জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-৩/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত



"টাকা যখন আছে,ছোট গাড়ি কিনবে কেন?" রাজীবকে উস্কে দিয়েছিল পাপিয়া। শুধু  উস্কে দেওয়াই নয়,রীতিমতো তাতিয়ে বলেছিল,"কেবল চয়নদারই টাকা আছে,তোমাদের নেই? দেখাতে তো তোমরাও পারো। জেদ থাকা চাই,বুঝেছ? সেবার চয়নদা গ্রামে গাড়ি নিয়ে এসে এমন ভাব দেখাল,যেন গাড়ি নয়,পৃথিবীটাই কিনে ফেলেছে। গ্রামের লোকগুলো কেমন ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল দেখেছ? যাই বল তাই বল,তোমাদের ঐ বুদ্ধিটাই নেই।পাঁচজনের কাছে মান আদায় করতে তোমরা জানো না। শুধু টাকা থাকলেই হয়না।"
রাজীবের বুকের ওপর হামলে পড়ল পাপিয়া। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবোনোর আগে চুলে বিলি কেটে পাগল করে তুলল মানুষটাকে। ইদানিং এ অভ্যেসটা সে রপ্ত করেছে বস্তাপচা কিছু বাংলা সিরিয়াল দেখে। যেগুলো ন্যাকা ন্যাকা আর কাজ হাসিলের পূর্ণ আকর। 

"শোনো না,গাড়ি একটা কিনে নাও। ড্রাইভার ছাড়াও ছ'সাতজন যাতে বসতে পারে।   রাকেশকে বলো। ও যদি কিছু দেয়। দেওয়াটা তো উচিৎ। আমরা তো একা চড়ব না। আমার বিয়ের কিছু গয়না আছে। লাগলে ওগুলো দিয়ে তোমায় আমি......। চয়নদার গাড়িটার কত দাম হতে পারে,জানো? চয়নদা কিছু বলেছিল তোমায়?"

পাপিয়াকে জাপটে ধরে মনভরে আদর করছে রাজীব। দু সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও শরীরটাতে এখনও বিদ্যুৎ আছে পাপিয়ার। অথচ তেমন যত্নআত্তিও করেনা। শুধু একটু ফিটফাট থাকে আর মাঝেসাঝে কাঞ্চনার সাথে মোড়ে গিয়ে আই ব্রো করে। তাতেই যেন রূপসী লাগে ওকে।

রাজীব বলল,"চয়নদা আমায় নিজে কিছু বলেনি। তবে গাড়ি দেখে আমি আন্দাজ করেছি,ওর দাম তিন লাখের বেশি হবে না। খুব বেশি হলে সাড়ে তিন। ড্রাইভার বাদে তিন থেকে চারজন বসতে পারবে।"

"আমরা তাহলে পাঁচ লাখের মধ্যে কিনব। ছ লাখ পর্যন্তও এগোনো যায়। লোকের চোখে যেন লাগে। চয়নদার দেমাকটাকে যেন ভেঙে দেওয়া যায়। কলকাতায় থাকে বলে কি লাটসাহেব হয়ে গেছে?"
"ঠিক আছে,দেখছি।" রাজীব বলে।
"দেখছি নয়,কাল থেকেই খোঁজখবর নাও। তাড়াতাড়ি কেনো।"

     পরদিন দেওর রাকেশকে নিজেই বলল পাপিয়া। সব শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে রাকেশ বলল,"ফালতু। চয়নদা নিজের টাকায় গাড়ি কেনেনি। কোম্পানি ওকে দিয়েছে। কিছু  বড় বড় কোম্পানি কমিশন হিসেবে অমন দেয়। নিখিলেশদার এক পিসতুতো ভাইয়ের সাথে আমার আলাপ আছে। ওর মুখেই শোনা,চয়নদা গাড়িটা পেয়েছে। কেনেনি।"
"সত্যি?"
"আমি তোমায় মিথ্যে বলতে যাব কেন বউদি? ঐ ছেলেটাও কয়েকমাস আগে একটা মোটরবাইক পেয়েছে।"
"সে চয়নদা কিনুক বা নাই কিনুক,তোমরা তো কিনতে পারো। আমাদের ঐটুকুই নেই। বাকি সব তো.....। গাঁয়ের লোক তাহলে আমাদের আর একটু......। কী বলছি,বুঝতে পারছ তো ভাই?"

      গাড়িটা এভাবেই কেনা হয়। পাপিয়ার জেদ আর কাঞ্চনার আব্দারে।আশ্চর্যের ব্যাপার,গাড়িটাতে ওদের কোনও ভাগাভাগি নেই। যে ভাগাভাগিটা ওদের মায়ের বেলা ওরা করেছিল। গিরিধারীর মেজ ভাই বংশীধারীর স্ত্রী কাদম্বিনী স্বামীর মৃত্যুর পর বছর ছয়েক বেঁচেছিলেন। এই ছ বছরে দু ছেলে রাজীব আর রাকেশ পনেরো দিন করে হিসেব করে খাইয়েছে। ওদের দু ভাইয়ের হাঁড়ি আলাদা হয়েছে অনেকদিন। রাকেশের বিয়ের পর পরই। তবে পারিবারিক ব্যবসাটা একসাথে দেখে। ব্যবসা ভাঙলে আভিজাত্য কমে যায় যে! বাবার তৈরি করা ব্যবসা আজ বেশ বড় ওদের। ও সিদ্ধান্তটা হুটহাট নেওয়া চলেনা। একটু ভুলভাল কিছু হয়ে গেলে অয়নদাটা যে তিরের মতো এগিয়ে যায়। আর ওকে এগোতে দেওয়া মানেই নিজেদের আভিজাত্যে ঘা। চয়নদা না হয় কলকাতায় থাকে। রোজ দু বেলা দেখা হচ্ছে না। কিন্তু  অয়নদা তো গ্রামেই। জ্যাঠতুতো দাদার জন্য ওরা মরবে কেন? বরং মারবে। হাতে তো মারা যায় না,তাই এভাবেই মারবে। কুন্ডু বংশের ওরাই হবে শেষ কথা। জ্যাঠতুতো দাদার প্রতি শুধু লোক দেখানো মান্যতা। আর কিছু নয়।

     এ সব বুদ্ধি পাপিয়া আর কাঞ্চনার কাছ থেকে পাওয়া। অনেক কৌশল করে তাই গাড়ি কেনার আট মাস পর আজ চয়নদাকে দেখবার জন্য কলকাতার উদ্দেশ্যে যাওয়ার নাম করে অয়নদা আর বউদি সুমিত্রার কাছে ভালমানুষি করে রাজীব বলল,"আমাদের গাড়ি থাকতে তোমরা বাসে ট্রেনে যাবে কেন? তোমরা কি আমাদের পর? আমরা সবাই একসাথে যাব। চয়নদার বাড়াবাড়ি। আমাদেরও দেখতে ইচ্ছে করে। একসাথে কোলেপিঠে মানুষ হয়েছি সবাই। জ্যাঠার ছেলে মানে তো নিজেরই ভাই।" বলে মনটাতে বিষাদ মিশিয়েছিল সে। অয়নদা আর বউদিকে সযত্নে তুলেছিল গাড়িতে। পাপিয়া আর কাঞ্চনার মাঝে বসিয়ে বউদিকে সম্মান দেখিয়েছিল।

      পুরুলিয়া থেকে কলকাতা অনেকটা পথ। রাঢ় বাংলার রুক্ষভূমি চিড়ে সৌখিন আর পেলব রাস্তার মায়াগন্ধ নিতে গাড়ি ছুটছে এখন। চালকের আসনে রাজীব। সঙ্গে রয়েছে রাকেশ। ওদের দুই বউ পাপিয়া আর কাঞ্চনা। রয়েছে অয়নের ছোটকাকা রাসবিহারীর একমাত্র ছেলে সজল। সজলের বউ যাচ্ছে না। ও এখন তার বাপের বাড়িতে। গত পরশু গিয়েছে।আসবে দিন পনেরো পর। আর রয়েছেন অয়ন আর সুমিত্রা। ঊনসত্তর বছরের অয়নের মুখে মেঘ ছায়া ফেলেছে আজ সকালেই। খবরটা শোনার পর থেকেই তিনি গম্ভীর। ঊনিশ বছরের ছোট ভাইটাকে দেখবার জন্য মন ছটফট করছে তাঁর। কত কথা যে ভিড় করে আসছে! এলোপাথাড়ি কত স্মৃতি। নিখিলেশের মুখটা মনে পড়ছে ভীষণ। ঘোষালবাড়ির মেজ মেয়ের দেওর ছিল নিখিলেশ। চয়নকে ওই প্রথম কলকাতায় নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার আগে গিরিধারীর অনুমতি চেয়েছিল নিখিলেশ। "আপনি যদি বলেন,চয়নটাকে একটা কাজে ঢুকিয়ে দিই। আমাদের ওদিকে কারখানায় কিছু ছেলে নিচ্ছে। একে তাকে ধরে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেব ওর।" চয়নের তখন মাত্র পনেরো বছর বয়স। নাইন টেনে পড়ে। সরসীবালার চোখের জলকে অগ্রাহ্য করে গিরিধারী বললেন,"নিয়ে যখন যাবে বলছ,যাও। কাজ করে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। একটা ছেলে আমার কাছে থাক।" সেই বাড়ি ছাড়া চয়নের। অভাবকে মুছে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে নিখিলেশের সাথে চলে গিয়েছিল কলকাতা। প্রথমে ও কাজ পায় ব্যারাকপুরের এক কারখানায় সামান্য বেতনের শ্রমিক হয়ে। তারপর নিজের চেষ্টায় আস্তে আস্তে উন্নতি। ভাল উন্নতি। কলকাতায় নিজস্ব ব্যবসা তৈরি করা। আহিরীটোলার মতো জায়গায় জমি কিনে বাড়ি করা। কী করেনি চয়ন! সেই ছোট ভাইটা আজ হাসপাতালে ভর্তি। কোমায় চলে গেছে। ডাক্তার বাহাত্তর ঘন্টার ঝুঁকির কথা শুনিয়েছে।

     যেতে যেতে রাজীব অয়নকে বলল,"মিলিটাকে তো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতে দাদা। কাকুকে একবার দেখে আসত। সেই তো ঘরে থাকবে একা একা।"

     মিলির প্রসঙ্গ উঠলেই আঘাতটা বুকে এসে এখনও লাগে অয়নের। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারেন না তিনি। সংসারটা কেমন করে যেন ভেঙেচুরে গেল ওর। অথচ সম্বন্ধ করে সুপাত্র দেখেই বিয়ে দিয়েছিলেন। সরকারি চাকরি করা জামাই সুমনের মুখোশটা খুলে গেছে বিয়ের বছর তিনেকের মাথায়। এক বছরের মেয়েকে নিয়ে মিলি বাপের বাড়িতে চলে এল। ডিভোর্স হয়ে গেল ওদের। ঐ একমাত্র ময়ে অয়নের। কোনও ছেলে নেই। সারাক্ষণ শুধু মেয়ের জন্যই চিন্তা হয় সুমিত্রার। কী হবে মিলির! শহরে এসব হামেশাই ঘটে। প্রায় প্রতি বাড়িতে বাড়িতেই ডিভোর্সী মেয়ে। গ্রামে যে পাঁচজন পাঁচকথা বলে! লেখাপড়াও বেশিদূর শেখেনি। উচ্চমাধ্যমিক পাশ। আজকাল ঐটুকুনি যোগ্যতার  দাম কেউ দেয় নাকি?

      "ওকে বলেছিলাম। যেতে চাইল না। এতদূর রাস্তা। মেয়েটাও তো ছোট। থাক। বাড়িতেই থাক। বাড়িতেও তো একজনকে থাকতে হয়।"

চশমা খুলে চোখদুটো মুছলেন অয়ন। মেয়ের পর একটা ছেলে খুব দরকার ছিল তাঁর। অন্তত দিদিটাকে দেখার জন্য। ভাগ্য যে কীভাবে তৈরি হয় এক একজনের!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments