জ্বলদর্চি

খপ্পর-৫ (উপন্যাস) /(উৎসব ১৪২৮) অনিন্দ্য পাল

উপন্যাস: খপ্পর 
পর্ব: পাঁচ 
লেখক: অনিন্দ্য পাল 
চিত্র- জাহ্নবী সেন



#ছয়
গাড়িটা রাতের বাইপাস ধরে তীব্র গতিতে ছুটছে। ব্যানা এরকম গাড়িতে বসেনি কখনো। দু-একবার বাস চড়েছে, একবার অটো। গাড়িটা বাইপাস হয়ে বারুইপুর এর দিকে যাচ্ছে। ব্যানা প্রথমে দেখেনি, এবার দেখলো, পিছনের সিটে কেউ একজন বসে আছে। অস্পষ্ট নীল আলোয় তাকে ঠিক চিনতে পারলো না। পিছনে মুখটা ঘুরিয়ে আর একবার দেখার চেষ্টা করতেই একটা নরম, উষ্ণ শরীরের মধ্যে আটকে গেল। জৈসা তাকে নিজের ভিতরে নিয়ে যেতে চাইছেন, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছেন বুকে, ধবধবে মসৃণ হাতের গতি প্রতিমুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। লম্বা নখ দিয়ে ঢাকা আঙুলগুলো ব্যানার বারমুডার আড়ালে প্রচন্ড খিদেয় পাগলের মতো আঁকড়ে ধরেছে কিছু। ব্যানা একবার ছটকে ছিটকে বেরোতে চাইলো সেই মাংসের বাঁধন থেকে, কিন্তু তার মুখটা জৈসার বুকের ঠিক মাঝখানে, জৈসার বামহাতের চাপে আর একটা অদ্ভুত গন্ধে ব্যানা কেমন একটা হয়ে গেল। থাক-থাক মাংসের বিছানায় যেন ডুবে যেতে লাগলো ব্যানা। কি ঘটছে, কি হতে চলেছে সে সব বুঝতে না পারলেও বছর চোদ্দর শরীরে অন্য একটা কিছু ঘটে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছিল। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসছিল ব্যানার। জৈসার বুকের মধ্যে তখন শ্বাস নেবার জন্য ছটফট করে উঠছিল। জৈসা তাকে ঠিক একটা পুতুলের মত দুহাতে ধরে নিজের সমস্ত ঘর বারান্দা ঘুরিয়ে আনছিলেন। মাঝে মাঝে বমি পাচ্ছিল ব্যানার। 
         আসার আগে রাসু তাকে বার বার বেশী কথা বলতে আর কোনো কাজে না করতে বারণ করেছে। ব্যানা রাসুর কথা শোনে। রাসু বাবাবাছা না করলেও ব্যানা বোঝে, রাসু তাকে শুধু কর্মচারী হিসেবে দেখে না। কিন্তু তাই বলে আদর আহ্লাদে গলেও যায় না, খেয়াল রাখে। সকালের টিফিনটা গালে তুলে দেয়। রুটির ভিতরে আলু চচ্চড়ি দিয়ে সেটাকে পাকিয়ে ঠেসে দিতে থাকে ব্যানার মুখে, ব্যানা বাসন মাজতে মাজতে চিবোয়। 
     সবিতার কথা মনে পড়ে না। সে কখনো ও ভাবে খাওয়ায় নি। খাবারই তো থাকতো না সকালে। কোনো কোনো দিন একশো গ্রাম মুড়ি আর পেঁয়াজ জুটতো, রঘু একাই তার বেশিটা খেয়ে নিতো। আর চম্পা আসার পর সকালে খাওয়া তো জুটতোই না, বেশিরভাগ দিন দুপুরের খাওয়াও আধপেটা। তরকারি থাকতো না, চম্পা তার ভাতে নুন আর সর্ষের তেল দিয়ে দিত। 
কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানে না ব্যানা। তার গা হাত পা শরীর সব জৈসা লেপ্টে নিয়েছিলেন, সেখান থেকে হঠাৎ ছাড়া পেয়ে কি করবে বুঝতে পারছিল না সে। গাড়িটা তখনই থামলো। একটা বাড়ি। অনেকটা ছোট বাংলোর মত। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। গাড়ির আলোতে বাড়ির গেটের বর্শাফলক গুলো চকচক করে উঠলো। ব্যানা বুঝতে পারে না, এটা ঠিক কোথায়? রাসু বলেছিল, জৈসার ফ্লাটে কাজ আছে! কিন্তু এটা কি ফ্লাট? এতো গ্রামের মত মনে হচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা, আর কোন বাড়ি ঘর চোখেও পড়ছে না আশপাশে। গাড়িটার হেডলাইটের আলোতে বাড়িটার ভিতরে অনেক গাছপালা দেখা যাচ্ছে। চারদিকে কোন শব্দ নেই। হঠাৎ হর্ণের শব্দে একটা পাখি উড়ে পালালো পাশের গাছ থেকে। জৈসা পায়ের নিচে জড়ো হয়ে থাকা শাড়িটা তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলেন। কোন অন্তর্বাস ছিল না শরীরে। 
             কেউ একজন গেটটা খুলে দিল। গাড়ি থেকে নেমে জৈসা ব্যানাকে নামালেন, একটু জোর করেই। ব্যানা এতক্ষণ যে ঘোরের মধ্যে ছিল, সেটা কেটে গেলেও ওর সামনে এখনো সবটাই ঘোর। এ কোথায় নিয়ে এলেন জৈসা তাকে? এতক্ষণ তার সঙ্গে কী হচ্ছিল? ছোটবেলায় ঘুমের ঘোরে দু-একবার বাবা-মা কে দেখেছে এরকম করতে। আর পিছনে বসে ছিল, ওটা কে? মাঝে মাঝে গলা খেঁকারির আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ পাওয়া যায়নি । পিছনের মানুষটা পুরুষ না মহিলা, এমনকি জেগে আছে না ঘুমিয়ে, সেটাও সে বুঝতে পারে নি। অবশ্য বোঝবার মত সুযোগও সে পায়নি। এসবের কিছুই তার বুদ্ধিতে কুলোচ্ছিল না। 
        তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে জৈসা পিছনের দরজা খুলে সেই মানুষটিকে নামালেন। একটু বয়স্ক আর ঠিকঠাক হাঁটাচলা করতে পারেন না, অন্তত ব্যানার তো তেমনি মনে হল। তবে তিনি পুরুষ না মহিলা বোঝার আগেই জৈসা তাকে নিয়ে এগিয়ে ঢুকলেন বাড়ির মধ্যে। সাজানো গোছানো ছিমছাম বাড়ি। একতলা। ঢুকেই প্রথমে বিরাট ড্রয়িং কাম ডাইনিং। মাঝবয়েসি এক মহিলা একধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জৈসা তার কাছে ব্যানাকে দিয়ে বললেন :
-- রেডি কর। গরমজল আর বডিওয়াস নিবি। আধাঘন্টা। 
মহিলা মাথা নাড়লেন। তারপর শক্ত করে ধরলেন ব্যানার একটা হাত। এতক্ষণ পর যেন ব্যানা কিছুটা বোধবুদ্ধি পেল। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল, এবার বুঝতে পারলো। 
-- জল খাবো!
 গলার ভিতরে যেন কিছু আটকে গেছে। তার শব্দ আটকে গেল, কাটাকাটা, ছেঁড়াছেঁড়া খানিকটা স্বর বের হয়ে এল গলা থেকে। 
-- জল খাবো, খুব তেষ্টা লেগেছে। 
এবার হয়েছে। নিজের কথা গুলো নিজে শুনতে পেয়ে একটু স্বস্তি পেল ব্যানা। 
-- চান করে এসে। 
সেই মহিলা যে ভাবে শব্দ গুলো উচ্চারণ করলো, ব্যানা আজ পর্যন্ত তেমন ভাবে কাউকে কথা বলতে শোনেনি। প্রায় টানতে টানতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। 
-বাপরে! 
একটা চমক ব্যানার জন্য। 
--এটা চান করার জায়গা! 
এরকম বাথরুম কখনো দেখেনি ব্যানা। বাড়িতে, বস্তির কমন পায়খানা, আরো ছোট বেলায় খাটা পায়খানা, যেটাতে বসে নিচে তাকালেই তার মনে হত ওই পোকা গুলো কী সবার গু এর সঙ্গে পড়ে? আর কর্পোরেশনের টাইমের জলে চান। তারপর দোকানের পাশে চাঁচের বেড়া আর  ইট পাতা, ট্যাঙ্কের জলটা অবশ্য ছিল। কিন্তু এরকম পাথর দেওয়া মেঝে, টালির দেওয়াল, আরো সব কতরকমের চকচকে জিনিস, এসব সে কখনো চোখেই দেখেনি। 
-- খোল। 
চমকে উঠলো ব্যানা। 
-খোল! 
এবার স্বরটা একটু নরম করে বললো মহিলা। 
ব্যানা বুঝতে পারে না, কী খুলতে বলছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পর সেই মহিলার বললো, 
--- জামা, প্যান্ট সব কিছু খোল। 
মহিলার মুখে ছোট্ট একটু হাসি। 
অন্য সময় হলে ব্যানা খুলতে এত সময় নিত না। এসব তার ভিতরে কোন লজ্জা ফোটায় না। কিন্তু এখন, এই  অচেনা অজানা মহিলার সামনে, চকচকে ঝকঝকে বাথরুমে, এত উজ্জ্বল আলোয় কেমন একটা দ্বিধাগ্রস্ত হল। উপরের গেঞ্জিটা খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, মাথাটা নিচু করে। সেই মহিলা তখন ওর মুখটা দু'আঙুলে তুলে ধরে নিঃশব্দে মিষ্টি করে হাসলো :
-- নাম কি? আর তো লজ্জা করে লাভ নেই। এখানে এসে পড়েছো যখন, ওসব ভুলে যাও। তাতেই ভালো তোমার। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে নাও। তারপর খেয়ে নিয়ে শুরু হবে...
একদম ফিসফিস শব্দে কথা গুলো বলে একটানে ব্যানার বারমুডা খুলে দিল সেই মহিলা। 
-- ভিমি, জাদা বক্ত নেহি হ্যায়। উসে জলদি রেডি করো। 
বাথরুমের বাইরে জৈসার গলা। এরকম কর্কশ স্বরে জৈসাকে কখনো কথা বলতে শোনে নি ব্যানা। 
  খেয়ে খুব আনন্দ হল ব্যানার। খাসির মাংস আর সরু চালের ভাত। এসব জোটে না তার। এর আগে কবে খাসির মাংস খেয়েছে মনে পড়ে না তার। খাওয়ার পর ভিমি যখন তাকে নিয়ে উপরের ঘরে গেল, সেখানে জৈসা আগে থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন। 

ব্যানাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে চলে গেল ভিমি। ঘরটা আবছা নীল আলোয় রহস্যময়, যদিও ব্যানা রহস্য বোঝে না। বিরাট একটা খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিলেন জৈসা। ব্যানাকে হাত নেড়ে ডাকলেন কাছে। ব্যানা ইতস্ততঃ করছে বুঝতে পেরে ইশারা করলেন কাউকে। একজোড়া সবল হাত তখনি ব্যানাকে টেনে জৈসার কাছে পৌঁছে দিল। জৈসার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল ব্যানা। সম্পূর্ণ  শরীরে কোথাও এতটুকু পোষাক নেই তার। ব্যানার হঠাৎ গাড়ির ঘটনাটা মনে পড়েই কেমন গুলিয়ে উঠলো শরীরটা। জৈসা ততক্ষণে এক হাতে তার ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে। অন্য হাতে একটা গ্লাস, তাতে একটা সোনালী তরল। ব্যানা দেখতে পেল না, আরো কয়েকটা শরীর আবছা অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে বিছানার দিকে। ঘরের এক কোণে ততক্ষণে চালু হয়ে গেছে বিদেশী ক্যামেরা।


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments