উপন্যাস
ছায়া ছায়া অন্ধকার
শিশির পাল
অলংকরণ : সায়নী পাল
পর্ব: ০৫
কলেজের পড়াশুনো শেষ করে চন্দ্রপুর স্কুলেই শিক্ষকতার চাকরি পেলাম। আকাশ ডাক্তারি পড়া শেষ করে নর্থ বেঙ্গলে, শিলিগুড়ির হাসপাতালে চাকরিতে জয়েন করল। শেষ পর্যন্ত এই কুসুমপুর গ্রামেই থেকে গেলাম আমি। শান্তি আশ্রম, আনন্দমেলা, চন্দ্রপুর স্কুল,কুসুমপুর, মুকুন্দনগর,আনন্দপুর, কাঁসাই, লক্ষ্মী ঝর্ণা এই নিয়েই আমার এক স্থায়ী পরিধি তৈরি হয়ে গেল। বাকি বন্ধু যারা আছে, বিমান, মলয়, কমল, অসীম সবাই এখন শান্তি আশ্রমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকল।
স্বরূপানন্দজি একদিন আমাদের সবাইকে ডাকলেন। অনেক বড় কিছুর পরিকল্পনা ওঁর মাথায়।
'তোমরা এই অঞ্চলের উন্নয়ন সম্পর্কে কী ভাবছ?'
সবাই একে অন্যকে দেখি। মলয় রুলিং পার্টির এলসিএস।বিমান পঞ্চায়েত প্রধান। অসীমও পার্টির সঙ্গেই থাকে। আমি বললাম, 'আপনি কী বলতে চান সাধুবাবা? আমরা তো সমাজের কাজের মধ্যেই আছি। আপনি চাইলে আরও কিছু এক্সট্রা কাজ করতে পারি।'
বছর দুই আগেই মাত্র এই বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর। শোষিত, নিপীড়িত, নিঃস্বদের পাশে দাঁড়ানোর পার্টি। এলাকার সব মানুষের তো দুবেলা খাবারও নেই। মজুর কাজ করে এত কম মজুরি পায় যে, দিন চলে না।তার ওপর আছে জমিদারদের আধিপত্য। শিবনারায়ণবাবুদের মতো লোকেরা জমি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে, নিজেদের পরিবারের সবার নামে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে সব জমি। কিন্তু আভিজাত্য খর্ব হয়নি। এই সমাজ বদলের , সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আমাদের চোখে।
স্বরূপানন্দজি ভেবে বললেন, 'আসলে আমি ভাবছিলাম একটা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র খুলব শান্তি আশ্রমে। সরকার থেকে তো বয়স্ক শিক্ষার ওপর জোর আছেই, তাই সরকারের সাপোর্ট আমরা পাব। শুধু শিক্ষকের কাজটা তোমরা যদি করে দাও। পালা করে। এলাকার বয়স্ক মানুষ যদি নিজের নামটাও স্বাক্ষর করতে শেখে, সেটাই হবে আমাদের জয়।'
মলয় বলল, 'বাহ্। উত্তম প্রস্তাব সাধুবাবা। এমন কাজে আমার মনে হয় না কেউ গররাজি হবে।'
মলয়কে অন্যরা সমর্থন করল।
সাধুবাবা আবার বললেন, 'সমস্যা তো মিটেই গেল। আমারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা শুরু করব। আমার আর একটা ইচ্ছে আছে। এই আশ্রমের জঙ্গলে যে ছোট্ট চিড়িয়াখানাটা বানিয়েছি, যেখানে হরিণ আছে, ময়ূর আছে; এর সঙ্গে যদি আরও কিছু পশু পাখি রাখা যায়।'
অসীম বলল, 'আপনি তো সবকিছুই ভালোর জন্য বলছেন সাধুবাবা। সুতরাং এখানে আমাদের দ্বিমত নেই। আমার তো নেই। অন্যদেরও আশাকরি নেই।'
আমরা সবাই একবাক্যে বললাম। 'আমরা সবাই সহমত।'
'আমরা বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালাব। চিড়িয়াখানাটাও সাজাব। আর অবশ্যই আমাদের সাধের নাটকের দলটা বানাবো।' আমি বললাম।
সাধুবাবা হাসতে হাসতে তাঁর ডান হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন।
আশ্রমের দিনকাল খুব ভালোই চলতে লাগল। নাটকের দল যেমন বানালাম, তেমনই এলাকার ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে বানানো হল ফুটবল টিম। আসলে এই নাটকের দল, ফুটবল টিম সবাই মিলে এলাকার সাংস্কৃতিক চিত্রটাকেই পাল্টে দিতে চাইলাম। স্বরূপানন্দজি দারুণ খুশি। ততোধিক তার আগ্রহ।নতুন কিছু করার। এলাকার লোকের ভালো করার।
এরই মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। শিলিগুড়ি থেকে আমাকে চিঠি লিখল আকাশ। ওর সঙ্গে যেটুকু কথা হয়, চিঠিতেই। শহরে গেলে ওকে টেলিফোন করি। তাছাড়া বাকিটা চিঠিতেই। ও খোঁজ নেয় এখানকার মানুষজনের। শান্তি আশ্রমের। আমাদের সবার। এবারের চিঠিটা হঠাৎ করেই এল।
কেশব,
ভালো আছিস আশা করি। আমিও ভালো আছি। একটা খুব
বড় ঘটনা ঘটেছে কয়েকদিন হল। সেটা জানানোর জন্যই আজকেই এই চিঠি।
এই হাসপাতালে আমার তো খুব বেশিদিন হয়নি। একদিন হঠাৎ করে এক মহিলাকে চিকিৎসার জন্য আউটডোরে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল ওর বাড়ির লোকজন। বাইরের থেকে আপাতভাবে সুস্থির। কথা বলে জানতে পারলাম ও মেন্টালি ইল। আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। কেস স্টাডি করব বলে। তুই তো জানিস সাইকিয়াট্রি আমার স্পেশালাইজেশন।
যেহেতু আরও অনেক সমস্যা ছিল, তাই হাসপাতালে ভর্তি করলাম। সকাল সন্ধে আমি আসি। রোজ। দেখে যাই। আস্তে আস্তে ও ভালো হতে শুরু করল। একদিন আমাকে বলল, 'ডাক্তারবাবু। আমার কাছে একটু বসতে হবে আপনাকে। আমার কথা শুনতে হবে।' ক'দিন আগেও যে পেশেন্ট বেশ অসুস্থ ছিল, সে যখন এতটা ভালো রেসপন্স করছে, আমার ভেবেই খুব ভালো লাগল। আমি হেসে বললাম, 'নিশ্চয়ই। বসছি আমি।' বেডের পাশ থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আমি বললাম। আমাকে কাছে পেয়ে যেন বড় অবলম্বন পেল। তার অভিব্যক্তি সেরকমই ইঙ্গিত করল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'আমি তো ভালো হয়ে গেছি। এবার আমার ছুটি লিখে দিন। বাড়ি যাব।'
'বাহ্। আপনি পুরোপুরি সুস্থ বোধ করছেন তো? তাহলে ছেড়ে দেব কালকেই।'
'হ্যাঁ। আমি কালই যেতে চাই। কিন্তু আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল।'
'বলুন। আমি শুনেছি।'
এদিক ওদিক একবার দেখে নিল। অন্য কেউ যাতে শুনতে না পায়, একটু নিচু স্বরে বলল, 'আপনার জানতে ইচ্ছে করে না?আমার কেন এরকম হল?'
'বলুন। আমি তো জানি না কিছুই। জানার ইচ্ছে হয়ই।'
'সব তো এত তাড়াতাড়ি বলা যাবে না। তবে এটুকু শুনে রাখুন, আমি আমার মাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। মায়ের কষ্ট হলে আমার কষ্ট হয়। আমার মা কিছুদিন হল খুব কষ্টে আছেন। কেন, বুঝতে পারছি না। জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলেন না। আর আমি একজনকে ভালোবাসতাম। আমাদের বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর জানতে পারি আমার স্বামীর অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। আমি মেনে নিতে পারিনি। একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় বেঁচে গিয়েছিলাম। ভালোবাসতে গিয়েই তো যত আঘাত পেয়েছি! এই আঘাত সহ্য করতেও পারি না। দিন দিন যেন তলিয়ে যাচ্ছি। কোনও আশা নেই। অবলম্বন নেই। আমি তো মা'কেই দেখেছি, কীভাবে প্রথম ভালোবাসা সারা জীবনের জন্য ছায়া ফেলে যায়। মা'ও একজনকে জীবন দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। চেয়েছিলেন, তার সঙ্গেই জীবন কাটাতে। ভাগ্যের পরিহাসে তাঁকে পাননি। উপহার হিসেবে আমাকে পেয়েছিলেন । আমিও পেয়েছি, সবদিনের জন্য বাবাহীন এক জীবন। শুনেছি আমার বাবা বিজয় মহাপাত্র নাকি, সাধুসন্ত মানুষ ছিলেন। স্ত্রীও ছিল। তা সত্বেও আমার মা'কে মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে ভালোবেসেছিলেন। বলেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দেবেন আমার মা'কে। মা'ও বোকার মতো সর্বস্ব সঁপে দিয়েছিলেন। যার ফল আজীবন ভুগছেন। বাবা পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে দূরে কোথাও চলে গেছেন। আমরা অনেক সন্ধান করেও তাঁর খোঁজ পাইনি।'
কথা বলতে বলতে একটু থামল মহিলা। আমি অবাক হচ্ছি ক্রমশ। আমাকেই বা এত কথা বলছে কেন! আমি ডাক্তার বলে, নাকি আমার মধ্যে কোনও অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি ওকে এবার থামাই।
'সাধু সন্ত বলতেই মনে হল একটা কথা। আমার বাড়ির পাশে একটা খুব সুন্দর আশ্রম আছে। শান্তি আশ্রম। সেখানেও একজন সাধু থাকেন। যদি কোনোদিন সুযোগ হয় আসবেন। মনে অনেক শান্তি আসবে। আমি তো বাড়ি গেলে আশ্রমেই থাকি বেশিরভাগ সময়।'
হাসতে চেষ্টা করে মহিলা। 'যাওয়া ! আর কিছুই হবে না যে জীবনে। কোনো আশা নেই।'
আমি বলি, 'এত কথা বললেন। অথচ নামটাই বলেননি। কোথায় থাকেন আপনারা, তাও জানি না।'
'আমি অঞ্জলি। আমাদের তো ঘর বলতে তেমন কিছুই নেই। দার্জিলিং এ থাকতাম। ওখানেই আমার জন্ম। বড় হওয়া। বিয়ে। মা যেহেতু আমাকে একাই মানুষ করেছেন, তাই গুছিয়ে বাড়িঘর করতে পারেননি। সামর্থ্যও ছিল না। আমারা একটা ছোট আশ্রমে, শিলিগুড়িতেই থাকি এখন। সেভকের কাছে। একটা সুন্দর মন্দির আছে। নিত্য পুজো হয়। অনেক মানুষ ঘুরতে আসে। প্রতিদিনই। পুজো করে আর মানুষের সেবা করে দিন যায়। এখন তো আমার সংসার বলতে মা আর আমি। আক্ষরিক অর্থে সংসার তো আর হলই না!'
আক্ষেপের সুর শোনা যায় ওর গলায়। আমারও মায়া হল।আমি বললাম, 'কাল নিজের জায়গায় ফিরে যান। আমি কথা দিচ্ছি আপনাদের কাছেই আমি আসব একদিন। দেখে আসব কেমন থাকছেন আপনারা।' আমার কথায় ভরসা পেল মহিলা।
পরের দিন ওকে ছুটি দেওয়া হল। ওরা চলে যাবার পরও ওদের কাছে গেছি অনেকবার। কেন জানি না, ওর প্রতি আমার প্রবল মায়া বেড়ে গেছে। ওদের কষ্ট এখন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। জানি না আমার মতোই অঞ্জলিও একই রকম টান অনুভব করছে কি না?
আমি এখন খুব অস্থির সময় কাটাচ্ছি কেশব। তোর কথা শোনার আশায় থাকছি। জানাস।
ভালো থাকিস খুব। বড়দের প্রণাম।
অনেক ভালোবাসা তোকে।
---আকাশ।
আকাশের চিঠি পেয়ে অবাক হলেও, কিছু মতামত দিতে পারছিলাম না। ওনেক ভেবে, অবশেষে ওকে পাল্টা চিঠি লিখলাম। একটু সাবধান করে।
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
0 Comments