জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (দ্বিতীয় পর্ব)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

 বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ২১
মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (দ্বিতীয় পর্ব)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

প্রবাদ আছে, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। নাকফুড়ি দেবীর হয়েছে মরণ দশা। শাঁখের করাতের মতো অবস্থা। যেতে-আসতে দুদিকে কাটে। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছে ছেলে। কোথায় আনন্দ করবেন, কচুটা মুলোটা ভালোমন্দ রান্না করে ছেলেকে পেট ভরে খাওয়াবেন তা না; ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হচ্ছেন এই ভেবে―
এরপর কী হবে ছেলেটার? পড়াশোনার পাহাড় সমান খরচের বোঝা কেমন করে বইবেন তিনি? নাকি অভাবের অবিন্যস্ত স্রোতে, দারিদ্র্যের হড়কা বাণের তোড়ে ভেসে যাবে তার ছেলের লেখাপড়া? আর মা হয়ে তিনি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন? দেখা ছাড়া তাঁর কী করণীয় কিছু নেই? আক্ষেপ যায় না অসহায় মায়ের। হা ঈশ্বর! তুমি এত নিষ্ঠুর! সহায় হও, প্রভু। সহায় হও। কাকুতি মিনতি ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে।

সেজন্য কোনও কাজে মন বসে না আজকাল। মন আচ্ছন্ন গভীর চিন্তায়। বিচরণ যেন অন্য জগতে। হৃদয়ে অনবরত কু ডেকে ওঠে। উল্টোপাল্টা হয় সব কাজ। থালাবাসন হাত থেকে মাটিতে পড়ে ঝনঝন শব্দে কেঁপে ওঠে। অনাগত বিপদের আশঙ্কা স্মরণ করে 'ঠাকুর ঠাকুর' বলে প্রতীকী কান মুলে তড়িঘড়ি সে-স্থান ত্যাগ করেন তিনি। পাছে কেউ দেখে ফেলে। অপ্রস্তুতে পড়ে যান এই ভয়ে। দুঃখ করে গোমড়া মুখে ঘরে বসে থাকবারও জো নেই। ছেলে আরও ভেঙে পড়তে পারে। অবশ্য ছেলে কতক্ষণই বা ঘরে থাকে! সারাক্ষণ পাড়ায় অথবা স্কুলে। মাস্টার মশাইদের সঙ্গে সবসময় কী যেন মিটিং, গুজগুজ ফুসফুস লেগেই আছে। অথবা দেখ গিয়ে, গ্রামের এ-ও-সে ঠিক ধরে নিয়ে গিয়ে হয় গল্প জুড়েছে, নয়তো হাত দেখাচ্ছে। হাত দেখা? ব্যাপারটা কী? 
        
ছোট থেকে জ্যোতিষ চর্চার খুব শখ নারানের। স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি জ্যোতিষ শাস্ত্রের বই হাতে পেলে গোগ্রাসে গিলবেই― এ একদম ধ্রুব সত্য কথা। বই পড়ে হাতের রেখা চিহ্নিত দাগগুলো দেখে অনায়াসে ভুত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান পড়ে দিতে পারে। তাই গ্রামের ছেলে ছোকরার দল সুযোগ পেলে ঘিরে ধরে নারানকে। সবার এক বায়না― হাত দেখে দিতে হবে, ভাগ্য গণনা করে দিতে হবে। ভবিষ্যৎ বলে দিতে হবে। কেউ পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে কিনা, আগামীর দিনলিপি কেমন হবে, চাকরি-বাকরির হাল হকিকত কী, জন্মকুষ্ঠি বানানো― হরেকরকম আবদার। আর নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিব্যি ভাগ্য গণনা করে চলে সেই খুদে জ্যোতিষী। 
হাত দেখা কিংবা জন্মকোষ্ঠী বানানোর জন্য কোনও টাকা পয়সা নেয় না সে। সবাই ফোকটে হাত গণায়। আসলে পরোপকার তার জীবনের ব্রত। সেজন্য দক্ষিণা নিয়ে মাথা ঘামায় না নারান। 

সুতরাং ঘরে দুদণ্ড জিরোবে, সে ফুরসৎ নেই। সেজন্য অবশ্য কোনও ক্ষোভ নেই মায়ের। বরং তার প্রচ্ছন্ন মদত আছে এতে। তার নারান যে সীমাহীন অরণ্যে এক মুক্তমনা নীলকণ্ঠ পাখি। সে কি খাঁচায় বন্দি থাকতে চায়? না-কি কেউ তাকে বন্দি বানাতে পারে? সে তো নীল আকাশে ডানা মেলে উড়বেই। উজাড় করে দেবে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার। পায়ে চরকি কেটে চষে বেড়াবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। আমার সাধ্যি কী তাকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখব! ও গগনে উড়লে তো আমারই বুক গর্বে ভরে উঠবে― মা হয়ে সেটুকুই কেবল আশা। আবার যে অল্প সময় ঘরে থাকে সে, উঠোনের কোনায় বসে মাকে লক্ষ্য করে। আজকাল মা কেমন যেন উদাস হয়ে গেছে। কথা কম বলে। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়। চোখের নিচে হালকা কালো দাগ জমেছে; রাত জাগলে যেমন হয়। আর সামান্য ফোলা ফোলা ভাব। সব বোঝে নারান। বলে না কিছু।

আসলে হৃদয়ের ঈশান কোনে একখানা ঝিম কালো মেঘ উঠেছে। মনখারাপের কাদম্বিনী। বিষাদের মেঘমালা। মন খুলে দুদণ্ড কেঁদে হালকা হবেন নাকফুড়ি দেবী, সে গুড়ে বালি। চোখাচুখি হলে ঠিক ধরে ফেলবে ছেলে। তখন অপরাধী মনে হবে নিজেকে। তাই পরমেশ্বর ঈশ্বরের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আড়ালে আবডালে চোখের জল ফেলেন তিনি। নিরবে। নিস্তব্ধে। আর মনে মনে আউড়ান― 'হে ঠাকুর, জয় জনার্দন, রক্ষা কর। মঙ্গল কর।'

জনমদুঃখিনী মায়ের কষ্টের ভার কিছুটা লাঘব হল। সফল হল তার প্রার্থনা। সাহায্যের ডালি নিয়ে এগিয়ে এল মাতৃসমা স্কুল সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির। এ হেন বিদ্যালয় যেন মাতৃমমতায় আপন ছেলেকে বুকে টেনে নিল। সাহায্যের লম্বা হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনজন গুণী মানুষ। সকলেই বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। বিজ্ঞানের জনপ্রিয় শিক্ষক মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী। দরদি হেডমাস্টার শ্রীনিবাস নন্দ। আর স্কুলের পরিচালন সমিতির তৎকালীন সেক্রেটারি নিমাইবাবু। নারানের পড়াশোনার যাবতীয় ভার নিজেদের পরিণত স্কন্ধে সানন্দে অর্পণ করলেন তারা। শুধু নারান নয়, বিদ্যালয়ের আরেক কৃতী দুস্থ ছাত্র গৌরহরি রাউতের সব দায়িত্বও সাদরে গ্রহণ করেছেন তারা। সবাই জানে, নারান আর গৌর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। স্কুল-বেলা থেকে। তাই বন্ধুর একটা হিল্লে হওয়ায় বেজায় খুশি নারান। এদিকে ছেলের একটা সদোপায় হয়েছে জেনে আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন নাকফুড়ি দেবী। তার দুঃখের গুরুভার অনেক লঘু হল। বিবেকের দংশন থেকে সাময়িক নিস্তার মিলল।

(দুই)
লাহিড়ী বাবুর আদি নিবাস কলকাতার নিউ আলিপুরে। চাকুরী সূত্রে দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে তিনি। প্রথমে বিহারে পোস্টিং। তারপর ১৯৬৫ থেকে ঠিকানা বদলে হল মেদিনীপুরের দাঁতন ব্লকের ২-নং অঞ্চল; সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের হোস্টেল। গ্রীষ্মাবকাশ ও পূজার ছুটিতে হোস্টেল বন্ধ থাকে এক মাস করে সব মিলিয়ে প্রায় ষাট দিন। তখন আসেন আলিপুরে। তা নাহলে বাড়ির পথ মাড়ান না খুব একটা। অবশ্য প্রয়োজন বেসিসে আগমন হত তাঁর। তিনি অকৃতদার। চিরকুমার ব্রত নিয়েছেন। সংসারের ঝক্কি নেই। বাড়িতে মা-ভাই-বোন আর তাদের ভরা সংসার। ওদের টানেই কালেভদ্রে বাড়িমুখো হওয়া। এছাড়া আর কোনও পিছুটান নেই। এ টুকুই তাঁর নিউ আলিপুর-যোগ। নইলে কবেই চুকে যেত সে সুক্ষ্ম দড়ি টানাটানি। বাদবাকি তাঁর ধ্যান-জ্ঞান বলতে সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির। পল্লীগ্রামের সহজ সরল ছেলেমেয়েগুলোকে যত্ন নিয়ে বিজ্ঞান পাঠদান করা তাঁর বড়ই প্রিয় বিষয়। আর নেশা নিজের পড়াশুনা, বিজ্ঞান সংক্রান্ত পুস্তক লেখা, বিজ্ঞানের নিত্য নতুন মডেল বানানো, নিজের তৈরি টেলিস্কোপে স্কাই-ওয়াচ। জীবনে আর কী প্রয়োজন? এ নিয়েই বেশ সুখে আছেন তিনি। 

সেটা ১৯৭০ সাল। বলা নেই, কওয়া নেই! আগাম কোনও সংবাদ নেই। সেবার হঠাৎই নিজের বাড়িতে অসময়ে হাজির তিনি। সঙ্গী দুটি কিশোর বয়স্ক ছেলে। রোগা দোহারা গড়ন। হাঁটু অব্দি পা প্যান্ট। গায়ে সস্তার শার্ট। পায়ে হাওয়াই চটি। কলকাতা শহরে এই প্রথমবার তাদের আগমন। লক্ষ্য প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রি-ইউনিভার্সিটি (PU) কোর্সে ভর্তি। ছেলে দুটির আস্তানা আপাতত লাহিড়ী বাবুর বাড়ি। যতদিন না নারান আর গৌর-এর হোস্টেল মিলে, ততদিন ওরা দুজন আলিপুরে থাকবে। এমনই বন্দোবস্ত হয়েছে। লাহিড়ী বাবুর তরফে।

সারাদিন খুব ধকল গেছে ছেলে দুটোর ওপর দিয়ে। প্রথম বার এতখানি পথের জার্নি! গা-হাত-পায়ের ব্যথা সারতে দিন তিনেক লেগে যাবে। কিন্তু কোথায় কী? গৌর আর নারানের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ক্লান্তি কী জিনিস! ছেলেদুটির ডিকশনারিতে সে শব্দ বোধহয় নেই। কেননা দুজন খুব উৎফুল্ল, উচ্ছ্বসিত। অপরিচিত জায়গায় সামান্য আড়ষ্টতা আছে ঠিকই। তবে তা সাময়িক। গৃহস্থের সকলের আন্তরিক অভ্যর্থনায় বেমালুম উবে গেছে সে জিনিসটি। দুজনের চোখে তখন স্বপ্ন সত্যি করার দৃঢ় প্রত্যয়, চিবুকে দাঁতে-দাঁত-চেপে শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের বলিষ্ট সংকল্পের ছাপ স্পষ্ট। আর চোখ বন্ধ করলে যাত্রাপথের মনোরম দৃশ্য। আহা, সে-ছবি ভুলিবার নয়।

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল নারানের। চকিতে প্রাত্যহিক ক্রিয়া কর্ম সমাপ্ত করে সে। তখনও রাত্রির তমশাচ্ছন্ন ভাব অব্যাহত। পাশের বাড়ি থেকে ভোরের মোরগ জানান দিচ্ছে রাত্রির অবসান আসন্ন। গাছের ডালে কিচিরমিচির করছে পাখিগুলো। কাজে বেরুবার তোড়জোড় চলছে তাদেরও। তাই এত কলরব! দূর প্রদেশে সূর্য দেবতা উঠি উঠি করছে; যদিও উদয় হতে অনেক বাকি। মা ফটাফট মুড়ি-বাতাসা খেতে দিয়েছিল। নাকে-মুখে যাহোক কিছু গুঁজে গত পূজোয় কেনা নতুন জামা পরে তৈরি হয়ে গেল সে। খেতে খেতে মা বারবার মনে করে দিয়েছিল―
'সব জিনিস ঠিক মতো গুছিয়ে নিয়েছিস রে, বাবা। কিছু বাকি রইল না তো? আর একবার দেখে নে কিছু বাদ পড়ল কিনা।' 
'সব ঠিক আছে, মা।'
'শোন, মাস্টার মশায়ের অবাধ্য হবি না। মাস্টার মশায় যা যা বলবেন, মন দিয়ে সব শুনবি। অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি। আর পথেঘাটে দেখেশুনে চলাফেরা করবি। শুনেছি, শহরে গাড়িঘোড়ার খুব প্রাদুর্ভাব।'
'আচ্ছা'― বলে মা'কে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। তারপর ব্যাগপত্তর নিয়ে সটান বড় রাস্তায় বেরিয়ে এল সে। চলে আসতে আসতে দূর থেকে সে শুনতে পেল মা বলছেন―
'দুগ্গা, দুগ্গা। কল্যাণ কর ঠাকুর।'
বাড়ির সামনে বড় রাস্তায় এসে হাঁটা দিল সোজা পশ্চিমে, সাউরি বাসস্টপেজ পাঁচশ মিটারের পথ। রাস্তা জনমানবশূন্য। পথচলতি দুএকটি কুকুর শুধু। তাদের পাশ কাটিয়ে সে চলে আসে স্কুলের গেটে। সেখানে তখন অপেক্ষারত মণীন্দ্র স্যার আর বন্ধু গৌর। স্কুলের গেটে পৌঁছে  করজোড়ে স্কুলকে প্রণাম করে নারান। এ তো স্কুল নয়, তার কাছে আস্ত এক মন্দির। মমতাময়ী মা। পৃথিবীর সেরা তীর্থক্ষেত্র।

তারা বাসে চড়ে প্রথমে যাবে খড়গপুর। খড়গপুর জংশন থেকে ডাউন লোকাল ধরে হাওড়া। ট্রেনে কোনও দিন চড়েনি নারান। প্রথম বার ট্রেনে চড়ে বেশ মজা পেল। সময় মেপে স্টেশন ছেড়েছিল ডাউন লোকাল ট্রেনটি। কত মসৃণ তার গতি। না দেখলে বিশ্বাস হয় না। থুড়ি, না চড়লে বোঝা যায় না। নির্ধারিত সময়ে ট্রেন হাওড়া পৌঁছল। হাওড়া থেকে বাসে গঙ্গা পার হয়ে নিউ আলিপুর। মণীন্দ্র স্যারের বাড়ি। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হল হাওড়া ব্রিজ, ওরফ রবীন্দ্র সেতু। এ হেন সেতু হাওড়াকে তিলোত্তমা কলকাতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। সেতুর ওপর দিয়ে কাতারে কাতারে বাসের আনাগোনা। নিচে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে সর্বপাপহরা পবিত্র গঙ্গা। সেতুর দুপাশে পথচলতি মানুষজন হেঁটে নদী পার হচ্ছে। বড় বড় চোখ করে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকে গৌর আর নারান। হাতের রোম খাড়া হয়ে ওঠে শিহরণে। পাঠ্যপুস্তকের আবছা ছবিগুলো জ্যান্ত হচ্ছে চক্ষুর প্রত্যক্ষ স্পর্শে। তাই এত শিহরণ, এত আবেগ। গঙ্গা পার হয়ে কলকাতায় ঢুকতে আর এক প্রস্থ বিস্ময়ের সূত্রপাত। ঝকঝকে তকতকে সড়ক। উঁচু-উঁচু-তলা বাড়ি। যেন আকাশ ছুঁয়েছে। ঐতিহ্যবাহী দোতলা বাস। ঘোড়ায় টানা গাড়ি। হাত রিক্সা। আর কলকাতার ঐতিহাসিক ট্রামগাড়ি। ঠিক ট্রেনের মতো। আবার পুরোপুরি ট্রেন নয়। মাত্র দুটো কামরা। ধীর গতি। তার লাইন পাতা আছে শহরের ব্যস্ত রাস্তার মাঝখান বরাবর। চলন্ত ট্রামে উঠে পড়ছে ছেলে-বুড়ো সকলে। ভয়ডর নেই। শহুরে লোকজন কত স্মার্ট! কথাবার্তায় বেশ চোস্ত। মার্জিত ব্যবহার। কেউ কারও জন্য দুদণ্ড বসে নেই। কথা বলবার অবকাশ নেই। সবাই যেন ছুটছে, বিদ্যুৎ গতিতে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ব্যস্ততার পরিপূর্ণ ইস্তেহার। মুগ্ধ বিস্ময়ে এসব চলমান দৃশ্যপট দেখতে দেখতে বাস কখন যে আলিপুর এসে পৌঁছল, সে খেয়াল নেই। বাস থেকে নেমে পদব্রজে মণীন্দ্র স্যারের বাড়ি। সামান্য হাঁটা পথ।

(তিন)
উত্তর কলকাতার এক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বেলঘরিয়া। এই অঞ্চলে পড়ে 'রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যার্থী আশ্রম'। রামকৃষ্ণ পরমহংশদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দ-এর ভাবধারার সংমিশ্রণে তৈরি এ হেন আশ্রম। কঠোর নিয়মাবর্তিতা আর অনুশাসন মেনে চলা দস্তুর মতো নিয়ম এখানে। আছে বিশাল সাইজের একটি প্রার্থনা হল। সকাল সন্ধ্যা দুবেলা প্রার্থনা সভা বসে হলে। প্রার্থনা সভায় মঠে বাসরত সকলের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। পরিচালনার ভার রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের উপর ন্যস্ত। স্বামী ধ্যানাত্মানন্দজী, স্বামী প্রীতি মহারাজ, স্বামী অমলানন্দজী সহ প্রমুখ সন্ন্যাসী আশ্রমে সর্বক্ষণের সঙ্গী। আশ্রমের বিশাল এলাকার মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশন রোড লাগোয়া একটি ছাত্রাবাস আছে। মূলত দুস্থ মেধাবী দেবশিশু সুলভ ছাত্রকূলের অব্যর্থ ঠিকানা এই আশ্রমিক হোস্টেল। স্কুল ফাইনাল ও হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করে যে সব বিদ্যার্থী সদ্য কলেজে অ্যাডমিশন নেয়, তাদের আবাসিক আশ্রম এটি। এখানে থাকবার একটাই শর্ত, পরীক্ষায় ভালো নম্বর। তাহলেই মিলবে স্কলারশিপ। 
        
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো ফলের সুবাদে সহজে স্কলারশিপ পেয়ে গেল নারান আর গৌর। কলকাতা-বাসের ক'দিনের মধ্যে তারা দুজন আলিপুর থেকে বেলঘরিয়া আশ্রমে চলে এল। আশ্রমের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত ভালো। অন্তত নারানের পছন্দ হয়ে গেল মঠের ঐশ্বরিক পরিমণ্ডল। ছোটবেলা থেকে ঠাকুর দেবতার প্রতি তার তীব্র ভক্তি। ফলে আশ্রমের আধ্যাত্মিক পরিবেশে মন বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। থাকা-খাওয়া-কলেজ যাতায়াত সহ যাবতীয় খরচ স্কলারশিপের টাকায় হয়ে যায়। উপরন্তু বইপত্তর কেনা আর লাইব্রেরীর সমস্ত খরচাপাতিও মোটামুটি চলে যায় বৃত্তির অনুদানের টাকায়। এবার তাদের ভাবনা― নির্ঝঞ্ঝাটে পড়াশুনা করে যাওয়া। আর ভালো রেজাল্ট করে আশ্রমের সন্ন্যাসীগণের প্রিয়পাত্র বনে যাওয়া। যাতে তাঁদের অকৃপণ স্নেহাশীষ অনবরত ছাত্রের মস্তিষ্কে বর্ষিত হয়। বিশেষ করে নারায়ণচন্দ্র রানা'র উপর সন্ন্যাসীগণের আন্তরিক কৃপাদৃষ্টি সর্বদা বর্ষিত হত। প্রত্যেকে খুব স্নেহ করেন সহজ সরল মেধাবী নারানকে। 

১৯৭০-এর প্রথম দিকে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে ভর্তি হয়ে গেল নারান। পছন্দের বিষয় সায়েন্স। বেলঘরিয়া থেকে রোজ ট্রেনে বাদুড়ঝোলা ঝুলে প্রেসিডেন্সিতে ক্লাস করতে আসতে হত। এই কোর্সটি মাত্র নয় মাসের। অথচ সেবার কোর্স সম্পূর্ণ হতে দুবছর সময় লেগে গেল। বিলম্বের কারণ অজ্ঞাত। অনেক পরে এক দৈনিক বাংলা নিউজ পেপারে তথ্যসহ কারণ সমূহ সবিস্তারে মুদ্রিত হয়েছিল। তা, ১৯৭১ সালে প্রি-ইউনিভার্সিটি'র ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। সেই পরীক্ষার বিজ্ঞান বিভাগে ভালো ফল করল সে। ত্রয়োদশ স্থান দখল করে। প্রাণের বন্ধু গৌর-এর র‍্যাংক ২০। 

পি ইউ-তে সফল হওয়ার পর ১৯৭১ সালে নারান আর গৌর ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পুনরায় ভর্তি হল প্রেসিডেন্সি কলেজে। এবার বন্ধু গৌরকে কাছে পেয়ে অনেক ভরসা পেল নারান। এতদিন একা একা যাতায়াত করতে হয়েছে বেলঘরিয়া থেকে কলেজ স্ট্রিট। তার নিসঙ্গ দশা এবার কিছুটা ঘুচবে। কিন্তু কোথায় কী! ছ'মাস পর গৌর মেডিক্যালের এমবিবিএস কোর্সে চান্স পেল। মুলতবি রইল ফিজিক্স অনার্স। কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে রওনা হয়ে গেল সে। ডাক্তারী পড়তে। আবার যে-কে সেই অবস্থা নারানের। একা একা কলেজ যাওয়া-আসা। প্রাণ খুলে দুদণ্ড কথা কইবার বন্ধুর বড্ড অভাব তার। যদিও তাদের দুজনের বন্ধুত্ব জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল।
      
বেলঘরিয়া আশ্রমে থাকাকালীন একটা গর্হিত কাজ করেছিল নারান। সকলের অজান্তে। আশ্রমের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন মোতাবেক আশ্রমের বাইরে টিউশনি করা ঘোরতর অন্যায়। পরিস্থিতি যাইহোক না কেন, টিউশনির খবর জানাজানি হলে অথবা ধরা পড়লে হোস্টেল থেকে বিতাড়িত হতে হত। তবুও সে রিস্ক নিল। অবশ্য নিজের জন্য টিউশনি নেয়নি। অধিকাংশ সময় তার মন পড়ে থাকত গ্রামের বাড়িতে। কেমন আছে তার মা-বোন-ভাই? কীভাবে চলছে সংসার? বাড়ির সংবাদ এলে মন ভারাক্রান্ত হয় যুবক নারানের। ঠিক করল টিউশনি করবে। গোপনে। টিউশনি করে যে টাকা পাবে, পুরোটা বাড়িতে পাঠাবে। এতে যদি দুঃখিনী মায়ের কষ্টের ভার সামান্য লাঘব করা যায়। ১৯৭৪-এ লুকিয়ে ছেলে পড়ানো শুরু করল সে। এক সম্ভ্রান্ত বাড়ির একমাত্র ছেলের হোম টিউটর। সাপ্তাহিক দশ টাকার বিনিময়ে। মাসে চল্লিশ টাকা। সপ্তাহে যখনই মাহিনা দশ টাকা পেত, তুরন্ত মানি-অর্ডার করে দিত। পোস্ট-অফিস মারফৎ বাড়িতে সরাসরি টাকা আসত না। বাল্য কালের সুহৃদ হিমাঙ্ক পাল। বড় রাস্তা থেকে তিন-চার কিলোমিটার উত্তরে তার বাড়ি। সে-বন্ধুর ঠিকানায় টাকা পাঠাত নারান। টাকা আনতে নাকফুড়ি দেবী অতটা পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিত ফি-হপ্তায়। সকাল সকাল। যেতে-আসতে এক প্রহর বেলা কোথা থেকে যে অতিক্রান্ত হত, টের পেতেন না তিনি। এমনও দিন গেছে, প্রচণ্ড গরমে ঘেমে নেয়ে তিনি পৌঁছে হয়তো দেখলেন হিমাঙ্ক বাড়ি নেই। খালি হাতে ফেরা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না তখন। টাকা সংগ্রহের জন্য পরের দিন পুনরায় রওনা হতেন। কষ্টেসৃষ্টে এভাবেই সংসার চালিয়েছেন তিনি। হাল ছেড়ে দেননি। শেষের দিকে দূর্গাপদ পণ্ডা'র ঠিকানায় পয়সা আসতে থাকে। রানা'র ঘর থেকে পাঁচশ মিটার দূরে পণ্ডা'দের বাড়ি। ফলে টাকা সংগ্রহ অনেক সহজ হয়ে গেল।

(চার)
প্রফেসর অমল কুমার রায়চৌধুরী (১৯২৩―২০০৫) একজন নামকরা বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী। সাধারণ অপেক্ষবাদ আর বিশ্বতত্ত্ব বিষয়ে পণ্ডিতব্যক্তি। সাধারণ অপেক্ষবাদে সিঙ্গুলারিটি প্রসঙ্গ উত্থাপনের প্রথম ধাপ তাঁর নামাঙ্কিত 'রায়চৌধুরী সমীকরণ' আবিষ্কার করে বিশ্বের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর গবেষণাপত্রের এ হেন সমীকরণ-এর সূত্র ধরে বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং (১৯৪২―২০১৮) আর রজার পেনরোজ (জন্ম ০৮ আগস্ট ১৯৩১) কৃষ্ণগহ্বরের একটি দীর্ঘদিনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান তুলে ধরলেন। তা হল 'ব্ল্যাকহোল সিঙ্গুলারিটি'। অসীম ভরের একটি বস্তু তার মধ্যেকার পদার্থের দরুণ ক্রমবর্ধমান মহাকর্ষীয় টানে শেষমেশ কোন অবস্থায় উপনীত হবে? অসীম ঘনত্বের একটি ব্ল্যাকহোল বনে যাবে সে। যে তার পরিপার্শ্বে থাকা সবকিছু― কচুটা, মুলোটা, ভারী বস্তু, গ্রহ, তারা, এমনকি আলো'কে পর্যন্ত গিলে খায়। আর সেই ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রে একটি বিন্দু যেখানে স্থান-কালের জ্যামিতি কাজ করে না; সেটাই 'ব্ল্যাকহোল সিঙ্গুলারিটি'। কৃষ্ণগহ্বর এককত্ব। এই অভিনব সিঙ্গুলারিটি আবিষ্কার করে ফিজিক্সে নোবেল পান পেনরোজ। ২০২০ সালে। 
      
স্বনামধন্য এ হেন বৈজ্ঞানিক অমল কুমার রায়চৌধুরী তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করেন। অনার্সের ক্লাস নেন কলেজের তিন তলায়। আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বোঝায়, তার সব গুণ তাঁর মধ্যে বিদ্যমান। সেজন্য স্টুডেন্টদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় তিনি। বিদ্যার্থী দল মন-প্রাণ ঢেলে তাঁর লেকচার শোনে। কেউ ক্লাস কামাই করে না। কলেজে অসম্ভব ফেমাস তিনি। সকলে সমীহ করে চলে।
       
নারানেরও খুব প্রিয় এই রায়চৌধুরী স্যার। স্যারের পড়ানোর টেকনিকস, বোঝানোর কৌশল স্রেফ মাইন্ডব্লোয়িং। সম্পূর্ণ আলাদা এবং বেশ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু অমল স্যারের ক্লাস করতে গিয়েই মহাসমস্যা বাধল। ব্যাপারখানা কী? তিনতলায় স্যারের ক্লাস করতে হলে একমাত্র উপায় সিঁড়ি। পেরোতে হবে সিঁড়ির বেশ কিছু অলঙ্ঘ্য ধাপ। কমপক্ষে ৪০―৫০ টি ধাপ ভেঙে উপরে উঠে পৌঁছতে হয় ক্লাসে। প্রায় দিন সিঁড়ি বেয়ে ক্লাসে যাওয়ার সময় অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠে নারান। আট-দশ ধাপ উপরে উঠতেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। যত উপরে ওঠে, তত শ্লথ হয় গতি। সিঁড়ির শেষের ক'টি ধাপ তখন হিমালয়ের এক একটি অলঙ্ঘনীয় পর্বত শিখর যেন। সেসব অতিক্রম করা এভারেস্ট জয়ের সমান মনে হয় নারানের। তীব্র শ্বাসকষ্টে প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। আজকাল পথেঘাটে জোরে হাঁটলেও শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করে, বুক ধড়পড় শুরু হয়ে যায়; যা একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির পক্ষে এই কম বয়সে একেবারে বেমানান। 

অনেকে উপদেশ দিল চেস্ট স্পেসালিস্ট দেখানোর। সেটা ১৯৭৩―১৯৭৪ সাল। ভালো হার্টের ডাক্তার দেখানো হল। ধরা পড়ল অসুখ। সকলে যা সন্দেহ করেছিল, তাই। হার্ট ব্লকেজ। বড় কঠিন রোগ। ডাক্তারী পরিভাষায়, Idiopathic Hypertrophic Sub-aeortic Stenosis with Complete Left Bundle Branch Block। বাম অলিন্দ- বাম নিলয়ের সংযোগস্থলে দুই স্তরের মাংসপেশির থিকনেস এত বেড়ে গেছিল যে, হার্ট ব্লকেজের মতো মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ফুসফুসে। সবাই ভীষণ চিন্তিত। এদিকে যার বড় রোগ, সেই নারান বেশি আমল দিল না তার অসুখকে। ভাবল প্রতিদিন ভীড় ট্রেনে যাতায়াত করে বোধহয় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। অসুখের একমাত্র কারণ হয়তো সেটাই। অথচ দিনকে দিন ক্রমশ জটিল হচ্ছে পরিস্থিতি। 

আসলে এ হেন মারাত্মক অসুখকে নারানের পাত্তা না দেওয়ার কারণ সংসারের আর্থিক টানাপোড়েন। অপারেশন করে সারানো যায় রোগ। শলা দিয়েছে ডাক্তাররা। তার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের প্রয়োজন। 'দিন আনি দিন খাই' সংসারে অত টাকা কোথায়? এত টাকা তাকে কে দেবে? তাই চুপচাপ থাকে সে। কপালে যা আছে তাই হবে, এই ভেবে নিরুত্তাপ থাকে। (চলবে)

তথ্য সহায়তা :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের ভাই সুজন রানা,
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments