জ্বলদর্চি

আমরি বাংলা ভাষা/মধুমিতা বেতাল

আমরি বাংলা ভাষা

মধুমিতা বেতাল

বাংলা ভালোবাসি, 
বাংলাতেই কথা বলি।
মোবাইল টিভি অফিস কোর্ট
সিনেমা চিকেন মটন-গ্রেভি...
ঝোল বোঝে না রেষ্টুরেন্ট,
আড়ালে হাসাহাসি...
তাই ইংরেজিতেই বলি
আমি বাংলাটাই ভালোবাসি।

মা-কে মা বলি, বাবা-কে বাবা।
মাছের ঝোলেতেই মন‌ ঢেলে
গরম ভাতে পেট ভরি।
বাংলা ভালোবাসি
স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি।

  যাদুঘরের ঐতিহাসিক মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী বা জিনিসপত্র বা নথিপত্র বা বস্তুর মতো তো আর ভাষাকে সংরক্ষণ করা যায় না, আবার বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা অভিধান, বাংলা ভাষার অনেক বই বাড়ির আলমারিতে সাজিয়ে রাখলেও বাংলা ভাষা সংরক্ষণ হবে না। অথবা যেভাবে প্রাণী বা বন বা মাটি কিংবা জল সংরক্ষণ করা হয়, সেভাবেও বোধ হয় ভাষা সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। 

  আমরা বাঙালিরা অনেকেই কোনো-না-কোনো বই দোকান থেকে কিনি। অনেক সময় মেলা থেকেও  বাংলা ভাষার নানান ও রকমারি বই সংগ্রহ করে কাঁচের আলমারিতে সাজিয়ে রাখি। এর মূল উদ্দেশ্য গৃহশোভা বর্ধনের মাধ‍্যমে পারিবারিক ও সামাজিক কৌলিন‍্য স্থাপন করা। তবে কেউ কেউ অবশ্যই পড়েন এবং পড়ার জন্যেই কেনেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় না।

  আমার মতে বাংলা ভাষা অবশ্যই বিপন্ন। আমদের ভালো কিছু মানেই হয় তা ইংরেজি কিম্বা হিন্দি। সেখানে আর বাংলার কোনো স্থান বা আশ্রয় নেই যেন। কোনো ভালো রেষ্টুরেন্টে খেতে গেলেই আপনাকে ধরিয়ে দেবে সম্পূর্ণ ইংরেজিতে লেখা বেশ লম্বা চাওড়া মেনু লিষ্ট। আপনি যদি ইংরেজিটা ভালো বোঝেন বা বার বার রেষ্টুরেন্টে খেয়ে অভ্যস্ত হন, তাহলে ঠিক আছে, চলে যাবে। আর যদি ইংরেজিতে বা রেষ্টুরেন্টে আনকোরা  হন তবে খুব মুশকিল। বাই চান্স গ্রেভির পরিবর্তে ঝোল বলে ফেললে সার্ভিস বয়দের বা পাশের টেবিলের  হাসাহাসিতেই আপনি বুঝে নেবেন যে আপনি কতটা মূল্যহীন ও অচল।

  তাই বলবো এই বিপন্নতার হাত থেকে বাংলা ভাষাকে সংরক্ষণ করা খুব  জরুরি।
  তো সংরক্ষণ কীভাবে সম্ভব? বাংলা ভাষা সংরক্ষণের মূল অর্থ হলো বাংলা ভাষাকে জাগিয়ে রেখে তাকে চিরকালীন বাঁচিয়ে রাখার স্থায়ী ব‍্যবস্থা করা। এটা আবার কীভাবে সম্ভব? আমরা যত ভাষা সম্পর্কেই অবগত বা ঠোঁটস্ত থাকি না কেন, বাড়ির ছোটোদের সাথে অবশ্যই বাংলা ভাষাতে কথা বলবো। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও অন্যান্য ভাষার সাথে সাথে বাংলা ভাষার ওপরেও জোর দেবো। এবং বাংলা ব্যাকরণ, অভিধান, গল্পের ও কবিতার বই, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী এবং মনীষীদের জীবনী সংক্রান্ত তথ্যের বই তরুণ প্রজন্মের হতে উপহার হিসেবে তুলে দেব আর ডিজিটাল কাজকর্মেও বাংলার ব্যবহার বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে তুলব। তবেই এই বাংলা ভাষার বিপন্নতা ঠেকানো সম্ভব। 
  উচ্চ শিক্ষার জন্য আমরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনাটা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছি। উচ্চ পদস্থ চাকরির জন্য ইংরেজি অথবা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে হিন্দিটা জানা জরুরি। বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ কর্মসুত্রে আমাদের বাংলাতে বসবাস করছেন, তাদের সঙ্গে সখ্যতা ও যোগাযোগ রক্ষার কারণেও আমাদের তাদের ভাষাটাও আয়ত্বে আনতে হচ্ছে।  তাই অন‍্যের ভাষা ব‍্যবহার করতে করতে আমরা জানতে বা অজান্তেই বাধ্য হয়ে আমাদের প্রিয় মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবহেলা করছি। খুব সংশয় হয় অন্যান্য ভাষাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা বাঙালিরা বাংলা না হারিয়ে ফেলি।

  আজও ভাষাই মানুষের সঙ্গে মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধন। ভাষা না থাকলে মানুষের জীবন জন্ম-মৃত্যুর বন্ধনের এক কারাগার মাত্র। বাংলায় যোগাযোগের এই বন্ধন সেতুটি বলিষ্ঠ না থাকলে আমরা না চাইলেও বাংলার মানুষের সাথে মানুষের মধুর মেলবন্ধন  কোথাও না কোথাও ব‍্যহত হবে, বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় ব্যাঘাত ঘটবে, মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলা ও বাঙালির সব ধরনের  অগ্রগতি।

  ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাষার মতোই বাংলা ভাষাও বিলুপ্তির পথে পা বাড়াবে। কালের করাল স্রোতে লোপ পাবে বাংলা গান, বাংলা কবিতা, যাত্রা, নাটক, বাংলা সিনেমা। এবং আমাদের সুন্দর বাংলা ভাষাটি নানান ভাষাভাষীর কাটা ছেঁড়াতে  বিকৃত রূপ ধারণ করবে। তখন বিশুদ্ধ বাংলার সন্ধানে বাঙালিকেই শরণাপন্ন হতে হবে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে।

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments