জ্বলদর্চি

খপ্পর-৩ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস : খপ্পর 
পর্ব : তিন 
অনিন্দ্য পাল 

চিত্র- জাহ্নবী সেন


মাস ছয়েক আগে রিটায়ারমেন্টের ঠিক পরেই বৈদুর্য নিউইয়র্কে সেটল হল। কিছু বলার ছিলনা বিজয়ার। তিনি সৌমেনকে যেতে দেননি। ইউ এস এ - তে সৌমেনের মাইনে হত মাসিক সাত লাখের মত। কিন্তু বিজয়া তখন নিজের বাবা মাকে ফেলে চলে যেতে পারেন নি। বাবা সেরিব্রাল পেশেন্ট, মা অ্যালঝাইমার্স এর রুগী। দাদা অকৃতদার, তার নাগাল পাওয়া যায় না। বছরে মাসখানেক বাড়ি থাকেন কি না ঠিক বলা যায় না। কী করেন, কোথায় থাকেন, এমনকি আদৌ বেঁচে থাকেন কিনা কেউ বলতে পারে না। বিজয়া এই নাচার মানুষ দুটোকে ইচ্ছাকৃত মেরে ফেলতে পারেননি। আর সৌমেনকে ছেড়ে থাকবেন, সেটাও ভাবতে পারেননি। 
সৌমেন সমস্ত জীবন এমন কি, মারা যাবার ঠিক আগের রাতেও বিজয়াকে বিঁধেছিলেন, "রঞ্জন এক কোটির ফ্ল্যাট নিচ্ছে, ফোন করেছিল আজ। আমাকে একটু খোঁজ নিতে বললো। ওরা ফিরছে আগামী পুজোয়। তুমি না আটকালে আজ আমাদেরও এই বিপজ্জনক বাড়িতে পড়ে থাকতে হতনা। মাঝে মাঝে বড্ড হতাশ লাগে। এই রাজ্যে পড়ে থেকে কিছুই হলনা আমার।" 
বৈদুর্য মাকে নিয়ে গেলেও ফেরত আসতে হয়েছিল বিজয়াকে। ওখানে থাকার অনুমতি মেলেনি।  বিজয়া এখানকার পুরো পাট চুকিয়ে দিয়েছিলেন। বাড়িটা বিক্রি করে পাকাপাকি ভাবে আমেরিকায় থাকার জন্যই বেরিয়েছিলেন। ফলে ফেরত আসার পর পড়লেন মহা ফাঁপরে। বৈদূর্য নিউইয়র্কে বসে ওর এক বন্ধুকে দিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কেনার ব্যবস্থা করে। মাস দুয়েক হল বিজয়া একা হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে দুরসম্পর্কের এক আত্মীয় তপু আসে। বিজয়াই ডাকেন তাকে। একটু সান্নিধ্য যেন এই অবসর জীবনের একান্ত শ্বাসবায়ু। 
ফ্ল্যাটের দরজায় চাবিটা ঢোকাতে ঢোকাতে বিজয়া একটু থমকালেন। ধপ করে একটা আওয়াজ হল যেন। একটু কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন। নাহ্, আর কিছু শোনা গেল না। ততক্ষণে দরজাটা খুলে গেলো। বিজয়ার নতুন ঠিকানা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকলেন বিজয়া। জানালা দরজা বন্ধ ঘরের ভিতর থেকেও যেন একটা একাকীত্ব প্রতিদীর্ঘশ্বাস ফেলে জানান দিল, সে বহাল তবিয়তে আছে। 
চার#
===== 
তপু ট্রেন থেকে যখন নামলো, তার মোবাইলের স্ক্রিনে তখন এগারোটা পাঁচ। স্টেশন রোড প্রায় সুনসান। শুধু প্লাটফর্মের পিছনে পলিথিনের গুমটিতে ভরা জনা আষ্টেক চোলাইখোর মাতলামি করছে। খিস্তি চলছে বৃষ্টির মত। 
        এখান থেকে বাড়ি যেতে হেঁটে মিনিট পাঁচেক লাগবে। কিন্তু তপু একটা অন্য কিছু ভাবছিল, তাই খেয়াল করলো না, দু'টো লোক অন্ধকারে মিশে তার পিছু নিল। ঠিক যেখান থেকে স্টেশন রোড হয়ে তপু বাড়ির গলির রাস্তায় ঢুকলো, সেখানেই একটা দোকানের আড়াল থেকে বের হয়ে লোকদুটো বেশ কিছুটা রাস্তা তপুর পিছন পিছন গিয়ে, যেমন অন্ধকার ফুঁড়ে এসেছিল, হঠাৎ তেমনি অন্ধকারে মিশে গেল। 
-কি রে? এত রাত করে বাড়ি ফিরছিস তপু? কোথাও পরীক্ষা দিতে গেছিলি নাকি? 
চমকে উঠলো তপু। খুড়ো। অশোক হালদার, এককালে বাম রাজনীতি করেছেন, এখন নতুন শাসক দলের নেতা। লোকে বলে, গোটা দশেক ভেড়ির দখল বজায় রাখতে লোকটা সব সময় ক্ষমতার পা চাটে। এমনিতে খুব একটা খারাপ মানুষ নয়। পাড়ার মানুষের খোঁজ খবর রাখে, বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায়। সাবাই খুড়ো বলেই ডাকে। বয়স ষাটের কোটায় হবে।
- না গো খুড়ো। এই একটু ... বলতে গিয়েও বললো না। এখুনি অনেক প্রশ্ন আসবে? কেন? কী কাজ? একা একা অতদূর? ভাই সঙ্গে যায়নি কেন? 
সামলে নিয়ে বললো, বন্ধুরা একটা পিকনিক করলো...
- ও, আচ্ছা আয়, তোর মা চিন্তা করছে। 
- হ্যাঁ আসছি, খুড়ো। 
খুড়োকে পেরিয়ে চলে এসে খেয়াল করে, সমস্ত রাস্তাটাই অন্ধকার। আগেকার অ্যালুমিনিয়াম তার গুলো বদলে ইনসুলেটেড তার দেওয়ার পর থেকে গ্রামের কোন রাস্তায় আর আলো নেই। এমনিতেই অনেক লোকের রাতে আলো থাকলে অসুবিধা হয়, আগে তো এমনও হয়েছে, ঢিল মেরে বিশেষ কোন পোষ্টের ল্যাম্প ভেঙে দিয়েছে। তাদের এখন পোয়াবারো। এতক্ষণ ভিতরে তাণ্ডব করা চিন্তাটা একটু শান্ত হয়ে এসেছে। 
বাড়ির সামনে এসে গেটে আওয়াজ করলো তপু। জানে কি হতে পারে। মিনিট দশেক ধরে মায়ের বাজখাই বকুনি শুনতে হবে, তারপর সেই জল দেওয়া দুপুরের ভাত, সঙ্গে খানিকটা আলুসেদ্ধ আর খুব ভাগ্য ভালো হলে কিছু একটা ভাজা। একদম ভালো লাগে না তপুর। মাঝে মাঝে খায়ও না। চপ মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে। 
দীপু তালা খুলতে এল। অবাক হল তপু। 
-তুই? মা কোথায়? 
- শরীর খারাপ। বমি করেছে দু'বার। শুয়ে আছে। তোর কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই তপু! 
- মানে? এই তুই পাকামো করছিস কেন? 
- না, তোর চোখ দুটো খোলা আছে কিনা তাই দেখার চেষ্টা করছি। তালাটা দিয়ে আয়। 
দীপু উঠে বারান্দার আলোটা জ্বেলে দিয়ে, নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। 
তপু বুঝতে পারলো তার কান দু'টো গরম হয়ে গেছে। 
ঘরে ঢুকে দেখলো উমা বিছানায় এক পাশ ফিরে শুয়ে আছেন, কোন শব্দ নেই। ঘরের নীল জিরো পাওয়ারের আলোতে খানিকটা রহস্যময় মনে হয়, মাকে সব সময়  বুঝতে পারে না তপু। 
- মা, ও মা 
কোন সাড়া নেই। 
তপু আবার ডাকলো, উমা কোন সাড়া দিলেন না।
কয়েক সেকেন্ড পর তপু শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল। আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে এল বারান্দায়। 
আজ রাতে উমা যে আর খাবেন না, সেটা তপু বুঝে গেছে। কলতলায় বালতিতে জল ভরে গা ধুয়ে যখন ঘরে এল, দীপুর ঘর থেকে মোবাইলে গানের হাল্কা আওয়াজ আসছে। উমা বারান্দায় একটা থালায় কয়েকটা লুচি আর বাটিতে খানিকটা মাংসের তরকারি বেড়ে দিয়েছেন। 
তপু অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো। কিছুই তার মাথায় ঢুকলো না। 
- ভাইটার আজ জন্মদিন ছিল, ভুলেই গেছিস না। 
উমার গলার রাগ আর শ্লেষ তপুকে হঠাৎ আজকের তারিখটা মনে করিয়ে দিল। 
কয়েক মুহুর্ত চুপচাপ হতভম্ব হয়ে থেকে ধপ করে বসে পড়লো তপু। নিজের গলা নিজের হাতেই টিপে দিতে ইচ্ছা করলো তার। 
বারোটা তেত্রিশ। তপু মায়ের পাশে এসে আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লো। পাড়ার বাকি মানুষদের ঘন্টা তিনেক ঘুম হয়ে গেছে। এখানে এখনও সন্ধ্যা হলেই খেয়েদেয়ে 
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়াই নিয়ম। ভোর থেকে তাই শুরু হয়ে যায় মানুষের কিচিরমিচির। তপু ঠিক উল্টো। আর তার জন্যই তাদের বাড়িতে যখন খাওয়া হয় তখন অন্যদের একঘুম হয়ে যায়। উমা অনেক চেঁচামেচি করলেও এসব বদলায় নি। এখন এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। 
মা কি ঘুমিয়েছে? তপু যতদূর তার মাকে চেনে, আজ আর তার মায়ের ঘুম হবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকবে ভোর অব্দি। 
এই সব ডামাডোলে তপুর চিন্তাটা কোথায় গায়েব হয়ে  ছিল এতক্ষণ, কিন্তু শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই সেটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। 
আজই প্রথম বিজু পিসির ফ্ল্যাটে সারাদিন কাটালো। পিসি গতকাল বরাভূম গেছেন। দিন পাঁচেক থাকবেন। অযোধ্যা পাহাড় ঘুরে ফিরবেন।  নিউইয়র্কে ছেলের কাছে যেতে এখনও মাস ছয়েক বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে, ততদিন এভাবেই এদেশে একা একা থাকতে হবে। মাঝে মধ্যে তপু যখন যায়, খুশী হন। খাদ্যরসিক মানুষ, বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে আর খাওয়াতে ভালবাসেন। তপুও রান্নায় হাত দেয়। অসম্ভব সুন্দরী এই মহিলা এই বাসট্টি বছর বয়সেও অনায়াসে পুরুষের চোখ চমকে দিতে পারেন।
               তপু ফিজিওথেরাপির সার্টিফিকেট কোর্স করেছিল। একটা সেন্টারের হয়ে কাজও করে। বিজয়া যেদিন কথায় কথায় সেটা জানতে পারেন, তপুকে দিয়ে সেদিনই বিজয়া বুক পিঠ ম্যাসেজ করিয়ে নিয়ে ছিলেন। অলিভ অয়েল দিয়ে মালিশ করতে করতে তপু দেখেছে বিজয়ার সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্য। ভগবান যেন ধবধবে মার্বেল কেটে নিজের হাতে অনন্ত সময় ধরে তৈরি করেছেন এক অমানবিক সৌন্দর্য। মানুষের শরীর এত সুন্দর হতে পারে! এত নরম কি করে হয় মানুষ? একটা মৃদু কিন্তু সুন্দর গন্ধ পেয়েছিল তপু, বিজয়ার শরীর থেকে। 
     বিজয়া তাকে পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন। অবশ্যই জোর করে। যেমন আজকে সে সোমকে জোর করেছে। বেশ কয়েক দিন ধরেই করছে। সোম কিছুতেই রাজি ছিলনা। একটু ক্যালানে ক্যাবলা টাইপের মেধাবী ছেলে। পড়াশুনার বাইরে তেমন কিছু করেও না জানেও না। তাকেই তপু আজ রাস্তায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু সেটাই বড় চিন্তার। সোম ফেরার সময় সমস্ত রাস্তাটা একটাও কথা বলে নি। যাদবপুরে ট্রেন থেকে নামার সময় শুধু 'বাই' আর হাত নাড়া ছাড়া পাথরের মত চুপচাপ ছিল পুরো ট্রেনটা। জানা জানি করবে না তো কিছু? কে জানে! কাল সকালেই আবার বগলদাবা করতে হবে ওটাকে। একটার ঘন্টা বাজলো। পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়িতে। তপু দুশো থেকে   উল্টো গোনা শুরু করলো, যদি ঘুম আসে!
পাশ ফেরেন উমা। তপু অবাক হয়ে দেখে উমার চোখে  জল। মাকে কাঁদতে খুব কমই দেখেছে। ছোটবেলায়, বাবার সঙ্গে অশান্তি হলে কখনো কেঁদেছে, তপু, দীপুর  সামনে নিজেকে আবার সামলে নিয়েছে। এমনকি যখন বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে তখনও না, পাথরের মত শক্ত হয়ে ছিলেন। একা হাতে সামলেছেন সব। সংসার, ছেলে মেয়ের পড়াশুনা, দিনের পর দিন লড়াই করে গেছেন। এক অসম লড়াই। চল্লিশ বছরের উমা যেদিন প্রথম আয়ার ডিউটি নিয়ে কাজে গেলেন, সে দিন ছিল কালিপুজো। উমা কাঁদেননি , দীপু খুব কাঁদছিল।

 তপুকেও কাঁদতে দেয়নি উমা। ভাইকে সামলাতে হবে তো। সে রাতে ওরা কেউ বাজি পোড়ায়নি। ঘরে দরজা দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, নিজেরাই বুঝতে পারে নি। সকালে উঠে আগের রাতের লুচি আর আলুর দম খেয়েছিল। উমা করে গেছিলেন। উমা বাড়ি ফিরে সেদিন কেঁদেছিলেন। কলতলায়। তপু দূর থেকে বুঝতে পেরেছিল। সেও কেঁদেছিল। দীপু এসব জানে না। ওই বয়সে তার বোঝারও কথা নয়। তপু একদিনেই দীপুর অভিভাবক হয়ে উঠেছিল, নিজের ও। এখনও তেমনই আছে। উমা দীপুকে তপুর হাতে দিয়ে সুস্থ আছেন, শারিরীক এবং মানসিক উভয় দিকেই। নিজেকে এখনো রোজ আগামী কালের লড়াই এর জন্য তৈরি করেন। আজ ও তেমনটাই ছিলেন কিন্তু তপুর বেপরোয়া হয়ে ওঠা তার পাথুরে খোলসটাকে ছিঁড়ে দিয়েছে। ভেবেছিলেন কিছু বলবেন, অন্তত কয়েকটা সাবধানবানী, কিন্তু কিছুই বললেন না। আবার অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। 
তপুও মায়ের এই ভেঙে পড়া আটকানোর চেষ্টা করলো না, সে জানে মরুভূমিতে বৃষ্টি নামলে সেটা থামাতে নেই, তাতে প্রকৃতি রাগ করে। সেও আবার উল্টো গোনা শুরু করলো। রাত একই গতিতে চলতে লাগলো।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments