জ্বলদর্চি

এই যে আলোর আকুলতা-২/(উৎসব ১৪২৮)/আবীর ভট্টাচার্য

এই যে আলোর আকুলতা
আবীর ভট্টাচার্য 


দ্বিতীয় অধ‍্যায়

বাড়ি ফিরে সবাই যে যার নিত্যব্যস্ততায় জড়িয়ে পড়লেন, তবে কাজকর্মের মধ্যে একঘেয়েমি যে নেই, অনেকদিন পরে কাজ করতে করতে রূপার গলার গুনগুন গান তার প্রমান দিচ্ছিলো,জোজোও দেখলেন বেশ মন দিয়েই পড়াশোনা করছে, বারবার উঠে মা-বাবাকে জ্বালাতন করছে না। অরণি ডুবে গেলেন কাজে, সকাল থেকেই সে অর্থে কাজকর্ম হয়নি, বাচ্চাদের আর কি দোষ দেবেন, তাঁর নিজেরই উত্তেজনা ছিলো তুঙ্গে। কতদিন, কতদিন পরে, একটি স্বাভাবিক দিনযাপনের স্বপ্ন ও তার সার্থক রূপায়ণ।

রাত দশটা নাগাদ রূপা ডিনারে ডাকলেন, সবাই অল্পস্বল্প যতটুকু না খেলেন, কথা বললেন, গল্প করলেন আরো অনেক বেশি, এর মধ্যেই অরূপ-দোলার ফোন এলো, প্রায় প্রতি রাতেই তাঁরা বন্ধুবান্ধবেরা যেমন মামুলি গল্পগাছা করেন, তেমনই; তবে আজকের সিংহভাগ জুড়ে ছিলো স্বাভাবিক ভাবেই সারাদিনের গল্প; এবং মনে করিয়ে দেওয়া, এবার ছুটির গন্তব্য কিন্তু বেলপাহাড়িই।

এবং অদ্ভুত ব্যপার,যে রূপা-জোজো দেশের বাড়িতে যেতেই চায়না, তারাও কানাইসর, দেওপাহাড়,লালজল গুহার গল্প শুনে রোমাঞ্চিত! অথচ মনে আছে, বিয়ের পরে পরে , কাঁকড়াঝোড় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন যখন নববধুকে, কারেন্ট নেই বলে ও যেতে রাজিই হয়নি…

এরমধ্যেই মনে পড়লো, অরূন্ধতীর কথা; ওনি তো আজ ফোন করলেন না! ক্লান্ত কি! যতই হোক, সারাদিন ধকল তো তাঁর ওপরে কম যায়নি, একবার ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি…
আসলে, তিনি মানুষটি এমনই, খুব বেশি নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না, আভাসে, মৃদু ইঙ্গিতে জানিয়ে দিতে চান মুগ্ধতা; এই নিয়ে বিবাহিত জীবনের শুরুতে বেশ অভিযোগ ছিলো রূপার, এখন মানিয়ে নিয়েছে।
টেবিল ছেড়ে ওঠার আগে রূপাকে বললেন, একবার ওনাদের খবর নিতে, তাঁর কিছু কাজ এখনো বাকি, তিনি স্টাডিতে ফিরে গেলেন, বৌ-ছেলেকে শুভরাত্রি জানিয়ে।
         
কম্পিউটারের সামনে বসলে তিনি নাকি জগৎ সংসার ভুলে যান, পরিবার বা বন্ধুমহলে এমন অপবাদ তাঁর আছে; আজ একটু ক্লান্ত লাগলেও কাজ না সারা হলে ঘুম আসবে না, তিনি জানেন, তাই দেরী না করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাজ যখন শেষ হলো,ঘড়ি জানান দিচ্ছে, রাত একটা পনেরো, অর্থাৎ ইংরেজি হিসাবে নতুন দিন।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে অভ্যাসমতো একবার ফেসবুক খুললেন, সেখান থেকে ঘুরে হোয়াটসঅ্যাপ। এটা ওটা মেসেজ তো আসেই, তেমন লক্ষ্য করেন না। আজ দেখলেন, সবার প্রথমেই অরূন্ধতীর মেসেজ; কৌতুহলী মন আঙুল ছোঁওয়াতে বাধ্য হলো….একখানি গহন বনের ছবি, দূরে এক পোড়ো মন্দির...ক্যপস্যন;  'স্বপ্নে দেখি'; 

        বারবার দেখতে লাগলেন,ছবি আঁকাআঁকির তেমন কিছু বোঝেন না, তবু কি প্রাণবন্ত আঁকা! তুলির প্রতিটি মোচড়ে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে প্রকৃতির! পড়ান ভালো, মিশতে পারেন সবার সাথে, এসব শুনেছেন, কিন্তু এতো ভালো আঁকেনও! 

অজান্তেই হাত চলে গেল টাইপিং প্যাডে,

-Marvelous!

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, শুনেছিলাম বাঙালি!

-সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমানুষের মত একটা ইমোজি দিয়ে কি-প্যাড পাল্টে লিখলেন,

-অপুর্ব!

প্রত্যুত্তর এলো একটি স্মাইলি এবং নিভে গেল সবুজ আলো।

তিনিও ফোন অফ করে ঘুমোতে এলেন,সারারাত ছেঁড়া-ছেঁড়া স্বপ্নে ঘুরে বেড়াতে লাগলো জন্মপারের কোন এক গহনবনে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা উপলখন্ড, পোড়ো মন্দির,ল্যাটেলাইট মাটি ধোওয়া লালরঙা ঝর্ণা,স্বাপদসঙ্কুল অরন্যানী, কোয়ার্জ পাথরের ধুম্র-পাহাড়, অগম্য প্রাচীন গুহামধ্যে আদিম মানুষের আঁকা ছবি, ফুল-পাতার গয়নাপরা হাস্যমুখী নারী,প্রস্তরায়ুধ-সজ্জিত যোদ্ধা-পুরূষের দল…

এক অমোঘ আকর্ষণে টানছে তাঁকে।এ ভুমি তাঁর অতিপরিচিত,অতিপ্রিয়। বহুদিন, বহুদিন ছেড়ে এসেছেন তাকে,কই! কখনো এমন করে ডাকেনি তো!

পরের কয়েকদিন,কাজের অবসরে সবাই মিলে পরিকল্পনা সাজালেন, কর্তারা নিজেদের অফিস কিভাবে সামাল দেবেন, জরুরী প্রয়োজনে ইন্টারনেট পরিষেবা ভালোভাবে পাওয়া যাবে কিনা; এসব আলাপ-আলোচনা চলতে লাগলো। অরণি-রূপা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করলেন, দেশের বাড়িতে সবাইকার থাকার সুব্যবস্হা করা গেলেও এই কয়দিনের জন্য নিকটবর্তী শহর ঝাড়গ্রামেও হোটেল বুক করে রাখা বাঞ্ছনীয়; যতই বন্ধু-স্বজন হোন, শহুরে মানুষ সবাই, এখন হুজুগে পড়েছেন; হয়তো গ্রামের নাগরিক পরিসেবাহীন নিস্তরঙ্গ জীবন কিছুক্ষণের মধ্যেই একঘেয়ে লাগবে; সেক্ষেত্রে…..

দিনগুলি যেন পাখির পালকের মতো উড়ে যেতে লাগলো, প্রতিদিন কথাবার্তার বহর বাড়তে লাগলো নিজেদের মধ্যে;  বনজঙ্গলে ঘোরাঘুরির উপযুক্ত পোষাক,ক্যামেরা, জুতো ধীরে ধীরে বেরোতে লাগলো; অরণির নিজের বাড়িতে ফেরার সুযোগ, তাঁর তো ভালো লাগারই কথা, কিন্তু সবার মনেই যে এক অনাস্বাদিত ভাবানুভূতি: যেন 'সমরে চলিনু আমি,মোরে না ফিরাও রে…'
        
তারমধ্যেই কখনও কখনও অরূন্ধতীর আঁকা ছবি আসছে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে, টুকটাক নিভৃত আলাপ; এবারের যৌথ-যাত্রাসুখের মাধুরী বাড়িয়ে চলেছে।
 
ক্রমে দিন গড়ালো, শারদীয়া পঞ্চমীর সকালে নাগরিক জীবনকে কয়দিনের জন্য টা-টা-বাই-বাই করে নিজস্ব গাড়িতে তিনটি পরিবার;থুড়ি একটি 'অষ্টবসু'-যৌথ-পরিবার কুমারী প্রকৃতির কোলে বহুযুগ আগে ফেলে আসা নিজেদের সত্ত্বার সঙ্গে পুনরায় আলাপিত হতে চললেন।

ঝাড়গ্রাম পর্যন্ত চেনা রাস্তা; কিন্তু ঝাড়গ্রাম প্রবেশের মুখেই  'হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি'...কালো পীচরাস্তার দুপাশে মহীরুহ শালের আকাশ আলিঙ্গনে, জঙ্গল থেকে উঠে আসা তীব্র কোন কামনাময় সুগন্ধে মন 'বাইরে দূরে যায় রে উড়ে'।

ছোট্ট ঝিমছাম শহরটির উড়ালপুল পেরিয়ে যেতেই আদিগন্ত ঢেউখেলানো অনাবাদী জমিতে বর্ষার জল পেয়ে ঘাসে আগাছায় সবুজের ছড়াছড়ি, রাস্তার দুইপাশে নাম না জানা অসংখ্য ছোট ছোট ঝোপে উপচে পড়া ফুল, নীল আকাশে ভারহীন সাদা মেঘের পালক; ছুটির আনন্দ যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। জানালার দিকে তাকিয়ে অরূপ বলে উঠলেন,

-এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে…

অরূন্ধতী মৃদুকন্ঠে বললেন,
-ইঞ্জিনীয়ার সাহেবরা সবাই যে দেখছি আজকাল কাব্যি করতে বসেছেন…

অরূপের তো বটেই,অরণিরও যে মন অকারণ পুলকে ভরে উঠলো কেন,কে তা জানে!

অরূপের বৌ দোলা একটু আল্হাদী, এরমধ্যেই আদুরে গলায় বললে,

-আমার জন্য কিন্তু গাছে দোলনা বানিয়ে দিতে হবে, আমি দুলবো।

সম্পর্কে বন্ধুপত্নী, একটু চটুল গলায় অরণি বলে উঠলেন,

-এমা! শুধুই দোলনা!আমার তো প্ল্যান ছিলো তোমার সাথে কাঁকড়াঝোরের বনবাংলোয় রাত্রিবাস করার!

সঙ্গে সঙ্গে কব্জিতে রূপার রাম-চিমটি, এবং ছয়জনের সম্মিলিত হাস্যরোল...

সত্যিই, কতদিন যে এমন প্রাণ খুলে হাসেন নি তাঁরা! প্রয়োজন ছিলো, ভীষন প্রয়োজন ছিলো এমন একটি ভ্রমণের; মনেমনে স্বীকার করলেন প্রত্যেকেই।

ইতিমধ্যে গাড়ি এসে পড়েছে দইজুড়ির চৌরাস্তায়, মোড়ের মাথায় কাঠের উনুনে ভাজা হচ্ছে ইয়া বড়ো বড়ো বেগুনী, পাশেই কাঁচের ঘেরাটোপে গামলা ভরা রসগোল্লা। লোভ সামলানো দায়! কিন্তু সংশয়; 'কোভিড'...
নামবেন কি নামবেন না ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত লোভেরই জয় হোল, গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন,অরূপ। সবাইকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে দোকানে গিয়ে অর্ডার, দোকানি যত্নে ভেজে তালপাতার খালায় পৌঁছে দিলেন ধোঁওয়া ওঠা বেগুনী, রসসিক্ত সাদা সাদা অমৃতগোলক। আহা! কি স্বাদ তার! শহরের বড়োসড়ো দোকানও পাল্লা দিতে পারবে কিনা সন্দেহ! হঠাৎ অরণির মনে পড়লো, ছোটবেলায় এখানেই পাওয়া যেত রাবড়ি, মা ভীষন ভালোবাসতেন, বাবা এদিকে কাজে এলেই নিয়ে যেতেন। তিনি তড়িঘড়ি নেমে এ দোকান ও দোকান খোঁজ করতেই পেয়ে গেলেন, কিনেও নিলেন হাঁড়িভর্তি। ওদিকে তখন ডাকাডাকি চলছে চায়ের জন্য। খাঁটি গরুর দুধে চা-পাতা মিশিয়ে আদা-এলাচ ছেঁচে টগবগ করে ফুটিয়ে ঢাল-ওপর করে তৈরি করা চা... বাড়িতে অতিযত্নেও এ স্বাদ আসবে না, তা সবাই নিশ্চিত!


খাওয়া-দাওয়ার শেষে দোকানীকে পাঁচশো টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিলেন অরূপ, দোকানী হিসাব কষে বাকি টাকা ফেরৎ দিতে এলেন, তাঁরা নিতে না চাইলে হাতজোড় করে বললেন,
-এই করোনায় ব্যবসাপাতির ভীষন ক্ষতি হচ্ছে, সংসার চালানোই দায়। আপনারা এসে বেশ কিছু টাকার ব্যবসা দিলেন, উপকার হলো। কিন্তু বাবু, আমরা ব্যবসাদার,খেটে খাই,ভিখারী নই; ভিক্ষা নেব কেন?
প্রতিমাসে ছয় অঙ্কের মাইনে তোলেন তিনজনেই, নীরবে হাত পেতে নিলেন দরিদ্র দোকানীর দেওয়া প্রাপ্য ফেরৎ কয়েকশো টাকা!
চতুর্দিকে ঘুস-অনৈতিকতার কারবার চলছে অপর্যাপ্ত ভাবে, তবু এই হয়তো আমাদের আসল দেশ; এখানে এখনো ভাগ্যিস এমন মানুষেরাও আছেন!...পরমশ্রদ্ধায় সাধারণ মানুষের এই স্বাভাবিক শততাকে সম্মান জানিয়ে এগিয়ে চললেন শিক্ষিত মানুষগুলি।
(আগামীকাল) 

চিত্র- লেখিকা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

2 Comments

  1. তুই যে আসলে ভিতর কবি, তোর লেখাতে তা বোঝা যায় রে। খুব খুবই ভালো লাগছে। ছবির মতো ফুটছে যাত্রাপথ...❤️❤️❤️❤️

    ReplyDelete
  2. ভীষণ ভালো লাগলো দ্বিতীয় অধ্যায়‌ও।
    - উপাসিকা

    ReplyDelete