জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-১০/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত


উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত

১০

রেগে যাওয়ার মতো এমন কিছু বলেনি ঋষভ। সাহসে ভর দিয়ে চোয়াল শক্ত করে সে শুধু তার মনের কথা বলল ওদের। কিন্তু  আজ তো এখানে তারা বাইশ বছরের একটা বাচ্চার কথা শুনতে আসেনি। ঋষভ এসবের কী বোঝে? কতটুকু  বয়েস তার? কোথায় দাহকাজ করা হবে,কোথায় অন্ত্যেষ্টি এসব ভারি বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনও ঋষভের আসেনি। তাই ওর কথাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে রাজীবের ইশারাতে অয়ন সুখেনের দিকে তাকালেন। "সুখেন,তুমি কী বলছ?"
সুখেন আশ্চর্য হয়ে গেল। "দেখুন দাদা,এটা আপনাদের সম্পূর্ণ পারিবারিক ব্যাপার। এতে আমি কী বলতে পারি? আপনারা যেটা ভাল মনে করবেন,সেটাই করবেন।"
"আলবাৎ পারো। তুমি বাচ্চা ছেলেটাকে মদত দিয়েছ। শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছ আগে থেকে। তানাহলে ও এমন কথা বলতেই পারেনা। আমরা সব বুঝি।" ঝাঁঝিয়ে উঠল রাকেশ। 
"আমি সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছি! কথাবার্তা একটু ঠিক করে বলুন। বাড়িতে শোক। মনমেজাজ কারও ভাল নেই। ......কী অয়নদা,আপনি চয়নদার বড় দাদা। আপনিই বলুন না,কথাগুলো কি উনি ঠিক বললেন? ঋষভকে আমি শিক্ষা দিতে যাব কেন? ও চাকরি করে। নিজস্ব একটা বোধবুদ্ধি আছে। আমি বললে ও শুনবেই বা কেন? না না,এ ভারি অন্যায়! সামনে এত লোকজন। ওরা সব শুনলে কী ভাববে? আপনাদের কথাটাই সত্যি মনে করবে তো ওরা। একটূ ভেবেচিন্তে কথা বলুন।"
      প্রভাকে অনেকক্ষণ আগেই লক্ষ করেছিল রাজীব। কিছু বলেনি। কাকিমার মুখটা দেখলে এখনও তার গা জ্বলে যায়। মাতব্বরিটা সেদিন ওভাবে যদি ও না করত,চয়নের কিছু করার থাকত কি? বীরেশকাকার ছেলে তো বলেই ছিল,"গাঁয়ে আসুক। জেঠুর শেষ কাজটা আমি নিজেই করব।" বীরেশকাকার ছেলের কথাটার কোনও গুরুত্বই দিল না কাকিমা। শুধু নিজের মতে চলল। সারাজীবন এবারে থাকুক এখানে একা একা! কলকাতায় বাড়ি। কলকাতায় সব। কী আহামরি কথা!
      কাকিমাকে সরাসরি কিছু বলল না রাজীব। ঘরভর্তি লোক। পরিবেশটা থমথমে। কথার ঠেস দিল সে। 
"সুখেনদাকে একাই দোষ দিয়ে কী লাভ? দলভারি করার লোকের তো অভাব নেই! একা একা থাকার যন্ত্রণা যে অনেক,দেরিতে হলেও কেউ কেউ টের পায়।" কথাগুলো বলেই রাজীব হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সময় ছুটছে। এখানে আসা হয়ে গেল তিরিশ মিনিটের ওপর। এবার তাড়াহুড়ো না করলে সব দিকেই দেরি হয়ে যাবে। গ্রামে পৌঁছে সরাসরিই তো শ্মশানে নিয়ে যাওয়া যাবেনা। চয়নদাকে পৈত্রিক ভিটেটাতে একবার নামানো হবে। গাঁয়ের দু'একজন লোক সব আসবে। যারা অনেকদিন ওকে দেখেনি। তারপর নামানো হবে আটচালার সামনে। ঠাকুর দেবতার ওপর একটা ভক্তি ছিল চয়নের। আটচালা জুড়ে অনেক রকম দেবদবীর মূর্তি। চয়ন যখনই দেশের বাড়ি যেত,কিছুক্ষণ দাঁড়াত ওখানে। 
নিজের মনে আনুমানিক একটা হিসেব করে নিল রাজীব। শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে ওদিকে সময় ব্যয় হবে প্রায় আধঘন্টার কাছাকাছি। মিনিট কুড়ি তো বটেই। দাহকাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে সাতটা বেজে যাবে নির্ঘাৎ। বেশিও বাজতে পারে। তাই তাগাদা দেয় রাজীব।
     চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ভেতরে ঢুকলেন তালুকদার। "কী হল? আপনারা সব কী নিয়ে কথা বলছেন?"
তালুকদারকে কাছে ডাকলেন অয়ন। অয়নের পাশে বসলেন তালুকদার।
"দেখুন দাদা,ভাইকে আমরা দেশের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। ওখানে আমাদের বাপ কাকাদের দাহ করা হয়েছে। অন্ত্যেষ্টি হয়েছে। চয়নকেও তাই.....। কিন্তু  ঋষভ বলছে,বাবাকে ও ওখানে নিয়ে যেতে দেবেনা। বাবার যা কিছু কাজ,সব এখানে হবে।.....আমরা ভুল কিছু বলেছি,বলুন?"
"দাদা,এ নিয়ে আমি কী বলব বলুন তো? আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলা আমার কি ঠিক হবে? আপনি যা বলছেন,কথাটা যে একেবারেই ভুল,তা নয়। দেশের বাড়ি,পৈত্রিক ভিটে এই শেষ সময়ে এসব তো আপনারা চাইতেই পারেন। তাবলে চয়নদার ছেলের কথা শুনবেন না,তা তো হয়না। ওনার ছেলে রয়েছে। ওর সিদ্ধান্তের একটা দাম আছে। চয়নদা এখানে পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর ছিলেন। নিজের তৈরি করা বাড়ি রয়েছে। সংসার রয়েছে। নিজের বন্ধুবান্ধব,ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠা.....শিকড়টা যে এখানেও অনেক গভীর। এটাও তো অস্বীকার করার নয়। দেখুন, ঋষভকে বলে যদি রাজি করাতে পারেন। বউদি রয়েছে,উনাকে বলুন।" তালুকদার কথাগুলো বলে চুপ করে গেলেন।
"শোভনকাকু,বাবাকে নিয়ে গিয়ে ওখানে কোথায় রাখা হবে,জেঠুকে একবার জিগ্যেস  করে দেখুন তো? দাদুর বাড়িটা থাকলেও একটা কথা ছিল। বাবার পৈত্রিক ভিটেটা আমি দেখেছি। দিন দিন ভেঙে যাচ্ছে সব। বাড়িটা কোন্ দিন না ধসে পড়ে। ওখানে কি বাবার কাজ করা যায়? দেশের বাড়িতে বাবার কাজ মানে তো জেঠুর বাড়িতে কাজ। এখানে বাবার নিজস্ব বাড়ি থাকতে আমি জেঠুর বাড়িতে কাজ করব কেন?" ঋষভ বলল।
অয়ন শেষবারের মতো বৈশাখীকে অনুরোধ করলেন। "বউমা,তুমি কিছু বলো। তোমার স্বামী। তোমারও একটা মত আছে।"
বৈশাখী বলে,"ঐ যে আপনি একটা শব্দ বললেন দাদা,স্বামী। বলুন তো কোনও স্ত্রী কি চায় স্বামীর শেষ কাজটা অসম্মানজনকভাবে হোক?"
"এটা অসম্মানজনক! বাবার ভিটে নাহয় বাস করার পক্ষে অনুপযুক্ত,দাদার ভিটেতে ভাইয়ের কাজ করলে ভাইকে অসম্মান করা হয় বউমা?"
"হ্যাঁ দাদা। বোধহয় তাই। আপনার ভাইয়ের নিজের একটা বাড়ি আছে,এটা আপনি ভুলে যাচ্ছেন।"
"ও। তোমারও তাহলে ইচ্ছে নেই।" অয়ন নিরাশ হলেন।
"আমায় ক্ষমা করবেন দাদা। আপনার ভাইয়ের একটা ছেলে আছে। বাবার কাজ তো ছেলেই করে। ছেলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তো আমি যেতে পারি না। ঋষভের কথাগুলো একটু বুঝুন। ও তো অন্যায় কিছু বলেনি। সত্যিই তো,নিজের বাড়ি থাকতে পরের বাড়িতে অন্ত্যেষ্টি হবে কেন?"

"আবার সেই সুরেশকাকার মতোনই ঘটনাটা হয়ে গেল না?" বলে রাজীব সবাইকে তাগাদা দিল। "চ রে,এখানে আর বসে থেকে কোনও লাভ নেই। অয়নকে বলল,"দাদা,এবার বেরোতে হবে। শুধু শুধু এখানে বসে থাকার কোনও মানে নেই।"
     চলে গেল ওরা সব। দেশের লোক। চয়নের আপন কাকার ছেলেরা। চলে গেলেন একই মায়ের পেটের বড় ভাই। চোখে জল নিয়ে ঋষভ শুধু তাকিয়েই থাকল ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে।
     পাড়া প্রতিবেশীরা এবার ব্যস্ততা দেখালো চয়নকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোন্ কাকভোরে চয়নের প্রাণটুকু চলে গেছে,আর কি রাখা যায় দেহ!
      শেষযাত্রায় ছাড়ার আগে চয়নের নিথর দেহটাকে ধরে পাগলের মতো কান্নাকাটি শুরু করল বৈশাখী। প্রতিবেশী মহিলারা এমনকি প্রভাও আটকাতে পারলেন না। বুল্টি সামলাতে ব্যর্থ হল ঐশীকে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments