জ্বলদর্চি

এই যে আলোর আকুলতা-১০(উৎসব ১৪২৮)আবীর ভট্টাচার্য

এই যে আলোর আকুলতা….
আবীর ভট্টাচার্য 
(দশম অধ‍্যায়)


আজ বিজয়া দশমী। এই কয়দিন বেশ সুন্দর কেটে গেল জল-জঙ্গলের নিবিড় সান্নিধ্যে, অনাঘ্রাতা প্রকৃতিকে আপন করে পাওয়ার নেশায়। হঠাৎ করেই খেয়ালবশে এসেছিলেন সবাই, এখন মনে হচ্ছে, সবার মনের ডালি চাওয়ার চাইতেও বেশি ভরে গেছে। ভোরবেলায় বেলপাহাড়ি বাড়িতে ফিরে আসার পরে, আজ দুপুরে বাড়িশুদ্ধ সবাই মিলে, এঁড়গোদার ভৈরবথান যাওয়ার পরিকল্পনা;  আজ আর কাল ওখানে 'পাতাবেঁধা পরব'; আগামীকাল ভোরে 'ব্যাক-টু- প্যাভেলিয়ান'। সেই মতই সকাল থেকে চলছে ব্যস্ততা।

জনশ্রুতি গল্পকথা এই যে: 'অনেকদিন আগে এই অঞ্চলে বাস করতেন অকালভৈরব। বিভীষণ তাঁর মুর্তি,প্রবল তাঁর শক্তি। তাঁর ভৈরবী ছিলেন ধলভুমগড়ের রঙ্কিনী।  প্রতি দশমীর রাতে মাটির তলার সুড়ঙ্গ বেয়ে ভৈরবী আসেন ভৈরবের কাছে, তাঁদের মিলন-চঞ্চলতায় কেঁপে কেঁপে ওঠে মাটি,ঘাম জমে পাথরে; সৃষ্টি-সুখ-তৃপ্তির যুগলাসঙ্গে সমৃদ্ধ হয়  আদিবাসী জনগোষ্ঠী'....  

সকাল সকালই বাড়ির মেয়েদের সাথে তিন বৌ গেলেন স্হানীয় দেবীদেউলে সিঁদুর খেলা খেলতে। শহুরে মানুষ এনারা,  হারবাল প্রসাধনী ব্যবহার করেন,  শাঁখা-সিঁদুর পরা তেমন পছন্দ করেন না। তাই অরণি বারন করেছিলেন, কিন্তু এখানে এসে, মধ্যবয়সিনীত্রয় যেন কিশোরী হয়ে পড়েছেন, ফলস্বরূপ, মন্ডপ থেকে ফেরার পরে, আনন্দ উচ্ছলতা আর সিঁদুরে মাখামাখি লাজাঞ্জলী দৈবীরূপ!আহা!..

অন্য কার চোখে কি পড়েছিলো জানেন না, তাঁর চোখে সবচাইতে সুন্দর লাগছিলো অরুন্ধতীকে, একখানা কালোপাড় ফলসারঙা বেগমপুরী তাঁত তাঁর বেতসীলতা শরীরখানি ঘিরে ধরেছে, ঝর্ণাধারার মতো একঢাল কুঞ্চিত কেশদাম এলোখোঁপার শাষন মানতে চাইছে না, শ্যামলা মুখখানি সিঁদুরে মাখামাখি, একখানি হলুদবসন্ত পাখি যেন সকালের রোদে ডানা ঝাপটিয়ে সামনের ঘন পল্লবছায় কাঁঠালগাছটিতে এসে বসলো, তিনি নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন!

'এসো বঁধু,আধো আচরে বসো'...

হঠাৎ অরূন্ধতী পূর্ণচোখে তাকালেন তাঁর দিকে, সেই দিনের পর থেকে শুধু মনেমনে নয়, কখনও সখনো চোখে-চোখেও কথা হয় দুজনের; তিনি নিবেদন করলেন তাঁর মুগ্ধতা,দেবীর প্রসন্ন হাসিতে চরিতার্থ হলো সে আকুতি।

এদিকে পুকুরে মাছ ধরা শেষ,রুই, চিংড়ির সাথে বেশ বড়ো বড়ো কইমাছ পড়েছে।

-'বর্ষাশেষে এই সময়ে হলুদ পাকা কইমাছের সুস্বাদ যেন অমৃত,মুখে লেগে থাকে'

অরণির এই কথায় সবাই হৈ হৈ করে উঠলো,'পাকারুই শুনেছি,তাই বলে,পাকা কই!!

অরূন্ধতী এগিয়ে এসে বড়বৌদিকে বললেন,

-'আজ যদি মাছটা আমি রান্না করি?'

-বিয়ের থেকেই ভালোমানুষ বৌদি শহুরে সুন্দরী রূপাকে সমীহ করে চলেন,রূপা সেটা বেশ উপভোগও করে থাকে। স্বভাবতই, ওনারা এখানে আসার পর থেকে সবাইকেই যেন কেমন ভয়ে ভয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, একমাত্র অরূন্ধতী বারংবার রান্নাঘরে গিয়ে ভয় ভাঙিয়ে ভাব করতে সমর্থ হয়েছিলেন, এরই মধ্যে সেই সেদিন মধ্যদুপুরে বৌ-ছেলের এসি না থাকার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেছিলেন,  ঢেঁকিশালে বৌদিদিদের সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে গল্প করছেন অরূন্ধতী,  ঢেঁকিতে চালগুঁড়ি তৈরির কৌশল দেখছেন…,সেদিন রাতে চালের রুটি আর বন মোরগের মাংস রান্না হয়েছিলো; সবাই খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলো, হাঁসের পালকের মতো সাদা সাদা রুটি, টুকটুকে লাল ঝালঝাল মাংস প্রত্যেকের মনে যেন এক 'বাসনার সেরা বাসা রসনায়' অনুভূতি এনে দিয়েছিলো। শুধু তাঁর চোখে ভাসছিলো ঘামে ভেজা প্রিয় নারীমুখগুলি, দুপুরে দেখা দৃশ্যটি, তাঁদের সুখী করার জন্য বাড়ীর মেয়ে-বৌরা হাসিমুখে দুপুরের স্বল্প অবসরটুকুও দান করছেন, অতিথিদের মধ্যে একমাত্র অরূন্ধতীই ছিলেন তার সহমর্মী। যে কোন ভালোবাসাই প্রিয়জনকে অন্যায় প্রশ্রয় দেয়, তার সবকিছুই ভালো দেখে; কিন্তু পরিনত প্রেমে জড়িয়ে থাকে শ্রদ্ধাও, সেই শ্রদ্ধার আলো যেন প্রিয়মানুষটিকে এক দৈবী উচ্চতা দান করে, মনে মনে ভাবলেন অরণি।

এদিকে বেলা গড়িয়ে চলেছে, রান্নাশাল থেকে ভেসে আসা সুগন্ধে মন অধীর, জিভেরও যেন আর তর সইছে না। তাঁদের বেরোবার আছে, তাই মধ্যান্হভোজন শুরু হলো একটু তাড়াতাড়িই। একে একে পাতে সাজানো হ'লো শুক্তো,  খোসাসহ দেশীমুগের ভাল, ভাজাভুজি, ক্ষেতের ঝিঙের কুঁচোচিংড়ি পোস্ত, চিংড়ির মালাইকারি, রুই-সম্বুরা ও কই-মনোহরা।পূর্বশর্তমতোই মাছগুলি রান্না করেছিলেন অরূন্ধতী, পেঁয়াজ-আদা-নারকেলের রসসিক্ত সোনালী চিংড়ির ভাসমানতায়,অল্পস্বল্প রাই-সর্ষেমাখা রুইয়ের সর্ষেতেল-মাখা আদরে, একদিক মিষ্টি, একদিক নোনতাস্বাদের লালটুকটুকে কইয়ের মনোহরা স্বাদমাধুর্য্যে খাওয়ার টেবিলে প্রশংসার বন্যা, সবাই রান্নার সুখ্যাতি করছেন,অরণিরও কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কেন যেন কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। একসময়ে খাবার দেওয়ার ছলে অরূন্ধতী পাশে এলেন,নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন,'পছন্দ হয়েছে?'

তিনি  শুধু ঘাড় নাড়লেন,কোন কথাই মুখে ফুটলো না।

ফিরে যাওয়ার সময়ে প্রিয়-আঁচলপ্রান্ত তাঁকে ছুঁয়ে গেল সবার অলক্ষ্যে,তা কী ইচ্ছাকৃতই!

যা হোক, খাওয়া দাওয়া মিটিয়ে, সবাই মিলে মাত্রা শুরু করলেন  ভৈরবথানের উদ্দেশ্যে। কথা ছিলো, ফেরার পথে শিলদায় মিষ্টিমুখ করা হবে, শৈশবের সুখস্মৃতির আস্বাদ বন্ধু-স্বজন-সন্তানের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার আনন্দটুকু উপভোগ করতে মন উদগ্রীব। যেতে যেতে দাদা গল্প শোনালো এই পথে ছোটবেলার মামাবাড়ি যাওয়ার,গরুর গাড়ি চড়ে সে যাত্রাপথ, ভৈরবমেলায় গিয়ে হৈচৈ, মাইকের চোঙায় হিন্দিগান,তেল তেল জিলিপি,গজা,পাঁপড়ের গন্ধ; তারপরে কখন যেন  মন্দিরথানের মাটিতে থরোথরো কাঁপন,উচ্চস্বরে 'জয় মা রঙ্কিণীর জয়'-ধ্বনি….দেবীর আগমণ...সব চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। 

             একসময় যাত্রাপথ শেষ, পৌঁছলেন ভৈরবথানে; আজ থেকে সম্ভবতঃ তিরিশ বছর আগে এসেছিলেন এখানে,তবু বিশেষ কিছুই পরিবর্তন চোখে পড়লো না।  শিলদা থেকে একটু দূরে, গ্রামপ্রান্তে, এক ফাঁকা মাঠের মাঝে মাকড়াপাথরের বেদীতে পোড়ামাটির ভৈরবমুর্তি। শরীর ডিম্বাকার,জটামন্ডিত প্রায় কানঢাকা গোলাকার মস্তক, কড়িবসানো দীর্ঘ দীঘল ভ্রূযুক্ত চোখ, সিঁদুর চর্চিত সুদীর্ঘ নাসিকা,দন্তবিকশিত ভয়ালদর্শন মুখবিবর রাক্ষসের মতো। সঙ্গী আটজন সহচর ভৈরব,অনেকটা জৈন তীর্থঙ্করমুর্তির মতো। পাশাপাশি আরও দুটি ভঙ্গুর স্তম্ভযুক্ত বেদী পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে,হয়তো অনেকদিন আগে এখানেই ভৈরব ও ভৈরবীর মন্দির ছিলো। তাঁরা সবাই নেমে এদিক ওদিকে চোখ দিতে দিতে  হঠাৎ অরূন্ধতীর সবিস্ময় প্রশ্ন,

-'একি!গ্রামের মেলায় বইয়ের দোকান!'

দাদার উত্তর,-'হুম। এখানকার মেলায় বই-বাজারও বসে।যদিও সবই প্রায় সাঁওতালি ভাষায় লেখা,তবু বিক্রি ভালোই।'

             সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন, শহর থেকে বহুদূরে একদল প্রান্তিক মানুষের আপন অস্তিত্বের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন,আত্ম-অনুসন্ধানের প্রবলতর অভীপ্সা। তাই দুদিনের এই মেলায় মীনাবাজার,জটীবুটি,নিত্যপ্রয়োজনীয় পশরা যেমন আছে, বইও থাকে। 

সবাই নিজের মতো এদিকে ওদিকে বেড়াতে লাগলেন, দাদা-বৌদি ভৈরবথানের দিকে এগিয়ে গেলেন,অরণি একাই খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, ছোটবেলার স্মৃতি ভীষণভাবে টানছে তাঁকে।

এদিকে সবাই ইতিউতি ছড়িয়ে পড়েছেন মেলায়; অরণিও ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে বেশ খানিকটা গহীন জঙ্গলে এসে পড়েছেন, খেয়াল নেই,  আকাশে বাঁকাচাঁদের ছায়া ছায়া আলো সামনের একখানা এঁদোডোবায় এসে পড়েছে, সম্ভবতঃ মন্দিরের খিড়কি অংশ এটা...বেশ নিরিবিলি,একটু বসতে ইচ্ছে হলো। দামী জামাকাপড়ের তোয়াক্কা না করেই বসে পড়লেন,  বর্ষাশেষের এই সময়ে বনজঙ্গলে সাপের উপদ্রব হয়, সে ভয়ও পেলেন না; মায়া আলোয় তাঁর দুচোখে ভাসছিলো যেন অন্য কোন জন্মপারের কথা…

এক রক্তপায়িনী উন্মত্তা দেবী তাঁর মানবী-কামনা-উদ্বেলতা নিয়ে ছুটে আসছেন প্রিয় মিলন পিয়াসে, মনে-মনে বেজেছে তাঁর ভৈরবের ডমরু-নিনাদ, কেঁপে কেঁপে উঠছে মাটি; দেবী আসছেন,দেবী আসছেন….

এক স্বপ্নময়তার গহনে তিনি দেখলেন, কোন এক পরমা প্রকৃতি হরিনীগতিতে ছুটে আসছেন তাঁর পুরুষের উদ্দেশ্যে; চোখে  তাঁর উদগ্র মিলন কামনা…. পরম পুরুষ তিনি; কি যেন এক ঐশী শক্তিছায়ে বৃক্ষান্তরালে হলেন অন্তর্হিত; অভিসারিকা গেলেন ফিরে, হলোনা কাঙ্ক্ষিত আলিঙ্গন।

এই অলৌকিক গহন বনমধ্যে স্খলিতমনা তিনি অনুভব করলেন, সামনে যাওয়ার চাইতে এ হয়তো ঢের ভালো। ঐহিক কামনা, মিলনবাসনা চির-অতৃপ্ত আসঙ্গ পিয়াসে বারবার টেনে আনবে তাঁকে, নবসৃষ্টির উন্মাদনায়, প্রাণের অঙ্কুরোদগমে, আলোর আকুলতায়। তাঁর মুগ্ধদৃষ্টির সামনে তা হয়তো স্মৃতির ফুল হয়ে ফুটবে, বিরহের অসহ তাপে ঝরে যাবে; মিলন রইবে বাকি, জাগরুক অনন্ত আকাঙ্ক্ষা। তারপরে তো আছেই জীবনভ'র অপেক্ষা…..'তোমার নিত্য আলো এলো দ্বারে এলো গো, তোমার পরাণপ্রদীপ তুলে ধরে এই আলোতে জ্বেলো গো…'

চিত্র- লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments