  তাড়াতাড়ি কথা বলে।) 
খ. তুই খালি ভুটভুট করুটু কেনি?  ( তুই বকবক করছিস কেন?) 
গ. সে রাগিয়া চোঁ-চোঁ করিয়া  চলিয়ালো। ( সে রেগে চোঁচা মেরে চলে গেল।) 
ঘ.মোর বথাটা কিনকিন কচ্ছে। ( আমার ব্যথাটা খুব হচ্ছে।) 
ঙ. জাংলা দিয়া ফুরফুর করিয়া বাতাস আইসেটে। (জানালা দিয়ে ফুরফুর করে বাতাস আসছে।) 
চ.,কালনু সারাদিন ধরিয়া টিপটিপানি বিস্টি হটে। (কাল থেকে সারাদিন ধরে ঝিরিঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে।)        
৩.১২. সম্বন্ধবাচক বিশেষণঃ   

  ক. বোরশার দিন নদীতে যাবা নি। (বর্ষার দিন নদীতে যাবো না।) 
খ.খায়ের জ  খারি লাগে। (খালের জল নুন লাগে।) 
গ.নউকার তক্তাগুয়া ভাঙিছে। ( নৌকার তক্তাগুলো ভেঙে গেছে।) 
ঘ.রাধাঁর ঘরে খাই। (রান্নার ঘরে খাই।) 
ঙ. কয়ের জ একটু দে। ( কলের জল একটু দে।)    

৩.১৩. সর্বনামজাত বিশেষণঃ                                                                 
ক. তানকের অবস্থা  কী সোরকুম আছে। ( তাদের অবস্থা কী সেই একইরকম আছে।) 
খ. ওউ জাইগাটা মোর ভালা লাগে। ( এই জায়গাটা আমার ভালো লাগে।) 
গ. আইজ মুই কেলান্ত। ( আজ আমি ক্লান্ত)     
ঘ. তারে নৌকাটা লোমবা। ( তাদের নৌকাটা লম্বা।)   

৩.১৪ অব্য্যজাত বিশেষণঃ                                
                                   
ক.চট করিকি মারামারি লাগুছি। ( আচমকা মারামারি লেগেছে।) 
খ. আচছা বদমাশ মাউসটাতো। (খুব বদমায়েশ মানুষটি।)      
গ.একটু পরে যাবা। ( একটু পরে যাব।) 
ঘ. ঠিক করিকি খা। ( ঠিক করে খা।)      


পূর্ব  মেদিনীপুর  জেলার  মৎস্যজীবীদের  কথ্যভাষার আলোচনায় যে বাক্যতাত্ত্বিক  সমীক্ষার  ভিত্তিতে শংকরপুর, কাঁথি, দীঘা, খেজুরী, হলদিয়া গেঁওখালীর বিভিন্ন মৎস্যজীবী অঞ্চলে বিশেষ্য, সর্বনাম,বিশেষণের  বিভিন্ন  দিক  আলোচনা  করলাম। পরবর্তী  পর্বে  এইসব অঞ্চলের কথ্যভাষা অনুযায়ী অব্যয় পদের ব্যবহার  আলোচিত হবে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments