জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী - ৫/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩৬


মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তরণের রোমহর্ষক কাহিনী - ৫

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এক দীর্ঘ কোয়ান্টাম লাফ 

দিগন্তরেখা যেখানে আকাশে মেশে, গুঁড়ো গুঁড়ো স্নো পাখা লাগিয়ে উড়ে বেড়ায় হাওয়ায়; কোথায় সমুদ্র আর কোনটা নীলাকাশ বোঝা দুষ্কর সেখানে। যতদূর চোখ যায়, শুধু ধবধবে সাদা। দুধ সাদা বরফের চাদর ঢাকা, না-কি আকাশে ভাসমান সাদা পেঁজামেঘ নেমেছে মাটিতে― প্লেনের জানলা দিয়ে দেখে একলপ্তে বোঝা মুশকিল। প্লেন ল্যান্ড করতেই মালুম হল ব্যাপারখানা। এ মাঝ-আকাশের মেঘমালা নয়; বরং অতীব ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় জমে যাওয়া বরফের আচ্ছাদন! তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। রেকর্ড শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থেকে কমে মাইনাস কুড়ি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে উষ্ণতা। সময়টা ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাস। কানাডায় বৎসরের শীতলতম মরশুম এখন। বিমানবন্দরের টারম্যাকে হাঁটু অব্দি বরফের পুরু স্তর। আলাদা করে রানওয়ে নজরে পড়ে না। শুধু বরফ আর বরফ। বিমানবন্দরের ল্যান্ডিং, বিল্ডিং, সিগন্যাল টাওয়ার, ওয়াচ টাওয়ার, মাঠ, ক্ষেত, রাস্তাঘাট―সব পুরু বরফে ঢাকা। লাউঞ্জে সেন্ট্রাল হিটিং চলছে। খুব গরম না হলেও মানানসই। বাইরে তখন হিমের করাল থাবা, গ্রাস করবে শরীর। মাস দশেকের শিশুসন্তান কোলে। চিন্তা ছোট্ট নির্ভীককে ঘিরে। অতটুকু ছেলে! এত কম তাপমাত্রা সহ্য করতে পারবে তো? মহাফাঁপরে নন্দগোপাল বাবু। বিমানবন্দর থেকে কীভাবে বের হবেন, সে-উপায় খুঁজে পেতে ব্যস্ত। কীভাবে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছনো যায়? কিংকর্তব্যবিমূঢ় তিনি আর কলিদেবী। লাউঞ্জের বাইরে বেরুলে ঠাণ্ডায় শরীর জমে কাঠ হয়ে যাবে। নিরুপায়! যা-হোক, বাইরে এসে ইউনিভার্সিটি থেকে পাঠানো ট্যাক্সি ধরাই শ্রেয় মনে হল। 

রেড-ওক গাছের পাতা ডালপালা অনেকটা ক্রিশমাস ট্রির মতো। রাস্তার দুপাশে তার উপরে থরে থরে বরফ জমে আছে।

রাস্তাঘাটের সে কী করুণ দশা! জনমানবশূন্য। আপন ডেরায় সবাই শীতঘুমে ব্যস্ত যেন। খুব প্রয়োজন না পড়লে এমন খারাপ আবহাওয়ায় বাড়ির বাইরে পা ফেলে না কেউ। বিমানবন্দর থেকে বাসা এক ঘণ্টার লম্বা ড্রাইভ। অথচ মনে হচ্ছে এ পথ কখন শেষ হবে? বরফের স্তুপ ঠেলে সরিয়ে; কঠিন আবহাওয়ার মধ্যে এগিয়ে চলেছে ট্যাক্সি; ওরা তিন সওয়ারী। 

জীবনে সময় বা টাইমিং একটা বড় ফ্যাক্টর―জীবনে থিতু হওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা অন্যত্র প্রতিষ্ঠা পেতে। এক্ষেত্রে সময়ের গুরুত্ব অস্বীকার করা মুর্খামি। প্রায় শত বৎসর পূর্বে একজন বিশ্বখ্যাত তাত্ত্বিক পণ্ডিত বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন বলে গেছেন―অন্যান্য তিন অবস্থান স্থানাঙ্ক (x, y, z)-এর মতো সময়ও একটি স্থানাঙ্ক মাত্র। সময়কে অবস্থানের চতুর্থ মাত্রা (Fourth Dimension) গণ্য করা হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্ধকারময় শূন্যস্থানে সময়ের অপরিসীম গুরুত্ব। তেমনি বৈজ্ঞানিক নন্দগোপালের জীবনে সময়ও একটা বড় ফ্যাক্টর। পাঁচ মাসের কানাডা সফর তাঁর জীবনে এক কালো অধ্যায় রূপে প্রতিভাত হচ্ছিল। কাজে মন নেই। কোনও কিছু ভাল্লাগে না। কেন যেন তাঁর কেবল মনে হচ্ছে―বড্ড ভুল সময়ে তিনি হাজির হয়েছেন পৃথিবীর বিপরীত প্রান্তে।

অথচ আসার পূর্বে সে এক দারুণ অনিশ্চয়তা! ভারত থেকে কানাডা―অনেক পথ; বিশাল বিমান-খরচ। পকেটের ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা। এ কঠিন সময় এগিয়ে এলেন পুত্রের গর্বে গর্বিত পিতা শ্যামাপদ বাবু। ভরসার চওড়া হাত রাখলেন নন্দগোপালের জোয়ান তরুণ কাঁধে। লক্ষাধিক টাকা দিলেন পুত্রকে। লক্ষ্য কানাডায় পোস্ট-ডক্টরেট ডিগ্রি। অথচ তখনও তিনি ডক্টরেট হননি। পি এইচ ডি থিসিস জমা পড়েছে মাত্র। 'রিসার্চ প্রফেশনাল' হিসাবে তাঁর কানাডার ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন। কানাডার উত্তরে আটলান্টিক মহাসাগরের কোলে ছোট্ট শহর হ্যালিফেক্স। ছবির মতো চোখ ধাঁধানো শহর। নোভা স্কোশিয়া অঞ্চলে, হ্যালিফেক্স শহরে অবস্থিত এই ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়। সারা বৎসর বেশ মনোরম আবহাওয়া। যত গণ্ডগোল কেবলমাত্র জানুয়ারিতে। ঠাণ্ডার চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
      

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় বত্রিশ তলার একটি হাই-রাইজিং টাওয়ার-এর সামনে। এর সাতাশ তলায় থাকার সুন্দর বন্দোবস্ত। আগে থাকতে বুকিং করে রাখা ছিল। হ্যালিফেক্স ইউনিভার্সিটির অফিসিয়ালরা সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছে। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে লিফট ধরে সোজা সাতাশ তলায়। ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট। বেশ প্রশস্থ। ব্যবস্থা অতিশয় ভালো। আধুনিক জীবন যাত্রার সব রকমের ব্যবস্থা হাতের নাগালে। রুম হিটিং, ওয়াশিং মেশিন, মডিউলার কিচেন, রান্নার সরঞ্জাম―সঅব আছে। বিনোদনের জন্য রয়েছে প্লাজমা টেলিভিশন। ফ্ল্যাট থেকে পুরো শহর দেখা যায়। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! ভাষায় অপ্রকাশিতব্য। 

উন্নত দেশ। উন্নত তার জীবন প্রণালী। ঘড়ির কাঁটায় সব কিছু বাঁধা। একচুল এপার-ওপার হবার নয়! অদ্ভূত যান্ত্রিকতায় দ্রুত গতিতে ছুটছে সকলে। এ হেন দৌড় ঝাঁপের জীবনে সময়ের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চলার অনেক ঝক্কি। বিস্তর সমস্যা। একদিনের ঘটনা। দেশ থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে নকশা দেওয়া গয়না বড়ি সঙ্গে করে এনেছেন কলিদেবী। রান্নার কড়াইতে তেল সহযোগে কলিদেবী বড়ি ভাজায় ব্যস্ত। সুন্দর নকশা বড়ির গন্ধে ম ম করছে ঘর। স্বল্প ধোঁয়া ফ্ল্যাটের সর্বত্র। যেই না অবাধ্য ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল ঘরের কোণায় কোণায়; অমনি ঘরের মধ্যে বেজে উঠল বিপদ-ঘণ্টি―ফায়ার এলার্ম। ব্যাস, আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে এসে হাজির ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটি গার্ড। ছ'ফুটের উপর লম্বা প্রত্যেকে। দৈত্যাকার চেহারা। বেজায় ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো চেহারা। অপ্রস্তুতে পড়ে গেলেন নন্দগোপাল বাবু। দরজা খুলে সরেজমিনে তদন্ত চলল বেশ কিছুক্ষণ― কোথায় লেগেছে আগুন! হাজার একটা প্রশ্ন। প্রশ্নবাণে জর্জরিত গৃহস্থ। জিজ্ঞাসাবাদের ধরন আর ঘটনার আকস্মিকতায় নন্দবাবু ও কলিদেবী―দুজনের বিস্তর নাজেহাল দশা। সে-যাত্রায় ছাড়া পেলেও কী করতে হবে আর কী করা যাবে না―তার একটা লম্বা লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিল সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষ।

সেহেতু দুজনের মন পড়ে স্বদেশে; ভারতে। বিদেশ বিভুঁই-এর শিক্ষা-সংস্কৃতি, মাত্রাতিরিক্ত ঠাণ্ডা, নির্ভীক-এর অনর্গল কান্না আর বিরূপ প্রকৃতি―এদের যৌথ যাঁতাকলে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা তখন। কখন, কীভাবে দেশে ফিরে আসবে―মাথার মধ্যে সর্বক্ষণের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কাজেও তেমন যুত নেই নন্দবাবুর। আর ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজটাও গবেষণামূলক নয়; বড্ড বেশি সিভিল কাজ। তাই মন নেই কাজে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে দেশে ফেরা মনস্থির করলেন তিনি। সেটা ২০০৪ সালের মে মাসের শেষদিক। সত্যি সত্যি ইন্ডিয়াগামী বিমানে চড়ে বসলেন তাঁরা।

(দুই)
বাড়িতে যথেষ্ট কাজ নেই হাতে। বেহাল দশা! একপ্রকার বেকার! দেশের বাড়ি কুনারপুরে অবস্থান করছেন পরিবার সমেত। কুনারপুরে তখনও কারেন্ট আসেনি। বেজায় কষ্ট। তায় জুন মাস! তীব্র ভ্যাপসা গরম। ছোট্ট নির্ভীক-এর বয়স সবেমাত্র এক বৎসর অতিক্রান্ত। কানাডার প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থেকে হঠাৎ খুব উষ্ণ অঞ্চলে পৌঁছে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা ছোট্ট শিশুর। নন্দবাবু কথা বললেন আই আই টি খড়গপুরের শ্রদ্ধেয় গাইড প্রফেসর সি কে দাস-এর সঙ্গে। ছোট্ট প্রোজেক্টের কাজে পুনরায় যুক্ত হলেন। সে-কাজ দেখিয়ে জাকির হোসেনে ফ্ল্যাটের দরখাস্ত করলেন। মিলল ফ্ল্যাট। জুন-জুলাই মাসে উঠে গেলেন ফ্ল্যাটে। প্রথম ক'দিন থাকার জন্য বন্ধু ধনঞ্জয় আর শম্পাদি'র ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছিলেন।

এসময় কী করণীয়, কী করণীয় নয়―দ্বিধাগ্রস্থ তিনি। পোস্ট-ডক্টরেট-এর জন্য বিদেশ গমন, না-কি দেশের ভেতর কাজের জন্য চিরুনি তল্লাশি অনুসন্ধান! ভেবে ভেবে রাতদিন কাবার হয়ে যায়, কুলকিনারা পাচ্ছেন না। শেষে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা― পোস্ট-ডক্টরেটের জন্য বিদেশ গমন করবেন। ভাবনা আর প্রত্যয়ের মাঝে সামঞ্জস্য রেখে আবেদন করে বসলেন দক্ষিণ কোরিয়ার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কনকুক ইউনিভার্সিটি আর ফুসান ইউনিভার্সিটি। দুটোই বেশ নামকরা। দু'জায়গা থেকে এল স্বীকৃতি। এবার নিজের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার।
         
শেষমেশ কনকুক ইউনিভার্সিটি জয়েন করা মনস্থির করলেন। এখানেই রয়েছে 'আর্টিফিসিয়াল মাসল্ রিসার্চ সেন্টার' (Artificial Muscle Research Centre)। এই রিসার্চ সেন্টারে যুক্ত হতে উড়ে গেলেন ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের একত্রিশ তারিখে। বছরের শেষ দিনে চেপে বসলেন রাজধানী সিওল-গামী এরোপ্লেনে। সরাসরি ফ্লাইট নেই। বিমান প্রথমে উড়ে গেল থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ডে ছয়-সাত ঘণ্টা বিরতির পর সরাসরি গেল সিওল-এর উদ্দেশ্যে। পরের দিন ইংরেজি নববর্ষ। ২০০৫ সালের পয়লা জানুয়ারি। সেদিন বৎসরের প্রথম আলো গায়ে মেখে প্লেন ল্যান্ড করে সিওল বিমানবন্দরে। জীবনে এই প্রথমবার তাঁর কোরিয়া আগমন। রাস্তাঘাট, লোকজন সবই অপরিচিত। বিমানবন্দর থেকে ইউনিভার্সিটি কতদূর কে জানে? টেলিফোনে ইউনিভার্সিটির গাইড প্রফেসর জেই হোয়ান চো'র সঙ্গে যে-টুকু কথা হয়েছে; তাঁকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে একজন উপস্থিত থাকার কথা। তবে সে কে, তার বয়স কত, দেখতে কেমন; কিচ্ছু জানা নেই। পুরোটাই অনিশ্চিত। কিছুটা গুগল সার্চ, কিছুটা লোকমুখে শোনা―রাজধানী সিওল-এ শীতলতম মরশুম জানুয়ারি। এসময় তাপমাত্রা শূন্যের আশপাশে উঠানামা করে। আবহাওয়া কেমন থাকবে জানা নেই। তাই এইবার আর রিস্ক নয়। ছেলে-বউকে বাড়িতে রেখে একা একা তাঁর দক্ষিণ কোরিয়া আসা। পরিস্থিতি অনুকূল বুঝলে পরে ডেকে পাঠাবেন দুজনকে। 

বিমানবন্দরে ল্যান্ড করেছে বিমান। তখন সকাল দশটা। দীর্ঘ প্লেন যাত্রার ধকল। মহিলা ঘোষকের সুরেলা গলায় অবোধ্য ভাষায় একটানা ঘোষণা― সম্ভবত বিমান ওঠানামার সময়সূচি। মিনিট পনেরোর বিরতি। লাগেজ ভেরিফিকেশন চলছে। ভেরিফিকেশন কমপ্লিট হলে সরাসরি লাউঞ্জে হাজির যাত্রী সকল। খুব ব্যস্ত সবাই। লাউঞ্জের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে দৃষ্টি পড়তে একটা ছেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে―
'মিস্টার সাহু? ফ্রম ইন্ডিয়া?'
সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন নন্দগোপাল বাবু।
'ওয়েলকাম টু দক্ষিণ কোরিয়া, স্যার'―আজানু নত হয়ে বিশেষ কায়দায় সম্বোধন জানায় ছেলেটি। বয়েস খুব বেশি নয়; তিরিশের ভেতর। চলতে চলতে কথা হচ্ছে ইংরেজিতে। আসলে ছেলেটি একজন রিসার্চ স্টুডেন্ট; প্রফেসর জেই হোয়ান চো'র আন্ডারে। প্রফেসর তাকে বিমানবন্দরে পাঠিয়েছেন অতিথি রিসিভ করতে। কথা বলতে বলতে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পৌঁছলেন তারা দুজন। এতক্ষণ ঠাণ্ডা অনুভূত হয়নি। বিমানবন্দরের বাইরে কিন্তু বেজায় ঠাণ্ডা। হাড় কাঁপানো শীত। বাইরে তখন অল্প বিস্তর স্নো-ফল চলছে। খুব ছোট ছোট সাদা বরফের টুকরোগুলো হাওয়ায় উড়ছে। মৃদু উত্তুরে হাওয়া বইছে। চোখে, মুখে হিমের চাবুক মারছে যেন।

মসৃণ গতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। বলা নেই, কওয়া নেই; অর্ধেক রাস্তায় ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। সম্মুখে আরেকটি ফোর হুইলার। তার দরজা খুলে বের হলেন একজন মাঝবয়সী কোরিয়ান ভদ্রলোক। ইনিই প্রফেসর জেই হোয়ান চো, তাঁর গাইড। অর্ধেক রাস্তায় বয়স্ক প্রফেসর স্বয়ং উপস্থিত। এত অভ্যর্থনায় আপ্লুত নন্দগোপাল বাবু। 'ইট'স আ গ্রেট অনার টু হিম'―মনে মনে ভাবেন তিনি। 
    
একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে থামল গাড়ি। ইতিমধ্যে নেমে পড়েছেন প্রফেসর জেই হোয়ান চো। নন্দগোপাল বাবু তাঁর ব্যাগপত্র নামাতে ব্যস্ত। সুন্দর ছোট্ট একটি বাড়ি। এখানেই তাঁর থাকার পাকাপাকি বন্দোবস্ত। বাড়িভাড়া থেকে ইউনিভার্সিটি মাত্র দুটো মেট্রো-স্টেশন দূরে। মিনিট তিরিশের সামান্য হাঁটা পথ। বেশিরভাগ দিন পায়ে হেঁটে সে-পথ পার হয়ে যান তিনি।

(তিন)
মিরাকল! অভূতপূর্ব! অত্যাশ্চর্য ঘটনা! মাত্র তিন মাসে রিসার্চ পেপার জমা। অবিশ্বাস্য ঘটনা! এমনই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন নন্দগোপাল বাবু। এ ঘটনায় যারপরনাই খুশি তাঁর পোস্ট-ডক্টরেট রিসার্চ গাইড প্রফেসর জেই হোয়ান চো। ডিপার্টমেন্টে সকলের সমীহ আদায় করে নিয়েছে তাঁর কাজ। কিন্তু কী এমন কাজ, যা দেখে মুগ্ধ সকলে?

আধুনিক সমাজে পলিমার যৌগের আধিপত্য, প্লাস্টিকের রমরমা। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, পলিথিন, ক্যারিব্যাগ, পলিব্যাগ প্রভৃতি পলিমারের বহু রূপ। পলিইউরিথেন (Polyurethane) তেমনই এক বহুমুখী পলিমার। তবে খুব শক্ত, দৃঢ়, নমনীয় আর অসম্ভব কাঠিন্য ধর্মে ভরপুর। পলিইউরিথেন পলিমারটি তেল, (অ্যারোমেটিক) হাইড্রোকার্বন, অক্সিজেন ও ওজোন গ্যাসে বাধাদানকারী বদ্ধ ম্যাটিরিয়াল হিসাবে পরিচিত। পূর্বে এ হেন পলিমার দিয়ে তৈরি হত কৃত্রিম লেদার জ্যাকেট, যা খুব পাতলা আর ওজনে খুব হালকা, বৃষ্টির জল লেদার ভেদ করে চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে না। তবে এর স্থায়ীত্ব বেশি দিন নয়। সাবানজলে ধোয়া যায়।
      
পলিইউরিথেন পলিমার ব্যবহারের অনেক অসুবিধা। এটা বিষাক্ত আইসো-সায়ানেট যৌগ দিয়ে তৈরি। এই মারণ যৌগ দিয়ে তৈরি জিনিস নিয়মিত ব্যবহারকারীর ফুসফুসে আক্রমণ করে। ফুসফুসের রোগ বাসা বাঁধে শরীরে। এই পলিমারের বিস্তর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। শুধু ফুসফুস নয়, অ্যাজমার মতো বংশগত রোগ নিজের অজান্তে আপন শরীরে ডেকে আনে ব্যবহারকারী।

এ হেন পলিইউরিথেন পলিমারের সঙ্গে পরিবাহী ফিলার (Conductive Fillers) জাতীয় পদার্থের সংশ্লেষণ ঘটানো হয়। সংশ্লেষ ঘটিয়ে তৈরি করা হয় তড়িৎ-সক্রিয় শেপ-মেমোরি পলিমার (Electroactive Shape-Memory Polymer)। এভাবে উৎপাদিত পলিমারকে নির্দিষ্ট ভোল্টেজ প্রয়োগ করে মেমোরি ডিভাইসের আকার-আকৃতির পরিবর্তন করার কাজে ব্যবহার করা হয়। স্পেস ভেহিক্যাল-এ বহুল ব্যবহত হয় এ ধরণের পলিমার।
    
তা, এ হেন পলিমার নিয়ে নন্দগোপাল বাবুর কাজটা ঠিক কী ছিল? পলিইউরিথেন পলিমারের কোন কোন ধর্ম উন্নত করা নিয়ে তিনি কী কাজ করেছিলেন? 

বহুল প্রচলিত একটি পলিমার হল ইলেকট্রো-অ্যাকটিভ শেপ-মেমোরি যৌগ (Electroactive Shape-Memory Composites)। এটি তৈরি হয় শেপ-মেমোরি পলিইউরিথেন ব্লক কো-পলিমার (Shape-Memory Polyurethane Block Copolymer বা PU) থেকে। এই তড়িৎ-সক্রিয় শেপ-মেমোরি পলিমার এবং তিন জাতের ফিলার যথাক্রমে, বহুস্তরীয় কার্বন ন্যানোটিউব (Multi-Walled Carbon Nanotube বা সংক্ষেপে MWNTs), পলিপাইরোল (PolyPyrrole বা সংক্ষেপে PPy) ও পলিপাইরোল (PPy)-এর প্রলেপ দেওয়া বহুস্তরীয় কার্বন ন্যানোটিউব (MWNTs)― এদের ধর্ম পর্যবেক্ষণ করেন নন্দগোপাল বাবু। এর সঙ্গে, বিভিন্ন MWNTs এবং PPy কম্পোজিশন সংবলিত একগুচ্ছ পলিমার যৌগ প্রস্তুত করেন। তাদের যান্ত্রিক, তাপীয়, অঙ্গসংস্থানগত আর তড়িৎ-সক্রিয় শেপ-মেমোরি প্রপার্টি পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়। বিভিন্ন স্ক্যান নির্ভর ক্যালরিমেট্রিক ফলাফল যাচাই করে দেখা যায়― পলিইউরিথেন যৌগের অভ্যন্তরে MWNTs পদার্থের সংযুক্তির ফলে তৈরি পলিইউরিথেন ন্যানো-কম্পোজিট যৌগটির স্ফটিক স্বচ্ছ ধর্ম বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। রঞ্জন-রশ্মির বিক্ষেপন প্রণালীর সাহায্যে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ইলেকট্রনিক স্ক্যান মাইক্রোস্কোপে সত্যি সত্যি ধরা পড়ে, PU ন্যানো-যৌগে পলিইউরিথেন যৌগের মেট্রিক্সে MWNTs-এর কণাগুলি সমস্বত্ত্ব আকারে গ্রথিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, MWNTs ও পলিইউরিথেন মেট্রিক্স―উভয় পদার্থের সংযুক্ত অঞ্চলের আসঞ্জন (আঁঠার মতো) গুণাগুণ বেশ বেড়ে গেছে। এর ফলে MWNT-PU যৌগের যান্ত্রিক ধর্মাবলী (Mechanical Properties) কয়েক শতাংশ বেড়ে গেছে। বিশুদ্ধ PU যৌগের থেকে সংশ্লেষিত পলিমারের মাপাঙ্ক (Modulus) ও প্রসারণ ক্ষমতা শতাংশের হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরপক্ষে, PU যৌগে পলিপাইরোল অন্তর্ভুক্তির ফলে প্রসার্য ক্ষমতা আর মডিউলাস দুটোই আবার বিপরীতক্রমে কমেছে। এখন একযোগে MWNT ও PPy-এর মিশ্রণ মেশানো হলে MWNT-PU যৌগের তড়িৎ পরিবাহিতাও বেড়ে যায়। এই তড়িৎ পরিবাহিতা সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছয় যখন MWNT-PU যৌগের পৃষ্ঠদেশে পলিপাইরোল-এর পাতলা আস্তরণ দেওয়া হয়। আর তখন স্বল্প মাত্রার তড়িৎ পরিবাহিতা যথেষ্ট হয়, যখন চল্লিশ―আটচল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্থানান্তর তাপমাত্রা (Transition Temperature)-এর উপরে উত্তপ্ত করলে সেটা তড়িৎ-সক্রিয় আকার পুনরুদ্ধার (Electroactive Shape Recovery) যৌগে পরিনত হতে সক্ষম হয়। তাই, শতকরা নব্বই―পঁচানব্বই পাল্লার আকার পুনরুদ্ধার করতে হলে শেপ রিকোভারি টেস্ট করানোর সময় মাত্র পঁচিশ ভোল্ট বিভব প্রয়োগ করলেই যথেষ্ট।

এমনই হাজারো ধর্মের মিশেলে তৈরি পলিমার বিষয়ে নন্দগোপাল বাবু আজও নিরলস কাজ করে চলেছেন।

(চার)
এ যেন সাফল্যের এক উচ্চ কোয়ান্টাম লম্ফন। এক ধাক্কায় অনেকটা পথ লাফ দিয়ে বসা; তাঁর সাফল্যের পথ গেল খুলে। তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট! এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে তাঁর স্বপ্নের উড়ানের শুরু। মনের মত কাজ, কাজের দুর্দান্ত পরিবেশ আর সর্বোপরি খুব ভালো মানুষ তাঁর শ্রদ্ধেয় রিসার্চ গাইড অধ্যাপক জেই হোয়ান চো ― এমন পরিমণ্ডল ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে তাঁকে। সেজন্য তিন মাসের ভেতর রিসার্চ পেপার জমার মতো আপাত কঠিন চ্যালেঞ্জ জয় সম্ভব হয়েছে।

২০০৫ সালের এপ্রিল মাস। তাঁর কোরিয়ার বাসায় এল স্ত্রী-পুত্র। ইতিপূর্বে, কানাডা সফরের অব্যাহতি আগে চাকুরির সুযোগ এল মাস্টার-উত্তীর্ণ কলিদেবীর নিকট। হেলায় প্রত্যাখ্যান করলেন সে-চাকুরি। তখন তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছোট্ট নির্ভীক-এর পরিচর্যা, যত্ন-আত্তী করা আর নন্দগোপাল বাবুর প্রতীষ্ঠা। অন্য কোনও দিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ তাঁর নেই। নিজের চাকুরির থেকে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরে রাখা। কেননা, সংসারের সাতে-পাঁচে নিজেকে জড়াননি নন্দগোপাল বাবু, কলিদেবী জড়াতে দেননি। ফলে সম্ভব হয়েছে নিজের গবেষণায় অনেক বেশি ফোকাস ধরে রাখা। সংসারের কোনও ঝামেলা তাঁকে পোহাতে হয় না। সবকিছুই কলিদেবী একা হাতে দেখভাল করেন। নন্দবাবুর বন্ধু-স্থানীয় দাদা দেবাশীষদা বলেন― 
'আসলে কলি আর নন্দগোপাল যেন একে অন্যের পরিপূরক। দুজনেই খুব ভালো মনের মানুষ।'

এদিকে যে-কলোনিতে তাঁদের বাস, সেখানে দু-একটি থাই-পরিবারের বসবাস, যারা ইংরেজিতে কথা বলে। ইংরেজিতে 'হাই', 'হ্যালো' পর্যায়ের স্বল্প পরিচিতি তাদের সঙ্গে। বাকি সব কোরিয়ান ফ্যামিলি। স্বভাবতই তাদের কথ্যভাষা কোরীয়। কোরিয়ান ভাষায় যাবতীয় কথাবার্তা, মনের ভাব প্রকাশ করে নিজেদের মধ্যে। একদণ্ড সে-ভাষা বোঝা দায়। এ তল্লাটে কোনও ভারতীয় ফ্যামিলি নেই যে দুদণ্ড গল্প করবেন, দেশের গপ্পো হবে, সুবিধা-অসুবিধা শেয়ার করবেন। ফলে একঘেয়েমি গ্রাস করে। মনখারাপ নিত্যসঙ্গী।
      
অধ্যাপক জেই হোয়ান চো'র মতো ভালো মানুষ মেলা দুষ্কর। অসম্ভব ভালো মনের মানুষ তিনি। নন্দগোপাল বাবুর সমস্যা সবই তিনি বোঝেন। বোঝেন বলেই পরিবার সমেত সপ্তাহান্তে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যান নন্দগোপাল বাবুকে, ডিনার সারতে। ফ্যামিলি নিয়ে বেড়ানোর পরামর্শ দেন। শুধু শুকনো পরামর্শ দিয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেন না; ছুটি মঞ্জুর করে জোরপূর্বক নিজে সঙ্গে করে ঘুরতে নিয়ে যান নন্দবাবুর পুরো ফ্যামিলিকে। এভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছেন। উত্তর আর দক্ষিণ―দুই কোরিয়ার সীমান্ত এলাকা ভ্রমণ এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল, চির ভাষ্মর হয়ে আছে।

মন বেজায় অদ্ভুত জিনিস। তাকে বেড়ি পরানো এক দুঃসাধ্য শক্ত কাজ। সুযোগ পেলেই উন্মুক্ত উড়ে বেড়ায় সে। মনখারাপ করে। একরাশ দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়ায়। এমনই এক দুঃস্বপ্নের সংবাদ নিয়ে এল তারহীন মুঠোফোন। উদভ্রান্ত কোমল মন অস্থির। মনের কষ্ট মনের ভেতর ঘুরপাক খায়। বাহির হবার পথ খুঁজে পায় না। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। কলিদেবীর পিতা গত হয়েছেন। পিতার শোকে মুহ্যমান তিনি। সে এক কঠিন সময়। কলিদেবীকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবেন, ভেবে ভেবে দিশেহারা নন্দগোপাল বাবু।

সর্বসাকুল্যে এক বৎসর সাত মাস। ওই সময় টুকু তাঁরা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল-এ ছিলেন। ওখানে থাকতে থাকতেই সিঙ্গাপুরের ন্যানিআঙ্গ টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (Nanyang Technological University বা সংক্ষেপে NTU)-এ আবেদন করে বসলেন। মঞ্জুর হল সে-দরখাস্ত। যে-দিন প্রথম চলে আসার সংবাদ প্রফেসর জেই হোয়ান চো'র কর্ণগোচরে প্রবেশ করে, সেদিন ফ্যাকাসে হয়ে গেছল চল্লিশোর্ধ্ব অধ্যাপক মানুষটির। তাঁর মন সায় দেয়নি। তিনি মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন― নন্দগোপাল বাবু এবং তাঁর ফ্যামিলি সিওল-এ সেটলড্ করুক। পার্মানেন্ট। চিরস্থায়ী। কিন্তু সে হবার নয়। নন্দগোপাল বাবু চোখের জলে বিদায় জানালেন সিওল-কে, কনকুক বিশ্ববিদ্যালয়কে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রিয় ছাত্রকে বিদায় জানালেন প্রফেসর জেই হোয়ান চো। নন্দগোপাল বাবুর জীবনে একটি সুন্দর অধ্যায়ের দারুণ পরিসমাপ্তি ঘটল। ২০০৬ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে তিনি চলে এলেন সিঙ্গাপুরের ন্যানিআঙ্গ টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি (NTU)-তে। (চলবে)

তথ্য-ঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সেজদা শ্রী ননিগোপাল সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বন্ধুস্থানীয় দাদা শিক্ষক শ্রী দেবাশীষ মান্না

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments