জ্বলদর্চি

প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ। শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণ করলেন এসময়ের স্বনামধন্য বিশিষ্ট কবি ও লেখকবৃন্দ

প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ। 
শ্রদ্ধা জানালেন বিশিষ্ট কবি, লেখক, প্রাক্তন ছাত্র প্রমুখ।


বিশিষ্ট কবি, সাহিত্য সমালোচক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ শঙ্খ ঘোষ আজ (২১ এপ্রিল ২০২১) সকালে কলকাতায় নিজ বাসভবনে প্রয়াত হয়েছেন। বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তাঁর প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। 

শঙ্খবাবু যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ --বাবরের প্রার্থনা, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, ধূম লেগেছে হৃদকমলে, কবির অভিপ্রায়, ছন্দের বারান্দা ইত্যাদি। 

জ্ঞানপীঠ, পদ্মভূষণ, দেশিকোত্তম, সাহিত্য অকাদেমি, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার তিনি ভূষিত হয়েছেন।  

 তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ সমগ্র দেশবাসী। শ্রদ্ধা জানালেন বিশিষ্ট কবি, লেখক, প্রাক্তন ছাত্র।

আমাদের শঙ্খদা থাকবেন
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
(কথাসাহিত্যিক) 

শঙ্খ ঘোষ প্রায় নব্বই বছর বয়সে প্রয়াত হলেন । আয়ুষ্কালের সবটুকু সময়েই তিনি সৃজনশীল ছিলেন, একথা বলাই যায়। তা বলে নিজের নাম ভাসিয়ে রাখার জন্য কখনওই লিখতেন না । মিতবাক, সুভদ্র, বিনম্র এমন সুজনও আজকাল দেখতে পাইনা। অহংকার তাঁকে কখনওই স্পর্শই করতে পারল না। কত বড় কবি তিনি? পরিমাপ করি, এমন মানদণ্ড তো হাতে নেই ! তবে কবিতার ভিতর দিয়েই তিনি আমাদের একান্ত এবং একাত্ম হতে পেরেছিলেন। শরীরে রইলেন না, তাতে কি ? শরীরের পরেও কিন্তু কেউকেউ ভীষণভাবে থেকে যায়। আমাদের শঙ্খদাও থাকবেন। স্মৃতিতে, স্মরণে, মননে, পুনঃপাঠে।

কবির হয়ে, সমকালকে
অনিতা অগ্নিহোত্রী
(কবি ও কথাসাহিত্যিক)

আগুনের কাছে কবিকে পৌঁছে দিলেন তাঁর প্রিয় জনেরা আর তাঁর অন্তিম ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে নীরব রইল রাষ্ট্রীয় তোপধ্বনি। আমাদের যে চেতনা ক্ষমতার সান্নিধ্যের আকিঞ্চন মুগ্ধ, তার কাছে হেঁয়ালির মত লাগবে, নীরবতা কিভাবে কবির মর্যাদার বাহক হতে পারে। শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য দেখছে শাখা প্রশাখা ছড়ানো মাটির গভীরে শিকড় ছড়ানো এক বৃক্ষের দাউ দাউ জ্বলে ওঠা। আমরা শোকার্ত! আমরা অভিভাবকহীন। কিন্তু এবার সময় হল আমাদের প্রাপ্ত মনস্কতার। তিনি যে হাতটি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তরুণ কবি লেখকদের, তেমন হাত কি আমাদেরও নেই? কবিতার মধ্যে জীবনের জয়গানে কেমন বেজে ওঠে স্বাধীন চেতনার নির্ভীক উচ্চারণ, তা  শেখা কি অসম্ভব? বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে চেনা যায় ভারতবর্ষকে, তার গণতন্ত্রের জন-বিমুখতাকে?  বোঝা যায় এক বুদ্ধিজীবীর নিরপেক্ষতা কোন্ মৃত্তিকায় তৈরী?

শঙ্খ ঘোষ সাত দশক জুড়ে আমাদের সব কিছু দিয়েছেন তাঁর— মনন, নির্মাণ, কণ্ঠস্বর। আমরা তাঁর স্মৃতিকে কি দেবো? তাঁর হয়ে কি দেব সমকালকে? তোপধ্বনি থেমে যাওয়া সন্ধ্যায় এবার কিছু সময় বসি, ভাবি।

মনুষ্যত্বহীনতার বিরুদ্ধে দ্বিধাহীন
প্রভাত মিশ্র
(বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক) 

উৎপলকুমার বসু তাঁকে সার্থক অভিধা দিয়েছিলেন: পঞ্চাশ দশকের ' প্রথম ভোরের পাখি'। সে-সময় খ্যাতিমান কবিগণ রচনা করেছিলেন কেবল ব্যক্তিজীবনের দিনলিপি । তাঁর  'নিহিত পাতালছায়া' ও ' দিনগুলি রাতগুলি' কাব্যগ্রন্থেও তেমন উচ্চারণ ছিল। কিন্তু তাঁর বারবার মনে হচ্ছিল , 'সত্যি  বলা ছাড়া আর কোন কাজ নেই কবিতার।' শেষ পর্যন্ত তিনি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছিলেন,  'রাজনৈতিক সমাজনৈতিক সমস্ত দিকেই আমাদের জীবন যাপনের যে অসত্য প্রকৃতি,তার সমস্যাকে এড়িয়ে থাকা মানেই সত্যের পাশ কাটিয়ে যাওয়া, ঐতিহাসিক পটের মধ্যে দাঁড়িয়ে গোটা জীবনের অ্যাম্বুগুইটিকে অস্বীকার করাও তেমনি এক পাশ কাটানোর কারণ।' তাই সাম্প্রতিক ভারতবর্ষে যে অসাধু অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে লেখক-কবিদের সজাগ ও প্রতিবাদী হ ওয়া দরকার : এরকম মন্তব্য তিনি করেছিলেন জ্ঞানপীঠ গ্রহণের পর । তার-ও আগে ১৯৭৬এ জরুরি অবস্থা চলাকালীন ইন্দিরা গান্ধীর আহূত বুদ্ধিজীবীদের সভায় আমন্ত্রিত হয়েও উপস্থিত থাকেন নি তিনি । যে কোন প্রকার সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মনুষ্যত্বহীনতার বিরুদ্ধে দ্বিধাহীনভাবে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার।

  আজ আর 'কবি ছাড়া জয় বৃথা ' উচ্চারণ করব আমরা কোন্ কবির দিকে তাকিয়ে?  চলে গেলেন তিনি । শঙ্খ ঘোষ । আমাদের কালের শঙ্খের ধ্বনি।বড় মনে পড়ছে , একুশ শতকের প্রথমেই শুনেছিলাম তাঁর এমন ধ্বনি : ' আমাদের ডানপাশে ধস্ / আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ /আমাদের মাথায় বোমারু/ পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ/ আমাদের পথ নেই কোনো/ আমাদের ঘর গেছে উড়ে/ আমাদের শিশুদের শব/ ছড়ানো রয়েছে দূরে দূরে /আমরাও তবে এইভাবে/ এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি ?/ আমাদের পথ নেই আর/ আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।

এখন আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না, অথচ স্মৃতির ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছি

শংকর চক্রবর্তী
(বিশিষ্ট কবি, গল্পকার)

তাঁর অভাবে বাংলা সাহিত্যের কতটা ক্ষতি হল তা উপলব্ধি করতে পারবেন প্রত্যেকেই। প্রকৃত অর্থে কবি-লেখকদের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি নিঃস্ব হলাম। আমার শেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে গেল। যখন তখন ছুটে গিয়ে নিজের আগল খুলে দেবার মতন আস্কারা পাবো না আর।  তাঁর কাছে জেনেছি কীভাবে একজন সৎ ও ভালোমানুষ হয়ে বেঁচে থাকা যায়। 

দুঃখের কোনো শেষ নেই। মহামারীর কারণে শেষ প্রণামও জানিয়ে আসতে পারলাম না। অথচ বছর ছয়েক আগে আমি যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, দ্বিতীয় দিনেই ছুটে এসেছিলেন। অক্সিজেন-নেওয়া অবস্থায় চোখ খুলে দেখেছিলাম তিনি আমার কপাল ও মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আজকের মতো সেদিনও আমার দু'চোখ উপচে উঠেছিল।
অশ্রুসজল নীরবতা
বিকাশ গায়েন
(বিশিষ্ট কবি)

যদিও বয়স একটি সংখ্যা মাত্র, তবু তারও দাবী থাকে। আয়ুর তুলাদন্ডে জীবনকে মেপে চলার পর্বটি শেষ হতেই হয়। কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণ সে অর্থে প্রাকৃতিক নিয়মেরই অনুবর্তন। শরীরী বিনাশজনিত মুহূর্তের বিহ্বলতা কেটে যাবার পর ব্যক্তিবিশেষের পুনর্জাগরণ ঘটে  তার এপর্যন্ত সম্পাদিত কর্মের উজ্জ্বল প্রাসঙ্গিকতায়। ক্ষুদ্র পরিচিতির বৃত্ত প্রসারিত হয়ে ব্যক্তিমানুষের বৃহত্তর পরিচিতি অর্জনে ফলদাত্রীর ভূমিকা নেয় মানুষটির নিজস্ব নিভৃতসাধনা। সেই সাধনায় সিদ্ধ হয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ কী শিক্ষকতা কর্মে, কী কাব্যরচনায়, কী স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী অর্জনে, কী মতপ্রকাশের দৃঢ়তায়, কী বিবেকী ও মানবিক উচ্চারণে।

     'কবি 'বিশেষণের একটিমাত্র আধারে শুধু মাত্র আধেয়কৃত না হয়ে তাঁর উপস্থিতি ছিল সদাজাগ্রত বিবেকীসত্তার। নীরস পান্ডিত্যের উচ্চগর্বী দূরত্বের ব্যবধান ব্যতিরেকে তার ঘরোয়া আলাপচারিতার দীপ্তি আভাসিত কথনভঙ্গী সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কিত বহুপ্রশ্নের উত্তরকে যেমন সম্ভব করে গেছে এতকাল, তেমনি তার কবিত্ব শক্তিও কল্পনা পারঙ্গমতাকে বহন করেও অবিরত স্পর্শ করে এগিয়েছে পাত্র, দেশ কাল।
দিনগুলি রাতগুলি ",নিহিত পাতাল ছায়া", বাবরের প্রার্থনা "পাঁজরে দাড়ের শব্দ" হয়ে যতই তার যাত্রা প্রসারিত হয়েছে গান্ধর্বকবিতাগুচ্ছ সহ নানান কাব্যগ্রন্থের অনুচ্চকিত প্রকাশের দিকে ততই পাঠকের কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে মানবিক প্রজ্ঞার আভাময় ভুবন। অন্তঃস্রাবী কাব্যরস ও সজ্ঞান নির্মিতির  যুগল মিলনে একাধারে ধ্বনিত হতে দেখা যায়  মানবিক বোধের উজ্জীবন এবং সমকাল  ও সমাজকে দেখার বিশ্লেষণী ভাষ্য। ছন্দের বারান্দায় বসে প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দের নিহিত সত্যটিকে আবিষ্কার করার মধ্যেই ব্যাপৃত থাকাই ছিল তার জীবনের অণ্বিষ্ট। তার  কবিতার মুহূর্তগুলি তো আসলে জীবনের প্রবহমানতায় সাক্ষী থাকা নানা ঘটনা বা পরিস্থিতি বিশেষের প্রতি চূড়ান্ত অভিনিবেশের দৃষ্টান্ত ছাড়াও বোধি অর্জনেরও নান্দিপাঠ। ভঙ্গী দিয়ে ভোলানোর যোজন দূরবর্তী অবস্থানে থেকেও তার উপস্থিতি ছিল বিশ্ববীক্ষায় প্রোজ্জ্বল। 

   শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণের ঘটনা আমাদের তাঁর শারিরীক সান্নিধ্যলাভের আকাঙ্খাতে যতি টানলেও প্রাত্যহিক পঠনঅভ্যাসে তাঁর বৌদ্ধিক ও অনুভবী উপস্থিতির অনিবার্যতাকে আমরা পাশ কাটিয়ে যেতে পারবো না কোনভাবেই। "নিবিড়ের সজলতা " সজলতা ছেড়ে তাঁর এই চলে যাওয়ায় আমাদের নিবিড়তাগুলি বহুদিন হয়ে থাকবে অশ্রুসজল।

স্মৃতি : সহকর্মী শঙ্খ ঘোষ
সমীর রক্ষিত
(কথাসাহিত্যিক)

 যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী শঙ্খ ঘোষের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মে অংশগ্রহণের সূত্রে কাছাকাছি এসেছি। দেখেছি তাঁর আশ্চর্য সহযোগ। সেবার আমি শিক্ষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। শিক্ষা ও সাহিত্যানুরাগীদের সহযোগিতায় আমরা 'মুখপত্র' নামে একটি কাগজ  প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। আমাকে অবাক করে দিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলে ওঠেন -- "আমি মুখপত্রের প্রুফ দেখে দেব।" তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে তাঁর প্রতি আমার গভীর শোক জ্ঞাপন করছি।

আমার প্রিয় শঙ্খদা
দীপ মুখোপাধ্যায় 
(ছড়াকার)

কবি শঙ্খ ঘোষ, চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। সব অন্ধকার লাগছে। কী অসহনীয়, কী মর্মান্তিক ও কী মর্মন্তুদ এই চলে যাওয়া! করোনা কেড়ে নিল তাঁর প্রাণ! আমার অভিভাবক, আমার প্রেরণা, আমার দিক নির্দেশক শঙ্খ ঘোষ। এমন জ্ঞানী, হৃদয়বান, মিতবাক, বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কবি শঙ্খ ঘোষ, প্রিয় শঙ্খদা, যতদিন বেঁচে আছি আপনাকে ভুলবো না। করোনাকে অভিশাপ দিই বিনা অপরাধে আপনার জীবন কেড়ে নেওয়ার জন্যে। অজস্র প্রণতি শঙ্খদা।চোখের জলে বিদায় জানাই আপনাকে! আমার প্রিয়তম মানুষ-দেবতাকে!!!!


দিন ফুরোলো
ড. বাণেশ্বর দাস
প্রাক্তনী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়(বাংলা বিভাগ)
সহ প্রধান শিক্ষক, কাঁথি হাইস্কুল,পূর্ব মেদিনীপুর 

জীবনের এক চরম দুঃখের দিন।
কবি শঙ্খ ঘোষ চলে গেলেন। ছাত্র জীবনের দীর্ঘ সাত বছর (১৯৮৮-১৯৯৫)উনার আশীর্বাদের ছায়ায় কেটেছে।
কত স্মৃতি......
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে বাংলা পড়তে যাওয়া। কিছুই না বুঝতে পারা, অসহায়তা। বোকার মতো উইংসান পেনের খাপটা চোখের কোনে লাগিয়ে ঠান্ডা অনুভব।
এলেন ক্লাশে সৌম্য মূর্তি স্মিত হাসি শঙ্খ বাবু।পরিচয় পর্বে মনে হয়েছিল কত জন্মের যেন চেনা।
তারপর ক্লাশের শেষে যাওয়ার সময় আমাকে দেখা করতে বলা।
গিয়ে প্রণাম করে দাঁড়াতেই বললেন-- "আমরা যা পড়াই তুমি মনে হয় কিছু বুঝতে পারো না। তুমি কি সায়েন্স থেকে এসেছো?"
সেই জানলাম, প্রকৃত গুরু চোখ দেখেই জানতে পারেন শিষ্যের অন্তর!
তারপর সাহিত্য পাঠের গোড়ার রূপ- রীতি -পদ্ধতি সুন্দর করে বলে দেওয়া এবং শেষে বাম কাঁধে হাত রেখে বললেন-- "ভয় কি! তুমি পারবে। আমরা তো আছি"
সেই পরশ আজো আমার স্মৃতিতে জীবন্ত।
কলেজ স্ট্রিট যাবো। হঠাৎ স্যার বললেন" আমার জন্য বিশ্বভারতী স্টল থেকে দুটো 'রক্তকরবী' ব‌ই আনবে। এই সুযোগ যেন চরম পাওয়া। তবুও বিস্ময় জড়িত প্রশ্ন-দুটো ব‌ই কেন?
উত্তর এলো কর্ম থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে। জানলাম, প্রতি বছর তিনি 'রক্তকরবী' পড়াতে শুরু করতেন এক নতুন ব‌ই দিয়ে। প্রতি ক্লাশের শেষে তারিখ লিখে রাখতেন।
তাই উনাকে কোনো দিন ক্লাশে এসে ছাত্রদের প্রশ্ন করতে শুনিনি--" কোথায় পড়াচ্ছিলাম বলতো?"-- যা আমরা বেশিরভাগ শিক্ষক বলে থাকি।
অবসর দিনের ছোট ছোট কত কথা, যা স্মৃতির মধুভান্ড যেন-
  ১. যে শিক্ষক নামের কাঙালি নয়, সে কখনো ভালো শিক্ষক হতে পারবে না।
২. শিক্ষক মনে মনে ছাত্রকে ভয় করবে। ভাববে একটা ক্লাশের সব ছাত্র মিলে এক শক্তি। তার পরিমাণ যে কোনো শিক্ষকের চেয়ে বেশি।
৩. শিক্ষক শিক্ষা দেয় না, শিক্ষা লাভে সহায়ক মাত্র।
৪. যত বড়ো খেলোয়াড় হোক না কেন সে অনুশীলন করেই যেমন মাঠে নামে, তেমনি যতবড়ো তুমি শিক্ষক হ‌ওনা কেন, তুমি প্রস্তুতি নিয়েই ক্লাশে যাবে।
এমনি আরো আরো কত কথা...

শঙ্খ বাবু শিক্ষকতায় জাদুকর। ছুঁয়ে দিয়েই তিনি জাগাতে পারতেন ছাত্রের ঘুমন্ত সত্তা

আজ এই আপনজন সব সীমানার ওপারে মুক্ত পথে বন্ধন বিহীন।আজ মন খারাপের গর্তে দাঁড়িয়ে আমার হয়ে ওঠার পথের ধ্রুবতারার চরণে মাথানত প্রণাম জানিয়ে বলি--
      " নয়ন সন্মুখে তুমি নাই।
           নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই"
     "তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম"

         বাঙালির সাহিত্য জগতের সুবর্ণ পর্বের শেষ সূর্য আজ অস্তমিত। 
অস্তমিত শিরদাঁড়া সোজা করে চলে যাওয়া এক নীরব পৌরুষ। অস্তমিত এক দুর্লভ শিক্ষক।
তাঁর অমর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

বিবেকী কন্ঠস্বর যেন জাতির কন্ঠস্বর হয়

সায়ন 
(কবি, প্রাবন্ধিক)

শঙ্খ ঘোষ আমাদের ছেড়ে বিদায় নিলেন। নশ্বর দেহ আর অবিনশ্বর ভাষার মধ্যে যে সরলরেখা তার প্রতিটি বিন্দুর মধ্যে দিয়ে একটা বাঙালি জাতির বিবর্তন ঘটবে। এই ভয়াবহ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যখন আমাদের মনে হচ্ছে " সভ্য একটা শতাব্দী শেষ হলো/ আমরা আজও কক্ষনো নই আমি!" তখনই আরও বেঁধে বেঁধে থাকার অঙ্গীকারবদ্ধ করতে হয় নিজের হৃদয়।

শঙ্খ ঘোষ একটি জাতির সামনে রেখে গেলেন সাংস্কৃতিক আত্মপরিচযে়র দলিল। কবিতা থেকে গদ্য আপামর মানবতার একটি সৎ কন্ঠস্বর চিহ্নিত করে দিয়েছেন - যে কন্ঠ অনায়াসে 'বিষের ভাঁড়' কে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে। 

সোজা কথা বলাটা যে খুব কঠিন নয়, তার চর্চা করার পথ নির্দেশ আমরা তাঁর প্রতিটা সৃষ্টির পাতায় পাতায় অনুভব করতে পারি। তিনি কত অবলীলায় বলতে পারেন " কবিকে তাই জেনে নিতে হয় যে সকলের কথা বলা আর সকলের জন্যে বলা একই জিনিস নয়।" যখন একটা নৃশংস সময় দেশ জুড়ে আমাদের গলা চেপে বসার চেষ্টা করছে, আমাদের হাতে, মানবিক ম্যনিফেস্টোর মতো থাকুক 'দিনগুলি রাতগুলি', 'নিহিত পাতালছায়া' কিংবা 'প্রতি প্রশ্নে কেঁপে ওঠে ভিটে'।
ঘরে ঘরে আজও সকাল সন্ধ্যা শঙ্খ বাজে
সন্দীপ কাঞ্জিলাল
(কবি ও লেখক)

"আমার বাঁধাধরা তোমারই হাতে/ স্মরণ রেখো বান্দাকে।" সত্যি তো কবির বাঁচা মরা আমাদের হাতে। আমরা তাকে কি মরতে দিতে পারি? পারি না। কারণ কবিতার নামে কবিতাকে ধ্বংস করার যে উদ্যোগ চারদিকে চলছে, কবিতাকে বাঁচানোর তিনিই তো ছিলেন একজন সজাগ প্রহরী। এখন প্রচুর কবিতা লেখা হচ্ছে, কিন্তু লিখে কি হবে যদি সেই কবিতায় আমরা বর্তমান সময়কে না খুঁজে পাই। তিনি মনে করতেন কবিতায় কোনো স্থায়ী বীজমন্ত্র নেই। কবি এক সাক্ষাৎকারে বললেন, --
 "ভাঙবার শুধু সময় চাই।/ এ রাস্তা থেকে ও রাস্তায়/ হব কদিনের বাসিন্দা/ কে না জানে সব অনিত্য।" 

আজকাল ভোটের সময় যখন নেতারা বলেন, জনতা জনার্দন - নারায়ণ, তাই গলায় বস্ত্র দিয়ে হাতজোড় করে জনতার সামনে ভোট ভিক্ষা করে। কিন্তু ভোট জেতার পর তারাই হয়ে যান নারায়ণ। আর তাদের সাগরেদরা নারায়ণী সেনা। তাই কবি গুজরাট দাঙ্গার পর লেখেন- "নারায়ণ নয়, আমি পেয়ে গেছি নারায়ণী সেনা।/ যতদূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসেনা কোন/ কূটতর্ক নিয়ে,...যদি বলি দিন বলে দেয় দিন/ যদি বলি রাত, বলে রাত।" 
আজকাল প্রচুর কবি সম্মেলন হয়। আর, দুই মলাটের ভিতর থাকা কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিরন্তর প্রয়াস। কিন্তু পাঠক পড়েন সব কবিতা! 
আর কবি শঙ্খ ঘোষ বলেন,- "একথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে/ সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।" কবির এই কথা শুনে মনে হয়, সহজ করে সবাই লিখতে বা বলতে পারে না। যা আমরা কবি শঙ্খ ঘোষের কাছে পেয়েছি। 

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, 'বার্গম্যান' এর সেই বিখ্যাত উক্তি- "জনতা বসে বসে নান্দনিক ভাবে লেহন করতে পারে এমন শিল্পকর্ম আমি তৈরি করতে চাই না, আমি তাদের পিঠের তলদেশে একটি ধাক্কা মারতে চাই, যাতে তাদের ঔদাসীন্য পুড়ে খাক হয়ে যায়, তাদের আত্মতুষ্টি ভেঙে গিয়ে তারা চমকে ওঠে।" তারই প্রতিধ্বনি পড়ি কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতায়- "তিন রাউন্ড গুলি খেয়ে তেইশ জন মরে যায়, লোকে/এত বজ্জাত হয়েছে।" 
এত বিমুর্ত ও মূর্ত, এত স্পর্শ ঘন, এত ইশারাভরা  জন্ম-মৃত্যু পার হয়ে বেঁচে থাকার আলোর উৎস উতসারিত হয়ে উচ্চারিত হয়, বেঁচে থাকার কবিতা নয়- মন্ত্র। তাই তো ঘরে ঘরে আজও সন্ধ্যা সকাল শঙ্খ বেজে যায়।

শঙ্খধ্বনি কাড়ল তবে অতিমারির সন্ত্রাসে
গৌতম বাড়ই
(কবি, লেখক)

তিনি ছিলেন আমরা ছিলাম,
বেশ ছিলাম, অভিভাবক তো একটাই।
কিন্তু এখন?
আর এখন?

শহরের মুখ না হয় এখনও ঢাকে
রাজনীতির সব বিজ্ঞাপনে
শেষ প্রতিভূ বলছি ঠিক
কাব্যপ্রভু সত্যি বটে
সিংহাসনটা রইলো পড়ে 
রাজা এখন শ্মশানভূমে
উড়ছে ছাই দেখছে সবাই 
অতিমারির নীরবগ্রাস
কোভিড নাকি কাব্যসন্ত্রাস!

শূন্যস্থানে পুড়ব আমরা 
তোমার কাব্যবিহীন 
নরমেধের ধরাধামে
শঙ্খকবি বিদায় নিলে 
আমাদের এই অনাথ ফেলে

শতকোটি প্রণাম কবি 
তোমার কাব্যের পুণ্যশ্লোকে
অভিভাবক কে ভাবছি বসে 
চোখের জলে স্নায়ুর কোষে
বিদায় বেলার যে রাগিণী 
শঙ্খছাড়াই বিষাদ বাজে----

হারালাম অভিভাবককে
তপোধীর ভট্টাচার্য 
(প্রাবন্ধিক)

অতিমারি করোনা আজ সকালে বিপন্ন বাঙালির অভিভাবক কবি ও প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্রতীর্থপথের প্রশস্যতম ভাবুক শঙ্খ ঘোষকে ছিনিয়ে নিল আমাদের কাছ থেকে। এই আভূমিতল রিক্ততাকে কোন ভাষায় প্রকাশ করব? আপৎকালে তিনি এতদিন আমাদের ধ্রুবতারা হয়ে পথ নির্দেশ করেছেন। আর কোনো বাতিঘর রইল না: হাহাকারের মতো গ্রাস করছে এই নিষ্ঠুর বাস্তব।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 
প্রয়াত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Post a Comment

0 Comments