জ্বলদর্চি

মালয়েশিয়ার লোকগল্প /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—মালয়েশিয়া

চিন্ময় দাশ 

পরোপকারী 

এক দেশে ছিল এক বুড়ো মানুষ।
বুড়ো বললেও, ঠিকঠাক বোঝানো যায় না, মানুষটা কতটা বুড়ো। সারা দেশে এতটা বুড়ো আর কেউ ছিল না। অতি বুড়োদের মধ্যেও বুড়ো ছিল সে। সাধে কি আর লোকেরা বলত-- 'হাজার বছর বয়স হবে মানুষটার'।
যতটা বয়স বুড়োটার, ততটাই সে ভালো মানুষ। একেবারেই সহজ সরল। আর, থাকেও একেবারে সাধারণভাবে। 
আর, সত্যি বলতে, আছেই বা কী তার? থাকবার মধ্যে তো মাথা গোঁজবার মত একটা ডেরা। এই যা! এত বড় এই দুনিয়ায় ঐটুকুই তার সম্বল। কতলোকের কত কিছুই তো আছে। কেবল তারই কিছু নাই। 
সমুদ্রের একেবারে গা-লাগোয়া একটা পাহাড়। মনে হয়, যেন এইমাত্র জলে ডুব দিয়ে উঠে এল বিশাল পাহাড়টা। সেই পাহাড়ের, কোন রকমে মাথা গোঁজা যায় এমন, একটা গুহায় থাকে মানুষটা। ডেরা বলো, সম্বল বলো, ঐ গুহাটুকুই। বনের ফল আর ঝর্ণার জল-- এতেই কাটিয়ে দিল সারাটা জীবন। 
তবে, একেবারেই কিছু নাই, এটা বলা যাবে না। দুটো জিনিষ ছিল মানুষটার-- গভীর জ্ঞান, আর দেশজোড়া সুনাম। সারা দেশ জুড়ে নাম আর খ্যাতি ছিল তার। কত গভীর তার জ্ঞান, কেউ কোনদিন আঁচ করতে পারেনি। দেশ উজিয়ে মানুষ আসে বুড়োটার কাছে। সমস্যা জানিয়ে উপদেশ চায়, পরামর্শ নেয়। তার পর হাসি মুখে ঘরে ফিরে যায়।
এমনকি, কোন কোনও দিন রাজবাড়ীর রথও এসে দাঁড়ায় তার ডেরার সামনে। কোনদিন রাজার মন্ত্রী এসে নামে। কোনও দিন বা স্বয়ং রাজামশাই এসে হাজির হয় দুটি হাত জড়ো করে। সঙ্কটের কথা বলে, নিরসনের হদিশ নিয়ে, নিশ্চিন্ত মনে ফিরে যায় দরবারে। 
রাজা হোক বা সাধারণ প্রজা, কোন কিছুতেই বেজার নয় মানুষটা। যেন মানুষের উপকার করবে বলেই সে জন্মেছে দুনিয়ায়। উপকার করবে বলেই, বেঁচেও আছে এতগুলো বছর।
একদিন এক যুবক এসে হাজির হল সমুদ্রের ধারে। খুঁজে খুঁজে গুহাটার সামনে এসে হাজির হল। গড় হয়ে প্রণাম করল বুড়োকে-- প্রণাম হই, বাবা!
ভালো থেকো।-- বুড়োর ডান হাতে অভয়মুদ্রা। 
যুবকটি হাসল সে কথা শুনে-- নিজে ভালো থাকার জন্য তো আমি আসিনি, বাবা! 
সবাই আসে নিজের ভালো চাইতে। এ ছেলে বলেটা কী? অবাক হয়ে বুড়ো জানতে চাইল-- তবে কী জন্য এসেছ? 
ছেলেটা বলল-- দেশ জোড়া তোমার নাম। অনেক জ্ঞান তোমার। জানো অনেক কিছুই। আমাকে বলে দাও, কী করে আমি অন্যের ভালো করতে পারব। সারা জীবন ধরে, আমি কেবল অন্যের ভালো করে যেতে চাই।
বুড়ো অবাক। এমনটা আগে শোনেনি কারও গলায়। অবাক গলাতেই বলল-- কারণটা কী, এমন ভাবনার? 
-- একটাই তো জীবন আমার। সেটা নিজের জন্যই কেন খরচ করে যাব?
 যেমন অবাক হল, তেমনি খুশিও হল বুড়ো। মনে ভাবল, আমার তো যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। কখন ডাক পড়ে যায়, তার নাই ঠিক। এত দিনে একজন মানুষের মত মানুষ পাওয়া গেল। 
বুড়ো বলল-- ভারী ভালো লাগল তোমার কথা শুনে। এমনটা কেউ বলেনি আজ পর্যন্ত। কিন্তু কাজটা সহজ নয়।
যুবকটি বলল-- হোক না কঠিন। তুমি আমাকে বলে দাও, কী করতে হবে আমাকে। যা বলবে তুমি, আমি তাই করব। 
বুড়ো বলল-- তিনটি মাত্র কথা। প্রথম কথা, কোনও কাজে অধীর হবে না।
ছেলের জবাব-- হবে না।
--নিজের ভালো মনেও আনবে না।
-- আনব না।
-- কৌতূহলকে দমন করবে চিরকাল।
-- করব। শেষবারেও ঝটিতি জবাব ছেলেটির।
আর কিছু না বলে, গুহার ভিতরে ঢুকে গেল বুড়ো। বেরিয়ে এল যখন, হাতে একটা ছোট্ট বাক্স। বাক্সটা ছেলেটার হাতে তুলে দিয়ে বলল-- আমার জীবনের একমাত্র ধন এটি। সময় হয়ে এসেছে আমার। তাই তোমার হাতেই দিয়ে গেলাম এটা। যার গুণে, আজ থেকে অন্যের উপকারই হবে তোমার জীবনের ব্রত।
ছেলেটা তো ভারী খুশি। আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল সারা মুখে।
বুড়োমানুষটি বলল-- তবে বাছা, এটা কিন্তু যাদুবাক্স। নিজের ঘরে পৌঁছুবার আগে, কোন কারণেই এর ডালা খুলবে না তুমি। তাতে কিন্তু বিপদ হবে তোমার।
-- ঠিক আছে, বাবা। তাই হবে! আর একবার মানুষটিকে প্রণাম করে, বিদায় নিল ছেলেটি।
কিন্তু বাক্সটা হাতে নেওয়া থেকেই একটু একটু করে কৌতূহল জমতে লাগল তার মনের মধ্যে। কী জিনিস আছে এর ভিতর? কী অমূল্য সম্পদ তার হাতে তুলে দিয়েছেন জ্ঞানী মানুষটি? ঘরে পৌঁছে খুললে যদি বিপদ না হয়, পথে খুললেই বা হবে কেন? 
খানিকটা পথ এসেছে মাত্র। আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। বুড়োমানুষটিকে এইমাত্র কথা দিয়ে এসেছে, কৌতূহল চেপে রাখবে, মনেই রইল না সেকথা। ডালাটা খুলেই ফেলল সে। 
কী অবাক করা কান্ড! ডালাটাই যা খুলল সে। ভিতরে কী আছে, সেটা আর দেখাই হল না তার। চোখের পলক পড়ল না, একেবারে ঠিক যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ছেলেটাই। তরতাজা একটা যুবক ছেলে, একেবারে ভোঁ-কাট্টা। আর, নিমেষে সেখানে গজিয়ে উঠেছে বড়সড় একটা নারকেল গাছ।

সেই উঁচু থেকে যেন অপরাধীর চোখে তাকিয়ে আছে জ্ঞানী মানুষের ছোট্ট গুহাটির দিকে।
কথা না শুনে বিপদ হয়েছে ছেলেটির। চূড়ান্ত বিপদ। নিজের মানুষ জীবনটাই হারিয়ে বসেছে সে। তবে, তার মনের বাসনা কিন্তু বিফলে যায়নি। 
বুড়োর আশীর্বাদ পেয়েছিল সে। সেটা মিথ্যা হবার নয়। মনের বাসনা পূরণ হয়েছে যুবকটির। সেই কোন আদ্যিকাল থেকে, আজও মানুষের সেবা করে চলেছে সে। নারকেল গাছের ধর্মই হল মানুষের সেবা করে যাওয়া। ফলে, জলে, পাতায় নারকেল গাছ আজও জড়িয়ে আছে মানুষের জীবনের সাথে। 
এদিকে হয়েছে কী, নিজের ডেরা থেকে গাছটাকে গজিয়ে উঠতে দেখেছে বুড়ো। মুখে হালকা একটা হাসি ফুটে উঠল তার। ধীর পায়ে এসে, তুলে নিয়ে গেল বাক্সটিকে। যত্ন করে তুলে রেখে দিল গুহার ভিতরে। আবার কোন দিন এরকমই কোন মানুষ এসে হাজির হবে, কে বলতে পারে!

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments