জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৯/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -২৯

শ্যামল জানা

অরফিজম্ ও আ্যাবস্ট্রাকশন

    কিউবিজমকে মূল মন্ত্র করে যে দ্বিধা এবং সরাসরি দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছিল কিউবিস্টদের ভেতরে, তার মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন তৎকালীন কিংবদন্তী ফরাসি কবি গিয়োম আ্যপোলোনীয়ার৷ তিনি কবি হয়েও পেন্টারদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতেন৷ এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ— “কিউবিজম্” নামটি তাঁর দেওয়া৷ শুধু তাইই নয়, চিত্রকর হিসেবে পল সেজান-এর ছবি থেকে কিউবিজম্-এর সূত্রপাত হলেও এর গতিবিধি, দর্শন, সেই অনুযায়ী এর আন্দোলন, সমস্ত কিছুতেই বলা যায় তাঁর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে অগ্রগন্য৷ পরবর্তীকালে তাঁকে “ফোরফাদার অফ সাররিয়েলিজম্” হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছিল৷ কবিদের পাশাপাশি চলচ্চিত্রকর ও চিত্রকরেরাও সমানভাবে সর্বঅর্থে তাঁর বন্ধু ছিল৷

    কিউবিস্টরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে গেছিলেন মূলত একটি প্রশ্নে৷ যে, ছবিতে আ্যবস্ট্রাকশন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন হব? দুটি দলের মধ্যে প্রথম দলটিতে ছিলেন পাবলো পিকাসো ও জর্জেস ব্রাক্৷ দ্বিতীয় দলটিতে ছিলেন খ্যাতনামারা প্রায় সবাই৷ তবে, প্রথম দলটিতে মাত্র দু-জন মানুষ থাকলেও, এঁরা চিত্রকর হিসেবে এত বেশি শক্তিশালী ও নামকরা ছিলেন যে, তাঁদের ছবির ধরনই জনমানসে ততদিনে কিউবিজম্ হিসেবে প্রায় চিহ্নিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে৷

    পিকাসো এবং ব্রাক্ ও তাঁদের অনুসারিরা মনে করতেন— কিউবিস্টরা ছবিতে জ্যামিতির ভেতর দিয়ে যে বাস্তবচিত্রকে দেখায়, তা সরাসরি বাস্তব নয় এটা ঠিক৷ কিন্তু এরও একটা সীমা থাকতে হবে৷ কারণ, কিউবিস্টরা যদি নানা জ্যামিতিক গঠনের ভিতর দিয়ে প্রকৃতির কোনো বস্তুর রূপকে পরিবর্তীতভাবে নতুন আদর্শে তুলে ধরে, তাহলেও, সে ছবিগুলি এমনিতেই এত নতুন ধরনের হবে যে, তা দেখার যে চোখ, যে মানসিকতা, যে অভ্যাস, তা তখনও মানুষের মধ্যে তেমনভাবে গড়ে না ওঠায় প্রাথমিকভাবে মানুষের বুঝতে একটু অসুবিধা হবে এটা নিশ্চিত৷ কিন্তু চেষ্টা করলে তারা ঠিক বুঝতে পারবে, এটা প্রকৃতির ওমুক দৃশ্য৷ ধরা যাক একটা গাছ, বা একটা পাহাড়, বা একটা গীটার— জ্যামিতিক গঠনের ভিতর দিয়ে তাদের রূপ পরিবর্তন হলেও মানুষ একটু ধৈর্য ধরলে ঠিক বুঝতে পারবে সেটা একটা গাছ বা একটা পাহাড় বা একটা গীটার৷ কিন্তু, আমি যদি প্রকৃতির কোনো বাস্তবচিত্রকেই যদি ছবিতে না রাখি৷ শুধুমাত্র জ্যামিতিক গঠনকে উপজীব্য করে সম্পূর্ণ আ্যবস্ট্রাক্ট একটি ছবি করি, তাহলে মানুষ আমাদেরকে প্রাথমিক অবস্থাতেই বাতিল করবে৷ তাই, শুধুমাত্র জ্যামিতিক গঠনের জটিলতা, আবার তার সঙ্গে সম্পূর্ণ আ্যাবস্ট্রাকশনের জটিলতা— এই দুইয়ে মিলে যে ভয়ংকর জটিলতা, তা কোনো অর্থেই মানুষ গ্রহণ করতে পারে না৷ ফলে, আমাদের আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে৷

  দ্বিতীয় দলের চিন্তা-ভাবনা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ বিশেষ করে চিত্রশিল্পী ফ্রান্তিসেক কুপকার৷ তাঁরা চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে পিকাসো বা ব্রাক-এর সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান করেছিলেন৷ আর, এটা তাঁরা স্পষ্টই বুঝতে পারলেন যে, পিকাসো বা ব্রাক-এর ছবির নিরিখেই কিউবিজম্ কথাটি উচ্চারিত হচ্ছে৷ তাই, তাঁরা কিউবিস্ট হলেও চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে যেহেতু বিপরীতে অবস্থান করছেন, সেহেতু কিউবিজম্-এর অংশ হিসেবেই তাঁদের দলের স্বতন্ত্র আর একটি নামকরণ করলেন৷ নাম দিলেন “অরফিজম্”৷ প্রাচীন গ্রীক পৌরাণিক কবি “অরফিউস”-এর থেকেই এই নামকরণটি করা হল৷ কিউবিজম্-এর মতো এই নামকরণটিও করেছিলেন কবি গিয়োম আ্যপোলোনীয়ার৷ শুধু তাইই নয়, তাঁর চিন্তা-ভাবনাকেই মূলত অনুসরণ করলেন এই “অরফিজম্” চিত্রশিল্পীরা৷

  এঁরা তাঁদের ছবিতে মূলত চড়া রঙের সাহায্যে জ্যামিতিক গঠনের সঙ্গে পূর্ণ আ্যবস্ট্রাকশনকে যুক্ত করলেন৷ আর, প্রচণ্ড প্রভাব পড়ল— পূর্বসূরি “ফবইজিম” ও এক্সপ্রেশনিজম্-এর “কালার স্পিরিচুয়ালিটি”-র৷ এই সবকিছু মিলিয়ে তাঁরা যেটা বললেন, তার মোদ্দা বিষয়টি হল— আমাদের ছবিতে এই যে পূর্ণ আ্যাবস্ট্রাকশন, এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট আছে৷ একে আমরা “Lyrical abstraction” নামে অভিহিত করতে পারি৷ এই জ্যামিতিক বিমূর্ততার মধ্যে ছন্দ ও গীতিময়তাকে নিশ্চিত অনুভব করা যাবে৷ আর, সেইসঙ্গে স্পষ্ট অনুভব করা যাবে, চেতনার সঙ্গে রং যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে৷ যদিও চেতনাই হবে উৎস এবং তার অনুসারী হবে রং(ছবি-১)৷
এঁরা প্রথম দিকে চেনা যায় এমন সহজ কোনো বিষয়কে বিমূর্ত গঠনের (abstract structures) সাহায্যে ছবিতে তুলে ধরতেন৷ যেখানে ছবির ঝোঁক থাকত মূলত আধ্যাত্মিকতার দিকে৷ এখানে দুশাম্প এবং পিকাবিয়ার কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য৷ এঁরা ১৯১২ থেকে ১৯১৪ সাল, এই দু-বছর জটিল আবেগ ও যৌনতাকে বিষয় করে প্রচণ্ড অভিব্যাক্তিপূর্ণ ও সাংকেতিক ছবি এঁকে তাঁদের মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করার পথে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছিলেন৷ পরবর্তীকালে তাঁরা তাঁদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী ছবি থেকে বিষয় বা বাস্তবচিত্রকে একেবারেই বাদ দিয়ে শুধুমাত্র জ্যমিতিক গঠন ও রঙের সাহায্যে ছবি এঁকেছিলেন৷ ওই একই সময়ে ১৯১২ সালে রবার্ট ডিল্যুনে Simultaneous Windows নামে একটা সিরিজ ছবি এঁকেছিলেন(ছবি-২)৷ 

যেখানে তিনি ছবিতে প্রিজম্-এর বর্ণচ্ছটার রঙকে আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহার করেছিলেন৷ এবং এই রঙের ব্যবহারে এক বিশেষ থিওরি প্রয়োগ করেছিলেন৷ সেই থিওরিটি হল— নিও-ইম্প্রেশনিস্টখ্যাত পল সিগন্যাক ও চার্লস হেনরির বিশেষ বর্ণালী-তত্ত্ব৷ নামটা একটু বড়— The decomposition of spectral light in Neo-Impressionist color theory৷ 
 (ক্রমশ)

   

Post a Comment

1 Comments

  1. ২৮ ও ২৯ তম লেখাটিও পড়লাম।এখন ভাবছি আমাদের কত কম জানা নিয়ে আমাদের অহং।অথচ
    এই রকম ব্যাপক বিস্তৃত গভীর অভিনিবেশের একটি লেখা কি দীপ্ত
    প্রত্যয়ে শ্যামল উপহার দিয়ে চলেছে
    আমাদের। সে যে শিল্প সাধনায় উৎসর্গীকৃত প্রাণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার সৃজনানন্দ
    আমাদের ঋদ্ধ করে চলেছে।অনেক
    শুভেচ্ছা রইল।

    ReplyDelete