জ্বলদর্চি

নববর্ষ : সেকাল আর আজ/ বন্দনা সেনগুপ্ত

নববর্ষ : সেকাল আর আজ 

বন্দনা সেনগুপ্ত 

প্রথমেই বলি আমি আজন্ম প্রবাসী বাঙালি। গত শতকের প্রথম দিকে আমার পূর্বপুরুষরা অধুনা বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যের খোঁজে এদিকে চলে এসেছিলেন। আমার বিবাহের আগে পর্যন্ত পূর্ব বা পশ্চিম কোন বাংলার সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল না অথচ বাড়িতে কিন্তু যথা সম্ভব বঙ্গ সংস্কৃতি বজায় রাখা হয়েছিল।সেই অনুযায়ী সরস্বতী পূজা, নববর্ষ, দুর্গা পূজা ইত্যাদি সব পালন করা হত।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, নতুন বছর পালন করা হত খুব অনাড়ম্বর ভাবে। তখন গুরুজনেরা বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে এদিন যা করা হবে, তাই সারা বছর হবে। অতএব বিশেষ করে এই দিনটি যেন খুব ভালো ভাবে শেষ হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হত। 

নববর্ষের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান করে ঠাকুর প্রণাম করাই ছিল প্রথম কাজ। হয়তো কখনও মন্দিরে যাওয়া হত, সময় সুবিধা  থাকলে। সেদিন মন্দিরেও থাকতো বিশেষ পূজার আয়োজন।আমাদের বাড়িতে অনেক ফুল হত। চৈত্র বৈশাখে গাছ ভরে থাকত বেলি ফুলে, সেই ফুল মন্দিরে দিয়ে প্রণাম করে আসতাম।

তারপর গুরুজনদের প্রণাম করে জল খাবার খেয়ে পড়তে বসা। স্কুলে ছুটি থাকলেও পড়তে বসা অবশ্য কর্তব্য ছিল। পাছে সারা বছর ফাঁকি দিয়ে কাটাই, সেই ভয়ে মা এদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখতেন। প্রসঙ্গত জানাই আমাদের ছোটবেলাটা কিন্তু এত পরীক্ষা, প্রতিযোগিতা, নাচ, গান, আঁকা ইত্যাদির ক্লাসে ভারাক্রান্ত ছিল না। যাদের সুযোগ বা প্রতিভা বা দুটোই থাকত, তারা কিছু কিছু শিখতো ঠিকই কিন্তু মূল ছিল পড়াশুনা।

কখনও কখনও নিকটস্থ আত্মীয় স্বজন আমাদের বাড়িতে আসতেন, বা আমরাও যেতাম। সেদিন সবার জন্য অবারিত দ্বার থাকত। ছোটবেলায় রাগ ঝগড়া এমনিতেই বেশিদিন থাকে না, তাও কারুর সঙ্গে ভাব করতে হলে এইটি ছিল আদর্শ দিন। কেউ এলেই তাকে হাসিমুখে আপ্যায়ন করে মিষ্টিমুখ করানো হত।সেদিন দুয়ার থেকে কোনও গরীব দুঃখী খালি হাতে ফিরে যেত না।

যাদের সুবিধা থাকত তারা নতুন জামা কাপড় পরত, অবশ্য তখনকার দিনে সবার এই বিলাসিতা সম্ভব হতো না। সেদিন সবার ঘরেই একটু বিশেষ খাওয়া দাওয়া হত। সব মিলিয়ে সাদাসিধা অথচ অন্য দিনের থেকে একটু স্বতন্ত্র, শান্তি, সৌহার্দ্য ও প্রীতিপূর্ণ ভাবে বছরের প্রথম দিনটি কেটে যেত।

তারপর বহু বছর ধরে সাউথ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন শহরে আছি। বাড়িতে এই নিয়মই বজায় রেখেছি। তবে কিছু পরিবর্তন তো অবশ্যই হয়েছে। এখন আর শুধু নব বর্ষ বলে নয়, সারা বছরই পড়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হয়। সেই সঙ্গে আছে অন্যান্য এক্সট্রা ক্যারিকুলার এক্টিভিটিস। বাচ্চাদের সব সময়েই ব্যস্ত সমস্ত অবস্থা।বছরের প্রথম দিনে একটু অন্য রকম খাওয়া দাওয়া বা একটা নতুন জামা ছাড়া আর বিশেষ কোন বদল থাকে না। সপ্তাহান্ত না হলে কারুর আসা বা আমাদের কোথাও যাওয়া একটু দুরূহ হয়ে উঠেছে।তাই আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা স্বাভাবিক কারণেই কম হয়ে গেছে। ছেলে মেয়েদের পড়া, পরীক্ষা এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতার চাপে এখন আত্মীয়তা বজায় রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। সবাই যেন আস্তে আস্তে একটু করে অসামাজিক হয়ে পড়ছে। তবুও, তার মধ্যে, বাঙ্গালী ক্লাবে এই দিনে ছোট্ট করে একটু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, একটু নাচ গান, একটু খাওয়া দাওয়া হয়।কিছু বাঙালি মিলে একসঙ্গে একটু আড্ডা, গল্প আর ভুরিভোজন হয়। সমবয়সীদের সঙ্গে একটু সময় একসাথে কাটিয়ে বাচ্চারাও একটু আনন্দ করে। তবে প্রতি বছর যাওয়া সম্ভব হয় না। বাচ্চাদের পড়া এবং অন্যান্য কাজের চাপের উপরে সময় বার করা নির্ভর করে।যেতে না পারলে খুব মন খারাপ হয়।

এলো বিভীষিকাময় ২০২০। ১লা বৈশাখ পরিণত হল একলা বৈশাখে। নিয়ে এলো করোনা। করোনা কালে আমরা অনেক কিছু দেখলাম। রোগ, অসুখ, মৃত্যু। লোকক্ষয়, অর্থক্ষয়।লকডাউন। দেখলাম পরিযায়ীদের পদযাত্রা, পথ মৃত্যু। অনেক সাধারণ মানুষ যত পারলেন সাহায্য করলেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবতার অবক্ষয় দেখলেও, অনেকেই সাহসের সঙ্গে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন। অনেকের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। সাধারণ মানুষ দুঃস্থ দরিদ্রের সাহায্য কল্পে এগিয়ে এসেছেন। আবার অনেকে মৃত্যুভয়ে মা বাবাকেও ফেলে দিলেন।

অনেক পরিবর্তন আচমকা চলে এলো।টেকনোলজির জয়যাত্রা দেখলাম। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার অগ্রগতি দেখছি। অবশ্য, সব কিছু সহজে হচ্ছে এমন নয়। অনেক খবর পড়লাম যেখানে সন্তানের পড়া চালাবার ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোন কেনার জন্য মায়ের গয়না বিক্রি করতে হল। এই সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে কেটে গেল আরেকটি বছর। 

এবার বহু বছর পরে নববর্ষে কলকাতায় থাকব। আমি বিস্মিত, ব্যথিত হিংসায় উন্মত্ত এই বঙ্গকে দেখে।

হয়তো ভোট চলছে বলে এখানে যেন সবাই উত্তেজিত হয়ে আছে।সামান্য কারণে মারামারি হানাহানি লেগে যাচ্ছে। কার দোষ, বা অন্যথায় কি করা উচিত সে উপদেশ আমি দিতে পারবো না। কিন্তু, পাড়ায় বা চেনা পরিচিতরা যদি আনন্দে না থাকেন, তাহলে তাঁদের চোখের জলে আমার আনন্দও ভিজে যায় না কি? বিশেষ, তাঁদের নিরানন্দের কারণ যদি আমিই হয়ে থাকি? শ্রী রামকৃষ্ণ দেব বলেছিলেন "মান আর হুঁশ, এই নিয়ে মানুষ"। আমার মনে হয় নিজের এবং সেই সঙ্গে অন্যেরও সম্মান ও অধিকার সম্বন্ধে যদি আমার হুঁশ থাকে, যদি সততা ও অহিংসার সাথে আমি নিজের ও অন্যের সেবা করে চলতে পারি, একমাত্র তখনই  আমি নিজেকে প্রকৃত মানুষ বলতে পারবো। 

এবার দেখছি সবার যেন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব।করোনার জন্য যে দূরত্ব বাধ্য হয়ে গত এক বছর ধরে মেনে চলতে হয়েছে, সেটা যেন একটা স্বভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ, আমি চিরকাল বলে এসেছি যে সাউথ ইন্ডিয়ার সঙ্গে এই বঙ্গের এটাই তফাৎ। এখানে সবাই খুব সহজেই অন্যকে আপন করে নেয়। এখানে এবার আমাকে এই দূরত্ব ব্যথা দিচ্ছে। 

এখানে একটা বড় উৎসব হালখাতা।গত বছর হয় নি। এবার সবাই করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু, এই করোনা বৃদ্ধির পরিস্থিতিতে এবং নির্বাচনের উত্তেজনায় হালখাতাও হয়তো ছোট করেই হবে।অনেক লোকের জমায়েত তো করা যাবে না। যাঁরা যাবেন, আশা করছি হয়তো তাঁদের মধ্যে একটা মিলন ও উৎসবের উল্লাস বিরাজ করবে। তবে  এই ভয়ের আবহাওয়াতে এবার কেমন নব বর্ষ উদযাপন হবে জানিনা।

আমার মনে হয় আমাদের  এবারের নববর্ষকে মনুষ্যত্বের নামে উৎসর্গ করে  অতীতের প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সেই উত্তরাধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে।।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments