জ্বলদর্চি

পুরোনো সেই নতুন বছরগুলো/মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

পুরোনো সেই নতুন বছরগুলো

মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস

সেই যে আমাদের ছেলেবেলা৷ সবার কাছে সব্বার ছেলেবেলাটা বড্ড প্রিয়৷ যাদের খুব কষ্টে দিন কেটেছে তাদেরও৷ আর সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই অবশ্যই মনে আসে পয়লা বৈশাখের কথা৷ 
ছোটবেলায় অনেকেই বলতাম একলা বৈশাখ৷
তখনও আমাদের মহকুমা শহরে আধুনিকতার উদ্দাম ছোঁয়া লাগেনি৷ স্টেশন বাসস্ট্যান্ড থেকে পাকা রাস্তা ছুট লাগিয়েছিল শহরের মাঝ দিয়ে বড় বাজার হয়ে শহর শেষে গঙ্গার খেয়াঘাটের দিকে৷
রাস্তার দুই ধারে দোকানে দোকানে শাটার বসানোর তাগিদ শুরু হয়নি৷ কাঠের ভাঁজ করা পাল্লা দেওয়া দোকান ঘরগুলো পরিস্কার করার ব্যস্ততা শুরু হত চৈত্রর শেষাশেষি৷ দোকানের জিনিসপত্র রাস্তার ধারে জড়ো করে ঝাড়পোঁচ রঙের প্রলেপ৷ মাঝরাত অদ্ধি গোছাগুছি৷ বাড়িতে বাড়িতেও পরিস্কারের পালা চলত৷ অশোকষষ্ঠী, নীলপুজো, চড়ক এলো মানেই বছর শেষ হয়ে যাবে৷ আর নতুন বছর শুরু হবে৷
মোটামুটি আমাদের মতো বাড়ির ছেলেমেয়েদের তখন বছরে দু'তিন বারই নতুন জামা জুটতো৷ জন্মদিন, পুজো আর পয়লা বৈশাখে৷ নতুন জামা হত গরমে পরার মতো নরম সরম হালকা রঙের৷

আমাদের বাংলা মিডিয়াম সরকারি স্কুলে নববর্ষের ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিত বড়োরা৷ আর অামরা অনেকেই প্রস্তুতি নিতাম শুভেচ্ছা জানাবার৷
পাড়ার খাতা পেনের দোকানে নববর্ষের কার্ড আর টাঙানো দেখি না এখন৷ কিন্তু আমাদের সময় চার পাঁচ টাকায় বেশ কিছু কার্ড হয়ে যেত৷ কেউ কেউ তাও কিনতাম না৷ বদলে আর্ট পেপার কিনে এনে ছোট ছোট করে কেটে এঁকে ফেলতাম ফুলের তোড়া বা সিনারি৷ অপটু হাতের সেই রকম কার্ডই ফেরত পেতাম বন্ধুদের থেকে৷ 

তবে কার্ড দেওয়া নেওয়ার আগে থাকত আরও মিষ্টি মিষ্টি ঘটনা৷ ভোর থাকতে মা কাকীমারা নতুনখাতার পুজো করাতে কালীবাড়ি যেত৷ আর সকাল সকাল আমরা যেতাম ইস্কুলে৷

ছোট্ট প্রভাতী অনুষ্ঠানের পর সার বেঁধে দাঁড়ালে দিদিমণিরা লাড্ডু আর আইসক্রিম দিতেন হাতে৷ কাঠির মাথায় বরফে নারকেল কুচো দেওয়া সেই সব আইসক্রিম আজও হাতছানি দেয় বাস্কিন রবিনসের কর্ণারে বসেও৷ সেগুলো পেটে পুরে তবেই আমাদের কার্ড দেওয়া নেওয়া শুরু হত৷

বেলা বাড়তে বাড়ি ফিরতে হতো আনন্দ কমত না৷ কারণ বাড়িতে লোকের আনাগোনা লেগে যেত৷
আমার দাদুর ডিসপেনসারিতে হালখাতা হত (এখন কোনো চিকিৎসক ভাবতেও পারবেন না)৷ আর বালতি বালতি মিষ্টি মাটির ভাঁড়ে করে সারা বছরের নিয়মিত রোগীদের মধ্যে বিলি হত৷

এরপর থাকত আরও মজার বিকেল৷ আমপাতা আর সোলার সাজ ঝোলানো হরেক দোকানের হরেক বাক্সবন্দি মিষ্টি আর দেব দেবীর ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার এসে পৌঁছাতো বাড়িতে৷ ছোটদের মনের মতো কড়া কড়া মিষ্টি৷ বেশ কিছুদিনের খোরাক হয়ে যেত৷

সেই সব সুন্দর নববর্ষের দিন আর পাওয়া যাবে না৷ মেসেঞ্জারে হোয়াটসঅ্যাপে রঙিন কত ভিডিও জিফি আর ছবি ভরা মিষ্টি বার্তা আসবে শুভকামনা জ্ঞাপনের৷ কিন্তু সেই সব আঁকাবাঁকা অক্ষরে ছড়ায় লেখা নববর্ষের বার্তা কোনো বন্ধু আর বাড়িতে পৌঁছাতে আসবে না৷ মহার্ঘ কেক আইসক্রিম ঠান্ডা পানীয় দিয়ে নতুন বাংলা 'সাল গিরা' উদযাপন হবে, কিন্তু মনের মধ্যে বরফ দেওয়া লস্যি আর নারকেল দেওয়া কাঠি আইসক্রিম মন কেমনের গন্ধ ভরাবে৷
সাল ভুলে যাব তবু বাংলায় নতুন বছর আসবে আমাদের শপিং মলে মলে চৈত্র সেলের শেষ প্রহরে৷

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments