একটি বাইসিকল, একটি নদী ও একটি গ্রাম: তরুণ সত্যজিতের প্রেরণারা
অনমিত্র বিশ্বাস
চিত্রনাট্য: সিজার জাভাত্তিনি, পরিচালনা: ভিত্তোরিও দি সিকা। গত কয়েক বছরে ইতালিতে যে neo-realism জন্ম নিচ্ছিলো, তাকে পূর্ণতম মাত্রা দেয় ১৯৪৮ সালের ‘দ্য বাইসিকল্ থীফ’। একটি চুরি যাওয়া বাইসিকল নিয়ে ছবি, যেটি না পাওয়া মানে সেটির মালিক অ্যান্টনিও ও তার পরিবারের নিশ্চিত অনাহার। বাইসিকলটি খোঁজার মরিয়া চেষ্টা অ্যান্টনিওর, আর তার সমান্তরালে তার অসহায়তা, আর ছেলে ব্রুনোর সাথে তার সম্পর্কের কারুণ্যের মধ্যে দিয়ে ছবিটি পৌঁছোয় এক মর্মান্তিক উপসংহারে, চ্যাপলিনের Monsieur Verdouxএর মতো। ছবিটির শুটিং স্টুডিও চত্বরের ত্রিসীমানায় হয় নি, হয়েছে রোমের রাস্তায় রাস্তায়। কোনও একটি চরিত্রেও পরিচালক কোনও পেশাদারী অভিনেতাকে রাখেন নি (প্রধান ভূমিকায় ল্যামবার্তো ম্যাগিয়ারানি যেমন পেশায় ছিলেন কারখানার কর্মচারী)। এই ছবিটি যখন প্রবল জনপ্রিয়তায় ইংল্যান্ডে চলছিলো, তখন একদিন দর্শকের আসনে বসে ছিলেন এক তরুণ বাঙালী চলচ্চিত্রপ্রেমী। ৬ মাস ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি যে ৯৯টি ছবি দেখেছিলেন, তার মধ্যে এটিই তাঁর মনে সবচেয়ে বেশী দাগ কেটেছিলো। এই ছবিটি দেখে তাঁর মনে হয়েছিলো, এতোদিন তিনি এই জিনিসটিরই অপেক্ষা করছিলেন, তাঁর প্রত্যয় হয়েছিলো যে তিনিও ছবি বানাতে পারবেন। তিনি সত্যজিৎ রায়, যাঁকে বাংলা সিনেমার পথিকৃৎ বললেও অত্যুক্তি হয় না। ‘বাইসিকল্ থীফ’এর সার্বজনীন আবেদন সম্পর্কে তিনি পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ‘Bicycle Thieves is the best example so far of such a story, perfectly translated to the screen in the most universally accepted terms.’
ছবি বানানোর জন্য যে কলকাতায় সত্যজিৎ ফিরে এলেন, সেটা তাঁর visionকে বাস্তবায়িত করার অনুকূল নয়। স্টুডিও ছিলো, ছবিও হতো, আর খ্যাতির দিক দিয়ে বাংলা ছবি সারা ভারতের মধ্যে বেশ এগিয়েই ছিলো। তার কারণ এখানকার বেশীরভাগ ছবি-করিয়েরা খুব নিরাপদ গণ্ডির মধ্যেই থেকেছেন। প্রধানতঃ আশ্রয় নিয়েছেন ক্ল্যাসিক উপন্যাসের, যার মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কদর ছিলো সবচেয়ে বেশী। তিন দেয়ালের ছাদহীন সেটের মধ্যে তার যে চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে, তা নাটকীয় এবং গতানুগতিক, আর সত্যজিতের নিজের কথায়, ‘the camera perched in the middle at a safe distance from the action, while the characters fitted in and out of impossible wing-like doors at the two extremities. Without the plethora of titles to tell the story, it would be impossible for someone not familiar with the plot to make out who was who and what they were doing and why.’ সামাজিক ছবিতে হলিউডের যে স্পষ্ট প্রভাব দেখা যেতো, সেটা নেহাতই অনুকরণের পর্যায়ে। যেমন কোনও একটি দৃশ্যে পিয়ানো বাজিয়ে নায়িকার গান আবশ্যিক, বা নায়ক প্রাতর্ভ্রমণে গেলেও দারুণ ঝকঝকে স্যুট পরে যায়— বাঙালী জীবনযাত্রার সাথে যার মিল সামান্যই। এই প্রভাব ৬০এর দশক পর্যন্ত থেকে গেছে বাংলা মূলধারার ছবিতে, এতোটাই, যে সাজসজ্জা আচারব্যবহার বাদ দিলেও কাহিনীক্রমে পর্যন্ত অজয় করের ‘হারানো সুর’(১৯৫৭)এর সাথে অ্যলফ্রেড হিচককের ‘স্পেলবাউন্ড’(১৯৪৫)এর আশ্চর্য্য রকমের মিল পাওয়া যায় (এরকম উদাহরণ আরো আছে)। এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটতে সময় লেগেছে।
আরো এক ধরণের ছবি ছিলো যাতে হলিউডের অনুকরণ ছিলো না, সেটা ভক্তিমূলক ছবি। দেবকী বসুর ‘সীতা ’কোনও বিদেশী চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত প্রথম বাংলা ছবি হিসেবে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সমাদৃত হলেও তার কতোটা শিল্পগুণের জন্য আর কতোটা Indian exoticaর জন্য, তা আজকে হিসেব করা শক্ত। কাজী নজরুল ইসলামের মতো বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন পরিচালকের ‘ধ্রুব’-ও সিনেমার আধুনিক সংজ্ঞা অনুযায়ী হয়তো পুরোপুরি ‘সিনেমা’ হয়ে উঠতে পারে নি, তার শিল্পগত উৎকর্ষ সত্ত্বেও। ইঙ্গ-বঙ্গ পরিবারে জন্মানো সত্যজিতের পক্ষে হয়তো এইসব ছবির রসাস্বাদন সম্ভবও ছিলো না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, এতো কিছুর মধ্যে কোথাওই প্রায় ‘shooting at location’এর কোনো ব্যাপার ছিলো না। পুরোটাই হতো স্টুডিওর মধ্যে, কৃত্রিম পরিবেশে।
অথচ ছোটোবেলা থেকে হলিউড সম্পর্কে অগাধ আগ্রহ সত্ত্বেও সত্যজিৎ তাঁর ছবিতে দক্ষ কনফিডেন্ট কারিগরি ছাড়া হলিউডের কোনও বৈশিষ্ট্যই গ্রহণ করেন নি।
এই অন্যান্য ছবির প্রসঙ্গে অবশ্য বিমল রায়ের উদয়ের পথের উল্লেখ না করা অন্যায় হবে, যাকে সত্যজিৎ রায় ‘সঠিক দিকে একটি পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছেন। এ ছাড়া চারু রায়ের ‘বাঙালী’ বা নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল ’ বা নির্মল দের ‘সাড়ে চুয়াত্তর’এর মতো ছবিও তো হতো সে কালে, কিন্তু তার সংখ্যা কম।
চিত্রায়নে সত্যজিতের শিক্ষক ছিলেন নন্দলাল বসু আর বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো আঁকিয়েরা। তাছাড়া রক্তে ছিলো পিতা আর পিতামহর উত্তরাধিকার, বাকি ছিলো শুধু তার প্রয়োগ।
সত্যজিৎ তাঁর ছবি বানানোর ভাষা যদি খুঁজে পেয়ে থাকেন দি সিকার ছবিতে, তবে তাঁর ভাব তিনি পেয়েছেন ফরাসী-আমেরিকান চিত্রপরিচালক জাঁ রেনোয়ার ছবি থেকে। ১৯৪৯ সালে রেনোয়া বাংলার পটভূমিকায় The River তুলতে কলকাতায় আসেন। সত্যজিৎ, যিনি অনেক আগে থেকেই তাঁর গুণগ্রাহী ছিলেন, এই সময় তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। রেনোয়াঁ একদিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘If you could only shake Hollywood out of your system and evolve your own style, you would be making great films here.’ যেটি সত্যজিৎ রায় অনুসরণ করেছিলেন বলে মনে হয়। একজন বিদেশী হিসেবে রেনোয়ার পক্ষে কতোটা কঠিন ছিলো বঙ্গনিসর্গকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, অথচ তা যে তিনি সুদক্ষ ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, শুধু পটভূমিকাটুকুই নয়, বাংলার লোকসংস্কৃতিকেও, তার প্রমাণ আছে রামার গডেনের উপন্যাস অবলম্বনে তাঁর The River ছবিতে। একটি দৃশ্য আমাকে সবচেয়ে বেশী অবাক করে। ভারতপ্রবাসিনী হ্যারিয়েট কলাগাছের জঙ্গলে চড়া রোদ্দুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখছে এক পুকুরধারে তার কিশরীবেলার প্রেম ক্যাপ্টেন জন আর তার খেলাসঙ্গিনী ভ্যালেরিকে চুমু খেতে, আর সে বলছে, ‘It is my first kiss which I never had.’ এই দৃশ্য অন্য কোথাও যে তোলা সম্ভব হতে পারতো, তা মনে হয় না… যে ইন্দ্রজাল ওই রৌদ্রস্নাত কলাবাগানে পুকুরের ধারে আছে, তা পৃথিবীর আর কোথাও— ঘন অরণ্যে বা ধুসর মরুভূমিতে— পাওয়া যেতো না। আর এই প্রকৃতির নিবিড় স্বরূপটি ধরতে পেরেছিলেন রেনোয়া। রেকির সময়ে পুষ্পভারে লাল পলাশগাছ দেখে তিনি সত্যজিৎকে বলেন, ‘Those flowers are beautiful. But you get flowers in America too. Poinsettias, for instance. They grow wild in California. But look at the clump of banana trees, and that green pond at its foot. You don’t get that in California. That is Bengal.’ যাকে তাঁর মাতৃভাষায় বলে la couleur locale। ‘You don’t have to show many things in a film, but you have to be very careful only to show the right things.’ যেটা সত্যজিৎ অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, আর ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’তে। কাশফুলের হিল্লোল আর রেলগাড়ির কালো ধোঁয়া যে কন্ট্রাস্ট তৈরী করেছিলো পর্দায়, বা অপু যখন দুর্গার চুরি করা হারটা পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে চিরদিনের জন্য মুছে দেয় দিদির ওই অপবাদকে— সেই জলের যে মৃদু গোপন তরঙ্গ, তাকে একবার দেখলে কে ভুলতে পারে? যখন হরিহররা গ্রামের বাড়ি আর দুর্গার স্মৃতি ফেলে রেখে চলে যায়, সেই দৃশ্যের সাথে আমরা ‘দ্য বাইসিকল্ থীফ’এর শেষে বিফলমনোরথ বিধ্বস্ত অ্যান্টনির বাড়ি ফেরার মিল পাই। এদের দুঃখ যেন দেশকালের ঊর্ধ্বে উঠে এক হয়ে গেছে। আর পুরো ‘পথের পাঁচালী’ দেখার পর আমাদের মনে যেন অনুরণিত হতে থাকে The Riverএ হ্যারিয়েটের সেই সংলাপ: ‘Ten minutes ago, she wasn’t born. And tomorrow, we shall get used to her. And yesterday… don’t bother about yesterday. This is today, and today. Here is the Baby, the Baby and us, the big River, the whole world and everything...,’ যেখানে পূর্ণযৌবনা দিগন্তবিস্তৃতা গঙ্গা হয়ে ওঠে জীবনের নিরন্তর প্রবাহের প্রতীক। সময়ের জল তার সব গ্লানি ধুয়ে দেয়।
সত্যজিতের ওপর এঁদের যে প্রভাব পড়েছিলো, তা আগের বাংলা ছবির ওপর হলিউডের প্রভাবের মতো বাহ্যিক প্রলেপ নয়। তিনি আয়ত্ব করেছিলেন দি সিকার টেকনিক, রেনোয়ার ন্যারেটিভ, আরো অনেক পরিচালকের খুঁটিনাটি যা তাঁর ভালো লেগেছিলো। তারপর নিজের মতো করে তিনি ‘পথের পাঁচালী’র স্টোরিবোর্ডের স্কেচবুকে বা চিত্রনাট্যের পাতায় তা বইয়ে দিয়েছিলেন। যখন তিনি ছবি বানিয়েছিলেন, তখন তা একান্তভাবেই হয়ে উঠেছিলো একটি ‘Ray film’, যা বিশ্বচলচ্চিত্রে আজও একটি প্রামাণ্য সম্পদ এবং অসামান্য ক্ল্যাসিক হিসেবে স্বীকৃত। ‘গৃহ থেকে শুধু দুই পা ফেলিয়া / একটি ধানের শিসের ওপর / একটি শিশিরবিন্দু’, যেটা বাংলা ছবিতে তার আগে পর্যন্ত অধরা ছিলো, তাকে তুলে এনেছিলেন তিনি পর্দায়, বিশ্বচলচ্চিত্রের দরবারে।
আসলে দারিদ্রের, দুঃখের আর ভালোবাসার কোনো জাত বা ভাষা হয় না। তার অভিব্যক্তি সহজাত। তাই সারা পৃথিবীর মানুষ একইভাবে উপলব্ধি করতে পারবে ‘পথের পাঁচালী’কে।
তথ্যসূত্র:
১। Satyajit Ray, Our Films Their Films, 1st U.S. edition, Hyperion, New York, 1994
২। সত্যজিৎ রায়, ১৯৭৮, ‘অতীতের বাংলা ছবি’, শারদীয় আনন্দলোক, ১৯৭৮
৩। Satyajit Ray, 1980, 'I Wish I Could Have Shown Them To You', Cinema Vision, January 1980
৪। Ladri di biciclette, 1948 [DVD], Vittorio De Sica, Italy, Produzioni De Sica, The Criterion Channel https://www.criterion.com/films/679-the-river
৫। The River, 1951 [DVD], Jean Renoir, India, Oriental International Films, The Criterion Channel https://www.criterion.com/films/210-bicycle-thieves
আরও পড়ুন
0 Comments