জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩২/ শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৩২

শ্যামল জানা

লে দ্যামোয়াজেলস দ’ অ্যাঁভো 

একটি কিউবিজম্-এর দল তাদের নাম “সেকশন ডি’ওর” হল কেন?  লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-র অংক নিয়ে গবেষণার একটি বই আছে৷ নাম— “ট্র্যাট্টাটো দেল্লা পিট্টুরা’৷ শিল্পবোদ্ধা যোসেপিন পেলাদাঁ এটি অনুবাদ করেছিলেন৷ এটি সদ্য পড়েছিলেন শিল্পী জ্যাকুয়েস ভিলোঁ৷ বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করেন তাঁর সতীর্থ কিউবিস্ট শিল্পী মেটজিঞ্জার ও গ্লেইজেস-এর সঙ্গে এবং পাশাপাশি প্রস্তাবও রাখেন ওইখান থেকে পাওয়া “সেকশন ডি’ওর” কথাটি তাদের দলের নামকরণ করা যায় কিনা৷ তাঁর এই প্রস্তাব গৃহীত হয়৷
ইয়োরোপীয়ানরা পুরো উনিশ শতক ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক কলোনী স্থাপন করেছিল৷ এতে শিল্পের লাভ হল এই যে— আফ্রিকা, পলিনেশিয়া, মাইক্রোনেশিয়া ও নেটিভ আমেরিকানদের যে আদিম বা পুরাতন ঐতিহ্যশালী শিল্প ছিল, তা আধুনিকতার প্রেক্ষিতে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হল৷ জনমানসে প্রচারিত হল৷ তৎকালীন আধুনিক শিল্পীদের মধ্যে দারুন প্রভাব ফেলল৷ বিশেষ করে পল গগ্যাঁ, আঁরি মাতিস ও পাবলো পিকাসো ওই সব শিল্প দেখে বলা যায় স্রেফ হত-বিহ্বল হয়ে গেছিল মূলত সেইসব শিল্পের শৈলীর সরলতা ও অভিনবত্ব দেখে৷ এই সময় তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক, নাট্যকার, শিল্প সংগ্রাহক, ‘গার্তুদে স্টেইন’-এর মধ্যস্থতায় পিকাসো-র সঙ্গে মাতিস-এর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল৷  কিন্তু ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তাঁরা সর্বতোভাবে পরস্পর পরস্পরের প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন৷ কারণ, দুজনেই আদিমতা (primitivism) , অইবেরিয়ার ভাস্কর্য (Iberian sculpture), আফ্রিকার শিল্প(African art) এবং আফ্রিকার উপজাতিদের মুখোশ (African tribal masks)-এর দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন৷ তাঁদের দুজনেরই ছবিতে এগুলির প্রভাব সমানভাবে এবং সাংঘাতিকভাবে পড়ল৷ ফলে, একই সময়ে, তাঁরা দুজনেই,  প্রায় একই রকমভাবে, ওই আদিম শিল্পের শৈলীর সরলতা তাঁদের নিজ নিজ ছবিতে প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন৷

 আমরা ’২৫ নম্বর’ লেখাতে স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলাম যে— ১৯০৬ - ১৯০৯ সাল অবধি কিউবিজম-এর বেড়ে ওঠার সময়। এই পর্যায়কেই প্রোটো কিউবিজম বলে চিহ্নিত করা হয়৷ এই সময়কালে তাঁদের কাজে আদিম(Proto) চিত্রকলার অর্থাৎ অইবেরিয়ার ভাস্কর্য (Iberian sculpture), আফ্রিকার শিল্প(African art) এবং আফ্রিকার উপজাতিদের মুখোশ (African tribal masks)-এর বেশ প্রভাব পড়েছিল৷ আর, এই কিউবিজম আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯০৭ সালে পিকাসোর  তেল রঙে আঁকা ‘অ্যাঁভোর রমণীরা’ ( Les Demoiselles d'Avignon) এই ছবিটির মাধ্যমে(ছবি-১), যেটি স্বাভাবিকভাবেই ছিল প্রোটো কিউবিস্ট পর্যায়ের ছবি৷ এবং পিকাসোর আঁকা তেল রঙের এই “লে দ্যামোয়াজেলস দ’ অ্যাঁভো” ছবিটি থেকেই ঐতিহাসিকভাবে কিউবিজম্-এর সূত্রপাত হল৷ স্বাভাবিকভাবেই সূত্রপাত অবস্থায় এই ছবি কিউবিজম্-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ বা পূর্ণাঙ্গ শৈলীর হবে না৷ অর্থাৎ, প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর এই অবস্থাকে বলা হল পূর্ণ কিউবিজম্-এর পূর্ব অবস্থা (Proto Cubism)৷

  চিত্রশিল্পের ইতিহাসে কিউবিজম্-এর জার্নিই সবচেয়ে দীর্ঘ এবং অত্যন্ত রহস্যময়, ঘটনাবহুল ও জটিল৷ এবং তা একেবারে গোড়া থেকেই৷ এই যে পিকাসোর আঁকা “লে দ্যামোয়াজেলস দ’ অ্যাঁভো”, কিউবিজম্-এর এই সূত্রপাত ছবিটির হয়ে ওঠার পিছনে কত যে ঘটনা, তা আমাদের যার পর নাই বিস্মিত করে!

  একদিন পিকাসো স্পেন-এর বার্সেলোনা শহরের অ্যাঁভোঁ স্ট্রীট-এর এক নিষিদ্ধ পল্লীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ তখন তাঁর চোখে পড়ল কয়েকজন গণিকা খরিদ্দারের আশায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে৷ বাড়ি এসে ওই বিষয়টি নিয়ে তিনি একটি পেন্টিং করার উদ্দেশ্যে যখন খসড়া করতে শুরু করলেন, দেখলেন, বিষয়টি তিনি কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে দাঁড় করাতে পারছেন না! পাগলের মতো একটার পর একটা খসড়া করে যাচ্ছেন, অথচ একটাও তাঁর মনঃপূত হচ্ছে না৷ এমতাবস্থায় তিনি অন্তত একশোটি খসড়া করেছিলেন(ছবি-২)৷

  শেষ পর্যন্ত একটি মোটামুটি সন্তোষজনক ছবি তিনি ক্যানভাসে আঁকতে সক্ষম হলেন(ছবি-১)৷

 তিনি পাঁচজন গণিকাকে ক্যানভাসে আঁকলেন খুব সহজাতভাবে, অথচ একেবারে ঠাসাঠাসিভাবে৷ এমনভাবে আঁকলেন, দেখে মনে হবে— অপরিকল্পিতভাবে দ্রুতহাতে কর্কশ তুলি চালনার ফলে, ক্যানভাসে অনিয়ন্ত্রিত ও এবড়োখেবড়ো রঙের প্রলেপ পড়েছে৷ যেন এটি স্বতঃস্ফূর্ত একটি সৃষ্টি, যা পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই আঁকতে আঁকতে গড়ে উঠেছে (কেউ কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারবে না, এই ছবি আঁকার আগে তিনি কত রকমভাবে প্রস্তুত হয়েছিলেন৷ অন্তত একশোটা খসড়া এঁকেছিলেন!)৷
আর, স্পষ্টতই বোঝা গেল— কামুক ও যৌনক্ষুধাতাড়িত অমার্জিত এক প্রায় পর্ণোগ্রাফি ক্যানভাসে প্রকটভাবে ধরা পড়েছে৷ আর, এমন ঠাসাঠাসিভাবে তাদের অবস্থান, যে, দেখেই মনে হবে— পুরো ক্যানভাসটি একটি পাপের ফাঁদ৷ আর, সেই ফাঁদে আটকে পড়েছে এই পাঁচজন মহিলা৷ ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে মূলত নীল রঙের যে ড্রাপারি(কাপড়ের ঝালর), সেটি এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে, বোঝার উপায় নেই— সেটি মহিলাদের সামনে না পিছনে অবস্থান করছে! অর্থাৎ, তিনি বোঝাতে চাইলেন এই মহিলাদের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই! সেইসঙ্গে স্পেস ডিভিশন ও রঙের বিন্যাস এমন করলেন— যেন, ক্যানভাসটি কোনো একটি ঘরের আভ্যন্তরীন চাপা পরিবেশের একটি অংশ৷ আলো-বাতাসহীন এই দমবন্ধকরা পরিবেশে বন্দীর মতো থাকতে থাকতে এই মহিলারা ফোবিয়া-আক্রান্ত ও একইসঙ্গে ভেতরে ভেতরে চূড়ান্ত বিদ্ধস্ত ও ভাঙাচোরা৷ অথচ বাইরে তারা খুব বিপজ্জনক!
সামগ্রিকভাবে এই বিষয়টিকে বোঝাবার জন্য, একটি বড় ফ্রেমের ভেতরে ওই মাপেরই একটি কাঁচ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আটকে থাকলে যেরকম লাগে, সেই রকমভাবেই পিকাসো ওই ছবিটা আঁকলেন৷ কিউবিজম্-এর অঙ্কন-পদ্ধতি হিসেবে এই অঙ্কন-পদ্ধতিটাই ক্যানভাসে প্রথম ব্যবহার হল! যদিও এই পদ্ধতিটিও পিকাসোর নিজস্ব মৌলিক অঙ্কন-পদ্ধতি নয়৷ তাঁর পূর্বসুরি পল সেজান মৃত্যুর দু-বছর আগে ১৯০২ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে ‘মঁ স্যাঁতে ভিক্তোরে’ পাহাড়ের অনেকগুলো ছবি এঁকেছিলেন এই অঙ্কন-পদ্ধতিতে(ছবি-৩)৷
 পিকাসো এটি জাস্ট টুঁকে এই অঙ্কন-পদ্ধতির সাহায্যেই আঁকলেন— “লে দ্যামোয়াজেলস দ’ অ্যাঁভো”৷ (ক্রমশ)

পেজ-এ লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments