জ্বলদর্চি

কথা-সাহিত্য নির্ভর সত্যজিৎ/রাজর্ষি রায়

কথা-সাহিত্য নির্ভর সত্যজিৎ

রাজর্ষি রায়

বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ভারতীয় সিনেমা বিশ্বে যে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছিল, যে সমস্ত ভারতীয় চিত্র-পরিচালকের মাধ্যমে সত্যজিৎ রায় তাঁদের অন্যতম পুরোধা। তিনি জন্মেছিলেন এমন এক পরিবারে এবং এমন এক সময়ে, যে কারণে আমরা যেমন তাঁর মধ্যে পেয়েছি শিল্প-সাহিত্যের সাহচর্য অন্যদিকে তেমনি পেয়েছি বর্তমান শিল্পমাধ্যমের চূড়ান্ত রূপ- চলচ্চিত্র। ১৯২১ সালের ২রা মে তাঁর জন্ম। এই বছর তাঁর শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে। এই একশ বছরে ভারতীয় চলচ্চিত্রের যে বিবর্তন ধারা লক্ষ্য করা যায় তার প্রায় সত্তর বছর জুড়ে আছে সত্যজিতের প্রভাব।

বাংলার নবজাগরণের অন্তিম রেশ যে কয়েকজন বাঙালিকে ভারতীয় তথা বিশ্বের করে তুলেছিল সত্যজিৎ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য পথিক। তিনি তাঁর জীবনের পথ চলা শুরু করেছিলেন একজন গ্রাফিক্স শিল্পী হিসেবে ডি জে কিমারে'র সিগনেট প্রেসে। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নাতি ও সুকুমার রায়ের সন্তান হিসেবে স্কুলজীবন থেকেই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল বিংশ শতাব্দীর এই শিল্পসমৃদ্ধ নব-মাধ্যমটি অর্থাৎ চলচ্চিত্র।
      
      চলচ্চিত্র দেখা শুরু সেই ছোটবেলা থেকেই, যেহেতু তাঁর শৈশব কেটেছিল কলকাতার পরিমণ্ডলে। তখন কলকাতার বেশ নামিদামি সিনেমা হলে খুব সহজেই দেখা যেত বিদেশী চলচ্চিত্র। পারিবারিক সূত্রে সিনেমা দেখার সূত্রপাত সেই সময় থেকেই। একই সঙ্গে তৎকালীন সময়ে রায়চৌধুরী পরিবারের সাহিত্য রচনা ও তার পরিমণ্ডলে বড় হওয়া এবং সেই সঙ্গে বিদেশি সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ তাকে এই নবতম মাধ্যমটির প্রতি আকৃষ্ট হতে উৎসাহিত করেছিল।

বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট স্কুল থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজ, সেখান থেকে শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষা তাঁর মানস জাগরণের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল বলা যেতে পারে। সাহিত্য পাঠ ও শিল্পের প্রতি অদম্য পিপাসা তাঁকে সম্পূর্ণ সত্যজিৎ হতে সাহায্য করেছিল সামগ্রিকভাবে। সাহিত্যপাঠ যে নিছক মানসিক তৃপ্তি বা অবসর যাপনের মাধ্যম নয় কিংবা সংগীত যে শুধু ব্রাহ্ম-পরিবারে জন্মে রবীন্দ্রনাথে থেমে থাকা নয়,একই সঙ্গে বিদেশি সুরস্রষ্টা মোৎসাট বা বেটোফেনের সুর তাঁকে যে আপ্লুত করেছিল- তা তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই আমরা বারবার প্রমাণ পাই।
চলচ্চিত্রের ভাষা, কথা, সুর কেমন হবে তা যেমন তিনি জেনেছিলেন বিদেশি মুভি দেখে তেমনি তার বিষয়বস্তু কেমন হবে তা জেনে ছিলেন ভারতীয় সাহিত্য-শিল্প থেকে। চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যের স্ক্রিপ্ট একটা প্রধান মাধ্যম সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সহজেই। ভারতীয় হিসেবে ছবি বানাতে গিয়ে একই সঙ্গে তিনি বাঙালি তথা ভারতীয় দর্শকদের কথা মাথায় রেখেই তার চিত্র নির্মাণকে বৈশ্বিক করে তুলেছিলেন নিজস্ব মেধা ও মননের দ্বারা। আবার একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যে ডিটেলিং-এর ব্যবহারের ধারা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়েই। তাই তিনি বলেন-
        "ভারতীয় শিল্প- সাহিত্যে ডিটেলকে যে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে তার তুলনা কমই আছে। ভারতীয় চিত্রশিল্পেও এই ডিটেলের ঐতিহ্য অনেকদিন অটুট ছিল।"

তাই ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি সাহিত্য-নির্ভর কাহিনীকেই চিত্রায়িত করেছেন বারবার।
 তাঁর নির্মিত ২৮ টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রের মধ্যে ১৯ টি বাংলা কথা-সাহিত্য অর্থাৎ গল্প বা উপন্যাস নির্ভর। একটি ইংরেজী নাটক ও একটি হিন্দি সাহিত্য নির্ভর। আসলে ২১টি সিনেমা তিনি তৈরি করেছিলেন বিভিন্ন সাহিত্যিকের কাহিনী নিয়ে। এছাড়া সাতটি ছবিতে তিনি নিজস্ব কাহিনীর জাল বুনছেন নিজস্ব শৈল্পিক রীতিতে। সহজেই প্রশ্ন আসে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য কেন তিনি সাহিত্যের কাছে গেলেন?
সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
    "বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে বাস্তবধর্মী সংলাপ রচনায় অনেকেই দক্ষ, যদিও সে সংলাপ যে সবসময় অপরিবর্তিত রূপে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা যায়- তা নয়।"

সুতরাং বলা যায় যে, সত্যজিৎ বাংলা সাহিত্য থেকে কাহিনী নিলেও তা সব সময় অপরিবর্তিত রাখেন নি, সিনেমার প্রয়োজনে তার রদবদল ঘটিয়েছেন খুব সচেতনভাবেই।
 সত্যজিৎ পূর্বযুগে-
    "যেমন হলিউডে তেমনি বাংলাতে প্রায় সব পরিচালকই মেনে নিতেন যে ছবি হল সকলের দেখার জন্য, সব স্তরের দর্শকের মন খুশি করার জন্য, চলচ্চিত্র যে একটা সিরিয়াস আর্ট হতে পারে, গভীর তথ্য, সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্বও, দোষে-গুণে মেশানো জটিল চরিত্র- বাংলা সার্থক উপন্যাসে যার সাক্ষাৎ মেলে-এসব যে চলচ্চিত্রে স্থান পেতে পারে এটা কেউ মানতেন না।"
তাই বলা যায় সাহিত্যে বা শিল্পে যে ডিটেলিং-এর ব্যবহার ছিল তাকেই তিনি চলচ্চিত্রে প্রকাশ করতে চাইলেন, সেই কারণে তিনি প্রধানত কথাসাহিত্যের কাছেই তার সিনেমা তৈরির রসদ খুঁজে নিলেন। 

তাঁর এই শিল্প সৃষ্টিতে তিনি যে সমস্ত সাহিত্যিকদের কাছে ঋণী থেকেছেন তাঁদের মধ্যে :
১)বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনটি উপন্যাস থেকে তিনি চারটি সিনেমা তৈরি করেছেন-
পথের পাঁচালী, অপরাজিত (ও অপুর সংসার) এবং অশনি সংকেত
২)রবীন্দ্রনাথ থেকে নিয়েছেন তিনটি কাহিনীসূত্র- তিনকন্যা (তিনটি নারীচরিত্র অবলম্বনে তিনটি ছোট গল্প-পোস্টমাস্টার মনিহারা ও সমাপ্তি), নষ্টনীড় গল্প অবলম্বনে চারুলতা ও একটি উপন্যাস অবলম্বনে
 ঘরে বাইরে 
৩)প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়-এর গল্প দেবী;
৪) রাজশেখর বসুর দুটি ছোটগল্প পরশপাথর ও  মহাপুরুষ (কাপুরুষ ও মহাপুরুষ একটি ছবি)
৫) তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ছোটগল্প এবং একটি উপন্যাস- জলসাঘর ও অভিযান
৬) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটি উপন্যাস অবলম্বনে- অরণ্যের দিনরাত্রি ও প্রতিদ্বন্দ্বী
৭) শংকর-এর কাহিনী অবলম্বনে সীমাবদ্ধ ও জনঅরণ্য
৮) প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প অবলম্বনে কাপুরুষ
৯) নরেন্দ্র নাথ মিত্রের মহানগর
১০) উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গল্প গুপী গাইন বাঘা বাইন
১১) শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস চিড়িয়াখানা
১২) ইংরেজি সাহিত্যের হেনরিক ইবসেন নাটক 'এনিমি অফ দ্যা পিপল' অবলম্বনে গণশত্রু
১৩) হিন্দি সাহিত্যের প্রেমচন্দের  ছোটগল্প অবলম্বনে শতরঞ্জ কে খিলাড়ি।

তাঁর নিজস্ব সৃষ্ট কাহিনী থেকে মোট সাতটি ছবি নির্মাণ করেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা, নায়ক, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, শাখা-প্রশাখা ও আগন্তুক ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে সত্যজিৎ কথাসাহিত্য-নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছিলেন। কিন্তু বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিংবা তাকে চিত্রনাট্যে রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে তিনি নিজের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। চলচ্চিত্র নামক এই নবমাধ্যমটির ক্ষেত্রে কাহিনী থেকে কতটুকু ছেঁটে ফেলা কিংবা সিনেমার প্রয়োজনে কাহিনীর মধ্যে নতুন কিছুকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি যেটাকে শ্রেয় মনে করতেন তাকেই গ্রহণ করতেন নির্দ্বিধায়। তাকেই তিনি পরিচালকের স্বাধীনতা বা সিনেমার শিল্প-সুষমা বলে মনে করতেন।

একবার তাঁকে  সাহিত্যিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেছিলেন- কোথাও না গিয়ে সবকিছুর খবর রাখেন কি করে?
তার উত্তরে তিনি বলেন-
"বই! সারাক্ষণ তো কিছু না কিছু পড়ছিই। মিডিয়া তো আছে, ফিল্ম দেখছি, এছাড়া আমার চলচ্চিত্রে তো পৃথিবী সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান প্রকাশ করি বলে মনে হয় না, আমার ছবি তো হয় কলকাতা নয় বাংলাদেশ কিংবা ভারতবর্ষ নিয়ে, সেসব তো অভিজ্ঞতা স্মৃতি থেকেই আসে। তবে হ্যাঁ আমার লেখালেখির জগতের নানা তথ্য সারাক্ষণ ব্যবহার করছি যা জেনে ফেলি বই পড়ে পড়ে, নানা ধরনের বই পড়ার অভ্যাস আছে, বিশেষ করে নন-ফিকশন।"
তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে দুটি ভাগের কথা তিনি উল্লেখ করেন-
টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, মান, কাফকা, কামু তিনি  পড়তেন জীবন ও জগতকে জানার প্রেরণা থেকে, নিছক স্টাইল বা বিনোদন সেখানে ধর্তব্য নয়।
আবার তারই পাশাপাশি তাঁর প্রিয় ছিলেন আর্থার কোনান ডয়েল,আগাথা ক্রিস্টি, আর পি জি উডহাউস, যাদের প্রায় সব লেখায় তার পড়া। তবু তিনি বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং বাংলা সাহিত্য থেকেই তার চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু গ্রহণ করেছেন।
তাঁর চিত্রনাট্যের বুনিয়াদ নির্মিত হয়েছে প্রায় সমস্ত আপাতবিরোধী বিষয়বস্তু নিয়ে। 
যেমন ধরা যাক:

পরশপাথর -অর্থনীতি
 চারুলতা - প্রেম
 অশনিসংকেত -দুর্ভিক্ষ
 জয় বাবা ফেলুনাথ-  
                     হত্যাকাণ্ড 
গণশত্রু - দুর্নীতি

-তাঁর  প্রায় সমস্ত কাহিনীর আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যে একটির সঙ্গে আরেকটির কোন সাদৃশ্য পাওয়া অসম্ভব কারণ সিনেমার নিজস্ব মাধ্যমগত চাহিদা অনুযায়ী সত্যজিৎ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তু ও কাহিনী নির্বাচন করেছেন তাঁর শৈল্পিক রুচি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী। তাদের মধ্যে মিল খুঁজলে দেখা যায়-
(এক)- তাঁর সমস্ত চিত্রনাট্যের মধ্যে আছে এক অন্তর্লীন সাদৃশ্য- দেশজ ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য রক্ষা করা,
(দুই)- মূল গল্পকে সুনির্দিষ্ট এক সময়ের আবর্তে মন্থন করে দর্শকের মনোযোগী করে তোলা
(তিন)-গল্পের কালধর্মকে যুগের নিরিখে বিচার করা।
        সেই বিচারে তাঁকে অনেকে রক্ষণশীল ভাবতে পারেন, তাতে তাঁর বিচার সঠিক হল কিনা তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা ছিল না।
তিনি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের শেষতম প্রতিভাবান বাঙালি প্রতিনিধি। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যা বারেবারে বিচ্ছুরিত হয়েছে তাহল রুচিশীল শিল্প-সুষমামণ্ডিত এক অখন্ড বাঙালি মননের দীপ্ত বহিঃপ্রকাশ। হয়তো বর্তমান জীবনধারার আগ্রাসী পরিবর্তন তার পছন্দ  ছিল না কিন্তু তিনি রায় পরিবারের সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে জীবনের মূল্যবোধকে স্থিরভাবে ধরে থাকায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারই মধ্যে প্রগতির সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্নে কোন অগোছালো এলোমেলো ভাবনার স্থান ছিল না। তাঁর সেই শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে নতুন যুগের ছোঁয়া লেগেছিলো তা তাঁর একশ বছরে দাঁড়িয়েও বড় বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।
 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments