জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প- এশিয়া (জাপান) /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- এশিয়া (জাপান) 
চিন্ময় দাশ 

যে লোকটা পাথর কাটে 

পাথর কাটে লোকটা। সম্বল বলতে একটা ছেনি আর হাতুড়ি। সকালে উঠেই গিয়ে হাজির হয় পাহাড়তলীতে। তারপর সারাদিন ঠঙ-ঠঙ, ঠুং-ঠাং, খুট-খুট। কাজের বিরাম নাই মানুষটার। কাজ করে যায় নিজের মনে। এটা বানায়। ওটা বানায়। বিকেল হলে, হাটে গিয়ে বেচে দেয়। তাতেই পেট চলে তার। 
ঘরে অভাব। তাই সারাদিন ঘাম ঝরানো মেহনত করতে হয়। কিন্তু তা নিয়ে কোন মনে ভাবনা নাই লোকটার। 
 একদিন পাথর কাটছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা লোক সামনে এসে হাজির। বলল-- চলো হে, আমার মালিক ডাকছে তোমাকে।
পাথরকাটুয়ে লোকটা বললো-- মালিক? কোথায় তিনি? 
-- এসোই না, দেখতে পাবে।
-- কিন্তু তোমার মালিক আমাকে ডাকবেন কেন? 
লোকটা বলল-- তার আমি কী জানি। চলো আমার সাথে। গেলে নিজেই শুনতে পাবে। 
লোকটার পিছন পিছন এসে হাজির হল মালিকের সামনে। একটা ঘোড়ার গাড়িতে জুত হয়ে বসে আছে মালিক। বললো-- আমার জন্য একটা পাথর কেটে দাও। বয়স হয়েছে। কবে আছি, কবে নাই। নিজের কবরের পাথর, আমি নিজেই বানিয়ে রেখে যাব-- এটা আমার অনেক দিনের সাধ।
  মালিকের কথায় কান নাই লোকটার। সে দেখছে মানুষটার জুড়িগাড়ি, ঝলমলে পোশাক, লোকলস্কর এইসব। মালিক বলল--  শোন, যত সময় লাগে লাগুক। বেশ কারুকাজ থাকে যেন পাথরে। টাকাপয়সা নিয়ে ভেবো না। খুশি হতে পারো, তত টাকাই দেব তোমাকে। 
কথা শেষ হতে, মালিকের গাড়ি চলে গেল। নিজের কাজে ফিরে গেল লোকটাও। কিন্তু কাজে তেমন মন নাই তার। পাথর কাটছে, আর মনে মনে ভাবছে, আমার চেয়ে কত বড় এই মালিক মানুষটা! কত কিছুই না আছে তার! আহা, আমি যদি এমন বড় হতে পারতাম! 
  হয়েছে কী, পাহাড়ের দেবতা শুনলেন তার কথা। (জাপানের মানুষেরা বিশ্বাস করেন, একজন দেবতা থাকেন সব পাহাড়েই। সকলের মনের কথা তাঁর কানে যায়। পাহাড়ের সেই ঠাকুর ভারী দয়ালু। সকলের কামনা-বাসনা পূর্ণ করেন তিনি।) একটু মুচকি হাসি ফুটে উঠল ঠাকুরের মুখে।
একসময় সূর্য হেলে পড়ল আকাশে। কাজ শেষ হয়েছে, ঘরে ফেরার পালা এখন। ছেনি আর হাতুড়ি গুছিয়ে নিয়ে, পেছন ফিরেই চমকে গেল লোকটা। একটা জুড়িগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। একেবারে সেই মালিকের মত জমকালো গাড়ি। ত্রিসীমায় তো কেউ নাই এখানে! তাহলে এই গাড়ি আর কার হবে? 
  গাড়িতে আলতো করে একটু হাত ছোঁয়াতেই, আবার চমক। কোথায় গেল তার নিজের পরনের ছেঁড়া-ময়লা কাপড়-চোপড়? সব উধাও। দামী আর ঝলমলে পোশাক পরে আছে এখন সে। পাহাড়ের ঠাকুর তার মত অভাজনকে এত দয়া করেছেন, ভাবতেই শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল লোকটার।
বেশ কয়েকদিন গেল ফরমায়েশ মত কবরের পাথর তৈরী করতে। পাথর পৌঁছে দিতে সেই মালিকের বাড়ি গিয়ে হাজির হল লোকটা। বাড়ি দেখে, চোখ গোল-গোল হয়ে গেল তার। কী বিশাল আর সৌখিন একখানা বাড়ি। একেবারে রাজার প্রাসাদের মত। চাকর-বাকর ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে। সামনে ফুলে-ফলে সাজানো বাগান। ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজহাঁস ভাসছে জলাশয়ে। 
লোকটা ভাবল, এ লোক তো দেখছি, আমার চেয়ে অনেক বড়। আহা, আমার যদি এরকম একটা প্রাসাদ থাকত! এরকম চাকর-বাকর, ময়ূর, রাজহাঁস!
ঘরে ফিরে আবার চমক। কোথায় তার সেই জরাজীর্ণ কুঁড়ে? তার বদলে, সামনে লোকজন ভরা বিশাল প্রাসাদ, ফলে-ফুলে সাজানো বাগানে ময়ূর, জলাশয়ে হাঁস-- সবই মজুত, সব।
  ভারী আনন্দ হল লোকটার। এবার সত্যিই বড় মনে হল নিজেকে। পাথর কাটার কাজ আর করে না। সুখেই দিন যায়।
  একদিন বাগানে বেড়াতে বেরিয়েছে। খানিক ঘোরাঘুরি করতেই, ঘাম ঝরতে লাগল মাথা-মুখ বেয়ে। চোখ তুলে দেখল, মাথার উপর গনগন করে জ্বলছে দুপুরবেলার সূর্য।
  লোকটার মনে হল, তাহলে সূর্য তো আমার চেয়ে বড়। আহা, ঠাকুর যদি আমাকে সূর্য করে দিতেন!
ভাবা মাত্রই প্রাসাদ, বাগান, জলাশয় সব রইল পড়ে। আকাশে সূর্য হয়ে জ্বলতে লাগল লোকটা। নীচে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখল, রোদের তেজে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে জীবকুল। গাছপালা ঝলসে যাচ্ছে। নদী-নালার জল শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে ভারী পুলক হল তার। এবার সত্যিই বড় মনে হতে লাগল নিজেকে।
  বেশি সময় গেল না। খানিক বাদেই ভাসতে ভাসতে একটা ঘণ মেঘ এসে হাজির। সে ঢেকে ফেলল সূর্যকে। কোথায় গেল রোদ আর তার তেজ। শ্যামল ছায়ায় ঢেকে গেল পৃথিবী। ঝরঝরিয়ে বৃষ্টিও নামল দেখতে না দেখতেই।
  লোকটা নীচে তাকিয়ে দেখল, সে কী আনন্দ মানুষজনের! বৃষ্টির জল পেয়ে গাছপালা সতেজ হল। নদী-নালা ভরে উঠল কানায় কানায়। পাখিদের কলকাকলি ভাসতে লাগছে বাতাসে। শান্তির হাওয়া বইছে চরাচর জুড়ে।
  ভারী বিমর্ষ হয়ে গেল লোকটা। তাহলে আমার চেয়ে মেঘই তো বড়। হায়, আমি যদি মেঘ হতাম, ঠাকুর!
চোখের পলকও পড়তে পেল না। সূর্য থেকে মেঘ হয়ে গেল সে। মনের আনন্দে ভেসে বেড়াতে লাগল আকাশে। কখন ঘণ কালো আর ভারী মেঘ হয়ে সূর্যকে ঢেকে দেয়। কখন বা পেঁজা তুলোর মত ধবধবে সাদা আর হালকা হয়ে ভেসে বেড়ায় বাতাসে। এবার সত্যিই নিজেকে বড় মনে হল।
  ভাসতে ভাসতে কতদূর চলে এল, খেয়ালই নাই। হঠাৎই গতি স্তব্ধ হয়ে গেল মেঘের। তাকিয়ে দেখল, বিশাল এক পাহাড়ের গায়ে এসে আটকে গেছে সে। সেখানেই থেমে রইল তো থেমেই রইল। নড়ন-চড়নটি নাই কিছু। বিরক্ত হয়ে রাগ এসে গেল মাথায়। শরীর কালো হয়ে গেল। প্রবল বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে লাগল পাহাড়ের উপর। সাথে ভয়ানক বজ্র আর বিদ্যুতের ঝলকানি।
  কতক্ষণ চলল এইভাবে। কিন্তু পাহাড়ের কোনও হেলদোল নাই। বজ্র বিদ্যুৎ বৃষ্টি-- কোন কিছুকে গ্রাহ্যই করল না পাহাড়। হঠাৎই লোকটার মনে হল, তাহলে পাহাড়ই হল সবার চেয়ে বড়। তাকিয়ে দেখল, কতখানি জায়গা জুড়ে হাজার হাজার বছর বসে আছে এই পাহাড়। এত উঁচু, যেন মাথা গিয়ে ঠেকেছে সেই আকাশে। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি-- কোন কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না। কাউকেই পরোয়া করে না সে। হতাশায় বিড়বিড় করে উঠল-- আমি কেন পাহাড় হলাম না, ঠাকুর! 
  আবার হাসলেন পাহাড়ের দেবতা। মেঘ থেকে পাহাড় করে দিলেন লোকটাকে। লোকটাও তাতে ভারী খুশি। এই পৃথিবীতে সে-ই সবার চেয়ে বড়।সে-ই সবার চেয়ে শক্তিমান। ভাবতে ভাবতে একসময় সূর্য ডুবে গেল। অন্ধকার নেমে এল চরাচর জুড়ে।   
  পর দিন। সকাল হয়েছে। বেলা না বাড়তেই, কোথা থেকে একটা ঠঙ-ঠঙ শব্দ ভেসে বেড়াতে লাগল বাতাসে। কোথাও কিছু নাই, শব্দটা তাহলে আসছে কোথা থেকে? 
  পাহাড় তাকিয়ে দেখল, অনেক নীচে, পাহাড়ের একেবারে পায়ের কাছটিতে, পাথর কাটছে একটা লোক। ঠঙ-ঠঙ শব্দটা উঠছে তারই ছেনি-হাতুড়ি থেকে। পাহাড়ের মন বলল-- এত বড় পাহাড় আমি, আর ওই ছোট্ট পুঁচকে একটা লোক কিনা আমাকেও কেটে টুকরো করে ফেলতে পারে! তাহলে, পাহাড়ের চেয়ে, মানুষই তো বড়! 
  এবার গলা ছেড়ে বলে উঠল লোকটা-- আর কিছু হতে চাই না আমি। আমাকে তুমি মানুষ করে দাও, ঠাকুর। পাথরকাটুয়েই হতে চাই আমি।
  ঠাকুর তার কথা শুনলেন। কাজও করলেন সেই মত। পাহাড় থেকে মানুষ হয়ে গেল লোকটা। অভাবী লোক, সকাল হলেই, ছেনি আর হাতুড়ি নিয়ে পাহাড়তলিতে গিয়ে হাজির হয়। তার পর? তার পর সারাদিন সেই একই ঠঙ-ঠঙ, ঠুং-ঠাং, খুট-খুট। কাজের যেন বিরাম নাই জীবনে। 
  এ জন্যই বলে-- কারও চেয়ে ছোট মনে কোর না নিজেকে। বিশ্বাস রাখো নিজের শক্তির উপর। আর নিজের কাজ করে যাও।
 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments