জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি (দশম পর্ব) / চিত্রা ভট্টাচার্য্য

"ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি "
 (দশম পর্ব) 
            
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

প্রেমের পূজারী নজরুল

 "হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়
রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,
ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,
বিষ-জ্বালা-ভরা হেথা অমিয়। 
হেথা হিয়া উঠে বিরহে আকুলি,
মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি,
হৃদয়ে যথায় প্রেম না শুকায়-
সেই অমরায় মোরে স্মরিও।''

মানব হৃদয়ে বসন্ত সমাগমে আগাম সংকেত ছাড়াই প্রেমের তুফান এলে সে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য করে। শাশ্বত প্রেমের পসরা সাজিয়ে মন নীরব প্রতীক্ষায় থাকে  সেই অনাগত সত্য সুন্দর কে স্বাগত জানাতে। তীব্র মানসিক আকাঙ্খা  নিয়ে হৃদয়ের উপবনে বসন্তের ছোঁয়ায় তার  প্রেমের ফুল ফোটানোর অপেক্ষা চলে নিরন্তর। চারদিক সুবাসিত করা সে সৌরভে প্রেমিক নিজেকে উজাড় করে সেই প্রেমের ফুলে   প্রিয়তমকে অঞ্জলি নিবেদনের প্রত্যাখ্যাত হলে তার হৃদয়ের জ্বালা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে  ।  
 মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে বিরহের সে জ্বালা যন্ত্রণা সহ্যকরা কতো যে কঠিন,সে আঘাত কতো যে গভীরতর ,কতো ভয়ানক হয়ে হৃদয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে তা একমাত্র ভুক্তভুগিই অনুভব করে খাকে । প্রেমে প্রত্যাখ্যাত আঘাতে জর্জরিত কবি হৃদয়ে সে বেদনা বেজেছিল মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে ও অধিকতর ভাবে । 

প্রেমের সাগরে ভেলা ভাসিয়ে মাঝিরূপে প্রেমকে বারবার তুলে এনেছেন কাব্যের তরীতে । পৃথিবীতে অনন্য   শিল্প সৃষ্টির নেপথ্যে  সর্বত্রই দেখা গিয়েছে প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জীবনে প্রেম-ভালবাসার বিচিত্র উপাদানে সৃষ্টি হয়েছে অমর শিল্প শ্রেষ্ঠ কাব্যসম্ভার সাহিত্য বা উপন্যাস । কেউ প্রেমাস্পদকে পেয়ে সৃষ্টি করেছেন ভালবাসার মহাকাব্য। কোথাও দেখাগেছে  বিরহের আগুনে দগ্ধ হয়ে রচিত হয়েছে করুণ রাগের অমর মর্মগাঁথা। সফল কবি ও সাহিত্যিকদের জীবনে সাধনসঙ্গী ও প্রেরণাদায়িণী রূপে যে-সমস্ত নারীর উপস্থিতি দেখা গেছে, তাঁদের অধিকাংশই কিন্তু ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রেই বৃহত্তর অবদান রেখে গিয়েছেন। কবি নজরুলের জীবনে প্রেম এসেছিল একাধিকবার।প্রেমিকারা  এসেছিলেন বহুরূপে ,গুণে সমৃদ্ধ দিলখোলা মানুষটির সামান্য সান্নিধ্য পাবার আশায়। কেউ এসেছিলেন কবিতায় ,গানে আকৃষ্ট হয়ে কেউ শুধুই রূপেগুণে মুগ্ধ হয়ে। কেউ এলেন  জননী রূপে বাৎসল্য রসে সিক্ত হয়ে। 
🍂

 
 নজরুলের চোখে এই বিশ্বসংসার  প্রেমময় হলেও রূঢ় কঠিন বাস্তবের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন কঠিন আঘাত ও বঞ্চনা । নানা  ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে জীবন চলেছে তবুও তাঁর প্রেমিক সত্ত্বাটি কে কখনো বিসর্জন দেননি  বিরহ যন্ত্রণায় বিদ্ধস্থ হয়ে মনকে ভাসিয়েছেন প্রেমের সাগরে সুরে সংগীত সৃষ্টিতে।                                                                             কবি লিখেছেন-
                             “ , অজানা বন্ধু, তুমি কী গো সেই,
                            জ্বালি দীপ গাঁথি মালা যার আশাতেই
                            কূলে বসে একাকিনী যুগ যুগ ধরি?
                         নেমে এসে বন্ধু মোর ঘাটে বাঁধ তরী” 

  ”১৩২৮ সনের তেসরা আষাঢ় অসমাপ্ত সেই বিয়ের রাতের আসর ছেড়ে  দৌলতপুর থেকে ক্ষুব্ধ ও অপমানিত কবি কুমিল্লা ছেড়ে ঝড় জলের গোমতী নদীর উচ্ছল ঢেউয়ে নৌকা ভাসিয়ে  বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের মাতা বিরজাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে তাঁদের কান্দিরপাড়ের গ্রামের বাড়িতে এলেন।  বিরজাসুন্দরী দেবীর স্বামী ইন্দ্রকুমার ছিলেন কুমিল্লার কোর্ট অব ওয়ার্ডসের ইন্সপেক্টর। এবং তাঁরা  ছিলেন উদার মনের মানুষ , স্বপ্ন দেখতেন এক স্বাধীন ভারতবর্ষের। দুজনেই বিশেষ স্নেহ করতেন কাজী নজরুল ইসলামকে। নজরুলের  সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় লিখতেন বিরজাসুন্দরী এবং কবির উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন একটি কবিতা।ভিন্ন ধর্মের মানুষ হয়েও  এই পরিবারে ছিল তাঁর অবাধ আসাযাওয়া। সামান্য কয়েকদিনের পরিচয়েই এই পরিবারের সঙ্গে কবির প্রগাঢ়  অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে , বীরেন্দ্রর মা ছিলেন কবির ও মা। নজরুল ততদিনে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।  বিরজাসুন্দরী ও নজরুলকে দেখতেন আপন পুত্র রূপে।কুমিল্লায় নজরুলের ঠিকানা পরিবর্তন হলো— দৌলতপুর থেকে কান্দিরপাড়। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মানসিক চাপ এবং ক্লান্তিতে নজরুল এখানে এসে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বিরজাসুন্দরী দেবী এ সংসারের বড়ো মেয়ে ত্রয়োদশী কন্যা আশালতা বা দুলী কে নিয়ে কবি কে সুস্থ করে তুলতে সচেষ্ট হলেন। 

 কন্যা আশালতা ছিলেন ,ইন্দ্রকুমারের ছোটভাই ত্রিপুরা রাজ্যের নায়েব বসন্তকুমার সেনগুপ্ত ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী গিরিবালা দেবীর কন্যা। আদতে গৃহবধূ গিরিবালা দেবী পাশাপাশি সাহিত্যচর্চায় ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। খুব সুন্দর চিঠি লিখতেন বেশকিছু ছোটগল্প সে যুগে অলকা, নারায়ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।মাকে অনুসরণ করে কন্যা দোলন ও খুব কম বয়সেই কাব্য সাহিত্যে সংগীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। খুব অল্প বয়সেই দোলন পিতৃহারা হলে গিরিবালা দেবী কন্যাকে  নিয়ে বিরজাসুন্দরী দেবীর কান্দিরপাড়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দোলন কিশোরীদের মধ্যে সবথেকে বড়ো ছিলেন । তিনি ফয়জুন্নেসা গার্লস হাইস্কুলে পড়াকালীন অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে স্কুল পরিত্যাগ করলেও গোপনে কবিতা চর্চা ও রবীন্দ্র সংগীতের  প্রতি তাঁর কিশোরোত্তীর্ণ মনের অনুরাগে নজরুলকে পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহিত হয়েছিলেন ।  অসুস্থ কবির সবরকম সেবারভার স্বহস্তে তুলে নিয়ে নিশব্দে পালন করেন।   

এদিকে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত অসহায় নজরুল তখন অলক্ষ্যে দোলনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। সে-সময় দোলন ও কবির সান্নিধ্যে এসে অজান্তে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পারিবারিকভাবেই আশালতা ছিলেন সংস্কৃতিমনা। আর সংস্কৃতির প্রতি চিরনিবেদিতপ্রাণ নজরুল। সেবাব্রতী  দোলনের  ভালবাসায় আড়ালে চাপা পড়লো সদ্য নার্গিসের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদের জ্বালা। স‌ওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন লিখেছেন ,নজরুল প্রিয়তমার 'দোলন' নামটি স্মরণীয় করে রাখতে নিজের কাব্যগ্রন্থের নাম রেখেছেন 'দোলন-চাঁপা'। আলাপ পরিচয় গাঢ়তর হয়ে উঠলে ও তার সাথে কবির ধীরেধীরে মিষ্টি মধুর এক প্রেম প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠলো।কবি সুস্থ হয়ে কলকাতা চলে এলেও তার উদ্দেশ্যে রচিত হতে থাকে গান, কবিতা। দোলন চাঁপা’ কাব্যগ্রন্থে ‘দোদুল দুল’ কবিতায় দোলনের রূপের বর্ণনা লিখলেন --'  
 ''মৃণাল-হাত নয়ান পাত গালের টোল, চিবুক দোল সকল কাজ করায় ভুল প্রিয়ার মোর কোথায় তুল? কোথায় তুল? কোথায় তুল? স্বরূপ তার অতুল তুল, রাতুল তুল, কোথায় তুল দোদুল দুল দোদুল দুল!’'

নার্গিস ও প্রমীলা দেবী  '' নজরুল ইসলামের তাবৎ সাহিত্যকর্মে এই দুই নারীর অপরিসীম প্রভাব মূল্যায়ন করতে গেলে দেখা যাবে, প্রেমের জগতে অন্তরের গভীর প্রাধান্য পেয়েছিল নার্গিস । পক্ষান্তরে প্রমীলাকে নিয়ে কবি জড়িয়েছেন জীবন জগতের বাস্তবে।’রোমান্টিক কবি দোলন কে ভালবেসে ডাকলেন প্রমীলা নামে ।  
কবির এই প্রণয় সমাজ তো বটেই পরিবারের লোকেরাও মেনে নিতে রাজি হননি। যদিও শেষ পর্যন্ত  প্রেম পরিণতি পায়। অনেক বাঁধা পেরিয়ে নজরুলের জীবনসঙ্গিনী হন প্রমীলা। তখন প্রমীলার বয়স ১৪ নজরুলের ২৩। এই বিয়ের সিদ্ধান্তে গিরিবালা দেবী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, একত্রে থেকে মেয়ের সংসার আগলেও রেখেছেন তিনি। যদিও এর প্রতিদান তিনি পাননি। অপমানে, লজ্জায় তাকেও একদিন সকলের অজান্তে সেই সংসার ত্যাগ করতে হয়েছিল।

'' নজরুল ও দোলনচাঁপার বিয়েতে  ''বর এবং কনের ধর্ম আলাদা, ফলে মুসলিম বা হিন্দু কোনো ধর্মমতেই বিয়ে সিদ্ধহবে না। অগত্যা ১৮৭২ সালের ৩ নম্বর সিভিল ম্যারেজ এক্ট অনুযায়ী, কনেকে 'আহলে কিতাব' পরিচয়ে, ১০০০ টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই ঐতিহাসিক বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল কলকাতার হাজী লেনের ৬ নং বাড়িতে। তখন ছিল রমজান মাস, ২০ রমজান— ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল— রোজ শুক্রবার। '' সাক্ষী ছিলেন আবদুস সালাম, সাংবাদিক মোঃ ওয়াজেদ আলি, কবি খান মুহাম্মদ মাইউদ্দিন।
জানা যায়, বিয়ের তারিখ আগে থেকে কাউকেই জানানো হয়নি। হঠাৎ আয়োজন। আসরে ছিলেন না নজরুলের কোনও বন্ধু বা প্রমীলার আত্মীয়রা।:এই বিয়ে নজরুলকে অনেক বেশি দায়িত্ববান করে তুলেছিল। প্রমীলাও কবির মনে ঢেলে দিয়েছিলেন অপার শান্তি। অভাব ,সাংসারিক কষ্ট থাকা সত্ত্বেও হাসি মুখে সব সহ্য করেছেন প্রমীলা। যেটুকু পেয়েছেন, সেটুকু দিয়েই গুছিয়ে তুলেছিলেন কবির সংসার। তাই তো নজরুল নিশ্চিন্তে সুরের মায়াজালে বিস্তার করতে পেরেছিলেন, নিজেকে উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন কবিতার জগতে। আসলে নজরুল খুব ভরসা করতেন প্রমীলাকে। 
 অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘বিজয়িনী’  কবিতাটি  নজরুল লিখেছিলেন স্ত্রী প্রমীলার উদ্দেশ্যে।

     '' ওগো জীবন-দেবী।
     আমায় দেখে কখন তুমি ফেললে চোখের জল,
      আজ বিশ্বজয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!
        আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত-রথের চূড়ে,
       বিজয়িনী! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
   যত তৃণ আমার আজ তোমার মালায় পূরে’,
          আমি বিজয়ী আজ নয়ন-জলে ভেসে। ''
সংসার সামলানোর পাশাপাশি প্রমীলাদেবী ও  কবিতা লিখতেন। গিরিবালা দেবী, বিরজাসুন্দরী দেবী তো বটেই, তাঁকে উৎসাহ দিতেন নজরুলও। প্রমীলা দেবীর কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাম্যবাদী’ পত্রিকার ১৩৩২ সালের বৈশাখ সংখ্যায়। পাশাপাশি লিখেছেন ‘সওগাত’ পত্রিকাতেও।  চমৎকার চিঠিও  লিখতেন তিনি।

 হিন্দু মুসলিম বিয়ের কারণে নজরুলের ওপর ব্রাহ্মরাও ক্ষেপে গিয়েছিলেন বন্ধ হয়নি সমাজের সামাজিক আক্রমণ। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ লিখেছেন , "প্রমীলা সেনগুপ্তাকে বিয়ে করেছিল ব'লে ব্রাহ্মরা নজরুলের উপর বড় বেশী চটে গিয়েছিলেন।' শ্রীঅশোক চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে  জুলাই মাসে প্রকাশিত ব্রাহ্ম মালিকানা বিশিষ্ট 'প্রবাসী' পত্রিকায় কবির বিবাহ নিয়ে চলতে থাকে লাগামবিহীন সমালোচনা, কুৎসা রটানো, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ব্যক্তি আক্রমণ‌। কিন্তু নজরুল ও প্রমীলাদেবী  এসব ব্যাপারে কর্নপাত করতেন না । আর এ কারণেই সামাজিক সমস্ত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে প্রেম গড়িয়েছে প্রণয়ে, প্রণয় দীর্ঘায়িত হয়েছে আমৃত্যু। সেই সময়ে দৃঢ় মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন গিরিবালা দেবী। তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল এই সম্পর্কে। সমাজের চোখরাঙানিতে  তিনি বিন্দুমাত্র পরোয়া করেননি। নজরুলের হাতে অনায়াসে  তুলে দিয়েছিলেন প্রাণপ্রিয় ষোড়শী কন্যাকে।''

 হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও নজরুল-প্রমীলার বিবাহ সম্ভব হয়েছিল প্রমীলার মা গিরিবালা দেবীর আন্তরিক প্রয়াস ও কঠিন মনবল ও সাহসে। মহিয়সী এই নারী শুরুতেই  অনিশ্চয়তার উত্তাল তরঙ্গে ভেসে যাওয়া কবির সংসারের হাল ধরায় তাদের  টলোমলো জীবনের তরী খানি বাধা বিগ্ন অতিক্রম করে সবেগে চলতে লাগলো। বিস্ময়লাগে ভাবতে তৎকালীন সমাজে হিন্দু ঘরের বিধবা মহিলা হয়েও সামাজিক বিধি নিষেধ জাতের আভিজাত্য কে অগ্রাহ্য করে এমন যত্নশীল অভিভাবক হলেন যে সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখলেন কন্যা জামাতার নতুন সংসার। গিরিবালা দেবীর মাতৃস্নেহে কি করে এমন সর্ববাধা বিজয়ী অজেয় শক্তি লাভ করলেন , চিরন্তন মানব ধর্মের গভীর বিশ্বাসে বিশ্বাসী তিনি ''সবার ওপরে মানুষ সত্য '' এই মানবিক ধর্মে বুঝি দীক্ষিত হয়ে ছিলেন আপন শক্তিতে । সঙ্কীর্ণ হিন্দু সমাজের পল্লী পরিবেশের সকল সংস্কার দূর করে চারিত্রিক দৃঢ়তায় নজরুলের কবি-মানসকে সর্ব জাতি সম্প্রদায়ের ঊর্দ্ধে তুলে প্রাধান্য দিয়েছিলেন সংসারের জীবনের চাওয়াপাওয়ায় কাঙ্ক্ষিত যৌবনের স্বাভাবিক ধর্ম কে। 

  নজরুলের তরফ থেকে এই বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন আরও এক নারী মিসেস এম রহমান, যাঁর কাছ থেকে নজরুল অপরিসীম স্নেহ অর্জন করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মুসাম্মাৎ মাসুদা খাতুন । সমকালে যে কতিপয় মুসলিম বাঙালি রমণী পর্দার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে শিল্পসংস্কৃতি ও সাহিত্যের আঙিনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন এবং মুসলমান নারীদের মধ্যে জাগরণের সূচনা করেন তাঁদের অন্যতমা ছিলেন এই মিসেস এম রহমান। কবি তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ কাব্যগ্রন্থটি এই মহীয়সী নারীকে উৎসর্গ করেন। ১৯২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর এঁর অকালমৃত্যুতে কবি আত্মীয় বিয়োগের আঘাত অনুভব করেছিলেন। মাতৃসমা এই নারীকে নিয়ে রচনা করেন দীর্ঘ এক শোকবন্দনা,যা চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে ।  

ক্রমশঃ 
 ( তথ্যসূত্র  --.কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা :/ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৬৯ )
কাজী নজরুল ইসলাম, ২০০৬। নজরুল-রচনাবলী (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ), (সম্পাদনা-পরিষদ : রফিকুল ইসলাম), বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
বিশ্বজিৎ ঘোষ/ নজরুল জীবন ও সাহিত্য।
ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments