জ্বলদর্চি

মাতৃভাষার অস্তিত্ব-সংকট ও সমাধান-দিশা/আবীর ভট্টাচার্য্য

মাতৃভাষার অস্তিত্ব-সংকট ও সমাধান-দিশা

আবীর ভট্টাচার্য্য

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। শুধু মাত্র মুখের ভাষার সম্মানরক্ষার্থে ১৯৫২ সালের এই দিনে, ঢাকায় অনেকগুলি কিশোর শহীদ জীবনদানের এক অসাধারণ দিন। পৃথিবীর ইতিহাসের এক বিরল ও অমূল্য স্মৃতি।

  স্বাধীনতার সময় থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় ঘোষণা করলেন, 'উর্দু'-ই রাষ্ট্রভাষা। একপ্রকার প্রায় অস্বীকারই করেছিলেন, প্রায় ৫৬% শতাংশ মানুষের ভাষাকে, মানুষকে। জারি হলো সার্কুলার, প্রতিবাদ; এবং প্রতিরোধ ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি। এতদিনের লালিত, প্রাণতুল্য ভাষার অপমর্যাদার প্রতিবাদে রাজপথ ডাক দিয়েছিল বাঙালীকে; শাসকেরা স্পর্ধায় রাঙ্গালো পথঘাট,আর জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বাঙালীর জাতীয়তাবাদ,
"ইতিহাস থমকে দাঁড়িয়ে লিখে নিলো সব।
তাইতো অজস্র পাখির কলতানে আজ দিগন্ত মুখর"...
 নিজস্ব স্বকীয়তা,কৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখার জন্য শুরু হওয়া এই অসম লড়াই, লড়াইয়ে নিবেদিত কিশোর শহীদদের স্মৃতিতটে বাঁচিয়ে রাখতেই দেশ-গন্ডি পেরিয়ে দিনটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে, ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর তারিখে। এই ভাষা-আন্দোলনের রক্তধৌত পথেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো "স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।"...সে বড়ো সুখের কথা! তারপরে, কালের প্রবাহে স্মৃতি ধূসর হয়েছে, আঘাত সহনীয় হয়েছে, একবিংশ শতকের 'বিশ্বনাগরিক' হতে গিয়ে মাতৃভাষার আবেদন আজ প্রায় ভুলতেই বসেছি আমরা, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালীরা। পৃথিবীর গতির সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে গিয়ে, 'আ কমপ্লিট ইউনিভার্সাল পার্সন' হতে গিয়ে, যা কিছু আমার নিজস্ব, তার প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল হতে না পারার অভাবেই হয়তো কোথাও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বাঙালিয়ানায়, কৃষ্টিতে। তার ওপরে এসে বসেছে নতুন প্রজন্মের বিকৃত ভুল ইংরেজি উচ্চারণ, প্রয়োগ-প্রবনতা, হিন্দির অভব্য আগ্রাসন! এই ক্রান্তিকালে, এক জ্বলন্ত প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা! আমাদের মাতৃভাষা কি বিপন্ন? একটি দিনের প্রাতিষ্ঠানিক উৎসব পালনের মাধ্যমে কি পূ্ণ্যদিনটির ব্রতপালন সম্ভব?
  এই আলোচনা শুরুর আগে বলে রাখা ভালো,
যদিও ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি,  ভাষাদিবস পালনের  অর্থ  অন্যান্য ভাষাগুলিকে অর্গলবদ্ধ করে শুধুমাত্র মাতৃভাষার প্রসারন নয়; কারণ, আজকের দিনে, এই আন্তর্জালিক বিশ্বে কেবলমাত্র একটি ভাষাযাপন হয়তো সম্ভব নয়, কাম্যও নয়; শিখতে হবে, বলতে হবে, পড়তে হবে একাধিক ভাষা; আপনার উন্নয়নে তা একান্ত জরুরী। তবু বিভিন্ন সরকারী কাজকর্মে, সামাজিক, পারিবারিক, শিক্ষাক্ষেত্রে--সর্বত্র যদি আমরা মুখের ভাষাকে প্রাধান্য না দিই,অস্তিত্বসংকটে পড়বো আমরা নিজেরাই। পৃথিবীর সমস্ত উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম, দেশীয় ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষার ব্যবহার সরকারী বা বেসরকারী ক্ষেত্রে ভাবাই যায়না। এমনকি,বাংলা ছাড়া ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও,সে সরকারী দপ্তরে, দোকানপাটে, সিনেমা বা অন্যান্য লোকমাধ্যমে স্হানীয় ভাষার ব্যবহার স্বীকৃত। এর ফলস্বরূপ শৈশব থেকেই এক অটুট জাত্যাভিমান গড়ে ওঠে নাগরিক-মননে, একমাত্র বেশী আন্তর্জাতিক বা বেশী উদার হওয়ার তাড়নায় বাঙালী, বিশেষতঃ মধ্যবিত্ত বাঙালী জীবনে বেনোজলের মতো বিজাতীয় শব্দ ঢুকে পড়ছে ক্রমাগত; যখন শোনা যায়, ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে পৃথিবীর মধুরতম ভাষা বলে, বাঙালী মা অহঙ্কার করে বলছেন, "আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না!"...এ লজ্জা আমরা রাখি কোথায়!

  বিশেষত, নিজেদের অবিমিশ্রকারিতার ফল ভুগবে আগামী প্রজন্ম, যাদের কোন জাত্যাভিমান নেই, নিজস্ব সংস্কৃতিবোধ নেই,এক অনির্দেশ্য অসহায়তায় দিকভ্রষ্ট হবে তারা...
তাই আজ ব্রতপালন নয়, শপথ গ্রহণের দিন, মাতৃভাষা ছাড়া অন্যভাষা আমরা প্রয়োজনে শিখবো,ব্যবহার করবো নিশ্চয়ই, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে, কাজে-কর্মে কখনই একটিও অ-বাংলা শব্দ ব্যবহার করবো না। স্কুল-কলেজে মাতৃভাষার যোগ্য সম্মান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বাঙালি মনীষীদের কথা শেখাতে হবে শিশু-কিশোরদের,রাজা রামমোহন থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেন, মণি ভৌমিকের মতন জগদ্বিখ্যাত মানুষেরাও যে শুধুমাত্র বাংলাভাষার মাধ্যমেই পড়া শুরু করেও ঈর্ষনীয় সাফল্য পেয়েছেন, সফল হয়েছেন, তার গল্প শুনিয়ে এক ঋদ্ধ চেতনায় সমৃদ্ধ করতে হবে আজকের প্রজন্মকে। এক্ষেত্রে আমরা সাহায্য নিতে পারি,জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম গুলিরও,তেমন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি। আমরা বড়োরা যদি সচেতনভাবে নির্ভুল বাংলা হরফে ও ভাষায় লেখা শুরু করি,'অভ্র'-এর মতো সুন্দর প্রযত্ন(অ্যপ্লিকেশ্যন) যখন হাতের কাছে আছেই...., রাস্তায়, দোকান-দানি, বিজ্ঞাপন প্রভৃতিতে আবশ্যিকভাবে বাংলা ব্যবহার করা হয় সরকারী নির্দেশ ও সদিচ্ছাক্রমে,সভা-সমিতিতে নির্ভুল ভাষা ও বাংলা গান ব্যবহার করি,ওরা হয়তো অনুপ্রাণিত হবে, নিজের সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হবে, শুধুমাত্র বিশেষ কিছু  সচেতন নাগরিকদের ভাবনার সাথে মুষ্টিমেয় মানুষের সম্মিলন হবে...

  হয়তো অনেক, অনেক দেরী হয়ে গেছে, তবু আমাদের মনে রাখতেই হবে, 'ফুরায় যাহা, ফুরায় শুধু চোখে, অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় ফিরে আলোকে'...
তাই শতব্যস্ততার মধ্যেও আজ থেকে অনেক, অনেকদিন পরেও যদি বাঙালি হয়েও 'শরৎমেঘে রবীন্দ্রনাথ' দেখতে না পাই, গোধূলির বিষন্ন সন্ধ্যায় নদীর বাঁকে কোন এক নির্জনতম মানুষের অস্পষ্ট ছায়া না দেখি,প্রিয়নাম উচ্চারণে বাংলাভাষা না আসে, প্রিয়তমার মুখে 'শ্রাবস্তীর কারুকার্য' না খুঁজে পাই, বিপ্লবে সুকান্ত না থাকেন, ঋত্বিক ভাবনার সাথে বাস্তবতার ঘটকালি না করান, সমস্যা-সঙ্কুল মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যদি 'একুশে আইন' রিলেট করতে না পারি, তবে কিভাবে 'ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে' উদযাপন করবে বাঙালী ?......এই অসহায়তা টুকুই সারাদিন ঘিরে থাক, এই বেদনাটুকু অন্তত আমাদের ব্যথিত করুক,...'যেন ভুলে না যাই বেদনা পাই শয়নে স্বপনে'...'আরো বেদনা,আরো বেদনা, দাও মোরে আরো চেতনা'..-এই চেতনা উন্মেষেই হোক আত্মশুদ্ধি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই হোক আমাদের একমাত্র প্রার্থনা।

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments