জ্বলদর্চি

মনোভাষাবিজ্ঞান ও স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের বিচিত্র পথরেখা/(উৎসব ১৪২৮)/অসীম ভুঁইয়া

মনোভাষাবিজ্ঞান ও স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের বিচিত্র পথরেখা

অসীম ভুঁইয়া


বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রথম মনোভাষাবিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। মানুষের মন বিচিত্র। নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানবমন "ইলেকট্রিসিটি" তৈরি করে। আর এই মনের বিচিত্র ভাব যেহেতু ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়, তাই মানব মনের সঙ্গে মানব ভাষার সম্পর্ক নিবিড়। মনোভাষাবিজ্ঞান এই সম্পর্ক নিয়েই আলোচনা করে। ভাষাবিজ্ঞানী এইচসন এ প্রসঙ্গে তিনটি ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করেছেন:

i. শিশুর ভাষা অর্জন দক্ষতা ও সমস্যা।
 ii. ভাষাজ্ঞান ও ভাষার প্রয়োগ সংযোগ।
iii. ভাষা বা বাচন উপাদান ও উপলব্ধি।
 
  আবার এই তিনটি ক্ষেত্রকে মাথায় রেখে ভাষাবিজ্ঞানী স্কোবেল ভাষা ও মনন বিষয়ে  চারটি মৌলিক প্রশ্নের উত্থাপন করেছেন।

i. শিশুদের মধ্যে কীভাবে ভাষা ও বাচন ক্ষমতা অর্জিত হয়।
ii. মানুষের ভাষা ও বাচন প্রক্রিয়া কীভাবে উৎপন্ন হয়।
iii. মানুষের ভাষা ও বাচন কীভাবে উপলব্ধ হয়।
iv. মানুষের ভাষা ও বাচন কীভাবে বিলুপ্ত হয়।
        (সূত্র: প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, পবিত্র সরকার, পৃষ্ঠা ৩২৪ দ্বিতীয় খণ্ড।)

    শিশুরা প্রথম কীভাবে ভাষা শেখে সে বিষয়ে নানান গবেষণায় মূলত দুটি তত্ত্ব উঠে এসেছে।
 
এক, অনুকরণ: শিশুরা যে ভাষিক পরিবেশে অবস্থান করে সেখান থেকে অন্যদের বাচন প্রক্রিয়া অনুকরণ করে ভাষা শেখার বা ভাষা বলার চেষ্টা করে। এটাই ছিল শিশুর ভাষা শেখার প্রাথমিক অনুমান।
 
দুই, মস্তিষ্ক-কেন্দ্রিক সামর্থ্য: 
ভাষাতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কি মস্তিষ্ক-কেন্দ্রিক সামর্থ্যের ওপর জোর দিলেন। তার মতে মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যেই ভাষা শেখার সামর্থ্য থাকে। তাই তিনি মস্তিষ্ককে "ভাষা শেখার যন্ত্র" (language acquisition device: LAD) হিসেবে অভিহিত করলেন। পরে নিজের পথ থেকে কিছুটা সরে এসে "যন্ত্র" শব্দটির পরিবর্তে পদ্ধতি বা system শব্দটি প্রয়োগ করেন। যা language acquisition system: LAS  নামে পরিচিত।
আসলে মনোভাষাবিজ্ঞান হল মনস্তত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের পারস্পরিক সম্পর্ক।

  যাইহোক সার্বিকভাবে বলতে গেলে LAD ও LAS: এই দুটি প্রক্রিয়া কিন্তু অনুকরণধর্মীতাকে বাদ দিয়ে নয়। অর্থাৎ মস্তিষ্কের ভাষা শেখার সামর্থ্য প্রকৃতপক্ষে অনুকরণের মধ্য দিয়েই সৃষ্টিশীলতার দিকে এগিয়ে যায়।

    মনোভাষাবিজ্ঞানে যে শুধু শিশুর ভাষা শেখার বিষয়টি আলোচিত হয় তা কিন্তু নয়, শিশুর জন্মগত বুদ্ধির বিকাশ, জিনগত সমস্যা, স্মৃতির পার্থক্য, অনুভূতির গভীরতা-অগভীরতা প্রভৃতি বিষয়ের ওপরও ভাষা শেখার অগ্রগতি বা মন্থরতা নির্ভরশীল।

   মনোভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে তাই স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের নিবিড় সম্পর্ক। পরস্পরের পরিপূরকও বলা যেতে পারে।

 ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে চমস্কির সহজাত তত্ত্ব ও অভিধা দুটি হল:  
ভাষা শিক্ষার উপায়( language acquisition device: LAD) ও সার্বিক ব্যাকরণ(universal grammar)
 
   এবার আসি স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানে:
স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান মূলত মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। ভাষার সঙ্গে মানব স্নায়ুর সম্পর্কের কারণে ভাষাবোধ বা ভাষার প্রকাশ যেমন স্বচ্ছ ও সাবলীল হয়ে থাকে তেমনি আবার ভাষা ব্যবহারের বা উচ্চারণের সমস্যাও তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ অসুস্থ বা মানসিক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ভাষা ব্যবহার সুস্থ মানুষের মতো নয়। তাছাড়া এই ভাষার প্রয়োগ দক্ষতা নির্ভর করে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে। ভাষাবিজ্ঞানীরা কোনো এক ধ্বংসাবশেষ থেকে অসংখ্য মানুষের মাথার স্নায়ু নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, অধিকাংশ মানুষেরই মস্তিষ্ক-জনিত আঘাতেই মৃত্যু ঘটেছে। আর তাদের ভাষাবোধও প্রভাবিত হয়েছে।

স্নায়ুর সঙ্গে ভাষা প্রয়োগের বিভিন্ন অজানা তথ্য আলোচিত হয় স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্নায়ুর ভাষা প্রয়োগ ও তার উৎসাহদান: এসবই আলোচিত হয় এই বিজ্ঞানে। বর্তমানে "ফাংশনাল নিউরো-ইমেজিং বা ব্যবহারিক স্নায়ুচিত্রণে "positron Emission Tomography ( PET) বা ( functional magnetic Resoname Imaging ( FMRI) ধরনের যন্ত্রের ব্যবহারে স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান নামক শাখাটি প্রতিদিনই বিবর্তিত ও সমৃদ্ধ হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান সূত্রে জানা গেছে যে, মানুষের ভাষাবোধ, যুক্তি পরম্পরা, আত্মপ্রকাশ, বাচিক দক্ষতা, সৃজনীশক্তি, অনুভূতি, পড়া,লেখা, বলা, জ্ঞান আহরণ প্রভৃতি মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের জন্য দায়ি বা বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সম্পর্কিত। 

মানব মস্তিষ্কের দুই দিক:
 বামদিক: লেখা, গণনা, বলা, ভাষাপড়া, বিশ্লেষণ, চিন্তা প্রস্তুতি।
 ডানদিক: সামাজিক, রোমন্থন, ভাবনা ও বিকাশ, ভাষা প্রস্তুতি প্রভৃতি।

    অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, ভাষাবোধের ক্ষেত্রে মাথার ডান গোলার্ধের থেকে বাম গোলার্ধের ভূমিকাই বেশি।
দীর্ঘদিনের গবেষণায়
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ভাষার বিভিন্ন দিক মাথার বিভিন্ন অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এককথায়, ভাষাবিজ্ঞানের যে শাখায় স্নায়ুতন্ত্রকে কেন্দ্র করে ভাষার গঠন, প্রকৃতি, প্রকাশ দক্ষতা প্রভৃতি আলোচিত হয়, তাকে স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান ( neuro linguistic) বলে। 

   স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে যেমন মনোভাষাবিজ্ঞানের সম্পর্ক রয়েছে তেমনি আবার বোধগত ভাষাবিজ্ঞানও স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। প্রকৃতপক্ষে বোধগত ভাষাবিজ্ঞান হচ্ছে "পুরোনো ঐতিহ্যের আধুনিক উত্তরাধিকার।"
 এ বিষয়ে নেরলিখ, ক্লার্ক, ফ্রেডরিক, ইবিং হাউস, গার্ডেনাররা বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। 

 স্নায়ুভাষাবিজ্ঞানের দুটি বিভাগ:
i. ভাষা শেখা( Language acquisition) এবং প্রক্রিয়াকরণ( processing)
ii. ভাষাগত সমস্যার সংস্কার( Language inpairment)

 এছাড়াও মানুষের অগ্রমস্তিষ্কের মূল দেশে কিছু নিউরোন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে স্ফীত গ্রন্থির মতো অংশ তৈরি করে, যাকে "স্নায়ুগ্রন্থি বা গ্যাংলিয়া" বলে।
 বর্তমান গবেষণা অনুযায়ী এরা মাথার অন্যান্য কিছু অংশের সঙ্গে মিলে মানুষের শিখন পদ্ধতি, ভাষাবোধ, ভাবাবেগ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষমতার বিকাশ করতে সক্ষম। মাথার এই "বেসাল গ্যাংলিয়া"গুলির কর্মক্ষমতা কোনো কারণে কম হলে "হাইপোফোনিয়া" বা কথা বলার শক্তি হারিয়ে যাওয়া, ভুলবকা, এলোমেলো কথা বলা ও দুটি ভিন্ন কথার মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করার ক্ষমতা প্রভৃতি হারিয়ে যেতে পারে। ফলে "পারকিনসনস ডিজিজ" বা  পারকিনসনের ব্যাধি"র মতো মারাত্মক রোগ পর্যন্ত হয়।

   গ্যাংলিয়া ছাড়াও একক নিউরোন আরেক প্রকার গঠন তৈরি করে। সেগুলি হল: "ধূসরবস্তু ও শ্বেতবস্তু।"
নিউরোনের একটি অনিয়তাকার ও একটি সূত্রাকার প্রবর্ধক অংশ রয়েছে। যার মধ্যে সূত্রাকার অংশে চর্বিঘটিত পদার্থের আবরণী থাকায় তা সাদা বর্ণের দেখায়। তাই এই অঞ্চলকে শ্বেতবস্তু ও অনিয়তাকার অংশকে ধূসরবস্তু বলে।
এই "ধূসরবস্তু" মানুষের ভাষা, সাহিত্য সম্পর্কিত দক্ষতাগুলির বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যাদের মাথায় 'ধূসরবস্তু" বেশি তাদের ভাষাজ্ঞান ও দক্ষতা তুলনামূলক বেশি। 

   পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে মিউজিসিয়ানদের মাথায় বেশি ধূসরবস্তু বেশি থাকে। 

   এছাড়াও গুরুমস্তিষ্কের একটি বিশেষ অঞ্চল ভাষা-প্রক্রিয়াজাতকরণ বা procesing করতে সাহায্য করে। একে "ল্যাঙ্গুয়েজ কর্টেক্স" বলে। এর অন্তর্গত আরো ক্ষুদ্রতর অঞ্চল যার নাম "ব্রোকার।" অঞ্চলটি মানুষের কথা বলা, কথার অভিব্যক্তি ও কথার বোধগম্যতা প্রভৃতি কাজগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। 
  এই হল আপাতত সংক্ষেপে স্নায়ুভাষাবিজ্ঞান ও মনোভাষাবিজ্ঞানের প্রাথমিক ধারণা।

----------------------------------------
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন। 

Post a Comment

0 Comments