জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (দশম পর্ব)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ২৯

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (দশম পর্ব)

পূর্ণ চন্দ্র ভূঞ্যা


সময়টা ১৯৯৫ সাল। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে গরুর গাড়ির চাকায় ক্ষতবিক্ষত উর্বর মাটির ধূসর ধুলোমাখা গ্রাম্যজীবন ওষ্ঠাগত। অথচ এ হেন দাবদাহে গণিত-না-মানা ছোট ছোট স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অবিরাম ছুটে চলেছেন তিনি, ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় জীবন বাজি রেখে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চষে বেড়ান অবিরাম, নিজের লক্ষ্য পূরণে। লক্ষ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা। সে-উদ্দেশ্যে বছরভর দৌড়াদৌড়ি লেগে থাকে। এবারের গন্তব্য স্থল খড়গপুর আই. আই. টি.। সুবিশাল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর পাঁচটি ভাষণের ব্যবস্থা করেছেন উদ্যোক্তারা। সেজন্য নির্ধারিত দিনে সাউরির বাড়ি থেকে খড়গপুরে চলে এসেছেন তিনি। উঠেছেন উদ্যোক্তাদের বুকিং করে রাখা গেস্ট হাউসে। যে-দিন বক্তৃতা থাকে, গেস্ট হাউসে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গাড়ি। সেই গাড়িতে চড়ে অডিটোরিয়ামে পৌঁছে ভাষণ দেন বৈজ্ঞানিক। 

  সেদিন ছিল বক্তৃতার অন্তিম দিন। আই. আই. টি. অডিটোরিয়ামে ভাষণের সময় ধার্য্য আছে ঠিক বিকেল পাঁচ-টায়। হলঘরে উপস্থিত থাকবেন বিড়লা প্ল্যানেটরিয়ামের তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল প্রফেসর রামানাথ সুব্রামানিয়ান। এদিকে গেস্ট হাউসে ড. রানাও খুব ব্যস্ত। সমস্ত ঔষধপত্র-জামাকাপড় ঢাউস সাইজের স্যুটকেসে ভরে নিয়েছেন। গোছানোর পালা আপাতত শেষ। বক্তৃতা সেরে তিনি কলকাতা ফিরবেন। সেখান থেকে আকাশ পথে সোজা পুনা'র ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (IUCAA)। আই. আই. টি. থেকে কলকাতায় পৌঁছে দিতে সাউরি গ্রাম থেকে হাজির তাঁর অঙ্কের মাস্টার মশাই শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস এবং মাস্টার মশায়ের একজন ছাত্র শ্রী কানাইলাল ব্যানার্জি। তারা দুজন গেস্ট হাউসে বিকাল তিন-টা নাগাদ পৌঁছে গেছেন।
     
তখন সময় বিকাল পৌনে পাঁচ-টা। ঘড়ি মেপে ঠিক পাঁচ-টায় তাঁর ভাষণ শুরু হওয়ার কথা। অথচ গেস্ট হাউস থেকে তাঁকে পিক-আপ করে বক্তৃতামঞ্চে পৌঁছে দেয় যে গাড়ি, তার পাত্তা নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শেষমেশ রিক্সায় চড়ে বসলেন তিনজন।

(দুই)
অডিটোরিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। হলঘর পুরো হাউসফুল। সমস্ত সিট ভর্তি। দর্শক-কাম-শ্রোতাদের ভীড়ে কে নেই! আই. আই. টি.-র সম্মানিত প্রফেসর। পি. এইচ. ডি. স্টুডেন্ট। উদ্যোক্তা। অগণিত ছাত্রছাত্রী। সাংবাদিক। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে প্রত্যেকে আসন গ্রহণ করেছে। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে সবাই।

  ঢং ঢং করে ঘড়িতে পাঁচ-টা বাজল। বক্তার দেখা নেই। উসখুস করছেন সকলে। মৃদু গুঞ্জনে মুখরিত অডিটোরিয়াম। এক মিনিট, দু'মিনিট, ... সময় পেরিয়ে যায়। শ্রোতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম। উদ্যোক্তারা অস্বস্তিতে। প্রায় দশ মিনিট কাল অতিক্রান্ত। বিক্ষোভের আগুন উঁচিয়ে উঠবার পূর্বে অবশেষে হলঘরে পা রাখলেন বৈজ্ঞানিক রানা। তাঁর পেছন পেছন চিত্তস্যার আর ছাত্র কানাইলাল। হলঘরে ঢুকে শেষোক্ত দুজন মঞ্চের সম্মুখে দ্বিতীয় সারিতে দুটি আসন বেছে বসে গেলেন। তাদের সামনের সারিতে বেশ ক'জন আমন্ত্রিত অতিথি। পোশাক আশাকে বেশ ভদ্রলোক গোছের, সম্ভ্রান্ত মনে হয়!

  তখন সময় পাঁচ-টা দশ মিনিট। আর সময় ব্যয় না করে বিজ্ঞানী রানা সোজা মঞ্চে উপবিষ্ট হলেন। তাঁর মূল্যবান বক্তব্য তখনও শুরু হয়নি। এমন সময় প্রথম সারি'র এক ভদ্রলোক বক্রোক্তি করে বসলেন (মৃদু স্বরে)―
'এই যে ভগবান এসে গেলেন!'
সেই ভদ্রলোকের ঠিক পেছনে বসে আছেন চিত্তবাবু। অচিরেই তার কানে গেল কথাটা। শুনা মাত্র চোখ-কান-মুখমণ্ডল লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল চিত্তস্যারের। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি। চুপ করে বসে রইলেন। কোনও প্রত্যুত্তর করলেন না।
    
  ইতিমধ্যে বক্তৃতা আরম্ভ হয়েছে। একঘণ্টার ভাষণ সবে মিনিট দশেক গড়িয়েছে কী গড়ায়নি! হলঘরে যেন পিন-ড্রপ সাইলেন্স। ড. রানা'র কথা ছাড়া অন্য কিছু উচ্চারিত হচ্ছে না। সকলের কান খাড়া। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর বক্তব্য শুনছে। শ্রোতাদের মুখ-চোখে অপার সন্তুষ্টির প্রতিচ্ছবি। চিত্তবাবু বক্তৃতার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। শুধু এটুকু বুঝে গেছেন―খুব সুন্দর বক্তব্য রাখছে তাদের প্রিয় নারায়ণ। শ্রোতাদের মুখমণ্ডলে তার ছায়া স্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছে। তা দেখে মনটা অন্যরকম প্রশান্তিতে আচ্ছন্ন মাস্টার মশায়ের। গর্বে তার বুকটা ছত্রিশ ইঞ্চি চওড়া হয়ে গেল যেন। এতক্ষণ গলায় যেন একটা কাঁটা আটকে ছিল। এখন উতরে গেছে। অস্বস্তি বেমালুম উধাও। নিশ্চিন্ত মনে বক্তৃতায় মনসংযোগ করার চেষ্টা করলেন।

  নির্ধারিত সময়ের আরও কিছুক্ষণ পরে শেষ হল ভাষণ। অডিটোরিয়ামে তখন হাততালির বন্যা বইছে। বেজায় খুশি অতিথি অভ্যাগতের দল। তাদের মুখ-চোখে খুশির ঝিলিক উপচে পড়ছে। আর প্রসন্ন চিত্তে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করছেন ড. রানা। একসময় মঞ্চ থেকে ধীর পদক্ষেপে নিচে নেমে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা কৃত্রিম ভীড় ঘিরে ধরল তাঁকে। মঞ্চের পাশে। ভীড় ঠেলে এগোনো দায়। দেরিতে আসার জন্য এতক্ষণ যারা বক্রোক্তি করছিল, ভীড়ের সর্বাগ্রে তারা। বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন আবদার। হাজারো প্রশ্ন। স্মিত হাস্যে সকলের আবদার মেটাচ্ছেন তিনি। উত্তর দিচ্ছেন হাঁটতে হাঁটতে। আসলে তিনি হেঁটে চলেছেন গাড়ির দিকে। ট্রেন ধরার তাড়া আছে। ধীর পায়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছেন তিনি। তাঁর পেছনে চিত্তবাবু আর কানাইলাল। চিত্তস্যারের সঙ্গে হঠাৎ মুখোমুখি সে-ই ভদ্রলোক, যে কিনা প্রথমের সারিতে বসে বক্রোক্তি করেছিল। তিনি পরিচয় জানতে চাইলেন―
'আপনি কে হন?'
'আমি নারায়ণের অঙ্কের টিচার।'
'আপনি একজন ভাগ্যবান শিক্ষক। বৈজ্ঞানিক নারায়ণ চন্দ্র রানা'কে পড়ানোর সৌভাগ্য অর্জন করেছেন'― প্রশংসায় পঞ্চমুখ আগন্তুক ক্ষণিকের মধ্যে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন।

(তিন)
শরীরটা বড্ড খারাপ। নতুন করে হৃৎপিণ্ডের গোলমাল শুরু হয়েছে। দু-দু'বার পেসমেকার বসেছে তাঁর শরীরে। এত কষ্ট পূর্বে কখনও হয়নি। হার্টের এবারের গণ্ডগোল কৃত্রিম পেসমেকারের কন্ট্রোলেরও বাইরে। হার্টের দক্ষিণ চেম্বারে উপরের দিকে যে বিশেষ কোষের অঞ্চল 'সাইনাস নোড' (Sinus node) থাকে, সেই সাইনাস নোড-ই মূলত হৃৎপিণ্ডের গতি নিয়ন্ত্রণ করে। বেশ ক'দিন ধরে বিজ্ঞানীর সাইনাস নোড-এর কম্পন মিনিটে দু'শ―আড়াইশো বার অতিক্রম করছে। বুক ধড়পড় করছে। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

  ঘটনাক্রমে চব্বিশে অক্টোবর ১৯৯৫ ছিল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের দিন। তার দেড়মাস আগে থেকে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন তিনি, জ্বর গায়ে। শরীরের প্রতি ততটা গুরুত্ব দেননি। তখন থেকে গোলমাল করছে শরীর। নতুন করে অসুস্থতার সেই শুরু। সময়ের সঙ্গে উত্তরোত্তর বেড়েছে হৃৎস্পন্দনের গতি। প্রথম দিকে অতটা আমল দেননি বৈজ্ঞানিক। প্রথম ক'দিন বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন রেস্ট নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় কী! অসুবিধা দিনকে দিন বেড়ে গেল। এ কষ্ট আর সহ্য হয় না! বাড়াবাড়ি হতেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মনস্থির করেন তিনি।
     
  ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ার কথা। নিরুপায় হয়ে পুনে'র হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলেন তিনি। হসপিটালের টেস্টে হৃৎস্পন্দনের মাত্রাতিরিক্ত গতির হদিস ধরা পড়ে। এই উচ্চ গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেসমেকার যন্ত্রটি পুনঃস্থাপন করতে হবে। তবে হয়ত সাইনাস নোড-এর স্পন্দন ঘাত নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডাক্তারবাবুরা সদা ব্যস্ত রইলেন। নার্সদের সতর্ক দৃষ্টি চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর উপর নিক্ষিপ্ত। রি-সেট (reset) করা হল পেসমেকার। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক গতিতে চলতে শুরু করল হার্ট। দশ দিন হাসপাতালের বেডে কেটে গেল। এখন সাইনাস নোড-এর স্পন্দন মিনিটে একশো কুড়ি। দশ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে রিলিজ নেওয়ার সময় এসে উপস্থিত। ছাড়বার পূর্ব মূহুর্তে ডাক্তারবাবু সাবধান বাণী শোনালেন―
'এখন কিছুদিন বাড়িতে সম্পূর্ণ বেড রেস্ট। শরীরের প্রতি যত্নবান হোন। আর কাজের চাপ কমিয়ে ফেলুন।'
'হুম, আচ্ছা'― শুকনো হাসলেন বিজ্ঞানী। শূন্যে চোখ স্থির। দৃষ্টি গভীরে। মুখের দুপাশে গালের মাংসপেশি ঈষৎ কুঁচকে গেল। হাসি হাসি মুখমণ্ডলে কপালের বলিরেখা স্পষ্ট হল। অনেক, অনেক কাজ বাকি তাঁর। সবকিছু কীভাবে সামলাবেন, ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। সাতপাঁচ ভেবে খানিক অন্যমনস্ক বিজ্ঞানী। ডাক্তারের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন।
'হাসছেন যে বড়! দুটোর মধ্যে যেকোন একটা বেছে নিতে হবে আপনাকে―হয় Total bed rest, নতুবা Work and Die'―কথাটা শেষ না করেই তড়িঘড়ি বিদায় নিলেন ডাক্তার।

  ঘরে নরম তুলতুলে আরাম কেদারায় চুপচাপ বসে থাকার চাইতে কাজ করে মরাও শতগুণ ভালো, বেশ গর্বের―মনে মনে ভাবল সে। সেজন্যে ডাক্তারের দ্বিতীয় পরামর্শটা শিরোধার্য করলেন ড. রানা। আগামী বছরের শুরুতে খুব ব্যস্ত শিডিউল তাঁর। পূর্বনির্ধারিত রয়েছে সবকিছু। জানুয়ারির পঁচিশ তারিখ থেকে শুরু লম্বা ট্যুর―মাদ্রাজ (বর্তমানে, চেন্নাই), ভুবনেশ্বর এবং সর্বশেষে, কল্যাণী। পঁচিশ তারিখ বিকেলের ফ্লাইটে পুনে থেকে মাদ্রাজের উদ্দেশ্য রওনা দেবেন। বিকেল সাড়ে চার-টায় পুনে ছাড়বে ফ্লাইট। সেদিনই রাত্রি আট ঘটিকায় মাদ্রাজে অবতরণ। চারদিন থাকবেন সেখানে। তারপর তিরিশে জানুয়ারি সকাল সাড়ে সাত-টার ফ্লাইটে উড়িষ্যা'র রাজধানী ভুবনেশ্বরে। দুদিন ভুবনেশ্বরে কাটিয়ে একত্রিশ জানুয়ারি রাতের ট্রেনে চড়ে হাওড়া ফিরবেন পয়লা ফেব্রুয়ারি দুপুরে। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে যাবেন কল্যাণী। তিনদিন থাকবেন কল্যাণীতে। কাজ সমাপ্ত করে চৌঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ কলকাতা থেকে ফ্লাইটে মুম্বাই হয়ে পুনা'য় ফিরবেন তিনি। সুতরাং ঠাসা পোগ্রাম। এত জার্নি তাঁর শরীরে বইবে তো? ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করে এত ছোটাছুটিতে শেষে হিতে বিপরীত ঘটনা না ঘটে? এদিকে, আবারও একবার চব্বিশে জানুয়ারি ১৯৯৬ বুধবার তাঁর হার্ট টেস্টের দিন ধার্য হয়েছে।

(চার)
'স্যার, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এস. সি. কোর্সে একটা স্পেশাল পেপার চালু করুন। জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বিষয়ে।'
'আমি তোমার বিষয়ে একদম আনাড়ি, নারায়ণ! তুমি আমাকে কী কী করতে হবে এবং কীভাবে এগোতে হবে সব লিখে পাঠাও। দূরবীন কোথা থেকে কিনব কিংবা জোগাড় করব সব ঠিক করে দাও। তারপর আমি সেইমত এগুবো।'
'স্যার, আপনাকে সব পাঠাবো। একদম চিন্তা করবেন না'― বলেই দ্বিতীয়জনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল প্রথমজন। 
  সময়টা ১৯৯৬ সাল। পয়লা ফেব্রুয়ারি। স্থান খড়গপুর স্টেশনের রেলওয়ে প্লাটফর্ম। বেলা সকাল ন'টা-দশ'টা হবে বোধকরি। ডাউন ভুবনেশ্বর-হাওড়া মেল ট্রেন খড়গপুর স্টেশনে অপেক্ষারত। এক্সপ্রেসের একটি বগির সামনে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে কথোপকথন চলছে দুজনের। সিগন্যাল লাল। অগত্যা মেল ট্রেনটি ক'মিনিটের জন্য প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরই ফাঁকে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে ফেলছেন তাঁরা। প্রথমজন বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা। আর দ্বিতীয়জনের পরিচয়―বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাবিদ্যালয়গুলির তদারক-অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই। সন্তোষ স্যারের সঙ্গে প্লাটফর্মে এসেছেন বেলদা গার্লস স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষিকা মাননীয়া বাসন্তী দাস আর অন্য একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। প্লাটফর্মে ভীষণ ভীড়। সন্তোষ স্যার প্লাটফর্মে এসেছেন ছাত্রপ্রতিম নারায়ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ হেতু। ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমে এলেন ড. রানা। প্রণিপাত করলেন স্যারকে। খড়গপুর স্টেশনে তাঁদের একান্ত আলাপচারিতায় বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ানোর প্রসঙ্গ এসে পড়ে, যা প্রথমে উল্লেখিত। আসলে বৈজ্ঞানিক রানা চাইতেন নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা পড়ানো হোক। সেজন্য বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। যেখানে ডাক পড়েছে, শরীরের কথা উপেক্ষা করে ছুটে গেছেন। শরীর পিছিয়ে পড়লেও অদম্য মনের জোর সম্বল করে তিনি এগিয়ে গেছেন। শারীরিক-প্রাকৃতিক সব বাধা ঠেলে দূরে সরিয়ে। পিছু হটেননি। সাহা ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, সত্যেন বোস ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স, আই. আই. টি. সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছেন; হয় বক্তৃতা দিতে কিংবা গবেষণাপত্র পাঠ করতে। কল্যাণী যাওয়ার ফাঁকে স্টেশনে অনেক কথা হল দুজনের। সময় দ্রুত এগিয়ে চলল।
    
হাওড়া অভিমুখে সিগন্যালের লাল আলো কখন যে সবুজ হয়ে গেছে! ট্রেন ছাড়বার হুইসেল বেজে উঠল। ট্রেনের মধ্যে উঠে গেলেন বৈজ্ঞানিক নারায়ণ। ছেড়ে দিল ট্রেন। জানালার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তিনি বললেন―
'স্যার, আসছি।'
  প্লাটফর্মে স্থবির দাঁড়িয়ে রইলেন প্রিয় 'স্যার'। বিদায় হাত নাড়ছেন। প্রথমে ধীর গতি; পরে দ্রুত সরে যাচ্ছে ট্রেন। আপেক্ষিকতার সূত্র ধরে ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে। চোখের অন্তরালে হারিয়ে যাচ্ছে তার প্রিয় নারায়ণ। যতক্ষণ যতদূর দৃষ্টি পৌঁছয়, দাঁড়িয়ে ট্রেনের মিটিমিটি জ্বলা আলো থেকে নজর সরেনি স্যারের। ছোট হতে হতে একসময় বিন্দু হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল নারায়ণ! তখন কে জানত এটাই তাঁর শেষ যাওয়া? হাজার বার চাইলেও আর কখনও সম্ভব হবে না একসঙ্গে তাঁদের কোয়ালিটি সময় যাপন! একান্ত আলাপচারিতা! (চলবে)

তথ্য সহায়তা :
'নিউটনের আপেল ও নারায়ণ'― ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই,
'মেদিনীপুরের বিশ্বজয়ী ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী'― বাদল চন্দ্র দে
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-শিক্ষক শ্রী অতনু মিত্র
বিশিষ্ট শিক্ষক শ্রী অশোক ভৌমিক
মণিস্যারের ভাইপো শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments