জ্বলদর্চি

আমার অনুভবে রবীন্দ্রনাথ /আলোকরেখা চক্রবর্তী

আমার অনুভবে রবীন্দ্রনাথ 

আলোকরেখা চক্রবর্তী

মৃত্যোর্মা অমৃতং গময় 

অসতো মা সৎ গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময় ।
আবিরাবীর্ম এধি।।
রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং-,
তেন মাং পাহি নিত্যম্।

আজ তোমার প্রতিকৃতির সামনে বসে এই প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করি।
   আমরা  শুনে এসেছি যে মাঝেমাঝেই প্রকৃতির বিরাট ব্যাপ্তির সম্মুখীন হতে হয় এতে সঠিক ভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। তবে এই পৃথিবীতে অনেক মহামানব আছেন যাঁরা  প্রকৃতির মতোই  একইভাবে তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে, তাঁদের কর্মের দ্বারা প্রতিনিয়ত আপামর জনগণ কে  প্রেরণা জুগিয়ে চলছে জীবনের   চলার পথ মসৃণ আর  সুন্দর রাখার জন্য। এনাদের একজন হলেন  আমদের প্রাণের কবি-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বের দরবারে যিনি বিশ্বকবি-! জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১২৬৮খ্রীঃ ২৫শে বৈশাখ তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। এত বছর(প্রায় ১৫৯) পর ও রবীন্দ্র প্রেমী মানুষ  সোৎসাহে, ভালোবেসে তাঁর জন্মদিন পালন করেন।হাজার হাজার মানুষ তাঁকে এবং তাঁর পাহাড় প্রমাণ কাজ নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন।কিন্তু কেন তাঁকে নিয়ে এত আয়োজন?তিনি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ও প্রাসঙ্গিক? এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পড়েছি তাই এবিষয়ে আমার মতামত অতি সাধারণ তবু একজন রবীন্দ্র প্রেমী মানুষ হিসেবে আমি সামান্য আলোকপাত করতেই পারি।এই প্রসঙ্গে আমি বলবো নৃত্যশিল্পী শ্রদ্ধেয়া অলকানন্দা রায় এর কথা। প্রায় চার বছর পূর্বে আলিপুর সংশোধনাগারের বন্দিদের নিয়ে বাল্মীকি প্রতিভা নৃত্যনাট্য করিয়েছিলেন এই গুণী শিল্পী।সেই সময় তাঁর মূল্যবান মন্তব্যের একটি, ‘আমার মনে হল ওরা যেন সবাই দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হচ্ছে’।
  এছাড়া বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দেয় ১৯০৫খ্রীষ্টাব্দে রাখি বন্ধন উৎসবের কথা। যে উৎসবের সূচনা হয়েছিল শুধুমাত্র সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও মৈত্রী বজায় রাখার জন্য।জানি তাঁর বিশালতা সম্বন্ধে বলে শেষ করা যাবে না তারচেয়ে বলি এই অনন্যসাধারণ মহামানব কিভাবে  একদিন  হয়ে উঠলেন আমার অত্যন্ত আপনজন,আর আমি  এক অতি সাধারণ  একনিষ্ঠ পাঠক থেকে হয়ে উঠলাম তাঁর পূজারিনি।তবে আত্মিক কাউকে লৌকিক দেখানো বড়ই কঠিন কিন্তু সেই মানুষ টি যদি লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে হার্দিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন তবে তাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে পারা মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার।তাই আজ আমার মনের মতো করে সাজিয়ে নিলাম অর্ঘ্য, করলাম মানসিক পূজো।  
  এক জীবনে সম্পূর্ণ ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর সৃষ্টি কে জানবো বা বুঝতে পারবো এমন ক্ষমতা আমার নেই।
তবু সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ নীল জলরাশি বা ঢেউ কে যতটা আপনার বলে মনে হয় সেইটুকু উপলব্ধি ব্যক্ত করতে আমি পাড়ি দিলাম স্মৃতির অতল থেকে বর্তমানের ধারা তে।
   সেই প্রায় ভুলতে বসা শৈশবে সম্ভবত চার বছর বয়সে প্রথম বার আবৃত্তি করলাম,কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘হাট’কবিতা টি।তারপর ‘সহজপাঠ’, ’শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’-।তা সেই ছোট্ট বেলা থেকে যে মজা যে আনন্দ পেয়েছি রবীন্দ্র পাঠে তা আজ ও পাই সমভাবে। তবে ক্রমশ বোধবুদ্ধির পরিণতির সাথে বেড়েছে সাহিত্যের রসাস্বাদন করার ক্ষমতা।তাই সুখানুভূতির সাথে  পড়েছে নীরব চোখের জল যখন আত্মমগ্ন হয়ে পড়েছি ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ বা ‘দেনাপাওনা’। এইভাবে বিশ্বকবির সৃজনশীলতার গণ্ডিতে থাকতে থাকতে  ‘রবীন্দ্র’ অনুরাগী থেকে আমি হলাম ‘রবীন্দ্র’ নির্ভর।
  সেই সময় আমাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে ধরে রেখেছে রবীন্দ্রনাথ।আমার সমস্ত আবেগে, আমার যত দুঃখে-সুখে, সকল বিক্ষোভে-প্রক্ষোভে তাঁর অতুল্য সৃষ্টি কে ব্যবহার করে ছড়িয়ে পড়া আলোড়িত মন কে করেছি শীতল-স্বাভাবিক। তখন আমি সন্ধ্যা আরতির সময় গাইতাম ‘সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি,ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে....’। অবাধ্য প্রণয়ী কে শুনিয়েছি-‘সবলা’ ‘র কথা। আমি বিপদে থেকেছি অবিচল! কারণ বারবার উচ্চকণ্ঠে বলেছি সেই অমূল্য বাণী “বিপদে মোরে রক্ষা কর হে নহে মোর প্রার্থনা----
বিপদে আমি না যেন করি ভয়”। এমন ভাবে প্রিয়জনের বিরহ বেদনায় একাধিকবার গেয়েছি “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম”।তুমি তখন আমার অপরিহার্য একজন।কিন্তু সত্যিই কি তাই?ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে একইরকম গুরুত্ব দিতাম? কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর ছবির সামনে বসে কাটিয়ে দিইনি, বা একেবারে তাঁকে উদ্দেশ্য করে গাইনি কোনো গান।আসলে আমি সেই আপ্ত বাক্যে বিশ্বাসী ছিলাম, ‘নামের মধ্যে আপনি আছেন শ্রীহরি’।
 কিন্তু জীবন সব সময় একভাবে চলে না। তীব্র তুফান-ঝড়ে আছড়ে গিয়ে পড়লাম মাঝ সমুদ্রে।বেদনায় নীল শরীরের তুচ্ছ প্রাণকে মনে হলো নিজ হাতে শেষ করে দিই।আর সেই মুহূর্তে যা দেখল যা শুনল আমার অতীন্দ্রিয় মন তা সঠিক ভাবে কুশলী ভাষা তে প্রকাশ করতে আমি অক্ষম।তবু বলি আমি যেন দেখলাম আমার প্রাণের কবি আমার সামনে এসে বলছেন,মনে কর 1902খ্রীঃ থেকে 1905খ্রীঃ সময়ের কথা।আমার প্রাণাধিকা স্ত্রী, কন্যা রেণুকা,প্রাণাধিক পিতা এবং কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ কে হারিয়েছি। শুধু সূর্যের আলো নিয়ে যাবি তাঁর বুকের ভেতর অহরহ যে আগুন জ্বলছে তা মনে করবি না কখনো।এরপর উনি মিষ্টি করে গাইলেন- “আকাশ ভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ”।
 এখন আমি মাঝেমধ্যেই কবি কে উদ্দেশ্য করে গাই।আর সবচেয়ে প্রিয় গান, ‘আমি শুনেছি হে তৃষাহারী তুমি এনে দাও তারে প্রেম অমৃত,তৃষিত চাহে যে বারি।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ 'রবীন্দ্র অনুভব'

    ReplyDelete