জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-১১/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত

১১

চয়নের দাহকাজ শেষ হতে বিকেল ফুরিয়ে গেল। সন্ধের মুখে শবযাত্রীসহ ঋষভ ফিরে এলে সাড়ে সাতটার দিকে চলে গেল বুল্টি। বাড়িতে বাচ্চা দুটো ভীষণ দুষ্টুমি করছে। ছ'টায় শ্রীরামপুর থেকে শ্যামল ফিরে এলেও একা পুরুষমানুষ হয়ে ওদের সামলাতে পারছে না। প্রভা রয়ে গেলেন বৈশাখীর কাছে। অসহায় বৈশাখীর পাশে দাঁড়ানোটা এখন খুব জরুরি। ওদের মনোবলটা বাড়ানো দরকার। বউমা,ঐশী আর ঋষভকে আর কিছু দিতে পারেন বা না পারেন,সান্ত্বনাটুকু তো দিতে পারবেন। দেশের লোক ওটাই দেয়নি ওদের। অতগুলো লোক বাড়ি বয়ে এল এই দুঃসময়ে,কারও একজনের মুখ থেকেও ঝরল না সহানুভূতি। সহমর্মী হয়ে একটা কেউ ঋষভকে বুকে টেনে নিল না! স্বজন মানে তো এটা নয়! পরিবার,পরিমন্ডল শব্দগুলো আজ সমাজঅভিধান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু শর্ত আরোপের খেলা চলছে চারদিকে। এ তো সম্পূর্ণ রাজনীতি! সুরেশের বেলায় যে ঘটনাটা ঘটিয়েছিল ওরা,একই ঘটনা আবার ঘটালো চয়নের সময়। দীর্ঘদিন ধরে বাইরে ঘরসংসার নিয়ে থাকা একটা মানুষ তো চাইতেই পারে তার শেষ কাজটা নিজের তৈরি করা বাড়িতেই হোক। এতে দোষের তো কিছু নেই! এমন তো কত কত ঘটে। এই তো চার মাস আগে প্রভাদের পাশের বাড়ির হলধরবাবু যখন মারা গেলেন,অন্ত্যষ্টির সব কাজ তো এখানেই হল। দেশবাড়ি থেকে সবাই এসেছিল এখানে। কই,ওনাকে নিয়ে তো টানা হ্যাঁচড়া চলেনি! জ্ঞাতিরা কেউ একবারও বলল না,"পৈত্রিক ভিটের মাটি না পেলে অসম্পূর্ণ থাকে সব। অন্ত্যেষ্টিতে আত্মার শান্তি আসে না।" বরং বলল উল্টো কথা। "পঞ্চাশ বছরের বাস এখানে দাদার। এখানেই দাদার সবকিছু। শ্রাদ্ধশান্তিটা ছেলে যদি এখানে করতে চায়,অন্যায় কিছু নয়। আমরা সবাই আসব। দাদার নিজের বাড়িতে কাজ হবে,এ তো ভালই।" আজ অয়নকে দেখে খুব অবাক হলেন প্রভা। নিজের বড় দাদা হয়ে এটা ওর ঠিক কাজ হল না। ঋষভের সাথে আলাদা করে জেঠু হিসেবে কথা বলতে পারত না কি ও? প্রভার চোখের সামনে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলো সব ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। অথচ একটা সময় গিরিধারীর পরিবারের বাঁধন ছিল চোখে পড়ার মতো। ঘরভর্তি একগাদা লোক। তাদের কলরব আর যাপনে গমগম করত দেশের ভিটে। গিরিধারীর মৃত্যুর আগেটাতেও এ চিত্রর অন্যথা হয়নি। পরিবার নিয়ে চয়ন যেত মাঝে মধ্যেই। অয়ন আর চয়নের পরিবারের চেনা মানুষগুলোকে সেসময় দেশে গেলে দেখতে পেতেন প্রভা। তখন সবকিছু  যেন অটুট। বুল্টির বিয়ে হয়নি। সুরেশের কর্মমুখর জীবন। চয়নের ব্যস্ততা। অয়নের ব্যবসা। ঋষভ আর ঐশী যেত কম। ওদের বাইরে বাইরে পড়াশুনো। পুরুলিয়ার যে গাঁয়ে ওদের দেশ,ওখানকার মানুষজনদের সাথে ওদের তেমন পরিচয় নেই। শেষবার ওরা বাবা মা'র সঙ্গে দেশের বাড়ি গিয়েছিল সরসীবালার অন্ত্যেষ্টির সময়। দিন পনেরো থাকার কারণে অচেনা গ্রাম নিয়ে অভিজ্ঞতা হয়েছিল একটু। তবুও কি জেনেছিল সব? জেনেছিল রাজীব রাকেশকে? চয়নদের পৈত্রিক ভিটে নিয়ে সত্যিই কি কিছু জেনেছে ঋষভ? বোধহয় জানা হয়ে ওঠেনি এখনও। অনেক কিছুই জানতে পারেনি ছেলেটা। খুলে বলতে হবে প্রভাকে। বাবার দুঃখটাকে চেনাতে হবে।
     চয়নের মুখাগ্নির পর ঋষভের বেশ এখন অন্যরকম। বৈশাখী ছেলের পরিধানের দিকে তাকাতে পারছিল না। এই বয়েসে এ কী পরতে হল তাকে! ঋষভ ঘরে ঢোকার সময় ছেলেকে প্রথমবার ওভাবে দেখে চিৎকার করে একবার কেঁদেছিল।  সান্ত্বনা দিয়ে প্রভা বোঝালেন,"এটাই তো নিয়ম বউমা। মুখে আগুন দেওয়ার পর এখন পনেরো দিন জামা প্যান্ট আর পরতে নেই যে! এখন অশৌচ চলবে।"
     সবই জানে বৈশাখী। সবই বোঝে। তবু মন কি মানতে চায়? চয়নের মুখে আগুন শুনতে গিয়ে তাই ভেঙে পড়ল সে। বোনকে শক্ত হতে বলল সুখেন। ইচ্ছে করছিল,আজ রাতটা বোনের কাছেই কাটিয়ে দেবে সে। ঐশী আর ঋষভকে আর একটু বোঝানো,বৈশাখীর মনোবলটাকে আর একটু দৃঢ় করে দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু  তা হলনা। বাড়িতে দু'দিন ধরে জ্বরে পড়ে আছে স্ত্রী সোমা। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বৈশাখীর কাছে বাবাকে রেখে সুখেনকে তাই চলে যেতে হল ব্যারাকপুরের বাড়িতে। আজ তিন চারদিন বাড়িছাড়া। সেরকম মনে হলে কাল সকালে নাহয় আবার একবার আসবে।
      প্রভার সাথে ঋষভের ভাল করে আলাপ হল ঘর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর। প্রভা যখন বললেন,"সম্পর্কে আমি তোমার ঠাকুমা হই",মনে পড়ল বাবার কথা। বাবা মাঝেমাঝেই তাকে বলত,"এই কলকাতায় তোর এক ঠাকুমা আছে ঋষভ। দেশের মানুষ বলতে এখানে ওই আমাদের আপনজন।"
সম্পর্কটা ছেলেকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিল চয়ন। "তোর দাদুরা যেমন ছিল তিন ভাই গিরিধারী,বংশীধারী আর রাসবিহারী একই মায়ের পেটের,সুরেশকাকা ছিল আমার বাবার খুড়তুতো ভাই। জেঠুর ছেলে। সম্পর্কগুলো দূরের নয় রে ঋষভ। দূর ভাবলেই দূর।"
প্রভার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে আজ ঋষভের তাই মনে হল। মনে হল,লতাপাতায় জড়ানো এ সম্পর্কগুলো রয়ে যায় বলেই নিজেদের পৃথিবীটা বাড়ে। শ্বাস নেওয়ার জোর পাওয়া যায়।
     অশৌচ গায়ে সুরেশের স্ত্রী প্রভার কাছে ঋষভ আজ দেশের বাড়ির বাপ কাকাদের পৈত্রিক ভিটের না জানা কাহিনি শুনতে বসল। সরসীবালার কাছে যা ছিল তীব্র যন্ত্রণার,প্রভার কাছে তাই যেন বুকের খেদ। গিরিধারীর কাছে যেটুকু  সম্পদ সোনার মতো লেগেছিল, জীবনের শেষ দু তিনটে বছর চয়নের কাছে তা  বেদনার শলাকা হয়ে গেছে। পৈত্রিক ভিটের ঐ বাড়িখানা অনাদরে পড়ে থাকার মধ্যে সামান্যতম ব্যথাও পাননি অয়ন। সুমিত্রার কথামতো বাড়িটাকে অভিভাবকহীন করে গ্রামেই নিজের টাকায় কেনা জায়গায় যেদিন  দু কামরার বাড়ি করলেন অয়ন,চয়ন খবর পেয়ে সেদিন রাতে এই কলকাতায় বসে কেঁদেছিল খুব। দাদাকে সে অনেকবার বলেছিল,বাড়িটা মেরামত করে ওখানেই থাকতে। বাবার তৈরি করা বাড়ি। কত মায়া,কত স্মৃতি ! অয়ন শোনেননি। বউয়ের শেখানো কথাগুলো ভাইয়ের সামনে বলেছেন চিবিয়ে চিবিয়ে।"তোর নিজের বাড়ি থাকতে পারে,আমার থাকবে না কেন? টাকা কি কেবল তোর একারই আছে? আমার নেই? তোর কথা শুনে আমি নাহয় বাবার বাড়িটাকে মেরামত করে থাকা শুরু করলাম,কিন্তু গাঁয়ের লোক বাড়িটাকে বলতে শুরু করল গিরিধারীর বাড়ি। এটা শুনতে আমার ভাল লাগবে না চয়ন। কলকাতায় তুই যে বাড়িটা করেছিস,ওতে তোর নাম লেখা নেই? ওরকম নিজস্ব একটা বাড়ি আমারও তো করতে ইচ্ছে করে। নিজের সংসার,নিজের বাড়ি তবেই না........। অয়নকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। বৈশাখী পর্যন্ত অনুরোধ করেছিল। "দাদা,বলছিলাম যে বাবার ভিটেটা অযত্নে থাকবে! আপনি ঐ বাড়িটাকেই আপনার ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে নিন না। আমরা এতটুকু বাধা দেবো না। তাও তো বলতে পারব,পৈত্রিক ভিটে।" বৈশাখীর কথাও সেদিন শোনেননি অয়ন। সরসীবালার অন্ত্যেষ্টি হল অয়নের বাড়িতে। চয়ন মেনে নিতে পারেনি। দাদাকে অনেকবার বলেছিল,"অন্তত মায়ের কাজটার জন্য ভিটেটাকে পরিষ্কার করা হোক। মায়ের স্বামীর বাড়ি। শ্রাদ্ধটা ওখানে করলে মায়ের আত্মা শান্তি পায়।" সেই কথাও শুনলেন না অয়ন। "অত ঝামেলায় যাওয়ার কী দরকার বলত চয়ন? ভিটেটা কি আর ভিটের মতো আছে নাকি? ছোট্ট এক চিলতে উঠোনটা এখন জঙ্গল। বুনো আগাছায় ভর্তি। ঘরগুলোতে সাপখোপ থাকতে পারে। পরিষ্কার করার লোক সহজে পাওয়াও যাবে না। মায়ের কাজটা আমার বাড়িতেই হোক না। ছেলের বাড়িতে মায়ের অন্ত্যেষ্টি হবে,এতে তো অন্যায়ের কিছু নেই। " কোনও অন্যায় নেই। কিন্তু  অন্যায়ের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন অয়ন। গ্রামশুদ্ধ সবাই জানল,খুব বড় করে মায়ের শ্রাদ্ধ করেছে গিরিধারীর বড় ছেলে। ছোট ছেলে কলকাতায় থাকে। ও শুধু পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পাশে এসে দাঁড়ানো আর দায়িত্ব নেওয়া তো এক নয়। ছোট ছেলে বউ ছেলে মেয়েকে নিয়ে অশৌচের পনেরো দিন গাঁয়ে এসে থাকতে পারে,ওটা বড় কথা নয়। খরচের অর্ধেকের বেশি হয়তো অয়নই দিয়েছে। কলকাতার জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা চয়ন।মানসিকতায় শহুরেপনা তো আসতেই পারে। 
     কথাগুলো সেসময় বাতাসে খুব ছড়িয়ে ছিল। মায়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর চয়ন যখন আবার কলকাতায় ফিরে এসেছে দৈনন্দিন ব্যস্ততায়,একদিন গ্রাম থেকে নটবরকাকার ছেলে বিজু চয়নকে ফোনই করে বসল। "চয়নদা,শুনলাম তোমার মায়ের শ্রাদ্ধের সমস্ত খরচ অয়নদা একা দিয়েছে। তুমি কিছু দাওনি। কথাটা কি সত্যি?"
অবাক হয়ে বিজুকে চয়ন বলেছিল,"কোথায় শুনলি এসব?"
"কোথায় আবার! চারদিকে সবাই বলাবলি করছে। তুমি কিছু দাওনি চয়নদা?"
"যারা বলছে,তারা বলুক। মুখ তো আটকানো যায়না। তবে তুই শুনে রাখ বিজু,মায়ের কাজে দাদার হাতে আমি নিজে তুলে দিয়েছি পঞ্চাশ হাজার টাকা। তুই দাদাকে একবার জিগ্যেস করে দেখিস। দাদা তো অস্বীকার করবে না।"
অয়ন অস্বীকার করেননি ঠিকই,তবে ভাইঅন্তপ্রাণ হয়ে এটাও বলেননি,"চয়ন ওরকম ছেলেই নয়। ও কিছু দেবে না,তা হয় কখনও?" অয়ন বিজুকে বলেছিলেন অন্যরকমভাবে। "যদি কিছু দিয়েছে তো দিয়েছে। মায়ের শেষ কাজে যদি কিছু দিয়েই থাকে,এতে ঢাক পেটানোর কী আছে? কী দিয়েছে না দিয়েছে,অত হিসেব আমার মনে থাকে না।" বিজু এই কথাটাও চয়নকে জানিয়েছিল।

      শুধু প্রভা একা নয়,বৈশাখীও আজ ছেলের সামনে উপুড় করে দিল ঋষভের অনেক না জানা কথা। চয়ন যে ব্যথা'টা সারাজীবন বুকে বয়ে বেরিয়েছিল,চয়নের ছেলে হয়ে ঋষভের তা জানাটা যে খুব দরকার! 
প্রভা বললেন,"তোমার জেঠুর মনটা আগে ভালই ছিল ভাই। আস্তে আস্তে ও পাল্টে গেছে। সুমিত্রা মানে তোমার জেঠিমা ভাল মানুষ নয়। ওর কথামতোই অয়নকে চলতে হয়। আর ঐ রাজীব রাকেশ। বংশীর ঐ ছেলেদুটো এই সমস্ত ঘটনার মূলে। আমি অনেকদিন আগেই টের পেয়েছি। কিন্তু  কী করব? করার তো কিছু নেই। এখন ভাগ্য যে পথে আমাদের টেনে নিয়ে যাবে!"
    মা আর প্রভা ঠাকুমার কাছে সব শুনে বাবার জন্য বুকটা একবার মোচড় দিয়ে উঠল ঐশীর।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। কিন্তু  ঋষভের চোখে জল এল না। মনটা তার শক্ত হয়ে গেছে। একেবারে নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তটার জন্য চোয়াল দৃঢ় করল সে। জেঠুকে যখন আজ সে বলল,পৈত্রিক ভিটে অক্ষত অবস্থায় থাকলেও বাবাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায়। ভাইয়ের বাড়িতে বাবা যাবে কেন? বাবার নিজের বাড়ি নেই? 
ঋষভের এ যুক্তির কাছে জেঠু কিছু বলতে পারেনি। কী বলবে? বলার কিছু ছিল কি?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments