জ্বলদর্চি

শ্রীকৃষ্ণ : মানবাদর্শের সর্বোত্তম প্রতীকী চরিত্র/মুক্তি দাশ

শ্রীকৃষ্ণ : মানবাদর্শের সর্বোত্তম প্রতীকী চরিত্র

মুক্তি দাশ


হিন্দুধর্মে দেবদেবীর সংখ্যা নেহাৎ নগন্য নয়। দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এবং যে-হারে তা ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এরকম আশংকা অমূলক নয় যে, অচিরেই তা ভারতের জনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে না তো!

তবু এই অগণিত দেবদেবীর মধ্যে কৃষ্ণই এযাবৎ জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ভগবান বিষ্ণুর নানান অবতারের মধ্যে কৃষ্ণাবতারই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং বহু বিতর্কিত। তেমনি সমাদৃতও। কৃষ্ণের ঘটনাবহুল জীবনালেখ্য, তাঁর কর্মব্রতী সত্ত্বা ও মানবিক-মাহাত্ম্য আমাদের শুধু বিমোহিতই করে না, ভারতের সনাতন জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধও করে।

কৃষ্ণজীবনের মূলত তিনটি পর্যায়। এক, ব্রজধামের নন্দদুলাল গোপীবল্লভ ও রাধারমণ রাসবিহারী কৃষ্ণ। দুই, পাপ ও অনাচারের মূর্তপ্রতীক কংসনিধনকারী মথুরাধিপতি কৃষ্ণ। এবং তিন, প্রখর রাজনীতিজ্ঞ ও কূটনীতিবিদ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নেপথ্য নায়ক দ্বারকাপতি কৃষ্ণ। উদ্দেশ্য ও ঘটনা পরম্পরার নিরিখে এই তিনটি পর্যায় আপাতসম্বন্ধহীন হলেও আদর্শগত বিচারে একে অন্যের সংগে সম্পৃক্ত। এবং সামগ্রিকভাবে তা ভারতের সনাতন ভাবধারা ও জীবনাদর্শের দ্যোতক। কৃষ্ণ চরিত্রে এই সনাতনধর্মের শাশ্বত রূপটি সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে ঋষি অরবিন্দের বিখ্যাত ‘KFISHNA’ কবিতায়, যার প্রথম দুটি স্তবক এরকম :

“At last I find a meaning of soul’s birth
Into this universe terrible and sweet,
I who have felt the hungry heart of earth
Aspiring beyond heaven to Krishna’s feet.

I have seen the beauty of immortal eyes,
And heard the passion of the Lover’s flute,
And known a deathless ecstasy’s surprise
And sorrow in my heart forever mute.

ঋষি অরবিন্দর ভাবশিষ্য দিলীপকুমার রায় এই বিখ্যাত ধ্রুপদী কবিতার একটি চমৎকার হুবহু এবং সার্থক ভাবগ্রাহী মর্মানুবাদও করেছেন, যা এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করা গেল না :

“জেনেছি অন্তিমে আজ – অন্তরাত্মা আমার লভিল
জন্ম কেন এই ঘোর শঙ্কাকুল মধুর ভুবনে,
ক্ষুধার্ত ধরার হৃদিস্পন্দ হৃদে করি অনুভব
চেয়েছি শরণ কেন স্বর্গাতীত কৃষ্ণের চরণে।

দেখেছি সৌন্দর্য আমি তার মৃত্যুহীন নয়নের
শুনেছি সে বল্লভের উচ্ছ্বসিত মুরলীঝংকার।
জেনেছি তাহার অমরণী মহান্দের বিস্ময়,
দুঃখতাপ চিরতরে শান্ত হয়ে গেছে স্পর্শে যার।”
            (শ্রীঅরবিন্দ স্মরণে/দিলীপকুমার রায়)

মানুষের দুঃখতাপ নিবারণের জন্যেই স্বর্গাতীত কৃষ্ণের মর্ত্যাবতরণ। ভাদ্রমাসের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বর্ষণমুখর মহানিশায় কৃষ্ণাঅষ্টমী তিথিতে রোহিনীনক্ষত্রে কৃষ্ণজন্মের পরম লগ্নটি সূচিত হয়েছিল ধরিত্রীর বুকে। পন্ডিত ও গবেষকদের মতে, সে ছিল দ্বাপরযুগের শেষপাদ। যে-কোনো যুগসন্ধিক্ষণের মুহূর্তে ধংসোন্মুখ পৃথিবীকে রক্ষা করতে, সৃষ্টিশীলতাকে চিরায়ত করতে অবতারের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী। যুগ যুগ ধরে ভগবান তাঁর বিভিন্ন অবতাররূপ পরিগ্রহের মাধ্যমে এভাবেই ধরা দিয়েছেন জগৎবাসীর কাছে। ধর্মভাবের মধ্য দিয়ে তাদের ভেতর প্রাণসঞ্চার করেছেন। 

এবার ভগবান আবির্ভূত হলেন কৃষ্ণরূপে। উদ্দেশ্য? দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ, দুর্বল, সৎ ও শিষ্টজনের পরিত্রাণ এবং ধর্মসংস্থাপন। কৃষ্ণের রূপপরিগ্রহ করে স্বয়ং ভগবান এসেছেন অত্যাচারিত, শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পুঞ্জীভূত হাহাকার ও বেদনা প্রশমন করতে, আর্ত মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দিতে।

সেই কৃষ্ণের জন্ম কিন্তু বড়ই অনাড়ম্বর। শঙ্কাকুল, ভীতব্যাকুল পরিবেশে জগদীশ্বরের আবির্ভাব। গভীর নিশুতি রাতে। নিষ্ঠুর কংসের অপরিসর কারা-প্রকোষ্ঠে। কাকপক্ষীরও অগোচরে, নিশঃব্দে। একটা শঙ্খধ্বনিও কেউ করেনি পর্যন্ত। তবু ভাগ্যবিড়ম্বিত বসুদেব ও দৈবকীর কোল আলো করে এসেছেন জগৎপতি। এসেছেন অপশাসনের কারাগারকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে। এসেছেন নিপীড়িত আর্ত মানুষের মনে মুক্তি, শান্তি ও আনন্দের স্বস্তিদায়ক বাতাস বইয়ে দিতে।

কৃষ্ণের জন্মলগ্নের দুর্যোগপূর্ণ প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটটি গভীর তাৎপর্যবহ। ভরাভাদ্রের সেই ঝড়ঝঞ্ঝার রাত আসলে অসহায় ও অত্যাচারিত মানুষের বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের আলোড়নকেই হয়তো মূর্ত করেছিল। অবিরাম বর্ষণ যেন আর্ত মানুষের অঝোর কান্না। শৃঙ্খলিত বসুদেব ও দৈবকী হলেন সেই আর্ত ও অসহায় নারীপুরুষের যুগ্মপ্রতীক। আর অত্যাচার ও উৎপীড়ন-নিপীড়নের পরাকাষ্ঠা হিসেবে দেখানো হয়েছে কংসের কারাগারকে। 

কিন্তু কে এই কংস? কংসের স্বভাব বর্ণনায় ভাগবতে বলা হয়েছে, “কিমকার্যং কদর্যানাং”। সবরকম হীনকর্মই করতে পারেন, তিনি কদর্য। কংস সেই কদর্যতারই প্রতিমূর্তি। ভোগ-তৃষ্ণা-লালসা ও কামনা-বাসনায় পরিপুষ্ট সেই কদর্যরূপী কংস রাজসিংহাসনে আসীন। আর শুদ্ধজ্ঞানরূপী বসুদেব ও শুদ্ধভক্তিরূপী দৈবকী বুকে পাষাণভার নিয়ে শৃঙ্খলিত অবস্থায় পড়ে আছেন কারান্তরালে। রোরুদ্যমানা ধরিত্রীর অসহায় নিরালম্বতার তুঙ্গ মুহূর্তেই নিজ অঙ্গপ্রভায় কারাপ্রকোষ্ঠ আলোকিত করে মহান পরিত্রাতারূপে যেন চুপিসাড়ে আবির্ভূত হলেন পতিতপাবন। জগৎবাসীর অন্তরাত্মার হাহাকার ও ক্রন্দন তাঁকে এমনই দ্রবীভূত করেছিল যে, মাতৃগর্ভে পূর্ণসময় অবস্থান করারও সময় পেলেন না তিনি। ন’মাস দশদিনের পরিবর্তে মাত্র আটমাসেই তিনি পরিত্যাগ করলেন মাতৃজঠর। কৃষ্ণের জন্মমাহাত্ম্যে এই আট সংখ্যাটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটিও লক্ষণীয়। তিনি জন্মগ্রহণ করলেন অষ্টমীতিথিতে, অষ্টমগর্ভে এবং ভূমিষ্ঠ হলেন গর্ভধারণের অষ্টমমাসে। এরমধ্যেও কোনো তাৎপর্যভিত্তিক গূঢ় উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে কিনা কে জানে! কৃষ্ণজন্মের মহামুহর্তটিকে ভাগবতে শুকদেবের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে, ‘সর্ব্বগুণোপেতঃ কালঃ’। অর্থাৎ, সর্বগুণসমন্বিত কাল।

এরকম এক অদ্ভূত বিচিত্র বিপর্যস্ত পরিবেশে ও প্রেক্ষাপটে যাঁর জন্ম, তাঁর সমগ্র জীবনের কর্মধারা ও আদর্শ যে আরো বৈচিত্র্যময় হবে – এ তো জানা কথাই। কৃষ্ণচরিত্রের জনপ্রিয়তার মূলরহস্য তো তাঁর জীবনবৈচিত্র্যের মধ্যেই নিহিত।

কৃষ্ণচর্চা ভারতীয় বিশেষত, বাঙালি জীবনের প্রধান অঙ্গ। বাংলাদেশে এই কৃষ্ণচর্চা শুরু হয়েছে সম্রাট অশোকের সময়কাল থেকে। কেবল প্রাচীনযুগের ভাস্কর্যে বা শিল্পকলায় নয়, সমকালীন সাহিত্যে এমনকি, লোকগাথাতেও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে কৃষ্ণপ্রসংগ।

আসলে কৃষ্ণচরিত্রে পুরোপুরি দেবত্ব আরোপ করতে আমরা কখনোই রাজি নই। কৃষ্ণকে দেবতার আসনে বসাতে আমাদের মনই সায় দেয় না। অতিলৌকিক দেবমহিমার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে কৃষ্ণের মানবসত্ত্বার যে লৌকিক ধারাটি প্রবহমান, আমাদের হৃদয়ের গভীরে কৃষ্ণের জনপ্রিয়তার আসনটি পোক্ত করার ব্যাপারে তার অবদানও কম নয়। কৃষ্ণের অতিলৌকিক দেবমহিমা আমাদের যত না বিভোর করে দেয় তার চেয়ে অনেকবেশি চমৎকৃত ও আকৃষ্ট করে তাঁর ঐতিহাসিক মানব-মহিমা। কৃষ্ণ যেন কোনো পৌরাণিক চরিত্র নয়, এক যুগন্ধর ঐতিহাসিক নায়ক। তিনি যেন মানবাদর্শের সর্বোত্তম রূপ। দেশ ও জাতির চির-অনুকরণীয় আদর্শ কর্ণধার। ১২৯২ বঙ্গাব্দের ২৫শে আশ্বিন তারিখে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা একটি পত্রে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র যথার্থই লিখেছিলেন -  “কৃষ্ণচরিত্র মনুষ্যচরিত্র, ঈশ্বর লোকহিতার্থে মনুষ্যচরিত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন”।

কৃষ্ণের জীবনপ্রণালী এমনই সহজ মানবিকতত্ত্বে পরিপূর্ণ যে, কখন তিনি যাবতীয় দেবসুলভ দূরত্ব ঘুচিয়ে হয়ে গেছেন আমাদের পরমাত্মীয়। একেবারে কাছের মানুষটি। একান্ত আপনজন। যেন পাশের বাড়ির কেউ। তাই বুঝি তাঁর জন্মদিনে, এই জন্মাষ্টমীতে আমাদের এত উচ্ছ্বাস, দেশজুড়ে এত সমারোহ। আর কোনো দেবদেবীর জন্মতিথি কখনো এরকম পালিত হয়েছে আমাদের দেশে? দেবতাদের তো জন্মও নেই, মৃত্যুও নেই। তাঁরা তাঁদের বিচিত্র লীলার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হন। আবার যথাসময়ে যথারীতি লীলাসংবরণও করেন। কিন্তু কৃষ্ণই সম্ভবত একমাত্র দেবতা যিনি এই ধরাধামে দস্তুরমতো জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং সেই জন্মদিন বা জন্মতিথি মানুষ আজও পালন করে আসছে। 

‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার সম্পাদক দেশবরেণ্য ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁর ‘পালপার্বণ’ গ্রন্থের ‘শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন –

“পুরাতন যুগের অন্তে নূতন যুগের প্রারম্ভে স্বয়ং বিষ্ণু কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হইয়া যুগধর্ম সংস্থাপন করেন। সেইসময় হইতেই আমাদের নূতন জীবন আরম্ভ হইয়াছে। শ্রীকৃষ্ণকে অবতার বলিয়া অনেকে মানেন বটে, কিন্তু তিনি যে আমাদের নূতন জীবনের মূল – এ তথ্য আমরা ভুলিয়া গিয়াছি। …ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অহংবিন্দুগুলিকে কৃষ্ণচরণবিনির্গত জাতীয় জীবন-জাহ্নবীতে নিমজ্জিত করিতে হইবে। হিন্দুর ঐতিহাসিক পারম্পর্য শ্রীকৃষ্ণের পাদমূল হইতে প্রসূত। আইস, জন্মাষ্টমীর দিনে সেই পারম্পর্য স্বীকার করিয়া সকলে কৃষ্ণপদকল্পতরুমূলে অভেদসূত্রে এক হই।” 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments