জ্বলদর্চি

আ - মরি বাংলা ভাষা/ শীর্ষেন্দু পাল

আ - মরি বাংলা ভাষা 

শীর্ষেন্দু পাল

একটা ভাষা টিঁকে থাকে নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে। ভাষা বহতা নদীর মতোই। নদী যেমন তার চলার পথে অনেক কিছু সংগ্রহ করে, আবার ফেলেও যায় অনেক কিছু, ঠিক তেমনই ভাষার ক্ষেত্রেও। এটা অনস্বীকার্য যে বাংলা ভাষার মধ্যে আজ অনেক ভাষার শব্দ, পরিভাষা স্থান পেয়েছে। এসব সত্ত্বেও বাংলা ভাষা যেন সত্যিই বিপন্ন হওয়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। আসলে এটা আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্য। আমি বাংলাদেশের, ত্রিপুরার, বা অন‍্যান‍্য যে সব জায়গায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আছেন সেখানে কি হচ্ছে বলতে পারবো না। আমাদের রাজ‍্যে কথা বলা ছাড়া অন্য সমস্ত কাজে বাংলা ভাষাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট।

        আমি অন‍্য ভাষার বিরোধী নই। ইংরেজি ভাষার তো নয়ই। কিন্তু যখন চারপাশে একটা ইংরেজি প্রীতির নামে বাংলা কে পিছনের সারিতে রাখার বা ফেলনা ভাবার চেষ্টা দেখি, তখন দুঃখ লাগে। এই মানুষ গুলোই কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের কথা বলবেন, বিদ‍্যাসাগরের নামে গদগদ হবেন, ভাষা দিবসের দিন বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের উদ্দেশ্য তৈরি স্মারকের ছবি দিয়ে ফেসবুকের পাতায় লম্বা চওড়া কথা লিখবেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে অন‍্যকে উৎসাহ দেওয়া তো দূরের কথা, নিজেও আন্তরিক ভাবে বাংলা ভাষা পড়ার, লেখার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করবেন না। একটা ভাষাকে জানতে হলে সবাইকে যে ভাষার ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়তেই হবে, তা আদৌ নয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় এত বেশি সুন্দর সাহিত্য রচনা হয়েছে, তার মধ্যে কতটুকুই বা আমরা পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি? 

   এর ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আমরা আসলে ভুলে যাই যে অন্য কোন ভাষায় আমরা ভাবতে পারবোনা। যে কোন কথা, সে কাজের হোক বা অকাজের, বা নিছকই আড্ডা দিতে গেলেও, নিজের মনে গুনগুন করে গান গাইতে হলেও বারবার আমাদের ফিরে আসতে হবে নিজের ভাষার কাছে। ইংরেজি না জানলে খেতে পাবে না - এইরকম একটা ধুয়ো তুলে সস্তার ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তির হিড়িক তো আছেই, তার সঙ্গে আছে সচেতন ভাবে বাংলা ভাষা থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা। পত্রপত্রিকা পড়া, নিদেনপক্ষে বাংলা খবরের কাগজ পড়া বা একেবারেই মনে যা আসছে, এলোমেলো ভাবে হলেও, তা লিখে ফেলতে উৎসাহিত করা - এগুলো  হয়তো বাংলা ভাষা ব্যবহার এর দিকে ঝোঁক তৈরি করতে পারতো। আসলে কথ‍্য ভাষা হিসেবে রেখে দেওয়া আর রচনাবলী কিনে দেওয়াল আলমারিতে সাজিয়ে রাখা, এসবের জন্য বাংলা ভাষা থাক, বাকি সব কাজেই ইংরেজি টা থাকুক - এমনটাই যেন আমাদের বেশিরভাগ জনের ইচ্ছা। এমনকি বাংলা কথা বলতে বলতেই তার মধ্যে দুচারটে হিন্দি বা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিতে পারলে কি ভীষণ আত্মশ্লাঘা অনুভব করে অনেকেই - তাও তো প্রায়ই দেখছি। 

     সারা পৃথিবীতে কতজন মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন,তা নিয়ে গর্ব করে একটা মিথ্যে আত্মতুষ্টি তে ভোগার কারণ নেই। আমাদের মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও এত দ্রুত এবং এই পরিমাণে বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা তৈরি দেখে আসলে আমাদের নিজেদের প্রতি করুণা জাগা উচিত। এ ব‍্যাপারে শিক্ষা ব‍্যবস্থার দোষ দেখিয়ে গা বাঁচানোর দিন শেষ। সত্যি কথা বলতে কি আড়ম্বর বাদ দিয়ে আন্তরিক চেষ্টা করে এই ভাষার চর্চা করতে হলে যা যা করা উচিত ছিল তা আমরা হয়তো করিনি। ভাষার প্রতি আগ্ৰহ গড়ে তোলার জন্য, সেটার নিয়মিত চর্চা এবং গবেষণার জন্য স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির বাইরেও স্বতন্ত্র উদ‍্যোগী হয়ে ওঠার দরকার ছিল, তা হয়নি। পাঠ‍্য বইয়ের মধ্যে অনেক কবিতা , গল্প অন্তর্ভুক্ত করা থাকলেও, তা থেকে মাত্র কয়েকটি নির্বাচিত করে পড়ানো হয়েছে। একের পর এক ইংরেজি মাধ‍্যমের স্কুলে বাংলা ভাষা কে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে নিতেও অনীহা তৈরি হচ্ছে দেখেও কোন কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সারা বছর ধরে কয়েকজন মাত্র লেখক লেখিকার কয়েকটি লেখা পড়েই যদি একজন ছাত্র বা ছাত্রীর আগ্ৰহ তৈরি হবে, এটা আশা করা অন‍্যায়। লাইব্রেরিতে বই থাকলেও পাঠক পাঠিকা নেই, বই পড়ার আগ্ৰহ নেই, হ‍্যারি পটারের কাহিনি কিনে দেওয়ার আগে সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল বা হযবরল পড়ার জন্য সুযোগ করে দিইনি আমরা। আমরা ভাষা নিয়ে গর্ব করে গল্প করে শোনাইনি, এমনকি আজ যখন আমাদের প্রিয় ভাষার এত বিপদ, তখনও এই ব‍্যাপারে যথেষ্ট পরিমাণে উদাসীন থাকছি। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। 
    বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক স্তরে কতোটা পরিচিত? এ ব‍্যাপারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা সাক্ষাৎকার এর কথা মনে পড়ছে। তিনি স্পষ্ট, দ্বিধাহীন ভাবে বলেছিলেন যে যতই আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে বিশ্বকবি আখ্যায়িত করি না কেন, বিশ্বের কতগুলো ভাষায় ঠিকভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা অনুদিত হয়েছে, অন্য ভাষার লেখক কবিদের লেখার অনুবাদের অনুপাতে তার পরিমাণ কত, তা আমরা ভাবিই না। আমরা যে কোন ব‍্যাপারে বাড়াবাড়ি রকমের দেখনদারিতে অভ‍্যস্ত হয়ে উঠেছি যত, ততই অন্তসারশূন‍্যতা গ্ৰাস করেছে নিজেদের। বাংলা ভাষা আন্দোলনের কথা তাই শুধু মাত্র মঞ্চে বক্তৃতার বিষয় হিসেবেই রয়ে গেছে, তার গুরুত্ব মানুষের মনে নিবিড় ভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। বাংলা সাহিত্যের অনেক অনন‍্য সাধারণ সৃষ্টি আছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেতে পারে সঠিকভাবে অনুবাদ এর কাজটি হলে। সেখানেও আমাদের প্রণম‍্য অগ্ৰজদের মধ‍্যে চরম উদাসীনতা কাজ করেছে। 

    বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ নেই, নেই যথাযথ বিজ্ঞান চর্চা করার সুযোগ, এটা যে কতোটা ভ্রান্ত তা বারেবারে প্রমাণ করেছেন অনেকেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, সার্বিকভাবে বাংলা ভাষাতে উচ্চশিক্ষা এবং বিজ্ঞানচর্চার জন্য যা যা করণীয় ছিল, তা করা হয়নি। একটা উদাহরণ দিই ; ক্লাসে মধুসূদন দত্তের বঙ্গভাষা কবিতাটি পড়ানো হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা শুনছে কবির আক্ষেপের কথা। কেমন করে তিনি নিজের ভাষাকে অবহেলা করে ইংরেজি ভাষায় কাব‍্যচর্চা করতে গিয়ে মূর্খের স্বর্গে বসবাস করছেন এবং পরে তা স্বীকার করেছেন। এখন দেখা গেল, এই কবিতাটি পড়ানো হচ্ছে একটি ইংরেজি মাধ‍্যম স্কুলের কোন একটা ক্লাসে। কি চরম হাস‍্যকর লাগছে না ব‍্যাপারটা? প্রতিদিন ওইসব সুকুমারমতি ছাত্রছাত্রীদের বাবা মায়ের কাছে শুনতে হয়, ইংরেজি ভালো করে না শিখলে কিস‍্যু হবে না অথচ ক্লাসে পড়ানোর সময় শিক্ষক বা শিক্ষিকা সম্পূর্ণ আলাদা কথা বলছেন। যদিও বা তাঁরা বাংলা ভাষার সাহিত্যিক দের গল্প বা কবিতা ইংরেজি অনুবাদে পড়ে, তার মান কোন কোন সময় এতটাই খারাপ হয় যে মূল ভাষায় বিষয়টি পড়বার মতো আগ্ৰহ আদৌ তৈরি করে না।

     মানুষ কাকে ভালো রাখতে চেষ্টা করে? এককথায় উত্তর হবে, যাকে মানুষ ভালোবাসে। তাহলে এটা কি প্রমাণিত যে, আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি না? এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে ব‍্যাপারটা ঠিক তাই। তা নাহলে আমাদের ভাষার উপর যে কোন রকমের আক্রমণ নেমে এলে, তাকে প্রতিহত করবার ঐকান্তিক চেষ্টা আমাদের মধ্যে দেখা যায় না কেন? ভাষার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা উচিত একেবারে জীবনের গোড়া থেকেই। তা করা হয়? সঠিক বাংলা বলার, লেখার উৎসাহ দেওয়া হয়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরটা না। আমরা প্রচারের ঢক্বানিনাদে চাপা দিয়েছি অন্তরের ভালোবাসা কে। তাই শপিং মলে, রেস্তোরাঁয়, হাসপাতালে এবং আরো অনেক জায়গাতেই যখন ইংরেজি বলা হয়, আমরা তার উত্তরে তাকে বাংলা বলতে বাধ্য না করে নিজেই ইংরেজি তে উত্তর দিতে পেরে বা ভাঙাচোরা হিন্দি বলতে পেরে 'আমি কি হনু' ভাব করি। আমাদের ভাষার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা যদি না থাকে, অচিরেই যে বাংলা ভাষা বিপন্নতর হয়ে উঠবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সে আমাদের যতই মণিমাণিক‍্য থাকুক না কেন। 

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments