জ্বলদর্চি

বিপন্ন বাংলা ভাষা/সূর্যকান্ত মাহাতো

বিপন্ন বাংলা ভাষা

সূর্যকান্ত মাহাতো

কোনও একটা 'দিবস' পালনের মানে হল, সেই দিনটির মহত্ত্বকে আবারও একবার স্মরণ করা। এবং দিনটির উদ্দেশ্যকে বর্তমানের নিরিখে  আরও একবার পর্যালোচনা করা। দিনটি যে গভীর অর্থ বহন করে তা আজকের দিনে  কতটা ফলপ্রসু, নাকি  কেবলই তা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে জৌলুসহীন হয়ে পড়ছে তার একটা বিচার বিশ্লেষণ। একটা আবেগের মোড়কে 'দিবস' গুলো প্রতি বছর একবার করে জ্বলে উঠে। আবার সেটা একটু একটু করে প্রচ্ছন্নও হয়ে পড়ে। কখনো কখনো সেখান থেকে নতুন একটা দিশা যে উঠে আসে না এমনটা নয়। এই যেমন "ভাষা দিবস।" প্রতি বছর ভাষা দিবসে বাংলা ভাষার সংকট নিয়ে কত নিয়ম নীতি পরামর্শ নির্দেশিকা রচিত হয়। সব কটা কী আর আর মানা হয়! তাছাড়া সেগুলো কতখানি কার্যকর হয়, নাকি আদৌ হয় না সে নিয়ে একটা সংশয় তো থেকেই যায়। কেননা বাঙালির চিন্তা ভাবনার গতির কাছে তাকে বাস্তবায়িত করার গতি বরাবরই অনেকখানি পিছিয়ে।

  সুতরাং ভাষাদিবস পালন করলেই ভাষা বাঁচবে না। ভাষাকে বাঁচাতে হলে সারা বছরই তার গোড়ায় প্রভূত ভাষা চর্চা, লেখালেখি,আর বহুল ব্যবহারের সার মাটি আর জলের যোগান দিতে হবে। নইলে ভাষা বাঁচবে কী করে! বছরে মাত্র একদিন বাংলা ভাষাকে স্মরণ করে বাকি দিনগুলোতে অন্য ভাষাকে আপন করলে  সে তো অস্তিত্ব সংকটে পড়বেই।

  এখন প্রশ্ন হল, তবে কি বাংলা ভাষা বিপন্ন? এমন একটা প্রশ্নের উদয় কেবল বর্তমান সময়ের নয়। সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বাংলা ভাষা সংকটের এই প্রশ্ন ঘোরা ফেরা করছে। প্রমথ চৌধুরী ১৯২২ সালে "আমাদের ভাষা সংকট" নামে তৎকালীন সময়ে একটি প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। তাই একটা দ্বিমত উঠতে পারে যে, বাংলা ভাষা যদি বিপন্ন তাহলে তারপরেও তো প্রায় একশ বছরের কাছাকাছি হতে চলল এ ভাষা দিব্যি বেঁচে রয়েছে। 

  আসলে উপরেরটা একটা মত হতে পারে কিন্তু একমাত্র যুক্তি হতে পারে না। কারণ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা হল বাংলা। অর্থাৎ কোটি কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে থাকেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দৈনন্দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং কথ্য বা মৌখিক ভাবে ব্যবহৃত হওয়াটা ভাষা সংকটের মাপকাঠি হয় না। ভাষা চর্চা কতটা হচ্ছে সেটাই দেখা হয়। বর্তমান কালে বাংলা ভাষা চর্চা তেমনভাবে আর হচ্ছে কোথায়! বিদ্দ্বজন সমাজেও বাংলার কদর বাড়ছে কই? তারাও তো বাংলা ভাষা থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে। এছাড়াও বাংলা ভাষার যথার্থ পরিভাষার অভাবে বাংলায় তেমন একটা জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা একেবারে নেই বললেই চলে। তাই উপযুক্ত পরিভাষার অভাবে সেরকম গ্রন্থও বাংলায় রচিত হতে পারছে না। গবেষণা মূলক বিষয় বাংলা ভাষায় সেরকম ভাবে লিখিত হচ্ছে না। এমনকি সেই প্রয়াসও নেই।এটা কি বাংলা ভাষার কম দৈন্যতা? সুতরাং বাংলা ভাষার আরও বেশি বেশি চর্চার প্রয়োজন। না হলে রেফারেন্স বা প্রয়োজনে অন্য ভাষার দিকে হাত বাড়াতে তো হবেই। তখন কুম্ভিরাশ্রু ফেলে কী লাভ? চাহিদা মেটাতে না পারলে কিংবা তার প্রয়াস গড়ে তুলতে না পারলে  বাংলা ভাষা তো বিপন্ন হবেই!

  বাংলা ভাষা যে বিপন্ন তার প্রধান দুটি দিক। এক. বাংলা ভাষা বর্জন। অর্থাৎ বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে হিন্দী ইংরেজির মতো অন্যান্য ভাষাকে গ্রহণ। 
দুই. বাংলা ভাষায় বহুল পরিমানে বিদেশি শব্দের আগমন। ফলে বাংলা ভাষার মূলত্ব বা আদিত্ব ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আর মূল বাংলা ভাষা আরও বেশি বেশি করে সংকর ভাষা হয়ে উঠছে। প্রমথ চৌধুরী "আমাদের ভাষা সংকট" প্রবন্ধে এই দ্বিতীয়টির ওপর আলোকপাত করেছেন। এটা কেবল বাংলা ভাষার একার দোষ নয়। প্রবন্ধের সূচনাতে তাই স্পষ্ট করে বলেছেন, "তবে বাংলার ভিতর ইংরেজি ঢুকলে ভাষা যদি সংকর হয়, তাহলে শুধু আমার নয়, দেশসুদ্ধ লোকের ভাষা সংকর হয়ে গেছে।"
  সুতরাং বিদেশি শব্দের আগমন বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার কে ধারে ও ভারে শুধুই ঋদ্ধ করে চলেছে এমন নয় তার পরিধিও বৃদ্ধি করে চলেছে। কেবল হিন্দি ইংরেজি নয়,  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরবি ফারসি আলেমান ওলন্দাজ দিনেমার পর্তুগিজ থেকেও নানা শব্দ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেইসব ভাষাকে বাংলা ভাষা এতটাই অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করেছে যে তা বর্জনের প্রশ্নই উঠে না। বরং বর্জন প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, একবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত মশাইরা আরবি ফারসি বর্জন করে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। ফলে আরবি ফারসি তো চলে গেলই সেই সঙ্গে অনেক তদ্ভব শব্দও বেরিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং এটাও একটা বিপদ। তাছাড়া প্রাবন্ধিক এর কথা অনুযায়ী---"পরের ধনে পোদ্দারি করা হচ্ছে যখন বাংলা ভাষার চিরকেলে বদ অভ্যাস, তখন এযুগে যে অসংখ্য ইংরেজি শব্দ শুধু মুখস্ত নয় উদরস্থও করবে সে তো ধরা কথা।"
তাছাড়া "বাঙালি যে দেহে সংকর মনে সংকর, ভাষায় সংকর এর জন্য দোষী আমরা নই, কেননা বাঙালি জাতি আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমরা বাঙালি জাতিকে সৃষ্টি করিনি।"

  এবার দেখা যাক বাংলা ভাষা বর্জনের বিষয়টি। বর্তমান প্রজন্ম ক্রমশই বাংলা বিমুখ হয়ে পড়ছে। ইংরেজি আর হিন্দিকে বেশি বেশি করে গ্রহণ করছে। কেননা ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের উপর এখন ভাষা অনেক বেশি যুক্ত হয়ে পড়েছে। তাই বর্তমানে অর্থনীতিও আজকাল ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। গন্ডি ছেড়ে আমরা যত বেশি করে বাহিরামুখী হয়ে পড়ছি ততই বাইরের ভাষা আমাদের মূল মাতৃভাষাকে গ্রাস করছে। এটা সত্যিই অবাক করা ব্যাপার। ঝাঁ চকচকে অফিস, বাবুয়ানা চাল চলন, আদব কায়দার পোশাকি জালে আমরা ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। সেখানে অভিজাত ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় বাহাদুরি দেখাতে না পারলে আমাদের সেই উপযুক্ত ভাবধারা নাকি বজায় থাকে না। সেই সঙ্গে ইগো সন্তুষ্ট হয় না। আমরাই বলি, ম্যাড়ম্যাড়ে অনভিজাত বাংলায় কথোপকথন? ব্যাপারটা কেমন খেলো হয়ে গেল না! তাছাড়া উঁচু পোস্টে চাকরি বাকরী পেতে গেলেও পাতি বাংলা বললে নাকি চলবে না। শুধু কি তাই, এখন নাকি একটা মুদির দোকানের ফর্ম ফিলাপ করতে হলেও ইংরেজি জানতে হয়। এই যে ইংরেজি ভাষার আভিজাত্যের প্রতি আমাদের একটা মিথ্যা অহংকার , ওপর চালাকি এটা তো আর এমনি এমনি হয়ে ওঠেনি। মাকে ছেড়ে মাসির কদর তো আমরাই করতে শিখেছি। পরবর্তী প্রজন্মকেও বিদেশি ভাষার আভিজাত্যের গুরুত্ব সেখাচ্ছি আবার চাপিয়েও দিচ্ছি। অবহেলা করে চলেছি বাংলার কৌলিন্য কে। এমনি করলে তো বাংলা ভাষা বিপন্ন হবেই।

  এখন প্রশ্ন হল, বাংলা ভাষা যদি না টেকে তবে কী ক্ষতি হতে পারে? আসলে ভাষা হল ভাব প্রকাশের একটা মাধ্যম। ভাব টা কার? না ভাব টা হল একটা জাতির। তাই ভাষার সঙ্গে একটা জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিচয় আত্মিক ভাবে জড়িয়ে থাকে। বাংলা ভাষার সঙ্গেও বাঙালি জাতির একটা সুদীর্ঘ সংস্কৃতির ইতিহাস ও পরিচিতি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। তাই ভাষা না টিকলে জাতির অস্তিত্বও বিপন্ন হবে। অন্য ভাষা গ্রহণে বাঙালি কেতাদুরস্ত হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে বাঙালিয়ানা কতটা থাকবে সেটা নিয়ে সংশয় তো একটা থেকেই যাবে! জাতির আত্মপরিচয়ও প্রশ্নের মুখে পড়বে। মাতৃভাষায় জড়িয়ে থাকা আদর আবেগ বাঙালির মধ্য থেকে হারিয়ে যাবে। 

"হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তবে বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি"
  --- সাবধান না হলে একদিন আমাদেরকেও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো এভাবেই অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হবে। আর ভাষা ও বাঙালিয়ানা দুটোই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো | লেখকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই |

    ReplyDelete