জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- এশিয়া (জাপান)/জিভ কাটা চড়ুই চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- এশিয়া (জাপান)
চিন্ময় দাশ


জিভ কাটা চড়ুই 

কতকালের পুরনো ছোট্ট একটা গ্রাম। সেখানে কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকে এক বুড়ো আর বুড়ি। 
একদিন সবে তখন ভোর হয়েছে। কপাট খুলে বেরুতে যাবে, বুড়ির চোখ আটকে গেল পায়ের কাছে। চৌকাঠে পরে আছে একটা চড়ুই পাখি। জবুথবু হয়ে বসে থরথর করে কাঁপছে পাখিটা।

আহারে, বেচারা! খুব কষ্ট হয়েছে তো এই শীতে। মন গলে গেল বুড়ির। আলতো করে তুলে নিল পাখিটাকে। তখন বুড়োও উঠেছে বিছানা ছেড়ে। সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটল গোয়ালে। দুধ দুয়ে আনল খানিকটা. দুধ গরম করে, ভারী যত্ন করে পাখিকে খাওয়াল দুজনে।
বুড়ো বলল-- এবার আমার হাতে দাও ওকে। একটু রোদ খাওয়ানো দরকার। দেখছো না, ডানাগুলো কেমন ভিজে গেছে শিশিরে!

রোদ্দুরে গিয়ে দাঁড়াল বুড়ো। ছোট্ট পাখিটা তার হাতের তেলোয়। যতক্ষণ না পাখির ডানা শুকলো, ঠায় দাঁড়িয়ে রইল মানুষটা। একটুও নড়ল না। ডানা দুটো শুকোল যখন, হাত আলগা করে, বলল-- যাও বাছা, ঘরে ফিরে যাও। এবার নিশ্চয় উড়তে পারবে তুমি। 

পাখিটাকে উড়িয়ে দিল বুড়ো। বুড়োর হাত থেকে উড়ে গেল বটে, চলে কিন্তু গেল না পাখিটা। সামনে ছিল ছোট্ট একটা সবজি বাগান। সেখানে একটা ঢেঁড়শ গাছে বসে, শিস দিতে লাগল। যেন আনন্দে আর কৃতজ্ঞতায় গান শোনাচ্ছে বুড়ো বুড়িকে। চড়ুইয়ের কান্ড দেখে ভারী আনন্দ হল দুজনের।

পরদিন। তখনও ভোর হয়নি ভালো করে। সবে গোলাপী আভা ধরেছে পাহাড়গুলোর মাথায়। সূয্যিঠাকুর আসছেন, তারই ঘোষণা এই রঙ। পাখিটা এসে বসল সেই ঢেঁড়শ গাছটায়। শিস দিয়ে গান গাইতে লাগল দুলে দুলে।

গান শুনে ঘুম কেটে গেল বুড়ো বুড়ির। কপাট খুলে বাগানে দেখতে পেল পাখিটাকে। মন ভরে গেল দুজনের। খুশিও হল খুব। ভালোই হয়েছে। দেরি হয়নি বিছানা ছাড়তে। কাজে যেতে পারবে তাড়াতাড়ি। মালিকের মুখ শুনতে হবে না আজ।

সেদিন থেকে নিত্যদিনই এসে যায় পাখিটা। ভোরের গান শুনিয়ে ঘুম ভাঙ্গায় দুজনের। পাখিটা গান গায়। ঘুম ভেঙে যায় দুজনের। কাজে যেতে পারে তাড়াতাড়ি। দারুণ ভাব হয়ে গেল তিন জনের।

কিন্তু সবাই তো আর সমান নয়। মন্দ লোকেরও অভাব নাই দেশে। পাখির গান ভালো লাগে না, ভোরবেলাতেই উঠতে চায় না-- এমন লোকও আছে দেশে।
বুড়োবুড়ির উল্টো দিকে থাকত এক বুড়ি। যেমন হিংসুটে, তেমনি বদমেজাজী। ভোরবেলায় এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিচ্ছে পুঁচকে একটা পাখি! ভারী মেজাজ গরম হয়ে গেল বুড়িটার। ভাবল-- দাঁড়া, হতচ্ছাড়া। মজা দেখাচ্ছি তোকে। গান গাইবার সাধ মিটিয়ে দিচ্ছি জন্মের মত।

পরদিন ভোর না হতেই, হিংসুটে বুড়িটা এসে, লুকিয়ে বসে রইল বেড়ার আড়ালে। যেই পাখিটা এসে বসতে যাবে, খপ করে ধরে ফেলল বুড়ি। একটা কাঁচি এনেছিল কিমোনোর আড়ালে লুকিয়ে। কী নিষ্ঠূর বুড়ি, পাখির জিভটা কেটে দিল কুট করে।

যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে কোন রকমে পালিয়ে বাঁচল পাখিটা। তার উড়ে যাওয়া দেখে, সে কী আনন্দ বুড়ির! নিজের মনেই বলতে লাগল-- যা হতভাগা, আর কোনদিন আসতে হবে না আর এখানে। গান গাইবার সাধ মিটিয়ে দিয়েছি জন্মের মত। বেআক্কেলে আপদ যত্ত সব!

বুড়িটার গজগজানিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল এবাড়ির দুজনের। তারা দেখতে পেয়ে গেল সব। দুঃখে কপাল চাপড়াতে লাগল তারা। 

একটু সামলে নিয়ে, বুড়ি বলল-- হ্যাঁগো, চলো না, পাখিটার বাড়ি কোথায় খুঁজে বার করি আমরা। 
কথাটা ভারী মনে ধরল বুড়োর। দুজনেই তারা ভারী দয়ালু মানুষ। দুজনে চলল চড়ুয়ের বাড়ি খুঁজতে।
কোথায় তার বাড়ি, কতখানি দূরে-- কিছুই তো জানা নাই। যেতে যেতে যেই না কোন পাখিকে দেখতে পায়, তাকেই ডেকে জিজ্ঞেস করে-- হ্যাঁগো, বাছা! চড়ুইয়ের বাড়ি কোথায়, বলতে পারো? তাদের কাছে হদিশ নিয়ে এগোতে থাকে।

এইভাবে চলতে চলতে একটা নদীর পারে এসে হাজির দুজনে। পাহাড়ি নদী। তার উপর একটা নড়বড়ে কাঠের সাঁকো। সেটা পার হতেই, এক সমস্যা। সাঁকো থেকে নেমেই, দুটো পথ গিয়েছে দু'দিকে। কোন পথে যাওয়া যায় এবার? কাউকে তো দেখাও যাচ্ছে না কোথাও। ভারী ভাবনায় পড়ে গেল তারা।

এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে একটা বাদুড়কে দেখা গেল। মাথা নিচু করে ঝুলছে গাছের ডালে। বাদুড়ই আগ বাড়িয়ে বলল-- হয়েছেটা কী? অত ভাবনা কিসের?  
বুড়ো বলল-- চড়ুইয়ের বাড়িটা কোথায় বলতে পারো, বাছা? 
-- খানিকটা পারি। ডাইনের রাস্তায় ওই পাহাড়চুড়োর দিকে মুখ করে এগোও। ওই দিকেই যেতে দেখি ওকে। কথা শেষ করে, আবার চোখ বুজে, ঘুমতো লাগল বাদুড়।
পাহাড়তলির শুঁড়ি পথ ধরে চলতে লাগলো দুজনে। কত দূর গিয়ে, আবার পথ গিয়েছে দু'দিকে। কোন দিকে যাওয়া যায়?
এদিক ওদিক তাকিয়ে, এবার একটা মেঠো ইঁদুর দেখতে পেল তারা। আলের গা ধরে ঘাসের ভিতর হেঁটে বেড়াচ্ছে। 
বুড়ো বলল-- চড়ুইয়ের বাড়ি কোথায় বলতে পারো তুমি? 

সামনের দু,পায়ে ভর দিয়ে, ইঁদুর মুখ তুলে দেখল খানিক। বলল-- কেন পারবো না? বাম হাতে বনের পথ ধরে এগোও। পেয়ে যাবে। সামনেই তো ওর বাড়ি।
বনের পথে কিছুটা এগোতেই, চড়ুইয়ের বাড়িতে পৌঁছে গেল তারা। বুড়োবুড়িকে দেখে পাখির তো আনন্দ ধরে না। তার বউ দৌড়ে এলো। দুটো বাচ্চা ছিল তাদের। কিচির মিচির করতে করতে, দৌড়ে এলো তারাও। চারটিতে মিলে গড়াগড়ি খেতে লাগল মাটিতে। 

সেদিন বুড়োবুড়িকে কিছুতেই ঘরে ফিরতে দিল না তারা। থেকে যেতেই হল  পাখিদের সাথে। ফেরা হল না পরদিনও। তার পরের দিনও না। খাওয়া-দাওয়া হল, নাচ দেখা হল। সেই বিখ্যাত চড়ুই নাচ। চড়ুইটা তো এখন আর গান গাইতে পারে না। তার বউ আর ছানা দুটো গান গাইল, আর নাচ দেখাল সে নিজে। 
দু'চার দিন থেকে, একদিন সকালে বের হল বুড়োবুড়ি। বাড়ি যাবেই আজ। পাখি বলল-- তোমরা না থাকলে, আমি তো মরেই যেতাম সেদিন। তাছাড়া, নিজের থেকে খোঁজ নিতে এসেছ আমার বাড়িতে। খুব খুশি হয়েছি আমরা। কিন্তু সামান্য ছোট্ট একটা পাখি আমি। কী-ই বা করতে পারি? কী-ই বা দিতে পারি প্রতিদান হিসাবে? সামান্য একটু উপহার দিতে চাই তোমাদের। না করতে পারবে ন, নিতেই হবে তোমাদের! 

চারজনে মিলে, ধরাধরি করে দুটো বাক্স নিয়ে এল ঘর থেকে। একটা বাক্স বেশ বড়সড়, আর তেমনই  ভারী। অন্যটা যেমন ছোট, তেমনই হালকা। চড়ুই বলল-- যেটা তোমাদের মন চায়, বেছে নাও।
বুড়ো বলল-- তুমি ভালোই জানো বন্ধু, নেহাতই সামান্য মানুষ আমরা। যা আছে, তাতেই দিব্বি দিন চলে যায়। কিছুই চাই না আমাদের। তবে, তুমি বলছো, তাই না করতে পারছি না। তাছাড়া, এতটা পথ বয়েও নিয়ে যেতে হবে। ছোট বাক্সটাই নিচ্ছি আমরা। তুমি যেন কিছু মনে কর না। 

বাক্স নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল দুজনে। অতিথিদের খানিকটা এগিয়ে দেবে বলে, চড়ুই উড়ে উড়ে চলল তাদের সাথে। 

বাড়ি ফিরে, বাক্স খোলা হতেই, চমকে গেল দুজনে। থরে থরে সাজানো সিল্কের পোশাক-আশাক। সেগুলোর তলায় আরেক কান্ড। একরাশ সোনার মোহর। কথাটি নাই দুজনের মুখে। চোখ কপালে উঠে গেছে। এত সম্পদ স্বপ্নেও কখনো দেখেনি তারা। 

এদিকে হয়েছে কী, ক'দিন আগে এদের দুজনকে ঘর থেকে যেতে দেখেছিল সামনের হিংসুটে বুড়িটা। আজ আবার বাক্স বয়ে নিয়ে ফিরে এল। ব্যাপার কী, দেখার জন্য এদের জানালায় এসে উঁকি দিয়ে দেখছিল সব। ব্যাপার দেখে, মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় তার।
পরের দিন বুড়িটা সোজা এদের ঘরে এসে হাজির। মুখ শুকনো করে বলল-- নিজের কাজের জন্য মরমে মরে যাচ্ছি আমি।রাগের মাথায় করে ফেলেছি কাজটা। পাখির কাছে গিয়ে মাফ চেয়ে আসতে চাই। পথের হাদিস একটু বলে দাও আমাকে।

এরা দুজন তো সহজ সরল মানুষ। অতশত মারপ্যাঁচ বোঝে না। পাখির ঠিকানা বলে দিল তারা। 
হিংসুটে বুড়ির যেন তর সয় না। সাথেসাথেই রাস্তায় নেমে পড়ল সে। যেতে যেতে পথ পেরিয়ে, সাঁকো পেরিয়ে, পাহাড়তলীর রাস্তা ধরে, বনের ভিতর পাখির বাড়িতে এসে পৌঁছালো সে।

হিংসুক বুড়িকে দেখে মোটেই ভালো লাগলো না পাখিদের। কিন্তু অতিথি বলে কথা! তাছাড়া নিজে বাড়ি বয়ে এসেছে। খাতির করেই বসাল তারা বুড়িকে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে, বুড়ি উঠে পড়ল বাড়ি ফিরবে বলে। পাখিগুলো তাকে দু'দিন থেকে যেতে বলল। বুড়ি রাজি হল না। আসলে তার তো সোনাদানা পাওয়ার লোভ। তর সইছে না তার। চড়ুই তখন দুটো বাক্স এনে বুড়িকে বলল-- যেটা তোমার মন চায়, বেছে নাও। বাড়ি বয়ে এসেছো, এটা তোমার উপহার। 

বুড়ি বড় বাক্সটাই নিল। কেন না, বড় বাক্স মানেই ভেতরে বেশি জিনিস। ছোটটা নিতে যাবে কেন?
 বনের ভিতর দিয়ে চলেছে বুড়ি। ঘাড়ে অত বড় একটা বাক্স। ভারী কষ্ট হতে লাগল তার। অগত্যা এক জায়গায় এসে বসে পড়ল সে। খানিক জিরিয়ে নেবে বলে। ঘাড় থেকে নামিয়ে বাক্সটা মাটিতে রাখতেই, বুড়ি ভাবল-- একবার দেখে নিই, কত টাকাকড়ি আর সোনাদানা আছে ভেতরে। 

সোনাদানাই বটে! যেই না বাক্সটার ডালা খুলেছে, অমনি বোঁ-বোঁ আওয়াজ করতে করতে বেরিয়ে এল এক ঝাঁক বোলতা আর ভিমরুল। বেরিয়েই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল বুড়ির ওপর। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ারও সময় পেল না বুড়ি। অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করতে লাগল। এদিকে পোকাগুলো তো হাজার হাজার। সবাই হুল ফোটাচ্ছে বুড়িকে। তাদের কামড়ে, একটু পরেই নেতিয়ে পড়ল বুড়ি। তারপর ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে। 
শব্দ পেয়ে, এবার বড় বড় ডানার এক ঝাঁক পাখি বেরিয়ে এল বাক্স থেকে। তারা বুড়িকে তুলে নিয়ে আকাশে উড়ে গেল। 
কোথায় গেল পাখিগুলো? কেউ জানে না সে কথা। উঁচু পাহাড়ের মাথায়, না কি সমুদ্দুরের মাঝখানে-- কোথায় যে টুক করে ফেলে দিল বুড়িটাকে, আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। এমন হিংসুটে আর লোভী মানুষ না থাকলেই ভালো-- এই ভেবে গাঁয়ের লোকেরাও কেউ খোঁজ নেয়নি তার।

পরের দিন। সবে ভোর হচ্ছে তখন। মিষ্টি গলায় পাখির  কিচির মিচির গান শুনে ঘুম ভাঙল বুড়ো বুড়ির। বাইরে বেরিয়ে দেখল,  এক দল পাখি এসে বসেছে সবজি বাগানে, বেড়ায়। শুধু চড়ুই নয়, আরও কতক পাখি। বাতাস ভরে উঠেছে তাদের গলার মিষ্টি সুরে। 
সেদিন থেকে প্রতি দিন আসে পাখিগুলো। ভোর না হতেই, উঠোনে এসে হাজির হয় পাখির দল। গান শুনিয়ে বলে-- ভোর হয়ে আসছে। উঠে পড়ো তোমরা। আর ঘুমিয়ে থেকো না। নিজের নিজের কাজে লেগে যাও। দিন শুরু হয়ে যাচ্ছে।

(জিভ কাটা চড়ুই পাখির এই গল্পটি প্রচলিত আছে পূর্ব এশিয়া জুড়ে। কোন কোনও এলাকায় কিছু রকমফের দেখা যায় কেবল। আমাদের এই গল্পটি জাপানের।)

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments