জ্বলদর্চি

বাংলা ভাষা : ২১ এবং বাস্তবতা/তনুশ্রী গাঙ্গুলী

বাংলা ভাষা : ২১ এবং বাস্তবতা

তনুশ্রী গাঙ্গুলী

কোনো বিষয়কে দিবসীয় মর্যাদা দেওয়া মানুষের স্বভাব। ভাষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রেও এটি স্বাভাবিক। তবে একটি দিন নির্দিষ্ট করে ভাষাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস করা হলে, একদিনের এই মর্যাদা সাময়িক আবেগ সৃষ্টি করে মাত্র। উদ্দেশ্যটির অবশ্যই সদর্থক দিক রয়েছে, কিন্তু তা যেভাবে ফুলের আভাস দেয়, ফল সে তুলনায় অল্প। তবে সারাবছরের চাপা থাকা চেতনা বিশেষ দিনের কারণে যদি কিছু মানুষকেও নিজের বশীভূত করতে পারে তাহলে তা মন্দ নয়। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যায় একুশে ফেব্রুয়ারি যেন মূল বিষয় থেকে সরে গিয়ে ক্রমশ 'জাতীয় অহংকার'  হিসাবেই সীমাবদ্ধ হচ্ছে।

  বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছে আন্দোলন ও আত্মত্যাগ। 'বাঙালি' এই পরিচিতির একটা কারণ হয়েছে বাংলা ভাষা। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই বাংলাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করে কতজন? ব্যবহারের ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা নিজের অপেক্ষা পরানুকরণকে অভ্যাসে পরিণত করার ফলে বাংলা ভাষার প্রতি কি অনীহা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না? পরিবর্তন মানেই বিপন্নতা নয়। এছাড়া অন্য ভাষার শব্দ বাংলায় প্রবেশেও বিপন্নতা সৃষ্টি হয় না। কারণ পরিবর্তন ও গ্রহণ এসব মিলিয়েই আজকের বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তন বা শব্দগ্রহণের নামে অন্য ভাষাকেই ক্রমশ আঁকড়ে ধরলে মাতৃভাষা বিপন্ন তো হবেই। তাই মনে প্রশ্ন আসে, যে ভাষাকে বাঁচাতে এত আন্দোলন তাকে কতখানি প্রাপ্য মর্যাদা দিচ্ছি? তাছাড়া ভবিষ্যতে সেই ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছি? নাকি বাংলাদেশের মতো কোনো আন্দোলন পশ্চিমবঙ্গে হয়নি বলেই এই উদাসীনতা, অবজ্ঞা।

  আসলে বাঙালির ইচ্ছা বাংলা ভাষা অমর হোক; কিন্তু বাংলা আমরা পড়বো না, শুনবো না, লিখবো না, জানবো না। স্বাধীন চিন্তার অভাবে, নিজস্ব সৃজন শক্তির অভাবে ক্রমাগত অন্য ভাষার অনুকরণ করছি। কথার মধ্যে অহেতুক ইংরাজী বা হিন্দি ভাষা এনে নিজেকে বর্তমানের 'স্মার্ট' দের দলে যুক্ত করে বাঙালি স্রোতে গা ভাসানোর প্রতিযোগিতায় মেতেছে।  সেক্ষেত্রে বাংলা উচ্চারণ বিকৃত হলে,  'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ' প্রবচন তো আছেই তা ঢাকা দিতে। এই বিষয়ের উদাহরণ খুঁজতে গেলে নিরাশ হতে হয় না।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু যতই বলুন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব, বর্তমানের মনোভাব অনুযায়ী এতে প্রচার বড়ো কম। তাছাড়া পারিভাষিক শব্দের অভাব তো আছেই। কিন্তু তাকে সমৃদ্ধ করার ব্যবস্থা না করে বাঙালি অভ্যাসের কাছে মাথা নত করেছে এবং কর্মক্ষেত্রে তো বটেই, ধীরে ধীরে অন্দরমহলেও অন্য ভাষা স্থান দখল করছে। অন্য ভাষা জানা অবশ্যই কৃতিত্বেরই পরিচয় দেয়, তবে তা মাতৃভাষাকে সুরক্ষিত রেখে, বিপন্ন করে নয়। যেমন, জার্মান বা ফ্রান্সে মাতৃভাষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বাদে বাংলা ভাষার ব্যবহার তেমন নেই। পশ্চিমবঙ্গে থেকেও বাঙালি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর বাংলায় লেখার সুযোগ হয় না সব বিষয়ে। বাংলা নিয়ে সুযোগের অভাব তো আছেই, তাছাড়া আছে ইংরাজীর প্রতি আনুগত্য এবং নিজের মাতৃভাষাকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা। কারণ দেখানো হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে উপযুক্ত গ্রন্থের অভাব এবং প্রয়োজনীয় পরিভাষার অভাব। কিন্তু শিক্ষা শুরু হলে তবে তো শিক্ষাগ্রন্থ রচনার প্রয়োজন হবে। তাই এই অজুহাত অন্য ভাষার প্রতি থাকা মোহকেই প্রমাণ করে।
  প্রতিবছর মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর ইচ্ছা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গল্প, কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ ইত্যাদিতে। কিন্তু পরে তা নিয়ে সারাবছরের নীরবতা অটুট থাকে আবার পরের বছরের দোহাই দিয়ে। এ যেন এক উৎসব, যার বছরের পর বছর প্রত্যাবর্তন আছে, কিন্তু সমাধান নেই। বাঙালির চিরকালের কথা 'আসছে বছর আবার হবে'। আসল সমস্যা মনোভাবে। বাংলাতে সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দিতে চায় বলার চেয়ে ইংরাজীতে সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দিতে চায় বলাতে বাঙালি অভিভাবক বেশি গর্ববোধ করে। এছাড়া বাংলা বাদে অন্য ভাষা না জানা বাঙালিও বাংলা ছেড়ে অন্যভাষায় নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের বুকেই গড়ে উঠছে নানা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ভাষা হিসাবে প্রধান ইংরাজী। মায়েরাও তাই সন্তানকে ইংরাজী স্কুলে পাঠান বাংলার মুখ উজ্জ্বল করতে। ব্রিটিশরা এদেশে নিজেদের ভাষা দিয়েও সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তারা চলে গেলেও বাঙালি তাদের ভাষা পরম সমাদরে গ্রহণ করার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা নিতে পারে।
ভাষা আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষার যে উন্নতির কথা ছিল, তা আদেও কতখানি শুরু হয়েছে সে ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করতে হয়। ২১ এলেই ভাষাকে মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছা সর্বত্র পেয়ে বসে। চারিদিকে নানা শিরোনামে, চমৎকার উদ্ধৃতিতে ভাষা নিয়ে অহংকার প্রকাশের দ্বারা ভাষার বাস্তব কঙ্কাল ঢাকার চেষ্টা চলে। সম্প্রতি দেখা যায় নতুন প্রজন্ম সেভাবে বাংলা পড়তে বা জানতে চায় না। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলিতেও ছাত্র-ছাত্রীর অভাব। এছাড়া ভাষা নিয়ে উদাসীনতা, আস্থাহীনতা, পাঠাগারের শোচনীয় অবস্থা তো আছেই। সাহিত্যের মাধ্যমেই যেকোনো ভাষা বলিষ্ঠ হয়; বাংলায় সাহিত্যের অভাব না থাকলেও, নতুন লেখকের লেখা বইয়ের প্রতি বাঙালির আকর্ষণ কম। বাংলা অভিধানে অন্য ভাষার শব্দের প্রবেশ তো আছেই। অফিস, আদালতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারী ঘোষণাপত্রে যেমন ঊনবিংশ শতাব্দী চলছে, তেমনি অন্যদিকে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করছে এক জগাখিচুড়ি ভাষা- যা অভিভূত করছে অভিভাবককে, সর্বোপরি বাঙালিকে। এছাড়া বাংলা ভাষার বিপন্নতার একটি বড়ো কারণ হিসাবে বলা যায় শিল্পে, বাণিজ্যে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিশ্বায়ন। যার কারণে বিদেশ ও বিদেশী ভাষার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে। ফলে বাংলা এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার গুরুত্ব কমছে। ইংরাজী প্রধান ভাষা হয়ে উঠছে জীবিকার প্রয়োজনে এবং অস্তিত্ব রক্ষায়। জীবিকা ও অস্তিত্ব রক্ষার উত্তম ক্ষেত্র যদি বাংলা হত(পশ্চিমবঙ্গে), তাহলে বাংলা ভাষার বিপন্নতা নিয়ে আজকের বাঙালিকে ভাবতে হতো না।

  কোনো ভাষাকে জোর করে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। তাতে শত চেষ্টাকে বিফল করে দূর ভবিষ্যতে হলেও তার মৃত্যু ঘটবে। তাই সমস্যার গোড়া থেকে ভাবতে হবে। বাংলায় লিখতে হবে, ভাবতে হবে, বাংলা জানতে হবে, বলতে হবে, পড়তে হবে। কারণ একটি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনজাতি বা মানুষ। বাংলা ভাষা বিলুপ্তির পথে গেলে অন্য অনেক ভাষায় সেই পথের সঙ্গী হতে পারে। কারণ বাংলা যেমন গ্রহণ করেছে, তেমনই অন্য ভাষাকে সমৃদ্ধও করেছে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই একটি জাতি ও তার সংস্কৃতির অস্তিত্ব বোঝা যায়। তাই বাংলা ভাষার মৃত্যু হলে বাঙালি সংস্কৃতিরও মৃত্যু হবে। মাতৃভাষা কেবল মনোভাব প্রকাশের জন্য না, একটি জাতির টিকে থাকার শর্ত। কোনো ভাষাই শ্রেষ্ঠ হয়ে জন্মায় না, বিকাশ ও বিবর্তনের দ্বারা শ্রেষ্ঠ আসনটি লাভ করে।

  তবে অনেকের মতে বাংলা ভাষার বিলুপ্তির কোনো সম্ভাবনা বর্তমানে নেই। বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা সেটাই নির্দেশ করে। কিন্তু মৃত্যু না হলেও তা যে দুর্বল হচ্ছে বেশ বোঝা যায়। বাংলা বলতে পারে অনেক মানুষ, কিন্তু বলে না। বাংলা উচ্চারণে যে অবহেলা, তাতেই লুকিয়ে আছে তার মৃত্যুবীজ। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখাতে হবে যাতে গর্বের সাথে বাংলাকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। মাতৃভাষার মাধুর্য্য ও বিকাশ তবেই পূর্ণতা পাবে।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments