জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-২২/শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-২২
শুভদীপ বসু

বিষয়-শ্রুতিনাটক

মানুষের অনুকরণ করার দক্ষতা থেকেই এবং আদিম সরল গঠন ভঙ্গি ও অভিব্যক্তি থেকে প্রথম অভিনয় করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল।সে সময় কোন নির্দিষ্ট মঞ্চ ছিল না।খোলা মাঠে দলগতভাবে যে যেখানে দাঁড়িয়ে তার মনের ভাব প্রকাশ করত। দর্শকরা বৃত্তাকার হয়ে সেই অভিনয় উপভোগ করত,যা কিনা এরিনা নাট্যমঞ্চের পথপ্রদর্শক। বলা চলে নাট্যমঞ্চের জন্ম তখন থেকে।
নাটকে মৌলিক উপাদান হিসেবে নৃত্য,গীত,অঙ্গসজ্জা ইত্যাদির প্রচলন ছিল সেই যুগেই।বলা ভালো প্রথমে অভিনয় পরে মঞ্চ।তারপরেই প্রয়োজন পরলো কাহিনীর।অর্থাৎ অভিনয়,রঙ্গ,মঞ্চ কাহিনী বা নাটকের হাত ধরে জন্ম নিল থিয়েটার প্রদর্শন।একটা আদর্শ নাটক আমরা তখনই বলতে পারি যখন'কাহিনী-ভাব ভাষাশৈলী-চরিত্র-দ্বন্দ্ব-সংগীত'-
এই ছয়টি মৌলিক উপাদান সন্নিবিষ্ট থাকে।ঋক,সাম,যজুঃ, অথর্ব-এই চারটি বেদের পরে নাট্যবেত্তারা নাটক কে আখ্যা দিলেন পঞ্চম বেদ হিসেবে।
নাটক নিয়ে নানা সময়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।বাংলায় সত্তরের দশকে বাদল সরকার প্রসেনিয়াম থিয়েটার এর বাধা গত থেকে বেরিয়ে এসে দর্শক অভিনেতার সীমারেখার ভেঙে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন থার্ড থিয়েটার।এই সত্তরের দশক যদি থার্ড থিয়েটার এর জন্য হয়ে থাকে তবে আশির দশক শ্রুতি নাটকের।

শ্রুতি নাটক কি গ্রামীন লোকসংস্কৃতির উত্তরসূরী?

আসলে শ্রুতিনাটক আমাদের সনাতন ঐতিহ্যের নবতম প্রকাশ রূপ।ভারতবর্ষ শ্রুতি-স্মৃতির দেশ। পট থেকে পাঁচালি,বৌদ্ধ জাতক, কথামালা,মঙ্গলকাব্য এমনকি কীর্তনের আসরে যে নাট্য উপাদান উচ্চারিত হতো তারই সাম্প্রতিকতম ফর্ম বলতে পারি শ্রুতি নাটকে।যেমন ধরা যাক কথক ঠাকুর গাইছেন,আবার বলছেন।বিভিন্ন চরিত্রের ভূমিকায় মেকআপ ছাড়া,পোশাক ছাড়া, অভিনয় করছেন।নাটকের ক্রিয়া এখানে অনুপস্থিত।হাতের সামান্য ভঙ্গি তথা মুদ্রার ব্যবহার করে তিনি একটি শিল্পরূপ তুলে আনছেন সকলের সামনে।পুরো ব্যাপারটা শুধু পাঠ বা গান নয়। একটা নাট্যিক ব্যাপার রয়েছে।এই গ্রামীণ সংস্কৃতির,কথকতার সঙ্গে আজকের শ্রুতি নাটকের মিল ফর্মে।এই দুটোতেই নির্ভর শুধুমাত্র কথা।এই দুটোতেই নাটক প্রিয় দর্শক শ্রোতা সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে সংলাপ।এই দুটোতেই শিল্পীরা মানানসই মেকআপ না নিয়ে চোখের দেখা কে অস্বীকার করে কণ্ঠস্বরের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ওই চরিত্রটি ওই ছবিটি দর্শক শ্রোতার সামনে মুর্ত করে তোলেন।তবে কথকতার মূল বিষয় সচরাচর আধ্যাত্বিক বা পৌরাণিক কেন্দ্রিক হলেও শ্রুতি নাটকের বিষয় একেবারেই আধুনিক রক্তমাংসের জীবন।

শ্রুতি নাটক ও বেতার নাটক:শ্রুতি নাটক ও বেতার নাটক এর মূল সাদৃশ্য-দুটি কন্ঠ নাটক।দুটিতেই চরিত্রের অঙ্গ সঞ্চালন নয় কণ্ঠের মধ্য দিয়েই মায়াময় জগতকে তুলে ধরতে হয়।তবে বেতার নাটক মাত্রেই যে শ্রুতি নাটক তা নয়।বেতার নাটকে একটু ডালপালা ছড়ানো যায় কিন্তু শ্রুতি নাটকে তুলে ধরতে হয় একেবারেই কাহিনীর নির্যাস।বেতার নাটক এর সময়সীমা ৭০ থেকে ৮০মিনিট ও হতে পারে কিন্তু শ্রুতি নাটকের সময়সীমা ২০ মিনিটের মধ্যে বেঁধে রাখতে হয়।একাধিক দীর্ঘ নাটক যেমন-শাজাহান,ডাকঘর এবং ইন্দ্রজিৎ,পুতুল খেলা ইত্যাদি বেতারে অমরত্ব লাভ করেছে।

শ্রুতি নাটকের বৈশিষ্ট্য:
১)মঞ্চে আসীন হয়ে শ্রুতিনাটক শিল্পীরা কণ্ঠস্বর এর মাধ্যমে মায়া সৃষ্টি করেন।
২)চোখের সামনে বসে থেকেও দর্শকদের দেখাটাকে তারা আবছা করে দিতে পারেন।ফুটে ওঠে নাট্য কাহিনীর সংঘাত।মূর্ত হয়ে ওঠে পোশাক-পরিচ্ছেদ সহ চরিত্রটি, শুধুমাত্র কন্ঠ অভিনয়ের চরম মুন্সিয়ানায়।
৩)মাইক্রোফোনের ব্যবহার শ্রুতিনাটক শিল্পীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।দীর্ঘদিন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এটি আয়ত্ত করা সম্ভব।
৪) শ্রুতি নাটক পোর্টেবল। যেকোনো বড় পরিসরের মঞ্চ থেকে একেবারে ঘরোয়া আসরেও পরিবেশন নৈপুণ্যে শ্রুতি নাটক সার্থক হতে পারে।
৫)অত্যন্ত কম খরচে শ্রুতি নাটক পরিবেশন করা যায়। এর জন্য নাটকের সেট লাগেনা,মেকাপ লাগে না,প্রয়োজন হয়না পোশাক-পরিচ্ছদের।
৬)খুব কম সময়ের রিহার্সালের মধ্য দিয়েই একটি শ্রুতি নাটক মঞ্চস্থ করা যেতে পারে যেহেতু শিল্পীদের হাতে স্ক্রিপ্ট থাকে তাই শ্রুতি নাটক এর শিল্পীরা হুবহু নাটকটি মুখস্ত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না।
৭)বারবার নাটকটি নিবিড় পাঠ করার ফলে নাটকটির সাথে একাত্মতা অনুভব করবেন শ্রুতিনাটক শিল্পীরা।এর ফলে যে চরিত্রে শিল্পী অভিনয় করছেন,সেই চরিত্রটি মঞ্চে উপস্থাপন করার সময় শুধুমাত্র কাগজ দেখে সংলাপ বলবেন না শ্রুতি নাটক শিল্পীরা।দর্শকদের সাথে মাঝে মাঝে ইন্টারাকশন করার জন্য তারা দর্শকদের চোখে চোখ রেখেও সংলাপটি বলতে পারেন। এর ফলে শ্রোতাদের মনে শিল্পীর প্রতি অনেক বেশি বিশ্বাস জন্মায়।
৮)মাইক্রোফোনের সামনে স্ক্রিপ্টের পাতা উল্টানোর সময় শ্রুতি নাটক শিল্পী কে অনেক বেশি সজাগ থাকতে হয়।না হলে পাতা উল্টানোর একটি আওয়াজ মাইক্রোফোনে চলে আসতে পারে যা ভালো শোনায় না।
নাট্য শাস্ত্রের রথী-মহারথীরা বলেছেন -"সোঙ্গপাদ্যভিনয়োমত: নাট্যামিত্যাভিধঁয়তে"-অর্থাৎ কায়িক অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে নাটককে।অভিনেতা তার নিজের কথা আঙ্গিক ও বাচনিক ক্রিয়ার সঙ্গে উচ্চারণ করবেন। কিন্তু যদি কোন শ্রুতি নাট্য অভিনেতা কণ্ঠস্বরের মডুলেশন এর মাধ্যমে সেই আঙ্গিক ক্রিয়ার প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, যদি বেতারের আড়ালে শুধু স্ক্রিপ্টে চোখ রেখে সহঅভিনেতাদের দিকে না তাকিয়ে যেভাবে অসংখ্য শ্রোতার সামনে রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে ওঠেন,মঞ্চে উপস্থিত থেকে সেই একই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ একটি চরিত্রকে নিপুন চিত্রকরের তুলির মত শুধু কন্ঠের সাহায্যে করে তোলেন মুর্ত,তাহলে সেই দৃশ্যমানতা অভিনয়ের কৌলিন্য পাবে না কেন?আমরা তো জানি সফল নাটকের শুরুটা হয় নাটক পাঠের মধ্য দিয়েই।স্বয়ং পরিচালক তাঁর কুশীলবদের সামনে নিয়ে এসে এক জায়গায় বসে নিজেই সমস্ত চরিত্রের কণ্ঠ অভিনয় করে দেখান। সর্বশেষে বলি,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিসর্জন নাটক পাঠের পর একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে ছিলেন, তিনি বলেন-
"দক্ষিণের দ্বার দিয়ে বায়ু আসে গান নিয়ে /কেঁপে কেঁপে ওঠে দীপশিখা,/খাতাহাতে সুর করে অবাধে যেতেছি পড়ে,কেহ নাই করিবারের টিকা।/ঘন্টা বাজে বাড়ে রাত,ফুরায় বইয়ের পাত বাহিরে নিস্তব্ধ চারিধার,/তোদের নয়নে জল,করে আসে ছল ছল শুনিয়া কাহিনী করুণার।"
-এই রসোত্তীর্ণ হওয়াই তো নাটক। সে মঞ্চে অঙ্গ সঞ্চালন এর মধ্য দিয়ে অভিনয় হোক আর কন্ঠের মধ্য দিয়ে মায়ালোক সৃষ্টি করে অভিনয় হোক। রক্ষণশীল নাট্যবোদ্ধারা যতই গেল গেল রব তুলুক না কেন,শ্রুতি নাটক বর্তমানে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয় এই বাংলা ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে সুনাম ও স্বনামেরর সাথেই জনপ্রিয় শিল্প।
 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments