জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা―(প্রথম অধ্যায়)পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ২০
মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা
(প্রথম অধ্যায়)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


'আমি একদিনও না দেখলাম তারে
বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথায় পড়শি বসত করে
             একঘর পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখলাম তারে।'

―বলে গেছিলেন এক আধ্যাত্মিক বাউল কবি। আজ থেকে আনুমানিক প্রায় দেড়শ বছর আগে। তিনি সাধক লালন ফকির (১৭৭৪―১৮৯০)। গোঁড়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ'র ঊর্ধ্বে মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং গভীর দার্শনিক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর বাংলাদেশে তখন বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। অথচ লেখাপড়া-না-জানা, স্কুলের গণ্ডি পার না-হওয়া এক বাউলের এ হেন সুগভীর দর্শন আপামর বাংলার মননকে অভূতপূর্ব নাড়া দিয়ে গেল। তিনি প্রদীপের শিখার তলায় যেটুকু অমানিশা ছেয়ে থাকে, তার নিচে ঢাকা-পড়ে-থাকা এক চিলতে আলো যেন। অবজ্ঞা আর অবহেলার পঙ্কিল সলিলে আজীবন নিমজ্জিত। অথচ নিয়তির কী নিষ্ঠুর পরিহাস! সমকালীন সমাজে আজও তিনি বড্ড বেশি প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক তাঁর মনন, দর্শন আর চিন্তন প্রণালী। 

আসলে এ হেন দার্শনিক ভাবনা-চিন্তায় ব্যথিত লেখকের কোমল মন। বাড়ির নিকট যে আঁতুরঘর―আরশিনগর, সেথায় যে-সকল অমূল্য রতন থাকে অনাদরে, অবহেলায়; সে-বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ আমরা। অথচ দূর আকাশের চাঁদ ধরতে গিয়েছি। আইনস্টাইন, নিউটন, স্টিফেন হকিং, আরও কত কী ভারী ভারী নাম! মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো দশা। বুঝতেও পারেনি, হিরে-মণি-মুক্তো খচিত খাঁটি সোনা আপন জন্মভূমিতে লালিত-পালিত। সে-সোনা অন্য কিছু নয়, বরং পরম প্রিয় পড়শি বৈজ্ঞানিক― যাঁদের জগৎজোড়া সুখ্যাতি আর আলমারি ভর্তি পুরস্কারের ডালি। রীতিমতো গর্ব করার মতো বৈজ্ঞানিক অন্বেষা ও এষণা। এবার তাই চাঁদ ধরা নয়, মরিচিকার পিছনে ছুটে বেড়ানো আর নয়; বাড়ির কাছে আরশিনগরে সত্যিকারের রক্ত মাংসের উজ্জ্বল নক্ষত্র যে একঘর বৈজ্ঞানিক আমার পড়শি, তাঁদের অনুসন্ধানে পায়ের নিচে সরষে নড়ে উঠল। তাঁদের অনুপ্রেরণাময় উল্কা গতি আর উত্থানের রোমহর্ষক অথচ রূঢ় বাস্তব গল্প আকর্ষণ করল এক অমোঘ টানে। সে-গল্প শোনাব আজ। রওনা হই মেদিনীপুরে বিজ্ঞানের আরশিনগর― সাউরি গ্রামে। সেখানে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা'র মতো একঘর স্বনামধন্য পড়শি বসত করে।

                        (এক)    
ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। একনাগাড়ে। এতটুকু বিরাম নেই। নিকষ কালো চাদরে ঢাকছে পূর্ণিমার চাঁদ। বিচ্ছিন্ন, আবার অনিয়মিত। আকাশে হালকা নীল মেঘ। অল্প জোছনায় যেটুকু হালকা নীলাভ আলো ছড়িয়ে পড়ছে চরাচরে, ধানের ক্ষেতে, মেঠোপথে, আম-নিম-আমড়া-অর্জুনের ডালে; সবকিছু কেমন যেন রহস্যময়তায় মোড়া! আংশিক পরাবাস্তব। আর বাকিটা বাস্তবের ধার ঘেঁষা অস্পষ্ট ছবি। জোছনার আলতো ছোঁয়ায় অপূর্ব সুন্দর লাগছে কুঁড়ে ঘরের খড়ের চাল টুকু। মাঝে মধ্যে পরিযায়ী মেঘ এসে অন্ধকারে ঢেকে ফেলছে তার চূড়া। লুকোচুরি খেলা খেলছে দুজনে― অভিমানী মেঘ আর গগন পারের ঝলসানো রুটি। শুনশান গোটা গ্রামে রাত নামে। নিমের পাতা ঝরার ডাক শোনা যায়, কান পাতলে। আর শোনা যায়  নিঃশ্বাসের শব্দ, এমনকি বুকের ঢিপঢিপও। উঠোনের পাশের আম গাছটায় ডানা ঝাপটায় কোনও এক নিশাচর। হাড় হিম করা দূরের অশনি আওয়াজে আত্মা চমকে ওঠে। চঞ্চল হয় অশক্ত মন। রায়দের পোষা কুকুরটা নাগাড়ে ঘেউ ঘেউ করছে। চাপ চাপ অমানিশা গা ছমছম ভয়ংকর রহস্যজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। অথচ কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেটার। নির্লিপ্ত। শান্ত। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন। রাতঘুম বেমালুম গায়েব। গুচ্ছ পাট কাঠি জ্বলছে বাড়ির উঠোনে। তার সম্মুখে। রেড়ির তেল অথবা কেরোসিন কেনার পয়সা নেই। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসারে। লেখাপড়া সেখানে বিলাসিতা ছাড়া আর কি? তবুও অদম্য জেদে বই-খাতা-পেনসিলে আঁকচিরা কেটে চলে সে, সাদা পৃষ্ঠায়। মধ্য রাত্রির আলতো হাওয়ায় তিরতির কেঁপে ওঠে পাঠকাঠির শিখা। কেমন যেন কুঁকড়ে ওঠে, শঙ্কায় নাকি হর্ষে কে জানে! ঠিক মতো ঠাহর হয় না অক্ষরগুলো। ওই স্বল্প আলোয় কুঁড়ে ঘরের দাওয়ায় বসে রাত জেগে নির্ভুল অঙ্ক কষে চলে সে। এতটুকু ভয় নেই। কী সাহস! কী অসম্ভব তার মনের জোর! কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়! নিশুতি রাত। দুটো বাজে। দু'চোখে একফোঁটা ঘুম নেই! একটেরে কুঁড়ে ঘর। খড়ের ছাউনি দেওয়া। চারপাশে বাঁশের খুঁটি দেওয়া মাটির দালান। সূর্য ডুবলে ঘুটঘুটে অন্ধকার নামে ঘরের ভেতর। সন্ধ্যা'পরে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়াই দস্তুর মতো নিয়ম। ঘরের ভেতর মাটির মেঝেতে পাতা একখানা চাটাই। খেজুর পাতার শীতল চাটাই। গরমে বেশ আরামদায়ক। সে-চাটাই পেতে তৈরি হয়েছে রাতশয্যা। তার ওপর নিশ্চিন্ত নিদ্রায় আচ্ছন্ন সারাদিনের-রণ-ক্লান্ত মা, বোন আর ভাই। আর রাতের অন্ধকারে তার সম্মুখে এখন কে. সি. নাগ। আর গণিতের একগুচ্ছ দুরূহ সমস্যা। একাকী মগ্ন সে সব সমস্যার সমাধানে। সাক্ষী কেবল নিশীথ আকাশের ঝিকিমিকি তারা, খসে-পড়া-উল্কা। আর মন খারাপের একফালি ভগ্ন চাঁদ।
           
সেটা ১৯৬৫ সাল। ক্লাস সেভেনের ছাত্র সে। গ্রীষ্মকালীন অবকাশ চলছে স্কুলে। বন্ধ হোস্টেল। অগত্যা কুঁড়ে ঘরে ঠাঁই চারটি প্রাণীর। বছর দশেকের বোন বিষ্ণুপ্রিয়া। বছর খানেকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা সুজন। নিত্যদিনের অসহ সংগ্রাম। দিন দু'বেলা আহার সংস্থানের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলা। লোকের বাড়ি ঝিয়ের কাজ, মায়ের। সে এক অবর্ণনীয় দুরাবস্থা। সে-বছর জুলাই মাসে পিতা রাজেন্দ্রনাথ রানা পরলোক গমন করে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর। অবশ্য রোগটি বেশ পুরোনো।

                       (দুই)
সে অনেক কাল আগেকার কথা। বড় ছেলে নারায়ণচন্দ্র জন্মায়নি তখনও। গ্রামেঘরে বাপঠাকুর্দার পুরাতন ব্যবসা পেতল-কাঁসার থালা-বাটি-যন্ত্রপাতি সারাইয়ের কাজ করত রাজেন্দ্র। রাজেন্দ্র কিশোর রানা। সাকিন সাউরি। মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। নিজ এলাকায় মন্দির রং করা ছিল পেশা। রোদ-ঝড়-জলে, বারোমাস। উপার্জন সামান্য। তবুও বিয়ে উপনয়নে কাজের বিনিময়ে পয়সা নেন না। হঠাৎ একদিন বংশগত হাঁপানি রোগ দেখা দিল তার শরীরে। প্রায়শই তীব্র শ্বাসকষ্টে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কেশে কেশে প্রাণবায়ু বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হত। কাজে কামাই লেগেই থাকত। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো হাজির হল কালাজ্বর। সেটা ১৯৪৯―৫০ সাল। মেদিনীপুর আয়ুর্বেদিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। পারিবারিক পুরোহিত এবং বন্ধু পিনাকী পণ্ডা দায়িত্ব নিয়ে সব দেখাশুনা করল। চিকিৎসার খরচ জোগাতে বেশ ক'বিঘা পৈতৃক জলজমি বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর প্রায় সর্বশ্রান্ত রাজেন্দ্র। অবশিষ্ট আর মাত্র দু-তিন বিঘা জমি। সংসারের অবস্থা খুব সঙ্গীন। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। লেখাপড়ার দৌড়  যৎসামান্য। তাই দিয়ে শুরু করলেন ছেলে পড়ানো। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের যত্ন নিয়ে পড়ালেন প্রাথমিকের পড়া। কোনওমতে স্রোতের প্রতিকূলে উতরে যাচ্ছে জীবন-নদী। 

এমন সময় দম-বন্ধ-করা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মাঝে একটুখানি হিমেল বাতাসের পরশ নিয়ে এল এক সুখবর। স্ত্রী নাকফুড়ি দেবী জন্ম দিয়েছেন এক ফুটফুটে পুত্র সন্তানের। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার (অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর) সাউরি-তে ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসের বারো তারিখে। ভূমিষ্ট হল জ্যেষ্ঠ পুত্র নারায়ণচন্দ্র রানা। টুকটুকে ফর্সা গায়ের রং। সাক্ষাৎ রাজপুত্র যেন। তাদের মাটির কুঁড়ে ঘরে চাঁদ নেমে এল। হাজার ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতির দ্যুতি ঘরময়। ভূমিষ্ট হয়েছেন স্বয়ং নারায়ণ যেন। আনন্দের সীমা-পরিসীমা রইল না। সব দুঃখ-কষ্ট-বেদনা বেমালুম উবে গেল রাজেন্দ্র'র। 

অবশ্য জন্মক্ষণ নিয়ে সামান্য দ্বিমত আছে। বার্থ-সার্টিফিকেটের প্রচলন সেসময় ছিল না। নির্ভর করতে হত জন্মকুষ্ঠির উপর। গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষজনের জন্মকোষ্ঠী তৈরির সে-সামর্থও নেই। অগত্যা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাপকাঠিতে বয়স নির্ধারিত হত। সে-হিসাবে জন্ম তারিখ ১২ অক্টোবর ১৯৫৪। প্রকৃতপক্ষে নারায়ণের জন্ম হয় ১৯৫২ সালের চব্বিশে সেপ্টেম্বর, শুক্লাপক্ষের দুর্গাষষ্ঠী তিথিতে। 

চিরটাকাল ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী নারায়ণ। অসাধারণ মেধা। আর প্রচণ্ড ডানপিটে। এই ডাকাবুকো স্বভাবের জন্য প্রায়ই মায়ের বকুনি জুটত। কখনও সখনও পিটুনি, বাঁশের কঞ্চি সহযোগে। চির দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। পিতার নিকট নারায়ণের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। পিতার টোলে তখন ৭০-৮০ জন ছেলেমেয়ে। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ার সুবাদে পিতার অবর্তমানে নিজের অধস্তন ক্লাসের মাস্টার হয়ে যেত স্বয়ং নারায়ণ। পড়া না-পারলে শিশু শিক্ষার্থীদের কড়া শাস্তি দিতে কসুর করত না সে। গার্ডিয়ানদের অবজেকশান লেগেই থাকত। পিতা রাজেন্দ্র নিরুত্তর; এক কানে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিত। অথচ কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই নারানের। আপন খেয়ালে-কৌশলে পাঠ সুন্দর বুঝিয়ে দিতে পারত। ফলে ছাত্র পড়ানোর অপূর্ব কৌশল ছোটবেলা থেকে রপ্ত হয়ে গেছিল তার। সেজন্য বড় হয়ে ভালো শিক্ষকের বীজ শৈশবের বন্ধ্যা জমিতে রোপণ হয়ে গেল বাড়িতে। এভাবেই পিতার পাঠশালায় ক্লাস থ্রি পর্যন্ত তার পড়াশুনা।

                      (তিন)
সাউরি কোটবাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোর্দণ্ড প্রতাপ হেডমাস্টার তখন পশুপতি নন্দ মহাশয়। সহজে কোনও ছাত্রকে উঁচু ক্লাসে ভর্তি নেন না। রীতিমত পরীক্ষা দিতে হত, ভর্তির জন্য। সাউরি কোটবাড় প্রাথমিক স্কুলে তেমন-ই এক ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তৃতীয় শ্রেণীর পঠনপাঠন শুরু হল নারায়ণের। ১৯৬০ সালে। ক্লাসে যথারীতি ফার্স্ট বয় সে। পড়াশোনার পাশাপাশি বদমায়েশীতেও ওস্তাদ। একেবারে যাকে বলে, পাকা ছেলে। বদমায়েশীর সব গুণ তার মধ্যে প্রকট। আবার ভালো পড়াশুনার অজুহাতে শিক্ষকদের নয়নের মণি। সব দোষ মাফ! খুব স্নেহ করেন প্রধান শিক্ষক পশুপতি বাবু। চতুর্থ শ্রেণীর পাঠ সমাপ্ত করে ১৯৬৩ সালে কিশোর নারান পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হল সাউরি ভোলানাথ ইনস্টিটিউশনে। অল্প সময়ে স্কুলে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল সে। ক্লাসে গৌর কিশোর রাউৎ, দীপক চৌধুরীদের সঙ্গে আজীবন গাঢ় বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হল। ক্লাসে প্রথম সে, দ্বিতীয় গৌর আর তৃতীয় দীপক। বন্ধুত্বের পাশাপাশি লেখাপড়ায় অদৃশ্য সুস্থ প্রতিযোগিতা চলত তাদের মধ্যে। 

কিশোর নারায়ণ তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৬৪ সাল। কাঁথি শহরে হবে বৃত্তি পরীক্ষা। ষষ্ঠ ক্লাস থেকে মনোনয়ন পেল নারায়ণ। নির্ধারিত দিনে রওনা হয়ে গেল কাঁথির উদ্দেশ্যে। স্কুলের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা-ছাত্রছাত্রী এবারে খুব আশাবাদী। প্রধান শিক্ষক শ্রীনিবাস নন্দ বাবু আশায় আছেন― এবার তাঁর স্কুলের নাম উজ্জ্বল করবে মেধাবী নারায়ণ। ১৯৫৯ সালে স্কুল প্রতিষ্ঠার পর যে কৃতিত্ব এতদিন অধরা ছিল; তীক্ষ্মধী নারায়ণ সে-সাধ পূরণ করবে―এই ছিল আশা। বৃত্তি পরীক্ষায় ভালো ফল করে স্কুলের নাম উজ্জ্বল করবে। কিন্তু, কোথায় কী? সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটি কিংবা দুটি পরীক্ষার পর বাড়ি ফিরে এল নারায়ণ। কারণ অজ্ঞাত। গোটা স্কুল আশাহত। রাগে ফুঁসছে। হেডমাস্টার নন্দ বাবু চটে লাল। বেজায় ক্ষিপ্ত। ক্ষমতা থাকলে টি সি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) দিয়ে দেবেন প্রাণাধিক প্রিয় ছাত্রটিকে। এতটা রেগে সকলে!
     
আসলে এ হেন বৃত্তি পরীক্ষায় যত না স্কুলের সম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল; তার থেকেও বেশি করে প্রয়োজন ছিল তার নিজের জন্য, নিজের পড়াশুনা সুন্দর সাবলীল অবিচ্ছেদ্য রাখার প্রয়োজনে। পরিবারের আয় তলানিতে ঠেকেছে। বইখাতাপত্র কেনার পয়সা নেই। বিকল্প উপায় দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। বাবার কাশিটা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। হাঁপানির দমকা টানে আস্ত হৃৎপিণ্ড বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। ঔষধ পত্তর নেই। সংসারের বোঝা টানা বড় দায় হয়ে পড়েছে। অনন্ত চাপ মায়ের উপর। এ সময় একটা বৃত্তি খুব প্রয়োজন ছিল তার। অথচ হঠাৎ জ্বর সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। মাঝপথে পরীক্ষা বন্ধ রেখে তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল সে। এদিকে স্কুলও অবুঝ। কোনও অজুহাত তারা শুনতে নারাজ। ফলে শিক্ষকগণের অবহেলায় অপমানে অনিয়মিত হয়ে গেল তার স্কুলে যাওয়া। সারাদিন বনেবাদাড়ে ঘোরাফেরা করে নারায়ণ। স্কুলের গণ্ডি আর মাড়ায় না খুব একটা। দিন দু'মুঠো ভাত ঠিক মতো জোটে না, তায় আবার পড়াশুনা! লাটে উঠল পড়াশোনা। রোগক্লিষ্ট অসহায় পিতার বাঁ-চোখ নেচে ওঠে। ভবিষ্যতে সন্তানের শিয়রে আসন্ন কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য আন্দাজ করে আঁতকে ওঠে তার হৃদয়। চটজলদি এর সমাধান খুঁজে না পেলে চির-অভাবের অবিন্যস্ত স্রোতে ভেসে যাবে তার সাত রাজার ধন এক মানিক মেধাবী নারায়ণ। স্কুলে ছুটলেন অসহায় পিতা। অনেক অনুনয় বিনয় করলেন। অবশেষে বরফ গলল। হেড মাস্টার রাজি হলেন নারায়ণকে স্কুলে ফেরাতে উদ্যোগী হতে। তবে কোথাও যেন সে রাম নেই আর সে রাজত্বও নেই। ছিড়ে গেছে যোগাযোগের তার। মনের অটুট বন্ধন আজ কিছুটা ম্লান।

পরের বছর ১৯৬৪―৬৫ সাল যুগপৎ হর্ষ ও বিষাদ নিয়ে এল নারায়ণের কাছে। ১৯৬৪ সালের নভেম্বরে জন্ম নিল ছোট ভাই সুজন। খুব আনন্দ বাড়িতে। খুশির জোয়ার থিতিয়ে পড়ার পূর্বেই পরিবারে নেমে এল শোকের ছায়া। আট মাস পর ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন পিতা রাজেন্দ্র রানা। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এল নারায়ণের। কীভাবে চলবে সংসার আর তার পড়াশোনা? অবস্থা বেশ খারাপ। এরকম কঠিন সময়ে এগিয়ে এল স্কুল― সাউরি ভোলানাথ ইনস্টিটিউশন। হোস্টেলে নারায়ণের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। তার বাকি খরচের কী হবে? রাতে পড়ার জন্য কেরোসিন তেল কেনা। বইপত্র কেনার পয়সা জোগাড়। আর জামা প্যান্টের খরচ! এত অর্থের সংস্থান বাড়ি থেকে কক্ষনো সম্ভব না। সেজন্য গ্রামের ধনাঢ্য মানুষ, অবস্থাপন্ন প্রতিবেশীদের কাছে সাহায্য চাইতে শুরু করে নারায়ণ। কেউ জামা কিনে দিল। কেউ শুধু খাতা কিনে দিল। কেউ বা কলম। আরও কত কী! কে কত টাকা অথবা কী কী জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্য করল, সে-সব হিসাব খাতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ লিপিবদ্ধ করে রাখত সে। 

টানাটানির সংসারে দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে ঝিয়ের কাজ বেছে নিল তার মা। সাউরি গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবার খগেন্দ্রনাথ চণ্ড রায়। পিতৃদেব গত হলে এই রায়দের বাড়িতে দৈনিক ঠিকাকাজ নিল মা নাকফুড়ি দেবী। সামান্য পয়সাকড়ির বিনিময়ে। যে-টুকু বেতন পায়, মা-বোন-ভাই তিনজনের দুবেলা ঠিক মতো খাবার জুটত না। সেজন্য প্রায় দিন শিশু সুজনকে নিয়ে কাজে‌ বের হত মা। যেটুকু টিফিন পেত, দুই মা-ব্যাটার ভাগবাটোয়ারা করে খায়, তবে পেট ভরে না। বাড়িতে একা বিষ্ণুপ্রিয়া। ক্ষিদের জ্বালায় অতিষ্ঠ সে ঠিক করেছিল ভিক্ষা করতে যাবে। মা বাধা দিলে। শেষে অনেক পরে বিষ্ণুপ্রিয়া লোকের বাড়ি কাজ বেছে নেয়। দুবেলা পেট ভর্তি খাবার পাবে এই আশায়। এত করেও মিটল না অভাব। সমস্যা প্রকট হত গ্রীষ্ম আর পূজার ছুটিতে। তখন হোস্টেল বন্ধ। প্রায় এক মাস বা তার বেশি। বাড়ি ফেরা ব্যতীত অন্য গত্যন্তর নেই নারায়ণের। এমনিতে বাড়িতে খাদ্য সংকট চরমে। ওই সময় সকলে আটাসেদ্ধ খেয়ে উদর পূর্তি করত। তাল পাতার চামচে খুব তৃপ্তি সহকারে খেত আটা-ঘাঁটা। স্কুল ছুটি। হাতে অফুরন্ত সময়। গভীর পড়াশুনায় ডুবে থাকত সে। প্রায় দিন রাত একটা-দুটো পর্যন্ত তার পঠনপাঠন চলত। ঘরে কেরোসিন কিংবা রেড়ির তেল বাড়ন্ত। রায়দের জমিতে পাট চাষ হত খুব। পাট উঠে গেলে তন্তু বের করে নিয়ে পাটকাঠি ফেলে দিত। সেই ফেলে দেওয়া শুকনো পাঠকাঠি সযত্নে সংগ্রহ করে আনত তার মা। যাতে পাটকাঠি জ্বেলে রাতের অন্ধকারে গভীর অধ্যবসায়ে ডুবে যেতে পারে তার নারান। সে-কথা পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে। স্কুল খোলা থাকলে নারায়ণের চিন্তা ছিল না। অন্তত দুবেলা খাবার ঠিক জুটে যেত। হোস্টেলে। সকাল দশটায় ভাত। আবার রাত ন'টায় ডিনার। এর মাঝে আর কোনও খাবার নেই। বিকেল বেলায় ছুঁচো ডন মারত পেটে। খুব ক্ষিদে পেলে কোনও কোনও দিন স্কুল ছুটির পর সে ঘরে ফিরত। একটুখানি খাবারের আশায়। এসে দেখত কেউ বাড়ি নেই। প্রত্যেকে নিজের কাজে ব্যস্ত। বাড়ির বাইরে। কুঁড়ে ঘরের বাঁশের দরজায় তালা ঝুলছে। অথচ চাবি নেই। একটা উপায় আছে, ঘরে ঢোকার। হাতে ধরে একটু নড়িয়ে দিলে তালাটি অটোমেটিক খুলে যেত। সেভাবেই তালা খুলত সকলে। ঘরে ঢুকে নারায়ণ দেখল বাটিতে একটু তরকারি ঢাকা। অথবা সামান্য শাকভাজা। গোগ্রাসে তা খেয়ে আবার ফিরে যেত স্কুলে। একেক দিন কোনও খাবার নেই। না-খেয়ে ফিরতে হত স্কুলে। এত কষ্টের মধ্যেও কারও কোনও অভিযোগ নেই। কারও বিরুদ্ধে। আবার, হাল ছেড়ে দেয়নি কেউ। নারায়ণ চালিয়ে গেছে লেখাপড়া। অসম্ভব মনের জোর নাকফুড়ি দেবীর। ঘরে দানা নেই। অভাব নিত্যসঙ্গী। যে যৎসামান্য জমিজমা আছে, তাও ভাগ-চাষে দেওয়া। ভুষিমাল দোকানে অনেক টাকা বাকি। ধারে সরিষা তেল, ডাল, মসলাপাতি কেনা। সেই ধারের টাকা শুধতে ভাগের ধান কাবার হয়ে যেত। চাষ উঠলে ভূষিমাল দ্রব্যের দেনা শোধ করতে ভাগ চাষের পুরো ধান মহাজনে নিয়ে যায়। পড়ে থাকে কিছু হরি-মটর। পোড়া কপাল আরও পুড়তে থাকে। আসলে বাবা গত হওয়ায় গায়ে গতরে মাঠে খাটবার লোকের বড্ড অভাব। অথচ নারায়ণের বয়সী গ্রামের ছেলে ছোকরার দল চাষের জমিতে অমানুষিক পরিশ্রম করে দুমুঠো অন্ন সংস্থান করে। নারায়ণের সে সামর্থ্য নেই। শত কষ্টে মা নাকফুড়ি দেবী কিশোর নারায়ণকে একদিনের জন্যও জোরাজুরি করেনি চাষের কাজে লেগে পড়তে। লেখাপড়া ছেড়ে রোজগারের পথ খুঁজতে বলেননি। বাধ্য করেননি পড়াশুনা ছাড়তে। এতটাই তার কলজের জোর। সেজন্য তিনি মহীয়সী। তিনি মহান। দৃঢ় সংকল্পের এক উচ্চ-মনা মহিলা। সন্তান প্রেয়সী এক অসহায় মা।

                      (চার)
১৯৬৫―৬৬ সাল স্কুলের ইতিহাসে একটি বিশেষ কারণে স্মরণীয়। সে-বছর বিহার থেকে সাউরি ভোলানাথ ইনস্টিটিউশনে এলেন বিজ্ঞানের জনপ্রিয় শিক্ষক মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী। বয়েস চল্লিশের কোঠায়। চিরকুমার। পেছন দিকে ঘাড় কিঞ্চিত হেলান দেওয়া। সেজন্য ডাইনে-বাঁয়ে গ্রীবা সঞ্চালন করতে পারতেন না। মাথা সহ পুরো বডি বাঁক নিত; পেছনে তাকাতে হলে। খুব গুণী মানুষ। ছাত্র দরদি। বিজ্ঞান বিষয়ে ছ'খানা পুস্তক রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম 'চাঁদের দেশে মাটির মানুষ', 'হ্যালি ও হ্যালির ধূমকেতু', 'পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ'। নিজ হাতে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান মডেল বানানো শেখাতেন। শখ দূরবীক্ষণ যন্ত্র বানানো। আর তা দিয়ে রাতের আকাশ দেখা। একবার কাঠের ফ্রেম আর নারকেল তেলের কৌটো দিয়ে তৈরি করলেন ছয় ইঞ্চি ব্যাসের একটি টেলিস্কোপ যন্ত্র। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের 'Sky and Telescope' পত্রিকাতে সেই টেলিস্কোপের রিভিয়্যু আলোচিত হয়েছিল। পল্লীগ্রামের এক স্কুল শিক্ষকের নিকট খুব কৃতিত্বের ছিল এই উদ্ভাবনা এবং বিদেশের পত্রিকায় তার প্রশংসাসূচক প্রশস্তি। এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে রাতের আকাশে গ্রহ তারা নক্ষত্র পরিস্কার দেখা যেত। রাতের আকাশ দেখা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কৌতুহলের অন্ত নেই। প্রিয় স্যারের উৎসাহ তো ছিল-ই, হোস্টেলে থাকাকালীন স্যারের তৈরি টেলিস্কোপে রাতের আকাশ দেখে গ্রহ-তারকা'র প্রেমে মজল কিশোর নারায়ণ। 
          
এ হেন মণীন্দ্র স্যারের দরাজ দরজা নারানের জন্য সর্বদা উন্মুক্ত। বিজ্ঞানের মডেল বানাতে স্যারের হাতে হাত লাগায় সে। বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি কীভাবে তৈরি করতে হয় তার দৃঢ় ভীত মজবুত হল মণীন্দ্র স্যারের সান্নিধ্যে এসে। উপরি পাওয়া― টেলিস্কোপে নিশুতি রাতে নিয়মিত আকাশ দেখা। সহজে স্যারের প্রিয় পাত্র বনে যায় সে। স্যার হাতে ধরে শুকতারা, সপ্তর্ষিমণ্ডল, অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি, শনির বলয়, বৃহস্পতির চাঁদ চিনিয়ে দেয় তাকে। তা দেখে ভেতরে ভেতরে খুব উত্তেজিত বোধ করে সে। ভাবে, কত সীমিত আমাদের দৃষ্টির সীমা! কত ক্ষুদ্র আমাদের অস্তিত্ব! কত অজানা গোপন রহস্যই না জমে আছে আকাশের অন্ধকারের ভেতর! তার ইয়ত্তা নেই! এ হেন ছাত্রটিকে খুব স্নেহ করেন মণীন্দ্র স্যার। ছেলেটার অজানাকে জানবার তীব্র আগ্রহ মুগ্ধ করে তাঁকে। সেজন্য লাহিড়ী স্যার পরে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন―
"নিজের মনের মতো করে না-বুঝে কোনও বিষয় অথবা ঘটনা মাঝপথে ছেড়ে দিত না রানা। নিজের পাঠাভ্যাস থেকে বিরত থাকা, পিছু হটার কোনও বদ ইচ্ছা তার মধ্যে ছিল না। বরং রানার বিশেষ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হত স্কুলের সকল শিক্ষককে। তার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে আমাকেও অনেক বেগ পেতে হয়েছে। পড়াশোনা করতে হয়েছে। কলকাতা থেকে আনাতে হয়েছে বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ। সেগুলো আমাকে অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে অধিকাংশ সময়।"

শুধু পড়াশোনা নয়, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতেও সমান দক্ষ রানা। ১৯৬৬-তে সে তখন ক্লাস এইটের স্টুডেন্ট। ক্লাসমেট গৌর হরি রাউৎ হোস্টেলে একসঙ্গে থাকে। দুজনে মিলে ঠিক করল ম্যাগাজিন বের করবে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। যৌথ সম্পাদনায় দেওয়াল পত্রিকা 'কিশোর' প্রকাশ করল তারা। চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। নিজ নিজ মৌলিক লেখা প্রকাশের ধূম পড়ে গেল। সংস্কৃতি-মনা শিক্ষক মোহিতোষ দাস পেছন থেকে ইন্ধন আর উৎসাহ দুটোই দিয়ে যেতেন। 

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকে। বিশেষ পরবের দিনে বিদ্যালয়ে গরহাজির অনেক মাস্টার মশাই। অল্প যে ক'জন মাস্টার মশাই উপস্থিত হতেন, তাদের সম্মিলিত প্রয়াসে সমস্ত ক্লাসের পঠনপাঠন সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব হত না। তখন ডাক পড়ত দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু'র― মেধাবী নারান আর গৌরহরি। নীচু শ্রেণীর ক্লাস নিত তারা। সমবয়সী বন্ধুদের সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিত পাঠ। এভাবে পড়ানোর সুন্দর কৌশল রপ্ত হয়ে গেল। ছাত্র হিসাবে নারান ছিল তীক্ষ্ম মেধার অধিকারী। বিশেষত গণিত, বিজ্ঞান ও ভূগোলে তার প্রাপ্ত নম্বর রীতিমত ঈর্ষণীয়। স্কুলের গণিতের শিক্ষক তখন চিত্তরঞ্জন দাস। দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা সমাপ্ত। পর্ষদের বইয়ের অঙ্ক কষে আর মন ভরছে না নারানের। সব অঙ্ক-ই কেমন সহজ প্রকৃতির! অঙ্ক কষে মজা নেই। সে ধরল অঙ্কের স্যারকে। অনুরোধ― গণিতের কঠিন থেকে কঠিন প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করে দিতে হবে। অঙ্কের স্যার তখন দ্বিমুখী সমস্যায়। না পারছেন ছাত্রের বিনীত অনুরোধ ফেলে দিতে; না গ্রহণ করতে। আসলে হয়েছে কী, তিনি ভালো মতো জানেন মেধাবী নারানের কাছে কোনও অঙ্ক কঠিন নয়। তিনি যা অঙ্ক দেবেন, নারান তা অবলীলায় সমাধান করে ফেলবে। এমন সোনার টুকরো ছেলেকে কাছে পেয়ে আশায় বুক বাঁধল ছাত্র-শিক্ষক সকলে। স্কুল ফাইনালে ভালো ফল করবে নারান ―হেডমাস্টার শ্রীনিবাস নন্দের সুপ্ত ইচ্ছা। স্কুলের মুখোজ্জ্বল করবে সে।


(পাঁচ)
১৯৬৯ সাল। বহু প্রতিক্ষিত একটি বছর। স্কুলের ইতিহাসে গৌরবময় কাল। সেবছর স্কুল ফাইনাল ব্যাচে একঝাঁক তারকা ছাত্রের ছড়াছড়ি। তাদের মধ্যমণি দুজন― নারায়ণ আর গৌর। যদিও সকলের তীক্ষ্ম দৃষ্টি নারানের উপর বেশি। সে ছিল রেডিও যুগ। এখনকার মতো অ্যানড্রয়েড মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠত না পরীক্ষার ফলাফল। ভালো ফলের জন্য রেডিও অথবা স্কুলের প্রতি মুখিয়ে থাকতো ছেলেমেয়েরা। সেদিন স্কুল ফাইনাল রেজাল্ট ঘোষণার দিন। আকাশবাণীর সংবাদ পাঠক ঘোষণা করল― 
'এবছর সাউরি ভোলানাথ ইনস্টিটিউশনের নারায়ণচন্দ্র রানা স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।'
ব্যাস, হৈ হৈ রব পড়ে গেল সাউরি'তে। এ হেন সংবাদ যেন বিদ্যুৎ সঞ্চার করল আকাশে বাতাসে। ছাত্র-মাস্টার-অভিভাবক-গ্রামবাসী সবাই উৎফুল্ল। এলাকা জুড়ে তীব্র হিল্লোল। হর্ষধ্বনি। হাজারের মধ্যে ৭৭৬ নম্বর পেয়ে স্কুল ফাইনালে সারা বাংলায় দ্বিতীয় হয়েছে নারায়ণ। স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। পাঁচটা বিষয়ে লেটার। প্রথম কার্তিক সাঁতরা'র থেকে মাত্র দু'নম্বর কম। আনন্দের আরও একটি কারণ বন্ধু গৌর রাউৎ মেদিনীপুর জেলায় দ্বিতীয় এবং বাংলায় ২৫ তম।
       
শিক্ষা সংক্রান্ত এলাকার পরিবেশ এক ঝটকায় আমূল বদলে গেল। এতদাঞ্চলে এডুকেশনের জোয়ার নেমে এল নারায়ণকে দেখে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ল। দীন দরিদ্র ঘরের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেল― দারিদ্র শিক্ষার অজুহাত হতে পারে না। শত অভাবের মাঝে একাগ্রতা দিয়ে সুউচ্চ শিখরের শৃঙ্গ জয় করা যায়। দারিদ্র্য জয় করে অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। নারায়ণের রেজাল্ট সাউরি গ্রামে আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে। খুশিতে মাতোয়ারা আবালবৃদ্ধবনিতা। পরের দিন ভোরে গ্রামের ছেলেছোকরার দল বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল নারানকে। গোটা গ্রাম ঘোরানো হল বিজয় মালা সহযোগে। সকাল গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যে।

সেই সাত সকালে ছেলে বেরিয়ে গেছে। সারাদিন ঘরে ফেরেনি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চলল। অথচ ছেলের পাত্তা নেই। বেজায় চিন্তিত মা নাকফুড়ি দেবী। এখন রাত ন'টা বাজে। আর তর সয় না। শেষে বিষ্ণুপ্রিয়াকে জিজ্ঞেস করল―
'নারান কোথায় গেছে, জানিস?'
চোখমুখে খুশির হিল্লোল বিষ্ণুপ্রিয়ার। এক হাতে মুখ ঢেকে চোখ কপালে তুলে সে সপাটে উত্তর দেয়―
'ও মা, তুমি কিচ্ছুটি জান না? দাদা খুব ভালো রেজাল্ট করেছে গো! তাই গেরামের ছেলেছোকরার দল দাদাকে গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে কাঁধে তুলে গোটা গ্রাম চক্কর কাটছে, দেখে এলুম। যে যা পারে, ভালো মন্দ খাবার খাওয়াচ্ছে আর প্রসংশা করছে।' চিন্তিত মা সাত-পাঁচ কী ভেবে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। আসলে ঘর পোড়া গরুর দশা এই রত্নগর্ভা দীন-দুঃখিনী মায়ের। আনন্দে ভাসবেন কি, অদূর ভবিষ্যতে আগত বিপদের সম্ভাবনা আগাম চিন্তা করে মায়ের বুক শিউরে উঠছে। কষ্ট যাপনের কথা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না।

রাত বারোটার পর বাড়ি ফিরে এল নারান। মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা তার বরাবরের অভ্যেস। প্রণাম সেরে উঠে বলল―
'মা, স্কুল ফাইনালে আমি সেকেন্ড হয়েছি।' 
'তোর বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন!'―মা বলল।
'এরপর কী হবে, মা? পড়াশোনা কেমন করে চলবে?'
ছেলের প্রশ্নের মুখে মা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত। মুখচোখে গভীর হতাশা। যেটুকু আলোর রোশনাই তার মুখমণ্ডলে এতক্ষণ প্রজ্বলিত ছিল, তা নিমেষে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। যন্ত্রণায় ছটপট খাঁচার পাখি যেমন বাহির হবার পথ পায় না, বুকের ভেতর আটকে থাকা কষ্টগুলো তেমনি খাঁচা বন্দি। মনোবেড়ি পরে একসঙ্গে ভীড় জমায় মাথার মধ্যে।
(চলবে)

তথ্য সহায়তা :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের ভাই সুজন রানা,
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ
 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments