জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তোরণের রোমহর্ষক কাহিনী -৪/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩৫

মেদিনীপুরের রসায়ন বিজ্ঞানী ড. নন্দগোপাল সাহু : সাধারণ থেকে 'অসাধারণ'-এ উত্তোরণের রোমহর্ষক কাহিনী -৪

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

আঙিনাতে/যে আছে অপেক্ষা ক'রে, তার/পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিন্দুর 


সাকুল্যে একটি মাত্র কক্ষ। দশ-বাই-বারো সাইজ। ঘরে একটিই মাত্র ছয়-সাত ইংলিশ খাট। আর স্টিলের আলমারি। জামা-কাপড়ের র‍্যাক। মোটা মোটা বইয়ের তাক। কাগজপত্র, দরকারি ফাইল। মাঝারি সাইজের শতরঞ্জি গোটা দুই। আর কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। রুমে হাত-পা নাড়াচাড়া করার ফাঁকা জায়গার বড্ড অভাব। মূল রুম থেকে হাত দশেক দূরে রান্নাঘর। কিচেনে রান্নার সরঞ্জামে ঠাসা। মূল দরজার সামনেটায় সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। ইঁটের গাঁথুনি ঘেরা। খোলা জায়গাটা পার হলে লোহার গেট, আংটা লাগানো।

ঘরে প্রাণী সর্বসাকুল্যে দুজন। নাহ, আরও আছে―দুটো টিকটিকি, অগুনতি ছোট বড় আরশোলা আর অগণিত ছোট ছোট লাল পিঁপড়ে। শেষের জনের জ্বালায় গৃহস্থের প্রাণ ওষ্ঠাগত। মিষ্টি জাতীয় জিনিসের দারুণ ভক্ত ওরা। এক টুকরো মিছরি বা চিনি পাকার মেঝেতে পড়ে থাকবার জো নেই। অমনি লাইন বেঁধে দলে দলে সব হাজির। চেটেপুটে খেয়ে সবার প্রথমে সাবাড় করবে, তারপরে প্রস্থান। লক্ষণ-খড়িতেও যায় না হতচ্ছাড়া নচ্ছার পিঁপড়েগুলো। এমনই তাদের জেদ! একলপ্তে এই ছিল নন্দগোপাল আর কলিদেবীর প্রথম সংসার পাতা। মেদিনীপুর শহরে; রাজাবাজারের সন্নিকটে।

২০০০ সালের জানুয়ারি মাস। শরীর থেকে তখনও বিয়ের গন্ধ মুছে যায়নি পুরোপুরি। শুরু হল দুজনের বেঁচে থাকার আসল লড়াই। সে এক অসম কঠিন সংগ্রাম। জীবনের রুক্ষ মাটিতে, বাস্তবের কর্কশ ভূমিতে দাঁড়িয়ে নব বিবাহিত দম্পতির ঘরকন্না আরম্ভ হল ওয়ান বেডরুমের ভাড়া ঘরে। আয় স্টাইপেন্ডের সামান্য টাকা। নন্দগোপাল তখন আই আই টি খড়গপুরে একটা ছোট্ট প্রোজেক্টের কাজে নিয়োজিত। উপবৃত্তি যৎসামান্য টাকা। এই সামান্য উপবৃত্তির টাকায় দুজনের সংসার ভালোভাবে চলে না। কলিদেবী তাঁর স্নাতক তৃতীয় বর্ষের পঠনপাঠন নিয়ে বেজায় ব্যস্ত। কলিদেবীর মেজদি কুহুদেবী আর জামাইবাবু শ্রী অমিত নায়েক তখন মেদিনীপুরে জর্জকোটের বাসিন্দা। দিদি-জামাইবাবু এসময় খুব সাহায্য করেছেন তাদের।

পি এইচ ডি'র এনরোলমেন্ট হয় ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রফেসর ড. চপল কুমার দাস স্যারের আন্ডারে। খড়গপুর আই আই টি'তে ল্যাবে রোজ নন্দগোপালের যাতায়াত ট্রেনে চড়ে। মেদিনীপুর থেকে সকাল আটটার পরে ছাড়ে লোকাল। আধ ঘণ্টায় গিরিময়দান স্টেশন। স্টেশনে নেমে বাস অথবা অটো গাড়ি নয়, নিজের দ্বিচক্রযান সাইকেলে চড়ে সোজা খড়গপুর আই আই টি। প্রতিদিন সাইকেলটি ট্রেনের ভেন্ডার কামরায় সঙ্গে আনে সে। ট্রেনের টি টি আই-এর নজর এড়িয়ে। সে এক দারুণ ঝক্কি! ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার! ধরা পড়লে চড়া ফাইনের ভ্রুকুটি ঘাড়ের'পর। চালান কাটবে দুষ্টু টি টি আই। পকেটে অত টাকাও নেই যে ফাইন ভরবে। মাঝে মধ্যে লোকাল ট্রেনে স্পেশাল চেকিং চলে। ন্যূনতম সংকেত পেলে তখন ট্রেন থেকে মাঝপথে নেমে পড়ে সে, সে-স্টেশন গিরিময়দান হোক, কিংবা গোকুলপুর। তারপর সাইকেলে ফেরা বাকি পথ; নয়-দশ কিলোমিটার চড়াই উতরাই রাস্তা। ফেরা সেই ভর সন্ধ্যায়। আর তার ফেরার আশায় ঘরের আঙিনায় একজোড়া চোখের ক্লান্তিহীন অপেক্ষা। ফি-দিনের একটাই রুটিন। ফিরে এসে অব্দি নন্দগোপালের নিস্তার নেই। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তার পথ চেয়ে বসে থাকে বাসায়। বিকল্প আয়ের সন্ধানে ইতিমধ্যে কেমিস্ট্রি অনার্সের স্টুডেন্ট পড়ানো শুরু করেছে সে। নিজেদের বাসা বাড়িতে। মেঝেতে শতরঞ্জি পাতা। হাত-পা-মুখ ধুয়ে শীঘ্রই মেঝেতে পড়াতে বসে সে। যখন নন্দস্যার টিউশনি পড়ান, কলিদেবী হয় রান্না ঘরে নিজের পড়াশুনায় ব্যস্ত কিংবা রান্নাবান্নার কাজে নিযুক্ত। এছাড়া অন্য গত্যন্তর নেই। অনন্যোপায় তিনি। কষ্টে সৃষ্টে আট-নয় মাস কাটল দুজনের। যদিও সুদিনের দেখা অমিল, তবু নন্দবাবুর ভয় অন্যত্র। অজানা আশঙ্কায় সর্বদা চিন্তিত তাঁর হৃদয়-মন। ভাবলেই হাত-পা ঠাণ্ডা কেমন হওয়ার জোগাড়! থরহরি কম্প অবস্থা!
         
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ভূমি। মহাপরাক্রমশালী গুরু দ্রোণ তখন কৌরবদের সেনাপতি। অমিত বিক্রমে যুদ্ধে লিপ্ত পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে। গুরু দ্রোণের পরাজয়ের ন্যুনতম আশা নেই। এমন সময় ছলনার আশ্রয় নিলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির। 'অশ্বত্থামা ইতি গজ'। 'গজ' শব্দটি খাটো গলায় উচ্চারণ করলেন যুধিষ্ঠির। পুত্র অশ্বত্থামা'র মৃত্যু সংবাদে উন্মাদ-প্রায় পিতা অকস্মাৎ দিশেহারা। এতে পাণ্ডবের আসল উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়। আসলে, যুধিষ্ঠির সেদিন কোনও মিথ্যা কথা বলেননি; কেবল প্রকৃত সত্য গোপন ক‍রেছিলেন মাত্র। একই রকম, নন্দবাবুও তাঁর শ্রদ্ধেয় রিসার্চ-গাইড প্রফেসর চপল কুমার দাসের কাছ থেকে রিসার্চ পূর্ববর্তী নিজের বিবাহের ঘটনার কথা গোপন করেছিলেন মাত্র। যদিও তা একটি গুরুতর অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত। আসলে প্রফেসর দাসের একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল―বিবাহের পরে রিসার্চ কমপ্লিট করতে পারবে না পি এইচ ডি-রত স্কলাররা। মাঝপথে রণে ভঙ্গ কতক্ষণ? অথচ বিয়ের পরে দিব্যি তরতরিয়ে চলছে নন্দগোপালের গবেষণা। কোনও অসুবিধা নেই। বরং নিজের পায়ের নিচের অশক্ত জমি সুদৃঢ় করতে তার এই কৃচ্ছ্রসাধন। এভাবে আট-নয় মাস সুখে শান্তিতে, নরমে গরমে চলল দুজনের ঘরকন্না।

(দুই)
আই আই টি ক্যাম্পাসে স্যারের কোয়ার্টার। দরজার বাইরে কাঁচুমাচু মুখে মহাদেবদা দাঁড়িয়ে। মহাদেবদা নন্দগোপালের সিনিয়র; আই আই টি'তে প্রফেসর সি কে দাসের আন্ডারে রিসার্চ করে। কলিং বেল বাজে। তিরিশ সেকেন্ডের বিরতি। দরজা খুলল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ম্যাডাম, স্যারের পত্নী―
'মহাদেব, কিছু বলবে?'
'হ্যাঁ, একটা জরুরি কথা ছিল, ম্যা'ম'― মহাদেবের শঙ্কিত উত্তর।
'তোমার স্যার তো এখন কোয়ার্টারে নেই। ল্যাবে গেছেন।'
'নাহ! আপনার সঙ্গে কথা ছিল?'
'আচ্ছা, ভেতরে এসো। বসো'― গুরুপত্নীর পিছু পিছু মহাদেব ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল। এ হেন গুরুপত্নীর মাতৃমমতায় আপ্লুত সকল পি এইচ ডি স্টুডেন্ট। গর্হিত কোনও কাজ করলে অথবা দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে স্যারের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস কারও ছিল না। যত অন্যায় আবদার মাতৃসমা ম্যামের কাছে সভয়ে পেস করে সবাই। সমাধান হেতু সেরকম এক আর্জি নিয়ে এসেছে মহাদেব, নন্দগোপালের মহাদেবদা। চেয়ারে বসে তার দৃষ্টি মেঝেতে নামানো।
'হ্যাঁ, বলো'―ম্যা'ম-এর কথায় সম্বিৎ ফেরে মহাদেবের। এক নিঃশ্বাসে ভাতৃপ্রতিম নন্দগোপালের পি এইচ ডি পূর্ববর্তী বিবাহ প্রসঙ্গ বিস্তারিত উপস্থাপিত করে, তারপর একটু থামে সে। টেবিলে রাখা বোতলে নিজের গলা ভেজায়। এক ঢোঁক জল খায়। ফের শুরু করে অনুরোধের ভঙ্গিতে―
'ম্যা'ম, স্যারকে আপনি যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।' সময় ও সুযোগ বুঝে তিনি শ্রদ্ধেয় স্যারের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলেন। প্রথম প্রথম ভারী রাগ করলেও কলিদেবীকে দেখার পর প্রফেসর সি কে দাসের রাগ গলে জল। আপন কণ্যার ন্যায় স্নেহ করতেন কলিদেবীকে। গর্ব করে সবাইকে বলে বেড়াতেন―
'কলির মতো মেয়ে হয় না।'
        
বাড়ি ভাড়া বাবদ বেশ কিছু নগদ টাকা মাস-পয়লা খরচ হয়ে যায়। অভাব-অনটনের সংসার। মাসের শেষে হাত ফাঁকা। পকেটে টান পড়ে, কষ্টে সৃষ্টে সংসার চালাতে হয়। বিবাহের কথা স্যারের গোচরে আনার তাই একটাই উদ্দেশ্য। আই আই টি'তে ফ্ল্যাটের জন্য আবেদন করা। ঘরভাড়ার টাকাটা তাহলে বাঁচে। জাকির হোসেনে তখন পর্যাপ্ত ফ্ল্যাট। সহজে অ্যাভেলেবল। আবেদন পত্রে সই করে দিলেন চপলবাবু। আবেদন করার পর ফ্ল্যাট পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। এক্ষেত্রে চপলবাবু খানিক প্রভাব খাটিয়েছিলেন। সহজে মিলে গেল দু'কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট। এসময় নারায়ণদা আর বন্ধু অসিত পাণ্ডা খুব হেল্প করেছেন; ফ্ল্যাটে থাকার ব্যাপারে। ২০০০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জাকির হোসেনে শিফট করল তারা। ফ্ল্যাটে তখন আত্মীয়-স্বজনদের যাতায়াত লেগে থাকে। নন্দবাবুর পিতা শ্যামাপদ বাবু মাঝে মধ্যে আসেন। এলে পাঁচ-সাতদিন কাটিয়ে যান; বাড়ি ফিরতে চাইতেন না। অথচ তিনি আপন ঘর ব্যতীত কখনও অন্যত্র রাত্রি যাপন করতেন না। আসলে আই আই টি'র সবুজে ঘেরা গ্রাম্য পরিবেশ তাঁর বেশ পছন্দ। সুউচ্চ অট্টালিকা সংবলিত শহুরে কংক্রিটের জঙ্গলের মতো নয়। সবুজ বনানী, গাছপালা। খোলামেলা। নিরিবিলি। অঢেল ফাঁকা জায়গা।

এভাবে দু'বছর চলল। যে-প্রোজেক্ট নিয়ে তাঁর পি এইচ ডি -গবেষণায় হাতেখড়ি, তার মেয়াদ মাত্র দুবছর। প্রথম দুবছর পর প্রোজেক্টের কাজ কমপ্লিট। প্রোজেক্টের সময়কাল আর এক্সটেন্ড হয়নি। ফলে দু'বছর স্টাইপেন্ড বন্ধ হয়ে গেল। মহাফাঁপরে নন্দগোপাল। স্টাইপেন্ড বন্ধ হয়ে গেলে খাবে কী? এ এক আশ্চর্য ধর্ম সংকট উপস্থিত। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দায়। 

রিসার্চ সম্পূর্ণ হতে আরও প্রায় দু'বছর বাকি। এই শেষের দু'বছর কেমন করে চলবে? সাত-পাঁচ ভেবে ভেবে একটা উপায় বের হল। শনিবার আর রবিবার দুদিন আই আই টি বন্ধ। ওই দিনগুলোতে দেশের বাড়িতে টিউশনি করবে দুজনে। নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের সায়েন্স ক্লাস নেবেন নন্দগোপালবাবু। কলিদেবী দেখাবেন আর্টস গ্রুপস্। সেজন্য শনিবার সকাল সকাল দেশের বাড়ি কুনারপুরে পৌঁছে যায় তারা দুজন। শনিবার আর রবিবার পর পর দুটো দিন টিউশনি পড়িয়ে সোমবার ভোরে আবার রওনা দেবে আই আই টি। সে-মত শুরু হল লড়াই। জোর কদমে চলছে টিউশনির লেখাপড়া। আর মাসের শেষে মাইনের জন্য হাপিত্যেস মুখিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের দিকে― কখন আসবে মাইনে। তবেই চলবে সংসার! এমনও দিন গেছে যেদিন পকেটে মাত্র দশ টাকা সম্বল। পরের দিন কীভাবে চলবে জানা নেই। অথচ সেটাকেই পুঁজি করে জীবনের আঁকাবাঁকা আলপথে হেঁটে চলেছেন তিনি। হাল ছেড়ে দেননি। বরাবরের মতো পেছনে থেকে সাহস যুগিয়ে ভরসা দিয়েছেন কলিদেবী।

(তিন)
তীব্র আর্থিক সংকট। টিউশনি করে চলছে সংসার। প্রথম প্রথম ফ্ল্যাট বাড়িতে শুরু হল ছেলে পড়ানো। তারপর শনি-রবিবার মেদিনীপুরে পুনরায় অনার্স স্টুডেন্ট পড়ানো আরম্ভ করল। দূর দূরান্ত থেকে পড়তে আসে বিস্তর ছেলেমেয়ে। মেদিনীপুরে এক স্টুডেন্টের বাড়িতে বসে টিউশনি। সপ্তাহ জুড়ে শরীরের উপর বিস্তর ধকল পড়ে। অনন্যোপায় তিনি। পরে মেদিনীপুর ছেড়ে দেশের বাড়িতে টিউটোরিয়ালের ভাবনা। শনিবার আর রবিবার। ফেরার সময় বাড়ির চাল-সবজি-মুড়ি সঙ্গে আনা। তাতে খরচ অনেক সাশ্রয় হয়। আই আই টি'তে তখন জয়দা, শুভেন্দুদা, ভানুদা, মহাদেবদা, জয়ন্তদা, সুপর্ণাদি, রঞ্জন, সঞ্জয়, শান্তনু, কাকলি আর মান্টি-এর সঙ্গে দারুণ দোস্তি। সেই কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়িয়ে সাহস আর সহযোগিতা দুটো জুগিয়েছে বন্ধু-বান্ধবের দল। মনের জোর বেড়েছে। 

অথচ দুজনের বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল। সম্ভ্রান্ত পরিবার। শুধু মুখ ফুটে ঘরে বলার আস্পর্ধা দুজনের কারও নেই। যতদিন কলেজ ইউনিভার্সিটির লেখাপড়া চলেছে, পয়সা চাইতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মাস্টার ডিগ্রি পাস করার পর সবার মধ্যে হঠাৎ একটা জড়তা, একটা পিছুটান কাজ করে―আর কতদিন টাকা পয়সা চাইব? নিজের খরচ নিজে উপার্জনের একটা সুপ্ত প্রবণতা গড়ে ওঠে। বর্তমানের সে-প্রবণতা কখন যে তাকে ভবিষ্যতের মূলস্রোতে খেয়া বাইতে শেখায়, ঘুণাক্ষরেও টের পায় না সে। তখন সকলের ভেতর নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পয়সা উপার্জন করার নেশা চড়ে বসে। টিউশন পড়ায়। পার্ট টাইম কাজ করে। চাকরির প্রস্তুতি নেয়। কত কী যে করে, তার ইয়ত্তা নেই! হাজার একটা বিকল্প ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায়। কিন্তু কোনও ভাবে বাড়িতে টাকাকড়ি চায় না। তায়, নন্দবাবু ও কলিদেবী তো বিবাহিত। সুতরাং তাদের সমস্যা অন্যদের চাইতে ঢের বেশি বই-কি কম নয়। 
        
আই আই টি ক্যাম্পাসে কলিদেবীর অনেক আত্মীয় স্বজন চাকুরীরত। তাঁর পিসিমণি'র ছেলেরা আই আই টি'র টেকনিক্যাল ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে উইক-এন্ডে প্রায়শই হইহুল্লোড় হয়। তারপর একে একে জয়দা, শুভেন্দুদা আর ভানুদা পোষ্ট-ডক্টরেটের জন্য দেশের বাইরে চলে গেল। মহাদেবদা গড়বেতা কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে বিভাগীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হল। আই আই টি'তে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়লেন নন্দগোপাল। চপল স্যারের আন্ডারে তখন জুনিয়র গৌতম-সহ একঝাঁক তরুণ রিসার্চ স্টুডেন্ট। ব্যতিক্রম সে একা। একমাত্র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। সেটা ২০০৩ সালের ঘটনা। লিক্যুইড ক্রিস্টাল পলিমারের সঙ্গে সাধারণ পলিমারের যোগসাজশে তৈরি যে-কম্পোজিট পলিমার, তার কাজ আপাতত সম্পূর্ণ। এভাবে জাত কম্পোজিট পলিমারের মেকানিক্যাল প্রোপার্টি যেমন কাঠিন্য, দৃঢ়তা, লংজিবিলিটা বেশ কয়েক গুণ বাড়ে। এবার থিসিস জমা করার পালা। সেবছর জুলাই-আগস্ট মাসে সে-কাজও কমপ্লিট। জমা পড়ল থিসিস পেপার। সাড়ে তিন বছরের অধ্যবসায় আর কঠিন পরিশ্রমের ফসল এই পি এইচ ডি থিসিস। থিসিস জমা করার পাক্কা এক বছরের ব্যবধানে মিলল ডিগ্রি। তাঁর নামের আগে যুক্ত হল 'ডক্টরেট' উপাধি। আজ আনন্দের দিন। খুশির দিন।

খুশি এবার দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ, ... অসীম। কারণ কলিদেবীর কোল আলো করে ছ'মাস আগে পুত্র সন্তান নির্ভীক-এর জন্ম হয়েছে। ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। প্রিয় পুত্রের মুখমণ্ডল দর্শন করলে সকল দুঃখ কষ্ট বেদনা পরিশ্রম মূহুর্তে লাঘব হয়ে যায়। এক ঐশ্বরিক গাঢ় প্রশান্তি ভর করে মনের উপর।

বাস্তবে নন্দগোপাল বাবুর জীবনে বারবার বিস্তর ঝড়-ঝঞ্ঝার ঢেউ আছড়ে পড়েছে। সেসব কালো অধ্যায়গুলো জয় করে সফল জীবনের বৈতরণী পার করেছেন তিনি। তাঁর এ হেন লড়াই অনুপ্রাণিত করে সমাজ সংসারের লাখো লাখো তরুণকে। সে-লড়াইতে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গেছেন তাঁর সহধর্মিণী কলিদেবী। তাঁর ত্যাগ ও সহ্য ক্ষমতা অতুলনীয়। সম্ভ্রান্ত ঘরের আদরের দুলালী হয়েও যেভাবে শত কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে নন্দগোপাল বাবুর পাশে থেকেছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসা যথেষ্ট নয়; তাঁর মহানুভবতার কাছে অতীব তুচ্ছ গণ্য হবে। সত্যিকারের প্রেরণার এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। আসলে উনার উদারতা ক্ষুদ্র পার্থিব স্বার্থ দিয়ে যাচাই করলে বড্ড বেশি ভুল হবে। উনি নন্দগোপাল বাবুর জীবনে ভগবানের আশির্বাদ স্বরূপ। অথচ উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আঙিনায় তাঁর সর্বক্ষণের এই প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষা নন্দগোপাল বাবুর সাফল্যের। সমাজের সেই অভিজাত শ্রেণীতে উত্তোরণের সংকল্প বাস্তবায়িত করার প্রতীক্ষায় দিনের পর দিন প্রার্থনা করেছেন। আর নন্দগোপাল বাবু নিশ্চিন্ত মনে গবেষণায় লিপ্ত থেকে নিজের অভীষ্ট সাধন করেছেন। উপকৃত হয়েছে সমগ্ৰ সমাজ সংসার।  (চলবে)

তথ্য-ঋণ :
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের রত্নগর্ভা মাতা বিমলাদেবী
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের জ্ঞাতিখুড়ো শ্রী নগেন্দ্রনাথ সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মেজদা শিক্ষক শ্রীঅসিত কুমার সাহু
পরম শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিক-গবেষক ড. নন্দগোপাল সাহু, কুমায়ুন ইউনিভার্সিটি, নৈনিতাল, উত্তরাখণ্ড
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের সেজদা শ্রী ননিগোপাল সাহু
শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের বন্ধুস্থানীয় দাদা শিক্ষক শ্রী দেবাশীষ মান্না

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. আজ নন্দ বাবু 'উত্তরাখন্ড রত্ন' সম্মানে ভূষিত। অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে ভূষিত। আমার অত্যন্ত প্রিয়ানুষ।

    ReplyDelete