জ্বলদর্চি

নব আনন্দ জাগে নববর্ষের ডাকে/মহুয়া ব্যানার্জী

নব আনন্দ জাগে নববর্ষের ডাকে

মহুয়া ব্যানার্জী

সময় বয়ে যায় যুগ থেকে যুগান্তরে। কালের স্রোতে ভেসে যায় কত, দিন, মাস বছর।সেই আদিম যুগ থেকে বিবর্তনের ধারায় মানুষ জাতির উদ্ভব। উদ্ভবের  ক্ষণ থেকেই তারা নিজেদের বুদ্ধি দিয়ে নিজেদের জন্য খুঁজে নিয়েছিল খাদ্য , বাসস্থান, অঙ্গের আচ্ছাদন। কালের নিয়মে ছন্নছাড়া মানুষ সভ্য হতে গিয়ে গোষ্ঠীবদ্ধ হল।জীবনসংগ্ৰামে জয়লাভের জন্য সেই সব গোষ্ঠীর মানুষদের লড়তে হয়েছে নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে। সেই সব প্রতিকূলতাকে জয় করার বাসনায় অথবা জয় করতে করতে তৈরী হল সমাজ ও তার নানান রীতি নীতি। আবার সমাজের রীতি পালনের জন্য তৈরি হল সময়ের হিসাব।সেই হিসাব গুহার গায়ের দাগ থেকে দিনপঞ্জী হয়ে পরবর্তীতে ক্যালেন্ডারে সভ্যতায় উন্নীত হয়। তৈরী হয় পঞ্জিকা। পৃথিবীর সকল জনজাতিরই একটি নির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার রয়েছে সন তারিখের ভিত্তিতে।রয়েছে সময় গননার নির্দিষ্ট রীতিও।বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। অন্যান্য জনজাতির মতই তাদেরও বাঙলা ক্যালেন্ডার, সন , তারিখ ও বাংলা পঞ্জিকা রয়েছে। অবশ্য এই ক্যালেন্ডার শুরু হয় কিভাবে তা নিয়ে বেশ একটা জটিল মতভেদও রয়েছে।
হিজরি সন থেকেই বাংলা সনের প্রধান কাঠামোটি তৈরী হয়। কারো মতে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা সনের উৎস।হিজরি সন চন্দ্রের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী গনিত হয়। এদিকে বাংলার মত কৃষিপ্রধান দেশে সূর্যের তেজের প্রকোপ বছরের অধিকাংশ দিন। হিজরি সন অনুযায়ী বাংলায় ফসল ফলানো ও ফসল কাটা কঠিন হয়ে উঠছিল। কারন এ বঙ্গ দেশের ঋতূর গতিপ্রকৃতি। তাই সম্রাট আকবর জ‍্যোতির্বিদদের দিয়ে হিজরি সন ও সৌর সনের মিলন ঘটিয়ে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন বলে জানা যায়। সেই অনুযায়ী আকবরের আমলে ক্যালেন্ডারের এবং পঞ্জিকার শেষ মাস চৈত্রের শেষে  খাজনা আদায়, বকেয়া শোধে করে দায়মুক্ত হত প্রজারা।ফসল কাটা ও খাজনা দেওয়ার সময় চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল‌। তাই চৈত্রমাসকে সেই আমলে ফসলি মাস বলা হত। তাই পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনটিতে সম্রাট আকভর প্রজাদের মিষ্টি বিতরণ ও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি পালন করতেন। তাই ঐ দিনটি পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখ।নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে ধরা হয়।হালখাতার প্রচলনের সাথেও সম্রাট আকবরের নাম জড়িয়ে আছে। আবার কেউ কেউ বলেন রাজা শশাঙ্কের আমল থেকেই বাংলা সনের শুরু। এ সম্পর্কে যে মতভেদ রয়েছে তা আগেই বলেছি‌। উৎস নিয়ে মতভেদ থাকলেও কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে ঋতুর পরিক্রমাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকা। 

গ্ৰহ নক্ষত্রের অবস্থান ও আবহাওয়ার ভিত্তিতে এক একটি মাস একেক রকম ভাবে প্রাধান্য পেয়েছে বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতায়। হিন্দু জ্যোতির্বিদ্যা অনুসারে চাঁদ পৃথিবীকে পরিক্রমণ কালে যখন যে নক্ষত্রের কক্ষপথে অবস্থান করে সেই অনুসারে বাংলা মাসের নামকরণ করা হয়েছে। যেমন-বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ,জ‍্যেষ্ঠা থেকে জ‍্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ ইত্যাদি। এইভাবেই বাংলা নববর্ষের সূচনাও সেই তিথি নক্ষত্র মেনেই চলে আসছে বছরের পর বছর।বর্তমানে প্রাচীন অবিভক্ত বঙ্গদেশে বাঙালিরা চৈত্রের ফসল ঘরে তুলে এবং তা বিক্রয় করে অর্থনৈতিক ভাবে যেমন শক্তিশালী হতেন তেমনই মহাজনের বকেয়া প্রাপ‍্য মিটিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। আবার মহাজন ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের পাওনা আদায়ে খুশি হতেন। তাই বাঙলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের প্রথম দিনটি এই সব পাওনা আদায়ের খুশিতে গ্ৰাহক বা খাতকদের মিষ্টি দিয়ে অ্যাপ্যায়িত করতেন। শুধু তাই নয়, পহেলা বৈশাখ বা পয়লা বৈশাখের দিনে মহাজন ও ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খুলতেন গ্ৰাহকদের জন্য। সেই প্রথাই হালখাতা বলে মনে করা হয়। সেই প্রথা সময় সারণী ধরে বর্তমানের হালখাতা নামক অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে। 

পয়লা বৈশাখ বছরের প্রথম দিনটিকে শুভ ধরে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতি বছরের ব্যবসার শুরু করেন। তাই বোধহয় শুভ নববর্ষ বলা হয়। তবে আমার মতে এই দিনটিকে কেন্দ্র করে আম বাঙালি যে আনন্দে মেতে ওঠে তাই এটি শুভ।ষড়রিপু তাড়িত জীবনে আনন্দ আর পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের চেয়ে শুভ আর কিই বা হতে পারে।এখন দুই বাংলা আলাদা হয়ে একটা রাজ‍্য আর একটা আলাদা দেশ হলেও আমাদের ভাষা এক। ঐতিহ‍্য, রীতি নীতিও প্রায় এক। তাই আজও পয়লা বৈশাখ এলেই দুই বাংলার সব বাঙালি, পৃথিবীর সব বাঙালি সেই পুরনো রীতি পালন করে সানন্দে। সকালে স্নান করে নতুন জামাকাপড় পরে মন্দিরে পুজো দিয়ে শুরু হয় বাঙালির নববর্ষ। তারপর বড়দের প্রণাম ও ছোটদের আশীর্বাদ দেওয়ার পালা। সমবয়সীরা নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময় করে। সকলে মিলে  সারা বছর ভালোভাবে কাটানোর প্রার্থনা করে।

আমাদের ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখের একটা আলাদা মাধুর্য ছিল।যৌথপরিবারে বড় হওয়ার সুবাদে যেমন অকারণ আনন্দ ছিল জীবনের আনাচে কানাচে তেমনই আর্থিক স্বচ্ছতার অভাব ছিল। যদিও সেই বয়সে সেসব বোঝার ক্ষমতা বা পরিবেশ ছিল না।কারণ, তখন মানবিকতা আর মূল্যবোধ অনেক বেশি ছিল। তবুও আমরা এটুকু বুঝতাম যে সবসযয়ে যে সব খাদ্য পাওয়া কষ্টকল্পনা পয়লা বৈশাখের দিন সেটাই আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে।বছর ভর অপেক্ষা করতাম এই দিনটির।কচি দাদুর সাথে যেতাম আমাদের এলাকার সবচেয়ে বড় দুটো দোকানে।দাদু ওখানে পয়লা বৈশাখের পুজো করত আর আমি ভাবতাম রঙিন শরবত কখন খেতে দেবে।হেঁটে হেঁটে ছোট পায়ে ব্যথা হলেও রঙিন শরবত আর একটা বড় কাগজের প্লেটে একদম নিজস্ব বড় বড় মিষ্টি আর নিমকি সে ব্যথা ভুলিয়ে দিত।আরও একটু বড় হওয়ার পর কাকুর সাথে দোকানে দোকানে ঘুরে হালখাতা করতাম।নতুন জামা আর চারপাশের রঙীন আলোয় নিজেকে বেশ মহার্ঘ্য মনে হত। এত মিষ্টি জমা হত যে আমরা সব ভাইবোনেরা পরদিন তা স্কুলের টিফিনে নিয়ে যেতাম। কোন হীনমন্যতা ছিল না তাতে।কারণ আসেপাশের প্রায় সকলের গল্পটাই তখন একই রকম। 

সময় বয়ে যায় নিয়মমতো। সেই সময় পেরিয়ে আজ এই মধ্যবয়সে নতুন বছরের উদ্দীপনা স্তিমিত অনেকটাই। সবপেয়েছির এই যুগে প্রাচুর্য এসেছে সমাজে। আজ সব কিছুই মোবাইল ফোনে অর্ডার করলেই ঘরে পৌঁছেযাচ্ছে। চারিদিকে সবসময় ঝকমকে ভোগবাদের ছোঁয়ায় পয়লা বৈশাখ দুখিনী মায়ের মত মলিন বসনা।ইংরেজীর আগ্ৰাসনে নববর্ষ হ্যাপি নিউ ইয়ার হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। তবুও আজও পয়লা বৈশাখ এলে একটি মেয়ে তার ছেলেবেলার সেই রঙীন শরবত, ক্ষীরের সিঙাড়া আর দাদুর হাতের আঙুলের ছোঁয়ার অপেক্ষা করে মনে মনে। সেই হাত ছাড়া হয়ে গেছে কবেই। তবুও মণের মণিকোঠায় সযত্নে লালিত হয় পয়লা বৈশাখ। পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠানের চমক,টিভির শোয়ের মোহজাল সব ছাড়িয়ে পয়লা বৈশাখ আসে আমাদের বুকের ভেতর। কাঁপন লাগে চোখের পাতায়। নতুন আশায় উজ্জীবিত হয় পুরাতন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব আনন্দ করে পড়লাাম কত স্মৃতি মনে পড়ে গেল - দৌঁড়ে হেটেছি আপনার সাথে সাথে.....! শুভ কামনা

    ReplyDelete