জ্বলদর্চি

মেদিনীপুর জেলার আঞ্চলিক লোকাচার/(উৎসব ১৪২৮)/রোশেনারা খান

মেদিনীপুর জেলার আঞ্চলিক লোকাচার
রোশেনারা খান

 ‘নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/বিভিদের মাঝে দেখ মিলন মহান’।বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবেই চিনিয়েছিলেন অখণ্ড ভারতবর্ষকে। এদেশে বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।স্থান-কালের ভিত্তিতে আচার আচরন, রীতিনীতি ভিন্ন হওয়াটায় স্বাভাবিক। এই রীতি নিয়মগুলি কোথাও ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত, কোথাও বা তা আঞ্চলিক রীতি হিসেবে সীমাবদ্ধ। শহুরে আধুনিকতায় আনেক রীতি নিয়মই আজ বিলুপ্তির পথে।কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ আজও ভারতের আদি সংস্কৃতি হিসেবে অনেক রীতি নিয়মই সযত্নে লালান করে চলেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি বৃহৎ জেলা ছিল মেদিনীপুর।পরবর্তী কালে  জেলাটিকে ভেঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম, এই তিনটি  জেলায় ভাগ করা হয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার বেশকিছু অঞ্চল বর্তমানে ‘জঙ্গলমহল’ নামে পরিচিত। এখানে, বিশেষ করে জঙ্গলমহল এলাকায় বিভিন্ন ধরণের জাতি-উপজাতি বাস করে।তারা নানা ধরণের রীতি-নিয়ম,প্রথা ও ব্রততে  বিশ্বাসী। ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে শাল মহুল,আম,জাম,শিমূল ইত্যাদি গাছের সবুজ জঙ্গল রয়েছে, তার  ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে আদিবাসীদের ছোট ছোট গ্রাম। এইসমস্ত গ্রামের সাঁওতাল, শবর, লোধা, মুণ্ডা ইত্যাদি জনজাতি আদিম যুগ থেকে একটা সময় পর্যন্ত জীবনধারণের জন্য সম্পূর্ণভাবে জঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। জঙ্গলের ফল-মুল, শাক-পাতা খেয়ে,পশুপাখি শিকার করে, জঙ্গলের কাঠ ও বনজ উপকরণ দিয়ে ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় নানান জিনিস বানিয়ে বিক্রি করে দিব্যি দিন কাটাত। সারাদিন খাটুনির পর সন্ধ্যাবেলা মহুল-সিমুলের তলায় বসে হাঁড়িয়া খেত আর মাতাল হয়ে মেয়ে-মরদ একে অপরের কোমর জড়িয়ে নাচত গাইত।        

  এমনই ছিল ওদের সহজ সরল জীবনযাত্রা। দিকুদের (বহিরাগত)প্রবেশ ঘটায়,ওদের সব সুখসান্তি নষ্ট হয়ে যায়। মহাজনরা ওদের সরলতার সুযোগে দিনির পর দিন ঠকাতে ঠকাতে ধিরে ধিরে কৃতদাস বানিয়ে ফেলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওরা মুক্তি পেলেও হারিয়েছে জঙ্গলের অধিকার। এখন আর ওরা জঙ্গলে ইছেমত পশু শিকার করতে বা গাছ কাটতে পারেনা। যার জন্য জনমজুরির সঙ্গে বেছে নিয়েছে  নানান পেষা। কিন্তু প্রাণপণে ধরে রেখেছে রীতি-রেওয়াজ ও সংস্কৃতি। এদের গানই হয়ে উঠেছে নিজেদের ভালো লাগা,মন্দ লাগার মাধ্যম।তাই  ওরা আক্ষেপের সঙ্গে গেয়ে ওঠে-‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
  এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা শহুরে মানুষের জীবনযাত্রা থেকে একেবারে  ভিন্ন।এদের জীবন নানারকম লোকাচার ও রীতি-নিয়মে বাঁধা। এদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে সমাজপতি বা মোড়লরা। মোড়লদের দায়িত্ব ভাগ করা রয়েছে। বিয়ে,অন্নপ্রাসন ইত্যাদি বিষয়গুলির দায়িত্বে থাকে একজন। কেউ পুজো করা, বিয়ে দেওয়া ইত্যাদি করে থাকে।কেউ ঝগড়াঝাটির মীমাংসা করে।এদের বিয়ে নানা  পদ্ধতিতে হয়ে থাকে।সম্মন্ধ করে বিয়ে, প্রেম করে বিয়ে, ছেলে মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু মেয়েটি রাজি নয়।সে ক্ষেত্রে অনেক সময় ছেলেটি বলপূর্বক মেয়েটির সিঁথিতে সিন্দুর ঘষে দিয়ে থাকে। একে সিঁদুরঘষা বিয়ে বলে।


      আদিবাসীদের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওরা শহুরে শিক্ষিত সমাজের থেকে  অনেক বেশি উদার এবং চিন্তা ধারায় আধুনিক ।যেমন নির্ধারিত লগ্নে কোনও অবাঞ্ছিত কারণে বিয়ে হওয়া সম্ভব না হলে মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা মানা হয়না। কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ের জন্য মাকে দায়ি করে গঞ্জনা দেও য়া হয় না ।বড়দিদির আগে ছোট বোনের বিয়ে হওয়াতে সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে এ নিয়ে দিদিকে কোনো ব্যঙ্গোক্তি শুনতে হয়না। বিয়ের বহুদিন পরেও কোনো মহিলার সন্তান না জন্মালে তাকে বন্ধ্যা বলে অপদস্থ করা হয়না।বরং তারা স্বামী স্ত্রী আলোচনা করে কোনো আত্মীয়র বাচ্চা বা কোনো আনাথ বাচ্চাকে নিজের সন্তানের মত লালনপালন করে বড় করে।

          বিবাহের সময় পাত্রপক্ষ পাত্রী খুঁজতে ঘটক লাগায়।পাত্রীর  খোঁজ পাওয়া গেলে মাসের বিজোড় তারিখে পাত্রী দেখতে যাওয়া হয়। যাওয়ার  পথে জলভরা কলসি দেখাকে এরা শুভ মানে।পাত্রী বা মেয়ে দেখার সময় কেউ বিশেষ কথা বলেনে।ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে ঘটকের উপস্থিতিতে দুই পক্ষের কথাবার্তা হয়।মেয়ে পছন্দ হলে বিবাহের দিন ঠিক হয়। এরপর ঘটক যতদিন পরে বিয়ে দুটি দড়ি নিয়ে ততগুলি গিঁট দিয়ে দুই পক্ষকে দুটি দড়ি দিয়ে দেয়। দুই পক্ষই রোজ একটি করে গিঁট খুলতে থাকে শেষ গিঁটটি বিবাহের দিন খোলা হয়।বিবাহের দুদিন আগে এদের পুরুত এসে তেল হলুদকে মন্ত্রপূত করে দেয়।সেই হলুদ মেয়েলি আচারের মাধ্যমে পাত্রের গায়ে লাগিয়ে কিছুটা মেয়ের জন্য পাঠানো হয়।এই দুদিন ধরে দুই পরিবারেই নাচগান চলে। এদের    বিবাহে কোনো যৌতূক প্রথা নেই ,নিয়ম মত উভয় পক্ষ কিছু জিনিস দেওয়া নেওয়ে করে। যেমন,বিয়ের সময় পাত্রীর বাড়ি থেকে রীতি অনুযায়ী দেওয়া হয় কাঁসা পিতলের ঘটি বাটি ও থালা। থালা ও বাটিতে ধান ভরে দেওয়া হয়।পাত্রের বাড়ি থেকে মেয়েকে দেওয়া হয় হলুদ রঙের সুতির শাড়ি, কন্যাপণ হিসেবে মেয়ের বাবাকে দেওয়া হয়  কিছু নগদ টাকা, একটি গরু, মেয়ের মা,ঠাকুমা,দিদিমা,মাসি পিসি সবার জন্যই নতুন শাড়ি দেওয়া হয়।বিয়ের সময় বরযাত্রীদের খাওয়া খরচ পাত্রপক্ষ সঙ্গে নিয়ে আসে, কিম্বা পথে খেয়ে আসে।বর পৌঁছালে মহিলারা ধানদূর্বা, সিন্দুর,কড়ি, মিষ্টি দিয়ে বরণ করে।বরকে খেজুর পাতার চাটাই বিছিয়ে বসতে দেওয়া হয়।এরপর  একজন ঝুড়িতে করে সাবান ইত্যাদি ও বালতিতে জল নিয়ে আসে।তালপাতার প্রতীকী ক্ষুর দিয়ে বরের চুলদাড়ি ও নখ কাটে,সাবান দিয়ে মুখ-হাত-পা ধোয়ায় ।কনেকে একটি বড় বাঁশের ঝুড়িতে বসিয়ে কয়েক মিলে বিবাহের মণ্ডপে নিয়ে আসে। কোনের মুখে কাপড় জড়িয়ে ঢাকা থাকে।বরকেও কয়েকজন মিলে তুলে ধরে থাকে। বর কোনের মুখ খুলে পানপাতা ছোঁয়ায়।এই অবস্থাতেই বর কোনেকে সিন্দুরদান করে। এটাই বিয়ের প্রধান অনুষ্ঠান। 

  এরপর রাতভর চলে  মদ-মাংস ও নাচগান।পরদিন সকালে নতুন কনেকে নিয়ে বর ও বরযাত্রীরা নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।  শ্বশুরবাড়িতে নতুন বৌকে নানারকম আচারের মাধ্যমে বরণ করা হয়।এদের একটি বেশ মজার রীতি রয়েছে,বর গাছে উঠে বসে থাকে।কনে তখন বরকে উদ্দেশ্য করে বলে,তুই গাছ থেকে নেমে আই।আমি তোকে মাটিকেটে খাওয়াব।এরপর  নতুন বউ বরকে মোড়ল- মুরুব্বীরা বোঝান যে তারা দুজন এখন থেকে একটি গরুগাড়ির দুটি চাকা । দুজনে সহমত হয়ে চলতে পারলে  সংসারজীবন  অনায়াস হবে,ইত্যাদি।

  এদের বিবাহবিচ্ছেদ হয় এক অদ্ভুত নিয়মে।দুজনের মধ্যে বনিবনা না হলে মোড়লসহ অন্যান্যদের ও স্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বামী একটি শালপাতার বোঁটা থেকে আগা পর্যন্ত মাঝ বরাবর ছিড়ে ফেললে বা জলভর্তি ঘটি মাটিতে রেখে স্বামী পা দিয়ে উল্টে দিলেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়।

  বর্ণ হিন্দুদের বিবাহও আচার সর্বস্ব বলা যায়। গায়েহলুদের তত্ত্ব পাত্রের বাড়ি  থেকে পাত্রীরবাড়ি, পাত্রীর বাড়ি  থেকে পাত্রেরবাড়ি পাঠানো হয়।পাত্রেরবাড়ি থেকে যে তত্ত্ব আসে তাতে জামাকাপড়, তেল-সাবান প্রসাধন সামগ্রীর সাথে মাছ,দই মিষ্টিও পাঠাতে হয়। এই রেওয়াজ মুসলিমদের মধ্যেও রয়েছে।তত্ত্বে পাত্রের গায়ে লাগানো হলুদ ও মেহেন্দিও পাঠাতে হয়। দুটি শাড়ি পাঠানো হয় একটি গায়েহলুদের জন্য।আর একটি ক্ষীর খাওয়ানোর জন্য।মুসলিমদের বিয়েতে ছেলেকে তত্ত্ব পাঠাতে হয়না।এই অনুষ্ঠানটি আগে হত বিয়ের সাতদিন,তিনদিন বা একদিন আগে। গায়েহলুদের দিন থেকে সুরু হয় বিয়েরগান।যা ‘ইসলামি বিয়ের গান’ নামে পরিচিত। গায়েহলুদ ও বিবাহের মাঝখানের দিনগুলিতে পাত্র পাত্রি দুজনেরই আইবুড়ো বা থুবড়ো ভাত খাওয়ার পর্ব চলে। এখন মানুষের সময়ের অভাব, তাই তিনদিন বা একদিন আগে গায়ে হলুদ হয়।বরের হয় একদিন আগে,কনের একদিন পরে।হিন্দুদের সামাজিক বিবাহ লগ্ন মেনে সন্ধ্যার পর হয়। মেদিনীপুর যে অংস বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা হিসেবে পরিচিত, ওখানকার গ্রামীণ এলাকায়  হিন্দুদের একসময় নানা আচার পালনের মধ্য দিয়ে তিনদিন ধরে মেয়ের বিয়ে হত।বর বিবাহ করতে আসার তিনদিন পর বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরত। মুসলমানদের বিয়ে দিন রাতের কোনো ব্যপার নেই, যে কোন  সময়,যে কোনো বারে, এমনকি যে কোনো মাসে হতে পারে। কেউ কেউ ভাদ্রমাস ও পৌষ মাসে এবং ছেলে মেয়ের জন্মমাসে, জ্যৈষ্ঠ মাসে জ্যৈষ্ঠ সন্তানের  বিবাহ থেকে বিরত থাকেন। এগুলি মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল অঞ্চলে অনেক মুসলিম পরিবারে মানা হয়। বিয়েও ঠিক হয় শুভদিন দেখে। হিন্দুদের মতই বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলা। একটা সময় পর্যন্ত জঙ্গলমহলের গ্রামাঞ্চলে বিয়ের দিন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর সময় বস্তাভরে মুড়কি ও গুড়পিঠে দেওয়ে হত। প্রতি বেশীরা নতুন বৌ দেখতে এলে  তাদের এই মুড়কি ও গুড়পিঠে দেওয়া হত। প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় এখনো এই রীতি বলবত  থাকলেও শহরাঞ্চলে নতুন বৌয়ের সঙ্গে এখন  লাড্ডু দেওয়া হয়। ভারতে বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স আইনত মেয়েদের ১৮ বছর ও ছেলেদের সর্বনিম্ন ২১ বছর হলেও  বাল্যবিবাহের হার উদ্বেগজনক। বর্তমান সরকার বিবাহের বয়স বাড়িয়ে মেয়েদের ২১ বছর আর পুরুষদের ২৫ বছর করার কথা ভাবছে।  মুসলিমদের বিবাহ শরিয়তি আইনের আওতাধীন। এই আইনে একটি মেয়ে ঋতুমতি হওয়া মানেই সে সাবালিকা।এদেশের মুসলিমদের জন্য এই আইন বলবত থাকায় মুসলিমদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার বেশি। যদিও সময় মত খবর পেলে পুলিশ-প্রশাসন বিয়ে বন্ধ করে।

  তবে একবার বিয়ে হয়ে গেলে কোনো আইন তা বাতিল করতে পারেনা। জঙ্গলমহলের বহু মুসলিম পরিবারে ‘মেয়ে জামাইয়ের ‘হলদি পা’ ধুতে আসাকে অষ্টমঙ্গলা বলা হয়। হিন্দুদের ৮ দিনে অষ্টমঙ্গলা হয়, মুসলিমদের ওভাবে  নির্দিষ্ট দিন মানা হয়না। জেলার অন্যান্য প্রান্তে মুসলিম বিবাহে মেয়ের বাড়ি থেকে চারদিনে চৌথি আসে। তাতে জামাই মেয়ের জন্য কাপড় জামা, গোসলের জিনিসপত্র ও নানারকম খাবার থাকে।আগে বিবাহের সময় বরের সঙ্গে ৫/৭ জন মহিলা যেতেন।তাঁদের দুলারবিবি বা দোলারবিবি বলা হত।বরকে যেমন বিয়ের আসরে বড় খাঞ্চায় করে আস্ত খাসি রোস্ট করে দেওয়া হয়ক। সঙ্গে অন্যান্য ঁখাবারও থাকে।বর তার ভগ্নীপতি ও বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে সেই খাবার খায়। এটাকে থাল বলা হয়।এইরকম দুলারবিবিদেরও গোটা মুরগির রোষ্ট প্রত্যেককেই দেওয়া হত।এখন দিন বদলেছে। এখন বরযাত্রীদের  একটা বড় অংশ মেয়েরা  থাকে।অনেকে তাই ক’খানা শাড়ি লাগবে বিয়ের পাকা কথার সময়ই জানিয়ে দেন।তবে অনেকে এসব বিষয়ে কিছু বলেন না। মেয়ের বাড়ি থেকে বর পোশাক ও সেই সঙ্গে বরের বাবা-মা,ভাই-ভাবি,বোন-ভগ্নিপতি সবার জন্যই জামাকাপড় পাঠানো হয়।ছেলের বাড়ি থেকেও মেয়ের বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্যদের জন্য জামাকাপড় দেওয়া হয়।মুসলিমদের বিয়ের পদ্ধতি সর্বত্র সমান।মুসলিমদের দুটি পদ্ধতিতে  বিবাহ হয়ে থাকে,মৌখিক বিয়ে মোল্লা পড়িয়ে থাকেন। লিখিত বিবাহ দেন সরকার নিয়োজিত কাজি বা রেজিস্টার। এই বিবাহকে ‘কাবিলনামা’ বলা হয়।একটা সময় পর্যন্ত বেশিরভাগ বিয়েতে কাবিলনামা হতনা। কিন্তু অত্যধিক যৌতূক, বধু নির্যাতন, বধুহত্যা,বিনা কারণে তালাক ইত্যাদির জন্য এখন সব বিয়েতেই কাবিলনামা হচ্ছে। বিনা যৌতূকে বিয়ে হলে ‘দেনমোহর’ এর টাকার  পরিমান পাত্রপক্ষ ঠিক করেন। যৌতুকের ক্ষেত্রে যৌতুকের অর্থমূল্য অনুযায়ী দুইপক্ষ  আলোচনা করে দেনমোহর ধার্য হয়।

    মেদিনীপুর শহরে ও জেলায় ,বিশেষ করে জঙ্গলমহল এলাকায় ধর্মান্তরিত খৃষ্টানরা বেশিরভাগই আদিবাসী।এদের রীতি-নিয়ম আঞ্চলিক,পূর্ব ধর্মের । বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান আদিবাসীদের ও  হিন্দুদের মত। বিবাহ বাড়িতেই হয়। হিন্দুদের মতই গায়েহলুদের তত্ত্ব এ বাড়ি ও বাড়ি আদান প্রদান হয়।পাত্রের বাড়ি থেকে দই-মাছ-মিষ্টি যায়।বিয়ের আগে আশীর্বাদ পর্ব থাকে।এটা মুসলিমদের হয়।অনেকটা  কোনোকিছু কেনার আগে বায়না করার মত।এটা লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত। বিবাহের সময় বর কোটপ্যান্ট পরে।মেয়ে  লাল বা অন্য রঙের বেনারশী শাড়ি  পরে।কিন্তু ওড়নাটি হয় সাদা এবং মাথায় বলয়াকার সাদা ফুলের মুকুট। বিবাহ হয় আইন মেনে রেজিস্ট্রি করে পাদ্রি উপস্থিত থেকে দুজনকে সফতবাক্য পাঠ করান।পরস্পর আংটি বিনিময়,মালাবদল করে।সিন্দুরদানও হয়।বর আংটি সিন্দুরে ডুবিয়ে নববধূর সিঁথিতে সিন্দুর এঁকে দেয়।বিবাহ সম্পন্ন হয় পরস্পর চুম্বনের মাধ্যমে।মেদিনীপুর শহরে অনেক মুসলিম পরিবারেও সিন্দুরদান প্রথা ছিল।বিবাহের পর অনেককে সিন্দুর পরতেও দেখা যেত।খৃষ্টানদের বিবাহবিচ্ছেদ কোর্টেই হয়।

    মুসলিমদের বিবাহবিচ্ছেদ কাজির উপস্থিতিতে কিম্বা কোর্টে হয়ে থাকে।সবাই আইন মেনে বা শরিয়তের বিধান মেনে তালাক দেয় না। পিছিয়ে থাকা নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত পরিবারের পুরুষরা আজও রাগের বশবর্তী হয়ে স্ত্রীকে তালাক দেয়। তাই ‘হালালা নিকা’র প্রচলনও রয়েছে। তবে সবাই যে রাগের বশে মৌখিক তালাক দেয় তা নয়।অনেকে দ্রুত স্ত্রীর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে থাকে। যদিও ২০১৯ এর জুলাই মাসে ভারতের বর্তমান কেন্দ্রিয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় মোতাবেক একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়কে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করেছে। প্রমাণ হলে স্বামীর ৩ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। কিন্তু এই নিয়ে আনেক প্রশ্ন থেকে গেছে। যদিও সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়,তবুও সামান্য আলোকপাত করা যেতেই পারে।৮ মার্চ (২০১৯) আন্তর্জাতিক নারী দিবসে অনলাইন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখিকার একটি নিবন্ধের কিছু অংশ তুলে দেওয়া হচ্ছে। ‘সুপ্রিম কোর্ট নতুন আইন করার যে নির্দেশ দিয়েছিল, তা রুপায়ণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সেপ্টেম্বরে অর্ডিন্যান্স জারি করে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক, হালালা নিকার মত অভিশপ্ত প্রথাগুলি বাতিলের লক্ষ্যে ২৭ ডিসেম্বর লোকসভায় প্রবল বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে ভোটের মাধ্যমে ‘তিন তালাক’ বিলটি পাশ হয়ে যায় ।কংগ্রেস এবং এডিএমকে ভোট বয়কট করে। প্রথম ওর্ডিন্যান্স জারির সময় বলা হয়েছিল, তালাকপ্রাপ্ত মহিলার হয়ে যে কেউ স্বামীর বিরুদ্ধে কোর্টে অভিযোগ জানাতে পারবেন। এ বারের সংশোধিত বিলে বলা হয়েছে, স্ত্রী বা তাঁর নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ কোর্টে অভিযোগ জানাতে পারবেন না। এটি প্রথমে জামিন অযোগ্য ধারা ছিল। সংশোধনের পর স্বামী-স্ত্রী সমঝোতায় এলে শুধুমাত্র স্ত্রী কোর্টে স্বামীর জামিনের আবেদন করতে পারবেন।তালাক প্রমাণ হলে স্বামীর তিন বছর জেল হবে। এই সময় স্ত্রী-সন্তানদের খোরপোশ দিতে বাধ্য থাকবেন স্বামী।প্রয়োজনে স্বামীর সম্পত্তি বায়েজাপ্ত করা হবে।

      লোকসভায় তালাক বিল পাশ হলেও রাজ্যসভায় আজও আটকে রয়েছে।বিরোধীদের আপত্তির কারণ তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য হিসেবে ওর্ডিন্যান্স জারি করা। স্বামীর জেল হলে পরিবারের ভরণপোষণের কি হবে?

    যুক্তিটি কিন্তু অগ্রাহ্য করার মত নয়।ভারতীয় মুসলিম মহিলাদের তাৎক্ষণিক তালাক বিরোধী আন্দোলনে কোথাও স্বামীর কারাবাসের দাবি করা হয়নি। তালাক যদি অবৈধ হয়, তবে তা গ্রাহ্যে আনার প্রয়োজন কী? একজন দিনমজুর জেলে বসে কিী করে খোরপোশ দেবেন? স্ত্রীর সঙ্গে জেলফেরত স্বামী সংসার করবেন তো ? সম্পত্তি যাঁদের নেই, তাঁদের কী বায়েজাপ্ত হবে? তা হলে কি মুসলিম মহিলাদের মুক্তির নামে পুরুষদের জেলে পাঠানোই মোদীর আসল উদ্দেশ্য? এর সদুত্তর না পাওয়া গেলে মুসলিন মহিলাদের অবস্থা হবে ‘পুনর্মূষিক ভব’।দরিদ্র পরিবারের স্বামীনির্ভর তাৎক্ষণিক তালাকের শিকার অসহায় মহিলারা কোর্টে না গিয়ে সংসার, সন্তানের জন্য হালালা নিকাই মেনে নেবেন।’

তাই এখনো একতরফা তালাক বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।  আর  মেয়েরাও অনেক সময় স্বামী তালাক দিতে রাজি না হলে  কাজির কাছে ‘খুলা’ নিয়ে নিজেকে অত্যাচারী স্বামী ও তার পরিবার থেকে  মুক্ত করে নেয়।কেউ আবার কাজির কাছেই অন্য পছন্দের পুরুষকে বিবাহ করে নেয় ।

জঙ্গলমহল অঞ্চলের  বর্ণ হিন্দু, মুসলিম ও জনজাতির মধ্যে  গর্ভবতী মহিলাকে সাধভক্ষন করানোর রীতি আছে।আদিবাসীদের গর্ভাবস্থায় মাকে ওদের  পুরুতের দেওয়া মন্ত্রপূত মাদুলি পরানো হয়। প্রসব আসন্ন হলে মাদুলি খুলে ফেলা হয়।ঠিক এভাবেই অনেক মুসলিম পরিবারেও বাড়ির বৌ গর্ভবতী হয়েছে জানা গেলে তাকে ও তার গর্ভস্থ সন্তানকে অশুভ প্রভাব থেকে বাঁচাতে মোল্লা মৌলবির থেকে দোয়া-দরুদ পড়া কালো কার বা সুতো কোমরে বেঁধে দেওয়া হয়।এই সুততে অসংখ্য গিঁট দেওয়া থাকে। মৌলবি সাহেব দোয়া পড়ে পড়ে এই গিঁটগুলি দেন।প্রসব যন্ত্রণা শুরু হলেই এটি কোমর থেকে খুলে নেওয়া হয়। মুসলিমদের গর্ভবতী মাকে নতুন  শাড়ি-কাপড় পরিয়ে পায়েস অন্যান্য খাবার (গর্ভবতীর পছন্দের)সাজিয়ে খেতে বসানো হয়। প্রথমে গর্ভবতী মহিলার সঙ্গে খেতে বসানো হয় সুলক্ষণা পাঁচজন  মাকে। জনজাতিরাও হিন্দু ধর্মের মত গর্ভবতী মহিলাকে পাচমাসে দুধ,মাখন,খই,ঘি,চিনির মণ্ড তৈরি করে পঞ্চামৃত খাওয়ানো হয়।ন’মাসে  নতুন কাপড় পরিয়ে বিশেষ খাবার, যেমন গুড়পিঠা  ইত্যাদি খাওয়ানো হয়। আদিবাসীরা তিনমাসে হোমের আগুনে লাল হলুদ কাপড়ে জড়ানো পাকাকলা পুড়িয়ে গর্ভবতী মহিলাকে খাওয়ায় পুত্রসন্তান লাভ হবে এই বিশ্বাসে।
  সন্তান জন্মের পর মাটির বাসনপত্র ফেলে দাওয়া হয় বাকি জিনিস ধুয়ে ফেলতে হয়।মাটির ঘরের দেওয়াল,মেঝে মাটি ও গোবর দিয়ে লেপন করে শুদ্ধ করা হয়। এভাবে পাকাবাড়ির দেওয়ালে চুনকাম বা রং করা হয়। পাঁচদিনে লত্যা হয়।এইদিন নাপিত এসে মা ও শিশুর নখ কাটে, সেইসঙ্গে জ্ঞাতি ও পাড়ার পুরুষেরাও নাপিতের কাছে নখ ও চুল দাড়ি কাটে। মহিলাদের ডাকা হয় তেল-হলুদ মাখার জন্য।এইদিনেই সবকিছু ধুয়ে পরিস্কার করে মা ও শিশুকে স্নান করিয়ে নতুন বা কাচা জামাকাপড় পরানো হয়। স্থানীয় ভাষায় এ অনুষ্ঠানটিকে ‘ছুত কামানো’ বলে।এর পরের অনুষ্ঠান একুশদিনে ‘একুশে’।সেটাও ছুত কামানোর  অনুষ্ঠান।এটা বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।তবে অনেক পরিবারে এইদিন পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান।নিমন্ত্রিতরা শিশু ও মায়ের জন্য শাড়ি জামাকাপড় উপহার দেন।

এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মুসলিম হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত বলে এদের আচার নিয়মগুলিতে হিন্দু রীতিনীতির প্রভাব থেকেই গেছে।মুসলিমরাও হিন্দুদের মত এভাবেই লত্যা ও একুশে পালন করে।মুসলিম দের জন্মের পর শিশুর নাড়িকাটা হলেই মা ও শিশুকে গোসল(স্নান)করিয়ে দেওয়া হয়।হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে বাচ্চার জন্ম হলে যেদিন বাড়ি আসে সেদিন মা ও শিশুকে গোসল করিয়ে, তাদের ব্যবহার করা জামা-কাপড়সহ সমস্ত জিনিস কেচেধুয়ে তবেই ঘরে ঢোকানো হয়।  এছাড়াও মুসলিমরা আরও একটি নিয়ম পালন করে ,তা হল পাঁচদিনে না হলেও একুশের দিন শিশুর মাথার চুল কামিয়ে দেয়।মনে করা হয় তা না হলে পুরোপুরি ‘ছুত’ যায়না। মাতৃগর্ভের চুলকে অপবিত্র মানা হয়।ষষ্ঠ দিনে হিন্দুরা শিশুর মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীপুজো করে ওইদিন রাতে শিশুর মাথার পাশে কালির দোয়াত কাগজ  ইত্যাদি লেখার সরঞ্জাম রাখা হয়। বিশ্বাস ভাগ্যদেবতা এই দিন রাতে শিশুর ভাগ্য লিখে দিয়ে যাবেন। কয়েক দশক আগে ভাগ্যলিখনের ব্যপারটি মুস্লিমদেরও মানতে দেখা যেত। তারাও ওই রাতে শিশুর মাথার পাশে লেখার সরঞ্জাম রাখত। মেদিনীপুর জেলার অন্য অংশে কিন্তু মুসলিমদের রীতি নিয়ম আলাদা।সাধ খাওয়ানোর রেওয়াজ কেউ মানে, কেউ মানেনা। শিশুর জন্মের পর, পাঁচদিনে নয়, ছ’দিনে ‘ছোটটি’হয়। প্রতিবেশীদের চুলদাড়ি কাটা ও মহিলাদের ডেকে তেল-হলুদ মাখানোর রেওয়াজ নেই।বাকি সব নিয়ম একই।এরা শিশুটির জন্মের চারদিনের দিন চালভাজা ঢেঁকিতে কুটে গুড় দিয়ে মেখে বিতরন করে। এরা একুশে পালন করেনা।চল্লিশদিনে চল্লিশা করে। একুশের মতই নিয়মকানুন। চল্লিশা পালনের কারণ মেয়েদের একুশদিনে শরীর পবিত্র হয়না।অনেকে মায়ের তার পরেও প্রসবজনিত রক্তপাত হয়ে থাকে। এইদিন আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রন করা হয়।তবে সবার পক্ষে তা করা সম্ভব হয়না।খৃষ্টানদের মধ্যে অশৌচটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলেও মা ও শিশুর পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর রাখা হয়।

  শিশুর অন্নপ্রাশন বা মুখেভাত এর রীতি এখানকার সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই রয়েছে।এই অনুষ্ঠানটিকে এ অঞ্চলে ‘ভুজনা’ বা ‘ভোজনা’ বলা হয়। ‘ভোজন’ থেকে ‘ভোজনা’। হিন্দুরা বাড়িতে পুরুত ডেকে তাঁদের রীতি মেনেই শিশুর মুখে ভাত দেয়। এইসময় আনুষ্ঠানিকভাবে শিশুর নামকরণ হয়।যে যার সাধ্যমত শিশুকে নতুন জামাকাপড়, সোনা রুপোর গহনা দিয়ে থাকেন। অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিতরাও উপহার দেন।রুপোর বাটি-চামচ দিয়ে মামা প্রথম শিশুর মুখে ভাত,মানে পায়েস  (পরমান্ন)দেন। কেউবা কাঁসার কেউ ষ্টীলের বাটি চামচে খাওয়ান।অনেক পরিবারে অন্নপ্রাসনের সময় শিশুর প্রথম মাথা নেড়া করে।অনেকের বিভিন্ন মন্দিরে মানত থাকে।পূর্ব মেদিনীপুর জেলার অনেককেই বাচ্চার একটু বড় বয়সে ওড়িশার  চন্দনেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে মাথা নেড়া করে আসে।

  মুসলিমদের নামকরণের অনুষ্ঠানকে ‘আকিকা’ বলা হয়। শিশুকে অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা করার জন্য তার নামে গরু বা খাসি সদগা দেওয়া হয়।একটি গরুতে ৭ জনের আকিকা করা যায়। খাসি হলে ছেলেদের ক্ষেত্রে দুটি,মেয়েদের একটি সদগা দেওয়া হয় ।আকিকার নির্দিষ্ট কোনও বয়স নেই। নিজের আকিকা নিজেও  দেওয়া যায়। এই অনুষ্ঠানেও আত্মীয় স্বজনদের আমন্ত্রণ জানানো। যার আকিকা তাকে নতুন পোশাক পরিয়ে ‘ক্ষীর খাওয়ানোর অনুষ্ঠান করা হয়।
তবে যেসব মুসলিমরা শিশুর জন্মের পর লত্যা ও একুশে  পালন করে,তারা শিশুর মুখেভাত বা ভোজনা করে। ছেলেদের ৫ মাসে, মেয়েদের ৭ মাসে ভোজনা ্দেওয়া হয়।পায়েসের সঙ্গে নানারকম মিষ্টি গুড়ের পিঠে ফল দিয়ে বড় থালা বা খাঞ্চা সাজিয়ে শিশুকে ভাত খেতে বসানো হয়।পিরের দরগায় শিশুর নামে শিরনি চড়ানো হয়।শিশুকে নতুন পোশাক সোনা-রূপোর গয়না পরিয়ে খাবারের সামনে বসানো হয়।বাড়ির মুরুব্বি,দাদি-দাদা বা নানি-নানা শিশুর মুখে প্রথমে সিরনি তুলে দেন। এরপর অন্যরা মুখে খাবার ছুঁইয়ে টাকা বা অন্যকিছু উপহার দেন।আগে রূপোর টাকায় করে শিশুর মুখে ক্ষীর দেওয়া হত। এখন চামচে করে খাওয়ানো হয়।কেউ কেউ রুপোর চামচে খাওয়ান।  অবস্থাপন্ন পরিবারে নানা বা মামা সোনার হার দিয়ে থাকেন। মুখেভাতের পরেও অবস্থাপন্নরা ছেলেমেয়ের আকিকা করেন।

      আদিবাসীদের মধ্যেও অন্নপ্রাশনের চল রয়েছে।সে অনুষ্ঠান  নির্দিষ্ট সময় মেনে হয়না।শিশু ভাতখেতে শিখলেই বাবা মা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।এই উপলক্ষে আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা হয়। । কাঁসার থালায়  ভাত, চালগুঁড়ি, গোবর, বইখাতা, ধান, মাটির ঢেলা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়।মামা শিশুটিকে কোলে নিয়ে সেই থালার সামনে বসে। শিশু কোন জিনিসটি স্পর্শ করছে  তা থেকে শিশুর ভবিষ্যৎ জানা যাবে বলে ওরা মনে করে।  ভাত ছুঁলে পেটুক হবে, চালগুঁড়ি ছুঁলে পিঠে ভালবাসবে, বইখাতায় হাত দিলে বুদ্ধিমান হবে।ধান ছুঁলে গরে লক্ষ্মী আসবে। গোবর ছুঁলে অনেক গরু-ছাগল, চাষবাস হবে।মাটিতে হাত দিলে প্রচুর জমির মালিক হবে।

          মেদিনীপুর জেলায় বেশকিছু ক্ষত্রিয়দের  বাস রয়েছে। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের হিন্দু রীতি মেনে যেমন উপনয়ন হয় তেমন মুসলিম বালকদের খাতনা হয়।খাতনার আগের দিন আকিকার মত অনুষ্ঠান করা হয়, আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়। পরদিন সকালে হাজাম খতনা করে। অনেকে নিজের ছেলের সঙ্গে দরিদ্র প্রতিবেশীদের খাতনার খরচ বহন করেন ।ইদানীং অনেকে হাজামের পরিবর্তে  নার্সিংহোম নিয়ে গিয়ে ডাক্তারের কাছে লিঙ্গের চর্ম ছেদন করাচ্ছেন।
  জঙ্গলের ভিতরে ও জঙ্গলের  বাইরে যে সমস্ত আদিবাসীদের বাস তাদের মধ্যে রয়েছে  সাঁওতাল, লোধা, কোল, ভীল, মুণ্ডা,শবর ,মাহালি, ভূমিজ,বিরহড়, রাভা,গরেত  ইত্যাদি। কৃষিনির্ভর,শহর ঘেঁষা ও বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলিতে ও শহরাঞ্চলে উচ্চবর্ণের হিন্দু, ব্রাহ্মণ, মুসলিম ও খৃষ্টানদের পাশাপাশি মাহাতো,কুমার,হাড়ি, ডোম,বাগদী,বাউরিরাও বাস করে।তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখানে মিশ্র সংস্কৃতি দেখা যায়।

    জঙ্গল সংলগ্ন আদিবাসীরা আদি অনন্তকাল ধরে নিজেদের লোকাচার,নিজেদের সংস্কৃতিকে আজও আনন্দের সঙ্গে প্রবাহিত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।একটা সময় পর্যন্ত আধুনিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার কারণ  খোঁজার চেষ্টা না করে গাছ-পাথর,ভূত-প্রেত ইত্যাদির পুজো করে বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করত, এখনো করে। সাঁওতালদের প্রধান উৎসবগুলি হল সহরায়, ডাঁসায়, বাহা ও কারাম। সহরায় কে চলতি কথায় ‘বান্ধনা পরব বলে।বান্ধনা সাঁওতালদের সব থেকে বড় উৎসব।৫ দিন ধরে  এই উৎসব চলে।এটি সাধারণত কালীপুজোর সময় হয়। অনেক স্থানে আবার পূর্ণিমার দিনও হয়ে থাকে। এই পরবে মেয়ে-জামাইকে  ডাকতে কতে হয়। প্রথমদিন গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল, ডাল, চিঁড়া, দুধ, ঘি, চিনি ইত্যাদি সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট জায়গায় গ্রামের পুরুষরা জড় হয়ে পুজো করে। এই পুজোকে ‘গট’ পুজো বলে। পুজোয় মহিলারা যোগ দিতে পারেনা।পুজো হয়ে গেলে  গ্রামের রাখাল বাগালরা ওই স্থানের উপর দিয়ে তাদের গরু-ছাগলের পাল  পার করে যার গরু প্রথম ওই জায়গায় পা রাখবে,তার মালিককে পরের বছর পুজোয়  একহাঁড়ি ভাত দিতে হয়।এইসব রীতি পালন শেষ হলে প্রসাদ খেয়ে সবায় বাড়ি যায়।সন্ধ্যেবেলে গোয়ালে প্রদীপ  জ্বেলে ওরা নাচগান করে। পরদিন যে যার বাড়িতে পুজো হয়।মাছ-মাংস ইত্যাদি রান্না খাওয়া,নাচ গান হয়।

তৃতীয় দিন গরু বাছুরের গা ধুইয়ে তদের গায়ে চালবাটা গোলা দিয়ে তাদের গায়ে বিভিন্ন রকম আলপনা আঁকে।বাইরের দরজা থেকে গোয়াল ঘরের দরজা  পর্যন্ত আলপনা দিয়ে তার অপর ঘাস ছড়িয়ে রাখা হয়।গরু ওই ঘাস খেতে খেতে গোয়ালে ঢোকে। এরপর উঠোনে খুঁটি পুঁতে তাতে গরুকে বেঁধে দুই শিংএ চামড়ার বাদ্য লাগিয়ে  বাজানো হয়। এভাবে গরুকে নাচানোর চেষ্টা হয়।

সাঁওতালদের এটি একটি খুবই প্রাচীন উৎসব হল ‘ডাঁসায়’। ওদের এই অনুষ্ঠান  আরম্ভ হয় দুর্গা পুজোর ষষ্টির দিন থেকে দশমী পর্যন্ত। এই ৫ দিন ধরে সাঁওতাল নারী-পুরুষ সেজেগুজে দল বেঁধে ধামসা-মাদল নিয়ে পুজো মণ্ডপে ও গৃহস্থের আঙিনায় নেচে বেড়ায়।বকশিসও পায়। এইদিন আনন্দের উপকরন হল হাঁড়িয়া, মাংস, তারসঙ্গে নাচগান। চতুর্থ দিনেও নাচগান খাওয়া দাওয়া হয়। পঞ্চমদিনে উৎসব শেষ। এইদিনের উৎসব সবচেয়ে বড় বলে ওরা হাতির সঙ্গে তুলনা করে  গান গায়- তিহিন নিন্দই  আমাবুসই/প্রাপা নিদই পুরনিমা/হাতি লেকান সরহায় দইনা/সেটের কান।
এই ‘ডাঁসায়’ উৎসব উৎস নিয়ে মতভেদ রয়েছে।অনেকের মতে বাংলার আশ্বিন মাসকে সাঁওতালি ভাষায় দাঁসায় বগা বলা হয়। দাঁসায় নাচ থেকে এই মাসের নাম হয়েছে। আর ,প্রাচীন যুগে আয়ন ও কাজল নামে দুই গুণবতী সাঁওতাল  যুবতীকে  কারা যেন অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাদের খুঁজতে বেরিয়ে দুই সাহসী যুবক  আশ্বিনের ভরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে স্রোতে হারিয়ে যায়।তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন সাওতাল যুবকেরা শাড়ি ব্লাউজ পরে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম গান গেয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি বাড়ি খুঁজতে থাকে। তা থেকেই এই প্রথা উৎসবের আকার নিয়েছে। দাঁসা শব্দের অর্থ খোঁজ আর আয় মানে নারী ।দুয়ে মিলে দাঁসায়।

  ফাল্গুন মাসে, মানে বসন্তকালে সাঁওতালদের ‘বাহা পুজো’ হয়। এটিও ওদের খুব বড় উৎসব। এইসময় শীতের পাতা ঝরা গাছে নতুন পাতা গজায়,বনে বনে নানারকম ফুল ফোটে। বাহাপুজোর মধ্য দিয়ে বসন্ত কালের প্রকৃতিকে সাঁওতালরা বরণ করে। এই পুজো না হওয়া পর্যন্ত এরা নতুন পাতায় খাবেনা,বনের মধু খাবেনা,মেয়েরা খোঁপায় ফুল গুঁজবেনা। এই সময় মেয়ে জামাইকে ডেকে ভালোমন্দ খাইয়ে,নতুন জামাকাপড় দিয়ে বিদায় করা হয়।তিনদিন ধরে এই উতসব চলে। প্রথম দিনে আদিবাসী যুবক বা ছেলেরা তাদের সব ঠাকুরথানে গিয়ে একটি ছাউনি তৈরি করে।সারা গ্রাম পরিস্কার করে ঘরে ফেরে।রাতে এরা এদের বামুন ঠাকুরের বাড়ি যায়। সেখানে পুজা এবং নাচগান হয়।এই দিনটিকে ‘উম’ বলা হয়।পরের দিনটিকে বলা হয় ‘সারাদি মাহা’।আইদিনে ওরা সারিদিয়ে নাচগান করতে করতে বামুনকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরথানে যায়।গ্রামের মোড়ল প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে  ধূপ, ঘি,চাল ইত্যাদি পুজার সামগ্রী চেয়ে নিয়ে আসে। জঙ্গল থেকে শাল-মহুয়ার ফুল ভেঙ্গে আনা হয়। এরপর পুজা হয়।ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে ‘বাহানাচ’ করে।এভাবেই সারাদিন কাটায়। বিকেলবেলা একইভাবে নাচতে নাচতে গ্রাম ঘুরে বামুনকে বাড়ি পৌঁছে গদিতে যায়। গ্রামের প্রত্যেক বাড়ির মেয়েরা ঘটিতে করে জল আর তেল নিয়ে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।বামুন দরজায় এলে মেয়েরা তার পাধুইয়ে তেল মাখিয়ে দেই। বামুন তাদের প্রত্যেকের হাতে শালফুল তুলে দেন। পরদিন,মানে তৃতীয় দিনটি এদের বিজয়া। এই দিনটিকে বলে ‘জালে মাহা’।বিজয়া বা জালে মাহার দিন ছেলে মেয়েরা একে অপরের মাথায় জল ঢালে আর দিনভর নাচগান করে উৎসবকে বিদায় জানায়।

  মুণ্ডা শব্দের অর্থ মাথা,সমাজের মাথা বা মোড়ল।সাঁওতালদের থেকে রীতি নিয়ম কিছুটা আলাদা। একটা সময় পর্যন্ত এদের পুরুষরা একধরণের মোটা খাটো কাপড় পরত। মহিলারা একটুকরো কাপড় কোমরে পরত,আর একটুকরো শরীরের ওপরের অংশে জড়াত। এখন বাজারে যে সব পোশাক পাওয়া যায় –সাড়ি ধুতি,জামা,প্যান্ট এসব পোশাকই পরে। মহিলারা নানারকম গহনা পরে এবং কপালে,হাতে উল্কি আঁকে। একটা সময় পর্যন্ত ছেলেরা জ্বলন্ত ন্যাকড়া দিয়ে বাম হাতের কবজিতে গোল করে পোড়া দাগ করত। এখনো কেউ কেউ করে।একে বলা হয় ‘শিখী’।এটি শুধু  অঙ্গের শোভাবর্ধনের জন্যই নয়, ওরা মনে করে মৃত্যুর পর শুধু এই উল্কিই সঙ্গে  যাবে। এই না থাকলে যমালয়ে শাস্তি পেতে হবে।এদের আর একটি রীতি কানফুটো করা। এটা বিয়ের আগে পর্যন্ত যে কোনো বয়সে করা যায়। মকর সংক্রান্তির দিন এরা কানফুটো করার অনুষ্ঠান করে। কানফুটো না করলে তাকে মুণ্ডা হিসেবে মানা হবেনা।সে বিয়ে করতে পারবেনা, কোনো সামাজিক অনুস্থানও অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। এদের মধ্যে বিধবা বিবাহের ও বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে, কিন্তু প্রেমজ বিয়ে নিষিদ্ধ।সিন্দুর দান ও মালাবদল করেই বিবাহ হয়। সন্তান জন্মালে এরা  উলুদ্ধনি দিয়ে নবজাতক জাতিকাকে স্বাগত জানায়।পাঁচ বা তিনদিন অশৌচ পালন করা হয়।ক্ষৌরকর্ম করে,মা ও শিশুকে স্নান করিয়ে অশৌচ কাটানো হয়। মাহালীদেরও এইভাবে অশৌচ পালন করা হয়।

  এইদিন পাড়া-প্রতিবেশীদের হাঁড়িয়া খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানানো হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে ওরা ‘ছাটিয়ারী’ বলে।মকর সংক্রান্তি ওদের প্রিয় উৎসব। ওদের  দেবতার নাম ‘মিওঁ বঙ্গা’।এই দেবতাকে খুশি করার জন্য মাহালীরা ছাগল ,মুরগি বলি দেয়।দেবতার থানে মাটির ঘোড়ায় সিন্দুর লাগিয়ে সাজায় এবং লম্বা বাঁশের আগায় লাল কাপড় বেঁধে ওখানে পুতে রাখে। ভূমিজরা মুণ্ডাদেরই একটি শাখা।এদের বিয়েতেও কন্যাপণ প্রথা আছে।পুরুত মন্ত্রপড়ে বিয়েদেন।মালাবদল, সিন্দুরদানও হয়।বিয়েতে একটি অদ্ভুত প্রথা রয়েছে। বিয়ের একসপ্তাহ পর বরবউ স্নান করে।তারপর বর আদিক সেদিক তির নিক্ষেপ করে। বৌকে সেই তিরগুলি খুঁজে নিয়ে আসতে হয়। লোধারা হল জঙ্গলের প্রাচীন  শিকারি জাতি। এরাও শিশু জন্মালে একুশদিন অশৌচ পালন করে।বাল্যবিবাহ ও পুনঃবিবাহের প্রচলন রয়েছে।এদের নিজেদের ভিন্ন কোনো দেবতা নেই।লোধারা আদিবাসীদের সব উৎসবই পালন করে।‘বড়ামপুজো’ এরা খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করে।ঝাড়গ্রাম ( সম্প্রতি মেদিনীপুর জেলা ভেঙ্গে ঝাড়গ্রাম থানা থেকে জেলা হয়েছে )জেলায় ‘গুপ্তমণি’ দেবী এদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।যে কারণে  দেবীর নামেই গ্রামটির নামও গুপ্তমণি।

  খেড়িয়ারা হল কোল জাতির অন্তর্ভুক্ত। এদের বিয়ের রীতিটি কিছুটা অন্যরকম।ছেলের বাড়ি থেকে মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। মেয়েপক্ষ কন্যাপণ হিসেবে এক থেকে দশটি পর্যন্ত গরু দাবি করতে পারে।কন্যাপক্ষ তাদের চাহিদামত গরু পেলে তবেই বিয়েতে রাজি হয়।আগের দিন মেয়ের বাড়ির লোকজন মেয়েকে নিয়ে বরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।কিন্তু বরের বাড়ি পর্যন্ত যায় না। কাছাকাছি কোনো গাছের তলায় অপেক্ষা করে।বরের বাড়ির লোকজন এসে ওখানে মিলিত হয়ে ঘট বিনিময় করে।সারাদিন ওখানে নাচগান খাওয়া দাওয়া হয়।পরদিন ভোরে সূর্য ওঠার আগে বিয়ের বর কনেকে তেল মাখিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর মাটিতে খড় বিছিয়ে তার ওপর একটি জোয়াল রাখা হয়।জোয়ালের ওপর  বরকনে একে অপরের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়, বর কনেকে সিন্দুর পরিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করে।

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার জঙ্গলমহল আলাকায় আদিবাসী সম্প্রদায় ছাড়াও হিন্দু মুসলিম ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।তাই স্থানীয় উৎসব গুলিতে নানান বইচিত্র দেখা যায়।বিশেষ করে গ্রামীণ উৎসব গুলিতে। যেমন ১লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। এই উতসব শহর গ্রাম সর্বত্র পালিত হয়।সংস্কৃতি মনস্ক বাঙালিরা মেতে ওঠেন নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নতুন জামাকাপড় ও বিশেষ খাওয়াদাওয়া নিয়ে।

  গ্রামাঞ্চলে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকেই তুলসী তলায় বসনঝারা দেওয়া  হয়।নতুন ছোট্ট মাটির ভাঁড় ফুটো করে সেটা দড়ি দিয়ে বট, অসত্থ,বেল, তুলসী ইত্যাদি গাছের গড়া থেকে একটু অপরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ভাঁড়ের মধ্যে দূর্বাঘাস দিয়ে জল ভরে দেওয়া হয়।সারাদিন ধরে ভাঁড় থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে গাছের গড়ায় জল পড়তে থাকে।এই লোকাচারটিও বর্তমানে লুপ্ত প্রায়।

  নববর্ষের দিন সকালবেলা শুকনো পাতা জড় করে আগুন ধরানো হয়।সেই আগুনে আঁশবটি গরম করে গৃহপালিত পশুর পায়ে ছ্যাকা দেবার নিয়ম আছে।এদের পায়ে যে পোকা হয়,তা মারা যায়। এছাড়াও এইসময় বাঁশগাছের গড়ায় মাটি দেওয়া হয়,যাতে বর্ষায় বাঁশের নতুন ফোঁড় ওঠে।এইসময় নতুন জামাইকে বাড়িতে ডেকে যবের ছাতু-মুড়ি খাওয়ানো হয়,তারপর গামছা-ধুতি দিয়ে বিদায় করা হয়। এভাবেই বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক পরম্পরাকে গ্রামের মানুষ বহন করে চলেছে।

  ভাদ্রমাসে হয় ভাদুপুজো।ভাদু শস্যের দেবী।এই উৎসব মূলত বাগদিদের। মেদিনীপুর জেলার শিলদা, বেলপাহাড়ি ও ঝাড়গ্রাম এলাকার বাগদিরা ভাদ্রমাসে ভাদুপুজো করে থাকে।এটিকে ওদের  নাচগানের উৎসবও বলা যায়। এই শস্যের দেবী ভাদুর একহাতে মিষ্টি থাকে,আর একহাতে থাকে ধানের শীষ। ১লা ভাদ্র থেকে এই উৎসব শুরু হয়, শেষ হয় সংক্রান্তির দিন। আখন এই উৎসব সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। এই মাসে ইন্দপুজোও হয়ে থাকে। ভাদ্র মাসের শুক্লা তিথির দ্বাদশীর দিন এই পুজো হয়। তিনটি শালগাছ কেটে নিয়ে এসে তাতে কাপড় জড়ানো হয়। তারপর গাছগুলি পুতে তার তলায় বেদী তৈরি করা হয়।বেদীর ওপর একটি ঘট রাখা হয়।সবথেকে বড় গাছটির ডগা থেকে একটি ঝুড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়।ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো করে।যজ্ঞও হয়,সেইসঙ্গে কিছু লোকাচারও পালন করা হয়।

সমগ্র মেদিনীপুর জেলা জুড়ে আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন ‘নলসংক্রান্তি’ পালিত হয়।এই অনুষ্ঠানটি হল,শস্যের দেবী লক্ষ্মীকে সাধভক্ষণ করানোর।এর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নাম। কোথাও ‘ডাকসংক্রান্তি’, কোথাও ‘সারধরা্’,কোথাও আবার ‘ডাক শাঁকরাত’ বলা হয়। এইসময় ধানের শিষে দুধ গমে দানা বাঁধতে শুরু করে ।তাই নলসংক্রান্তিতে ক্ষেতে গিয়ে লক্ষ্মীকে,মানে ধানগাছকে নানারকম খাবার দিয়ে ‘সাধভক্ষণ’ করানো হয়।হিন্দু,মুসলিম,তপসিলি জাতি ,উপজাতি কৃষক পরিবারে এই রীতি পালন করা হয়। বড় সাইজের নলপাতা ভেঙ্গে নিয়ে এসে তারমধ্যে কালমেঘ, ঘেঁটুপাতা, চিংড়িমাছ, কাঁচাহলুদ, আদা, শালুকফুল, বেলপাতা, সিন্দুর ইত্যাদি পাট দিয়ে বেঁধে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায়,যেমন-তুলশীতলায়,ঘরের চালে, পুকুর ইত্যাদিতে  পোঁতার  পর ধানজমিতে পুঁতে আসে।পোঁতার সময় নানারকম গান গাওয়া হয়, এতে আছে হলদি/ধান ফলবে জলদি/এতে আছে সুক্তো/ধান ফলবে মুকতো /এতে আছে ঝোটপাট / সব পোকার মাথা কাট, ইত্যাদি। এভাবে মুসলিম কৃষকরাও নল সঙ্ক্রান্তি পালন করে। এইদিন বাড়িতে আরও একটি প্রথা পালন করা হয়। একটি ঝুড়িতে নটেশাক,পুঁইডগা, কালমেঘ,চালকুমড়োর ডাঁটা, কাঁচা হলুদ, তালেরকুর আর ন্যাকড়ায় বাঁধা আতপচাল রাখা হয়। তারপর ঝুড়িটি পুকুরের জলে চুবিয়ে তোলার সময় যে জল ঝরে পড়ে তা একটি পাত্রে ধরে সেই জল দিয়ে আতপচাল আর তালকুর সরিয়ে রেখে বাকি উপকরণগুলি শিলে বেটে তালকুর আর আতপচালের সঙ্গে বাড়ির সবাইকে খেতে দেওয়া হয়। একে বলা হয় ‘আলুই’ খাওয়া।এইদিন  ন’রকম শাক খাওয়ারও নিয়ম রয়েছে।

    মেদিনীপুরের জঙ্গল এলাকায় যেহেতু আদিবাসী সম্প্রদায় ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে,তাই বিভিন্ন  উতৎবেও নানান  বৈচিত্র  দেখা যায়। গ্রামীণ উৎসবেই বইচিত্রতা বেশি। বলা যায় এরা এভাবেই এভাবেই বাংলার, তথা সমগ্র দেশের আদি সংস্কৃতির ধারাকে অব্যাহত রেখেছে।

            শিলদা,বিনপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁশপাহাড়ি ইত্যাদি এলাকায় গরামপুজো হয়। পুজো হয় গাছের তলায় পাথর কিম্বা মাটীর ঢিবির পুজোরথানে মাটির ছোট ছোট  হাতি, ঘোড়া রেখে পুজো হয়। গাছকেও প্রতীকী দেবতা হিসেবে মানা হয়।দেবতের কপালে তেল-সিন্দুর লাগানো হয়। এই পুজোতে পাঁঠা, মোরগ, পায়রা বলি দেওয়া হয়।

উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও যেসব উৎসব বা পরব দেখা যায় তার মধ্যে  মেদিনীপুর জেলার একটি অঞ্চলিক উৎসব হল বাঁধনা পরব। এই উৎসব প্রধানত ঝাড়গ্রামের শালপাতড়া জামবনি, বালিবাঁধ,লালবাঁধ, মুড়াকাটা, শীরষা, তুলশীবনী ইত্যাদি গ্রামের কুরমী,মাহাতরা পালন করে। এটি গো-সেবার উৎসব। তাই সুন্দর করে গোয়ালঘর পরিষ্কার করে গরুর গা ধোয়ানো হয়। গোধূলির সময় গোয়ালে প্রদীপ জ্বেলে গরুদের গোয়ালে তোলা হয়। তারপর গরুর শিংএ তেল মাখিয়ে তাকে জাগিয়ে রাখার জন্য বারে বারে খেতে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও সারারাত ধামসা বাজিয়ে ‘জাগানিয়া’ গান গাওয়া হয়।

      সুবর্ণরেখার তীরবর্তী গোপীবল্লভপুরের আনেকখানি অঞ্চলের মানুষ  ‘পইড়ান’ নামে আর একটি উৎসব পালন করে। এই অনুষ্ঠানটি কালীপুজোর সময় হয়। শনের আঁটি(একধরণের পাট) ও সিজ গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে, আতপ চাল, সিঁদুর দিয়ে পুজো করা হয়।দুপুরের সময় একদল জোয়ান সেই শন আঁটি  টান দিয়ে মাটি থেকে তোলে। বর্তমানে এই উৎসব বা প্রথা বিলুপ্তির পথে।

      কালীপুজোর পর রাস উৎসব। রাস উতসবের পরেই পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় পৌড়া অষ্টমী বা পড়ুয়া অষ্টমী পালন করা হয়।পড়ুয়া অষ্টমী সুবর্ণরেখা অববাহিকার দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত বাংলার অন্যতম সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব। রাসযাত্রার ঠিক পরের কৃষ্ণা অষ্টমীতে এই লৌকিক উৎসবটি পালিত হয়। বাবা মায়ের প্রথম সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই উৎসব পালন করা হয়।এই উৎসবে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয় না। এই উৎসবের নিয়ম হল,মামাবাড়ি নতুন জামাকাপড়, ধানদূর্বা,ফুল-চন্দন, মিষ্টি নিয়ে আসে। নিজেদের বাড়িতেও জামাকাপড় কেনা হয়। উঠোনে তুলসী তলায় সন্তানের মঙ্গল কামনায় মা কলা পাতার ওপর বিউলির ডালের বড়ি দেন। যার অষ্টমী হয় সে কাঁচা হলুদ বাটা ও আবাটা মেখে স্নান করে নতুন জামাকাপড়  ঘুনসী পরে।তারপর মা এবং বাড়ির বড়রা কপালে চন্দনের তিলক,মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করেন।মাথায় গাঁদাফুল গুঁজে দেওয়া হয়। এই নিয়ম চলা কালে  শাঁখ বাজানো হয়। বাড়ির বৌ যদি কেউ পৌঁড়া থাকে,তারও পৌঁড়া অষ্টমী পালন করা হয়। মামাবাড়ি থেকে জামাকাপড় আসতেই হবে, তা কিন্তু নয়। বিবাহিতা ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে,বিবাহিতা মেয়ের বাপেরবাড়ি থেকে আসে। এছাড়া নিজেদের বাড়িতে তো নতুন জামাকাপড় হয়ই।এইদিন আমিষ নিরামিষ বিভিন্ন রকম পদ রান্না হয়।

  এই সমস্ত উৎসবগুলির মধ্যে টুসু  সবচেয়ে বেশি প্রচলিত উৎসব এই সময় কৃষকের খামার-হামারে নতুন ধান ওঠে। টুসুকেও শস্যের দেবী বলা হয়।গ্রামের মানুষ একে ‘মকর পরব’ও বলে থাকে।আতপচাল,  নারকেল,গুড়,কলা,শাঁকআলু, রাঙ্গাআলু ইত্যাদি দিয়ে প্রতিটি কৃষক পরিবারে প্রসাদ তৈরি করা হয়। সব কৃষক (হিন্দু) পরিবারের খামারেই টুসু পুজো হয়। জঙ্গল এলাকায় খামারকে ‘খোলান’ বলে। তাই টুসুপুজোকে ‘খোলাপুজোও বলা হয়। সংক্রান্তির কয়েকদিন আগে থেকে মহিলারা ঘরদোর, উঠোন, খামার ন্যাতা দিতে শুরু করে। এর ওপর আলপনা দেওয়া হয়। এরপর খামারে ধামা,কুলো,কাঠা (ধান বা চাল মাপার ছোট বেতের কটোরা)ইত্যাদি একটার ওপর আর একটা সাজিয়ে রাখা হয়।একআঁটি ধান ও আড়াই মুঠি মাটি নিয়ে এসে ওখানে রেখে পুজো করা হয়। মাটিসহ ধানের আঁটিটিকে বলা হয় ‘শুক্র ব্রিড়া’।এই জেলার সুবর্ণরেখা নদী তীরের গ্রামগুলিতে তিনদিন ধরে মকর উৎসব পালিত হয়। সংক্রান্তির দুদিন আগের দিনটিকে ওরা ‘চাউড়ি’ ও তার পরের দিনটিকে ‘বাউড়ি’ বলে।বাউড়ির দিন রাতে বাড়ির মহিলারা গান গেয়ে গেয়ে পিঠে বানায়। ছেলেরা নদীর পাড়ে ‘মকর কুড়ে’ বানিয়ে সেখানে রাত কাটায় । পরদিন ভোরে ওই কুড়েতে আগুন দিয়ে নদীতে মকর ডুব দেয়। তারপর নতুন জামাকাপড় পরে মকরের প্রসাদ খায়।

      আদিবাসী মহিলারা টুসু নিয়ে গৃহস্থের আঙিনায় গান করে চাল পয়সা আদায় করে। তারপর নদীতে টুসু ভাসিয়ে মকর ডুব দেয়। এই দিনটিকে ‘মকর সংক্রান্তিও বলে। গ্রামের হিন্দু পরিবারের মহিলারাও সারারাত ধরে গান গেয়ে নারকেল ও সবজির পুর দিয়ে পুর পিঠে বা পুলিপিঠে বানায়। সকালে দল বেঁধে টুসু গান গাইতে গাইতে নদীর পাড়ে যায়। তারপর  টুসু ভাসিয়ে মকরস্নান করে নতুন জামাকাপড় পরে বাড়ি ফিরে যায়। অনেকে সোলা ও রঙ্গিন কাগজ দিয়ে রথের  মত টুসুর বাড়ি বানায়। আবার অনেকে মাটির সরাতে পুজোর উপকরণ সাজিয়ে,প্রদীপ জ্বেলে নদীতে ভাসায়। এইদিন সমগ্র জেলা জুড়েই মেলা বসে। কোথাও একদিনের মেলা কোথাও বা বেশ কয়েকদিন ধরে মেলা হয়। মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন কাঁসাই নদীর পাড়ে মস্ত মেলা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। টুসু গানগুলিও বেশ মজার।‘আমাদের টুসু মুড়িভাজে চুড়ি ঝলমল করে ল/ তোদের টুসু আঁচল পেতে মাগে লো।

  পৌষসংক্রান্তির পর ফাল্গুন মাসের সঙ্ক্রান্তিকে এই অঞ্চলে ঘেঁটু সংক্রান্তি বলা হয়। এইদিন ‘ঘেঁটুপুজো’ বা ‘ঘণ্টাকর্ণ পুজো’ হয়। ঘণ্টাকর্ণ হল শিবের অনুচর, খোস-পাঁচড়া রোগের দেবতা। মেদিনীপুর জেলার বাইরে এই পুজোর কথা তেমন একটা শোনা যায় না। এই পুজোর বিশেষ উপকরণ হল ভাঁটফুল।ভাঁটফুলের শুদ্ধ নাম ‘ঘণ্টাকর্ণ ফুল’।আবার ঘেঁটুফুলও বলা হয়। ছোট ছোট ছেলেরা জলচৌকিকে পালকি বানিয়ে তারমধ্যে ঠাকুরের পট, পুতুল, পিচকারি, ঘেঁটুফুল দিয়ে সাজিয়ে সন্ধ্যাবেলা হ্যারিকেন বা লন্ঠন জ্বেলে নিয়ে ওই পালকি কাঁধে ঘেঁটুগান গাইতে গাইতে বাড়ি বাড়ি ঘেঁটু, মানে চাল, ডাল, তেল, সবজি চাইতে বের হয় এইসব দিয়ে পরদিন বনভোজন হয়। ঘেঁটুর গানগুলিও বেশ – ঘেঁটু যায় গেরস্থ বাড়ি/ চাল দাও গো তাড়াতাড়ি। যে দেবে থালা থালা/তার হবে সোনার বালা ইত্যাদি।তবে বর্তমানে এইসব আঞ্চলিক উৎসবগুলি হারিয়েই গেছে বলা যায়।
  চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রাম বাংলার গাজন একটি বিশেষ উৎসব।  গাজনের অর্থ গাঁ  জন। মানে গ্রামের মানুষজন।চড়ক গাজন হিন্দুদের বিশ্বাস মতে শিব পার্বতীর বিয়ের দিন।  অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য শিবের মন্দির।কুমারপুরের হটেশ্বর, পাঁচরোলের মুক্তেশ্বর, বনমালী কালুয়ার রুদ্রেশ্বর, কেশপুরের ঝাড়েশ্বর, মাড়তলার সত্যেশ্বর, কিশোরচকের আনন্দেশ্বর, পিংলাবনীর জলেশ্বর, জলচকের তিলেশ্বর, মোগলমারির চন্দনেশ্বর ইত্যাদি কয়েকশ মন্দির রয়েছে।

  শিবের মূল উপাসক যারা তাদের  বলা হয় ভক্তা বা শিবের অনুচর। এরা হল অনার্য। এই শিবের বিয়ে উপলক্ষে নানারকম কসরত দেখিয়ে আনন্দ করে।সেই কসরতগুলি খুবই ভয়ঙ্কর এবং কষ্টদায়ক, নাম সুনলেই তা বোঝা যায়।যেমন- পিঠফোঁড়, চাটুফোঁড়, বাণফোঁড়, রজনীফোঁড়,রজ্জুফোঁড়, বঁটিঝাঁপ, কাঁটাঝাঁপ, ভুঁইশাপটা, মানিকচুরি, বেতচালা, মাথাচালা,আগুনে হাঁটা ইত্যাদি আরও অনেক ধরনের কসরত দেখায়। একসময় জেলার হটেশ্বরের গাজনে সবচেয়ে উঁচু চড়কে পিঠ ফুঁড়ে চড়কে ঘুরতে দেখা যেত।

  কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ বইটিতে চড়কের বর্ণনা রয়েছে।ফ্যানি পার্কস, এলিজা ফে ও বাংলার এই চড়ক সম্বন্ধে লিখে গেছে।স্মিথের লেখা উইলিয়াম কেরির জীবনীতেও চড়কের এই সমস্থ ভয়াবহ কসরতের কথা রয়েছে। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণও চড়কের বিষয়ে লিখেছেন। অনেকের মতে  ‘গাজন’ শব্দের উতপত্তি শিবের বিয়েতে ঢাক-ঢোল ও শিঙার গর্জন থেকে।যে চড়ক গাছে পিঠ ফুঁড়ে ঘোরা হয়, তাকে বলা হয়  ‘গজারি’। শিবের অপর নাম গজারি।‘চড়ক’ শব্দটি এসেছে ‘চক্র’ থেকে।গজারির মাথায় যে চক্রাকারে ঘোরা হয়,তাকেই চড়ক।
      এই জেলা জুড়ে এরকম আরও অনেক  উৎসব ও লোকাচার জঙ্গলের আনাচে কানাচে লুকিয়ে রয়েছে যা এই মুহূর্তে জানা সম্ভব হলনা।
                                  
                                 
ঋণ স্বীকার- ভাস্করব্রত পতি, ড.সুশান্ত দে
        ড.মধুপ দে, ড.জয়দেব মণ্ডল
        মানস কুমার রানামৃত্যুঞ্জয় দে
        ড.শান্তনু পণ্ডা

আরও পড়ুন 


Post a Comment

0 Comments