জ্বলদর্চি

সুতোয় বাঁধা পুতুল-৮(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/সুমন মল্লিক

সুতোয় বাঁধা পুতুল
সুমন মল্লিক

পর্ব – ৮


দ্বাদশ  অধ্যায়

৩৪
রূপাঞ্জনার পাশে শুয়ে আছে বিহান৷ রূপাঞ্জনা এখন বেশিরভাগ সময় শুয়েই থাকে৷ বিশ্রামে থাকে৷ কোন কাজ করতে দেয় না বিহান৷ একজন কাজের মহিলাও রেখে দিয়েছে৷ বিহান জানে শেষের এই ক’টা দিন ভীষণ সাবধানে থাকতে হয়৷ রূপাঞ্জনার পেটে হাত রাখে বিহান৷ বিহানের হাতে হাত রেখে রূপাঞ্জনা বলে, “কী দেখছো?”
     “খুব দুষ্টুমি করছে তো!”
     “তাই! আর মনে হয় ভালো লাগছে না ওর৷ আমাদের দেখতে চাইছে৷”
     “হ্যাঁ৷ তাই হবে৷” রূপাঞ্জনার কপালে ঠোঁট রাখে বিহান৷
     “আচ্ছা, শুনলাম তৃষা এসেছে?”
     “হ্যাঁ৷ ওর হাসবেন্টের এবার এখানে ট্রান্সফার হয়েছে৷ কে বললো?”
     “সুকমলবাবুর ওয়াইফ, মানে প্রিয়াদিকে ফোন করেছিলাম৷ তখনই জানতে পারলাম৷”
     “ও আচ্ছা৷”
     “তাহলে তৃষাকেও নিমন্ত্রণ করি? ও এলে ভালোই লাগবে৷ কি বলো?”
     “হ্যাঁ, বলো তাহলে৷ ফোন নম্বর দিচ্ছি৷”
     “হ্যাঁ, দাও৷ ছেলেকে তো সঙ্গে আনবেই৷ বরকেও নিয়ে আসতে বলি সঙ্গে? সবার সঙ্গে পরিচয়ও হয়ে যাবে৷’
     “বলো৷ তবে আসবে কিনা কে জানে৷ অনুষ্ঠানটা তো মেয়ে-মহিলাদের৷” 
     “তুমি ফোন নম্বরটা দাও৷”

৩৫
ভেতরের ঘরে রূপাঞ্জনাকে কেন্দ্র করে মহিলারা গল্প করছে৷ মাঝে মাঝে ভেসে আসছে হাসাহাসির আওয়াজ৷ রূপাঞ্জনাদের ফ্ল্যাটেই হচ্ছে ওর সাধের ছোট্ট ঘরোয়া অনুষ্ঠান৷ রূপাঞ্জনার দিদি চলে এসেছে দু’দিন আগেই৷ পঞ্চাশ থেকে ষাট জন লোকের খাওয়াদাওয়ার আয়োজন৷ ক্যাটারার বলেনি বিহান৷ নিজেই সামলে নিয়েছে৷ শুধু রান্নার একজন লোক ঠিক করেছে৷ পরিবেশনের দায়িত্ব বাড়ির মহিলাদের৷ 
     খানিকক্ষণ বাদে তৃষা এলো ছেলেকে নিয়ে৷ বিহান ফ্ল্যাটের নীচেই ছিল৷ তৃষার ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বললো, “একা যে? বর কোথায়?”
     “ও এলো না৷ মেয়েদের অনুষ্ঠান৷ বুঝিসই তো৷”
     “হ্যাঁ৷ তা ঠিক৷”
     “বিকেলে নিতে আসবে আমাকে৷ মার্কেটে ঢুকবো এখান থেকেই৷”
     “বেশ, তখনই পরিচয় হবে৷ আচ্ছা, ফ্ল্যাটটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি তো?”
     “না৷ শুধু ওই মোড়ের মাথায় একটা দোকানে একটু জিজ্ঞেস করেছিলাম৷”
     “চল ওপরে৷ রূপা তো বেশ কয়েকবার তোর খোঁজ করলো৷”
     “হ্যাঁ৷ একটু আগেই ফোন করেছিল৷”

তৃষাকে ঘর অবধি পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে এলো বিহান৷ তৃষা ভেতরে ঢুকে সাবধানে জড়িয়ে ধরলো রূপাঞ্জনাকে৷ রূপাঞ্জনা তৃষার ছেলেকে আদর করে পাশে বসালো৷ তৃষাকে কেউ চেনে না৷ রূপাঞ্জনা তৃষাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো, “বর আসেনি?”
     “না৷ মেয়েদের অনুষ্ঠান৷ শুনেই না করে দিয়েছে৷” তৃষার মুখ নিরুত্তাপ৷ যেন কিছুই আসে যায় না৷
     “ওহ্, দেখা হলো না তাহলে৷”
     “বিকেলে আসবে আমাকে নিতে৷ এখান থেকেই মার্কেটে চলে যাবো৷ নতুন করে সব আবার সাজাতে হচ্ছে৷ বোঝোই তো৷”
     “হ্যাঁ, ট্রান্সফারের চাকরিতে এই এক সমস্যা৷”
     “বিকেলে আসুক, বিহান আর তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো৷”
     “একদম৷ ওপরে নিয়ে এসো৷ একটু কিছু মুখে না দিয়ে গেলে কি চলে?”

তৃষা ও রূপাঞ্জনার কথোপকথন মিটে যেতেই মহিলারা আবার যথারীতি গল্প এবং হাসাহাসিতে মেতে উঠলো৷ রূপাঞ্জনার বাবা রান্নার ওখানে তদারকি করছে এবং মা অনুষ্ঠানের নিয়ম মেনে সব আয়োজন করছে৷ বিহান ফ্ল্যাটের নীচেই দাঁড়িয়ে৷ মনে মনে ভাবছে, তৃষা কি ইচ্ছে করেই ওর বরকে নিয়ে আসেনি? তৃষার সঙ্গে ওর অতীতটা কি কোনভাবে জানে সে? নাকি তৃষা সবটা হয়তো আগেই বলেছিল, তাই তাকে নিয়ে আসেনি৷ সিগারেট ধরায় বিহান৷ আবার মনে মনে ভাবে, দেখাই যাক না বিকেলে সে আসে কিনা – এলে তৃষা কী করে৷     
 

ত্রয়োদশ অধ্যায়

৩৬
রূপাঞ্জনার ঘরে বসেই গল্প করছে তৃষা ও রূপাঞ্জনা৷ অনুষ্ঠান ভালোভাবেই মিটে গেছে৷ বিহান রান্নার লোকের সঙ্গে কথা বলছে৷ একটু আগে লোকের গমগম ব্যাপারটা এখন নেই৷ তৃষার ছেলেও খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তৃষার ফোন বেজে ওঠে৷ রাজার ফোন৷ তৃষা রূপাঞ্জনাকে বলে নীচে আসে৷ বিহান তখন রান্নার লোকেদের পাওনাগন্ডা মেটাচ্ছে ওখানেই৷ তৃষা বিহানকে ডেকে পরিচয় করায়, “বিহান, এই যে রাজা৷ আমার হাসবেন্ট৷ আর রাজা, এই হলো বিহান৷ আমার কলেজ ফ্রেন্ড৷”
     “নমস্কার৷ আসুন প্লিজ৷ চলুন ওপরে৷” বিহানের মুখে সৌজন্যের হাসি৷
     “বিহানবাবু, আজ থাক৷ অন্য একদিন আসবো৷ অনুষ্ঠানটা তো মূলত মহিলাদের৷ তাছাড়া আমাদের একটু মার্কেটে ঢুকতে হবে৷” রাজা ওপরে যেতে চায় না৷
     “আরে তা হয় নাকি! ওপরে এখন লোকজন নেই৷ আর আমার ওয়াইফের সঙ্গে পরিচয়টা হোক৷ চলুন৷”
     “আচ্ছা বেশ৷ চলুন, আপনার মিসেসকে শুভেচ্ছাটাও জানানো হবে৷ তবে খুব বেশিক্ষণ কিন্তু বসবো না বিহানবাবু৷”
     “ঠিক আছে৷ এই তৃষা চল৷”

ওরা তিনজন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ওপরে উঠে আসে৷ বিহান ওদের রূপাঞ্জনার ঘরে বসায়৷ তৃষার ছেলে ঘুমিয়ে আছে৷ রূপাঞ্জনা বাথরুমের দরজা খুলেই দ্যাখে তৃষা এবং রাজা বসে আছে৷ অদ্ভুত একটা অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে রূপাঞ্জনার চোখে-মুখে৷ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বাথরুমের দরজায়৷ তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগে ওখানেই পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায়৷ শুরু হয়ে যায় রক্তপাত৷

৩৭
ঘন্টা তিনেক পরেও জ্ঞান ফেরেনি রূপাঞ্জনার৷ নিজের নার্সিংহোমেই আই সি ইউ তে শুয়ে আছে৷ ব্লিডিং তখনও বন্ধ করা যায়নি৷ বাইরে বসে আছে বাড়ির সবাই৷ বসে আছে তৃষাও৷ বিহান আই সি ইউ-র বাইরে পাগলের মতো হেঁটে চলেছে আর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে৷
     কিছুক্ষণ পর ডাক্তারের চেম্বারে ডেকে পাঠানো হয় বিহানকে৷ ডাক্তার জানায়, সিচ্যুয়েশন খুবই ক্রিটিকাল৷ ব্লিডিং কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না৷ যেকোন সময় অপারেশন করতে হতে পারে৷ এমন সময় খবর আসে রূপাঞ্জনার জ্ঞান ফিরেছে৷ আই সি ইউ-র দিকে ছোটে বিহান৷ 

৩৮
রূপাঞ্জনার পাশে বসে আছে বিহান৷ রূপাঞ্জনার হাত বিহানের ঠোঁটে৷ রূপাঞ্জনার হাতের ওপর ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল পড়ছে বিহানের৷ রূপাঞ্জনারও চোখে জল৷ ঠোঁট দুটো কাঁপছে৷ বিহান বললো, “এটা কী হয়ে গেল তৃষা!”
     “কেঁদো না৷ সবই আমার কপাল৷ কে জানতো, যে জানোয়ার একদিন আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছিল, সে এভাবে সামনে এসে হাজির হবে আবার!”
     “মানে!”
     “তৃষার হাসবেন্টই সেই শয়তান৷”
     “এর কথাই...” কথা শেষ করতে পারে না বিহান৷ একটা অসহ্য কিছু ঘুরে চলে সারা শরীরে৷
     “হ্যাঁ, এ-ই সে৷ এর কথাই তোমাকে বলেছিলাম বিয়ের আগে৷ এখন কী সুন্দর ভদ্রতার মুখোশ পড়েছে৷ আমার মতো না জানি আরও কতো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে ওই জানোয়ারটা৷”

কথা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে রূপাঞ্জনা৷ উত্তেজিত হয়ে পড়ায় রূপাঞ্জনার অবস্থার আরও আবনতি ঘটে৷ ছুটে আসে নার্স৷ খবর দেওয়া হয় ডাক্তারকে৷ নার্স বিহানকে বাইরে যেতে বলে৷ কিন্তু বিহান বাইরে যেতে চায় না৷ শেষে ডাক্তার এলে তার কথায় বাইরে যেতে রাজি হয় বিহান৷ বিহান উঠে আসতে গিয়ে দ্যাখে তৃষা দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে৷ হয়তো রূপাঞ্জনার সঙ্গে কথা বলার জন্য এসেছিল বিহানের পেছন পেছন৷ রূপাঞ্জনার সব কথা তৃষা শুনেছে৷ তৃষার চোখে যেন আগুন জ্বলছে৷ বিহানকে দেখে ছুটে পালিয়ে গেল তৃষা৷ বিহান এসে মূর্তির মতো বসে থাকলো চেয়ারে৷ একটু পরে খবর এলো রূপাঞ্জনার অপারেশন শুরু হয়েছে৷
(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments