জ্বলদর্চি

কিছু কথা কিছু গান আর শুভ নববর্ষ/গৌতম বাড়ই

কিছু কথা কিছু গান আর শুভ নববর্ষ

গৌতম বাড়ই

বঙ্গজীবনের অঙ্গ আর নববর্ষ মানেই হারিয়ে যাওয়া সেই একলা বৈশাখ। ধন্দে পড়তাম ঐ ১-লা বৈশাখ শব্দটি নিয়ে। আমার হারিয়ে যাওয়া একলা মনের ভিতর সেই পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ। বসন্তের উদযাপনের পর সমাপ্তির ছোঁয়ায় জেগে ওঠে চৈত্রের গাজন সন্ন্যাসীদের কলরোলে চড়কডাঙ্গার মাঠ থেকে,  আমাদের শুভ নববর্ষ। যা কিছু নতুন তাইতো শুভেচ্ছার সাথে শুভকামনা দিয়ে শুরু, সেজন্যই শুভ নববর্ষ। 

আমার কাছে বৈশাখ আসে কবিগুরুর কাব্য কথায়,
আমার মনের তানে---

"তুমি যে      সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে
এ আগুন  ছড়িয়ে গেল সবখানে।
যত সব     মরা গাছের ডালে ডালে নাচে আগুন তালে তালে,
আকাশে    হাত তোলে সে কার পানে?।"

কচি পাতায় ভরে উঠছে গাছ। আমের ডালের ফাঁকে সবুজ ছোট- ছোট আম। কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে আছে  মাঠের ধার টগরফুলে বাগান ভরে। ছোটবেলা খুব মনে পড়ে। 

তখনও টিভি আসেনি কলকাতার বাইরে ছোটো শহরে বা জেলা শহরে। পয়লা বৈশাখ ছিল ছুটির আমেজে মাখো- মাখো হয়ে একটি আনন্দ উদযাপনের দিন। বাড়ি- বাড়িতে যে যে-রকম ভাবে আয়োজন করতে পারে, একটু ভালো খাবার দাবারের ব্যাবস্থা করা হতো। অনেকটা মনে হতে পারে আমাদের বড় উৎসব দুর্গাপূজোর মতন প্রতিটি ঘরের সাধ ও সাধ্য মতন রসনার পরিতৃপ্তির জন্য যোগাড় ও আয়োজন । দুর্গাপূজোর মতন না হলেও একটু কম দামের কাপড়- চোপড় হত। নিদেনপক্ষে ঘরে পড়বার নতুন পোশাক। আমরা হাতে- হাতে কার্ড বানাতাম, গোটা- গোটা অক্ষরে লিখতাম-- "ডালে ডালে ফুল ফুটেছে, নববর্ষের ডাক উঠেছে। তুমি আমার বন্ধু হও, নববর্ষের কার্ড নাও"। তখন থেকেই জানি পৃথিবীতে বন্ধু আর বন্ধুত্বের কী ভীষণ প্রয়োজন!

বাংলা নববর্ষের স্মৃতি- বিজড়িত কথার আগে  একটু গৌরচন্দ্রিকা বর্ণনা করি। কী করে এল বাংলা নববর্ষের প্রচলন।

বাংলা নববর্ষ। বাঙালির প্রাণের উৎসব। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে নানা আয়োজনে আমরা বরণ করি নতুন বছরকে। ব্যস্ততাকে দূরে ঠেলে একদিনের জন্য আনন্দে মেতে ওঠে বাঙালি জাতি।

সম্রাট আকবরের আমল থেকে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হচ্ছে। সে সময় সম্রাট খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। প্রাচীন কিছু বর্ষপঞ্জিকার সাহায্যে তৈরি করা হয় বাংলা বর্ষপঞ্জিকা। আকবরের আমল থেকেই চৈত্র মাসের শেষদিনের মধ্যে খাজনা দিতে হতো। এর পরদিন জমির মালিকরা নিজেদের এলাকার অধিবাসীদের মিষ্টি খাওয়াতেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা ‘হালখাতা’ পালন করতেন, অর্থাৎ নতুন হিসাবের খাতা খুলতেন। তখন মূলত হালখাতারই উৎসব ছিল পহেলা বৈশাখ। এরপর ধীরে ধীরে নানা সংস্কার ও সংযোজনের পর বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয় এটি। এছাড়াও দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেয়।

হালখাতা এই একটি শব্দের সাথে ভীষণ পরিচিত ছিলাম আমরা সেই ছোট্ট বেলায়। পাড়ার মুদি খানার দোকান থেকে শুরু হত আমাদের সেই হালখাতা উপলক্ষে মিষ্টি খাওয়া। এরমধ্যে আমাদের মন আনচান করত সেইসব দোকানগুলিতে কখন ঢুকব বলে, যেখানে কোল্ড ড্রিংক দিত। বাবা দেখতাম কুড়ি টাকা, দশটাকার অথবা কোথাও পঞ্চাশ টাকার নোট  এইসব দোকানে দিয়ে হয়ত খাতাই খুলত। তারপর কোথাও বসে খাওয়ার ব্যবস্থা আবার কোথাও মিষ্টির প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিত। আর দোকানীরা একটা লাল খাতা খুলে টাকা পাওয়ার পর কিসব হিসেব লিখে রাখত। তখন বুঝতাম না, পরে বুঝেছি ওটাই হল হালখাতা। নতুন বছরের নতুন হিসেব। একদিক দিয়ে ইংরেজী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন আর্থিক বছর আর বাংলা ক্যালেন্ডার মেনে সেই আর্থিক বছর তো কাছাকাছিই। হ্যাপী নিউ- ইয়ারের উদযাপনের কাছে বাংলা নববর্ষ অনেক ম্লান হয়ত এখন, তবে মুছে যায়নি একটু আধটু চল আর উদযাপনের রেওয়াজ এখনও আছে। আমরাও স্যাটেলাইট আর অন্তর্জাল পেয়ে এখন আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছি, হয়ত তার প্রভাব হবে। তবে আবার সেই পুরানো কথায় ফিরে আসছি,আমাদের দু- ভাইয়ের হাতে রঙ- বেরঙের নানান ক্যালেন্ডার শোভা পেত বাড়ি ফিরবার সময় সেই পয়লা বৈশাখের রাতে। তাতে বেশিরভাগ বিভিন্ন দেবদেবীর, মহাপুরুষের ছবির প্রাধান্য বেশি। একবার পেয়েছিলাম যমরাজার ছবির সিরিজ যেখানে যমরাজ পাপীদের ধরে সাজা দিচ্ছেন। একজন লোককে ধরে গরম তেলের কড়াইতে ছুঁড়ছেন। দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম। আজ এইসময়ে দাঁড়িয়ে ঐ না ভোলা ছবির কথা মনে পড়লেই মুচকি হাসি। একবার পেয়েছিলাম একটি ল্যান্ডস্কেপের খুব সুন্দর এক পেইন্টিং। পরে ক্যালেন্ডারের ঐ ছবির অংশটি কেটে ঘরের দরজায় আঁঠা দিয়ে লাগিয়েছিলাম। বহুদিন ছিল, হয়ত দু- তিনটি বছর।
এইসব স্মৃতি খুব মনে পড়ে। আরও কিছু অন্য রকম স্মৃতির গল্পকথা বলি।

আমাদের গ্রামাফোন রেকর্ড প্লেয়ার ছিল না, ছিল আমাদের প্রতিবেশি ভট্টাচার্য্য জেঠুদের বাড়ি। ভট্টাচার্য্য জেঠুদের বাড়ি গান বাজনার  ভীষণ চর্চা হত। চন্দন-দা ও মনা-দি সকাল থেকেই গানের রেওয়াজে বসত, আর ঐ দিন পয়েলা বৈশাখের বিশেষ দিনে খুব সুন্দর গানে একের পর এক শুনে মন আনন্দে ভরে যেত। আর জেঠু- জেঠীমাদের বাড়ি ছিল আমাদের ভাইবোনের অবারিত দ্বার। কোনদিনও মনে হয়নি আমাদের সাথে রক্তের বন্ধন নেই। আমি এইসব ছোটোখাটো ঘটনা দিয়ে- দিয়ে বুঝতে শিখেছিলাম, আত্মা- আত্মীয় এইসব মিছে কথা, চিরন্তন ধারনা। আসলে সব মানুষ- ই একটা নিখাদ মানুষ খোঁজে, আর চায় অকৃত্রিম প্রাণের টান। যেমন দাদা- দিদি আমাদের বাড়িটিকে নিজের বাড়ি মনে করত , আমরা দু-ভাই ও বোনে তাই মনে করতাম। এক সকালে ঐ বিশেষ দিনে পয়লা বৈশাখের সকালে  শুনলাম পাশের বাড়ি দিদি গান গাইছে-- ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে, আর এই গান শুনে তখন তার মর্মার্থও বুঝিনি, তার সুরে শব্দে একদম অন্তরে কী যে এক ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ল, তার রেশ এখনও আছে। পরে আবদার করে রেকর্ড প্লেয়ারে সেদিন দুপুরে আবার শুনি। হয়ত এটাকেই বলে ক্লাসিক বা চিরায়ত সৃষ্টি। যে ভালোলাগা ভালোবাসা আজীবন থেকে যায়। পুজোর সময় এইচএমভি থেকে পূজার গানের বই বেরোত। তাতে গানগুলো পুরোটাই থাকত। সেই পয়েলা বৈশাখের দুপুরে গ্রামোফোনে রেকর্ড প্লেয়ারে জেঠুদের বাড়ির সংগ্রহে থাকা গানগুলি বাজত। আমি হা করে ঐ বিস্ময়কর প্রভুভক্ত কুকুরের দেখে তাকিয়ে গান শুনতাম। তারপর  আমরা দুটো পরিবার একসাথে খাওয়া- দাওয়া করতাম আর হৈ চৈ- এ মেতে উঠতাম। তাতে মা এবং জেঠীমা দু- জনের অনেকগুচ্ছের নানারকম রান্না থাকত। 

এখন ভাবি প্রযুক্তি বিজ্ঞান আমাদের অনেক এগিয়ে দিয়েছে আমরা বলি ঠিকই, অথচ আমরা পরস্পর থেকে কতই দূরে সরে গিয়েছি। সম্পর্কগুলো কত জটিল হয়েছে। সাম্প্রতিক এই এখনও বহমান অতিমারি কোভিড তার বড় প্রমাণ!

এই যে পয়লা বৈশাখ, এই যে বাঙালির শুভ- নববর্ষের উদযাপন, সেখানে আমাদের পড়শী একদম বাঙালীদের আপন দেশের একটু কথা না বললে এ লেখা অসম্পূর্ণ থাকে, তাই একটু এখানে বলছি।
 
বৈশাখের প্রথম দিনে ভোরে উঠেই পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে বাঙলাদেশের বাঙালিদের। এছাড়া পহেলা বৈশাখে বাঙালি মেয়েদের মধ্যে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ার প্রচলন আছে। এখন অবশ্য সবাই লাল-সাদা পোশাক পরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করেন।

আর গানে- গানে মেতে ওঠে বাঙালিরা। ঢাকার রাস্তায় শোনা যায় --- আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি তুমি কী অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী---

এই হল আমাদের নববর্ষ। আমাদের শুভ নববর্ষ। শুভ হোক মঙ্গল হোক এই আমাদের নববর্ষের প্রথম দিনের একমাত্র কামনা সমস্ত বাঙালি প্রাণে।  শুভকামনা। সবাই ভালো থাকুন আর ভ্রাতৃত্ব বোধে জেগে উঠুন। এই হোক পহেলার শপথ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments