জ্বলদর্চি

অন্ত্যেষ্টি-১৩/(উপন্যাস)/(উৎসব ১৪২৮)/ সন্দীপ দত্ত

উপন্যাস।। অন্ত্যেষ্টি।। সন্দীপ দত্ত

১৩

ক্ষৌরকর্মের দু'দিন আগে মামা সুখেনকে সঙ্গে নিয়ে ঋষভ তার দেশের বাড়ি পুরুলিয়ায় জেঠু অয়নের সামনে এসে দাঁড়াল যখন,জ্বরে তখন তার গা পুড়ে যাচ্ছে। জেঠুকে বিনীতভাবেই বলল সে,"পরশু দিন বাবার ঘাটকাজ। তোমরা সবাই যাবে।"
জেঠিমা সুমিত্রা দাঁড়িয়েছিলেন সামনে। রয়েছে মিলিও। একটিবারের জন্যও ওরা সুখেনের প্রতি আন্তরিকতা দেখাল না। এক গ্লাস জল দিল না এগিয়ে। ঐটুকুনি ছেলেটার কাছে একবারটিও স্নেহ প্রকাশ করলেন না। শুধু ঋষভের বলা শেষ হলে তোম্বা মুখে বললেন,"অতদূর রাস্তা। আমাদের শরীর ভাল নেই কারও। আমার আর তোর মিলিদিদির কথা ছাড়। অন্তত জেঠুর কথা ভেবে তোদের এখানে আসা উচিত ছিল ঋষভ। জেঠু কি আর অত ধকল নিতে পারে? চয়নের অন্ত্যেষ্টি'টা এখানে করলে তোর কত সুবিধে হত। এখনও তো দু'দিন সময় আছে ঋষভ। আসবি এখানে? এখানে করবি কাজ? আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব। তোকে কোনও চিন্তা করতেই হবে না। তবে হ্যাঁ,তোর ঐ প্রভা ঠাকুমাকে কিন্তু  এখানে আনা চলবে না। ওকে আমরা ছেড়ে দিয়েছি।"
জেঠিমার সব কথা শুনল ঋষভ। চুপ করেই শুনল। বৈশাখী বারবার বলে দিয়েছে,"ওরা এটা সেটা কথা শোনাতে পারে ঋষভ। তুই গলা তুলবি না।" বলেছেন প্রভাও। "ওদের এখন বলার সময় ভাই। ওদের বলতে দেবে। তোমার যেটুকু কর্তব্য,শুধু সেটুকুই করবে ওখানে। যাতে গাঁয়ের লোক পরে তোমায় দোষ না দেয়। বলতে না পারে,চয়নের ছেলেটা....."
      প্রভা ঠাকুমার কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মানল ঋষভ। কাল এক দুপুর মেজদাদুর ছেলেদের কৌশলের এক অজানা রোমহর্ষক কাহিনি শুনেছে। শুধু ওর ছেলেরাই বা কেন,বংশীধারীর নিজের কিছু কথাও প্রভা শুনিয়েছিলেন ঋষভ। যেসব কথার খাঁজে খাঁজে শুধুই ঘরোয়া রাজনীতি। গিরিধারীর একের পর এক জমি কেড়ে নিয়েছিলেন বংশী। সেসব নাহয় অনেকদিনকার কথা। অনেকগুলো বছর আগের। গাঁয়ের আমতলার পাশে চয়নের নিজের কেনা দশ কাঠা জমিটা নিয়েও কি কম জলঘোলা করেছে ওরা? দাদা হিসেবে অয়নকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল চয়ন। মাঝে মাঝেই সে জমির খোঁজ নিতে গিয়ে চয়ন বলত,"দেশে যখন দাদা আছে,ও জমি নিয়ে আমার চিন্তা নেই। দাম বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে যাক,তারপর নাহয় বিক্রি।" দশ হাজার কাঠায় কেনা সে জমির দাম হয়তো আকাশ ছুঁতে অনেক দেরি,তবে বাড়তে বাড়তে যখন পঞ্চাশ হাজার কাঠা হয়েছে,একটা সমস্যা সামলানোর জন্য কিছুটা বিক্রি করতে চেয়েছিল চয়ন। কথাটা অয়নকে ফোনে বলতেই অয়ন সেদিন ভাইকে মেজাজ দেখিয়ে বলেছিলেন,"তুই আমাকে কী ভেবেছিস? দেশে থাকি বলে তোর জমিটুকুরও খোঁজখবর রাখতে হবে? টাকা খাইয়ে দালাল ধর। তোর তো টাকা আছে অনেক। ওটা তো করতে পারিস। কে নেবে না নেবে,অতো ঝামেলার মধ্যে আমি ঢুকতে যাব কেন বল তো? এতে আমার কী লাভ?" এ সব কথাই ঋষভ ছেলে হয়েও আগে কোনওদিন শোনেনি। শোনবার মতো সময় পেল কোথায় সে? ছোট থেকেই বাইরে বাইরে পড়াশুনো,পড়া শেষ হতেই চাকরি নিয়ে চলে যেতে হল বাইরে। ঐশীটাও পর্যন্ত জানতে পারেনি। গাঁয়ের দশ কাঠা জমিটা এখনও অক্ষত চয়নের। বিক্রি করতে পারা যায়নি। শেষ পর্যন্ত তাই কি বাবা শখের কেনা গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে? মা আর প্রভা ঠাকুমার কাছ থেকে কথাগুলো শোনার পর প্রশ্নটা আর করতে হয়নি ঋষভকে। সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে গেছে। ঋষভ বুঝতে পেরে গেছে,জেঠু ইচ্ছে করেই খদ্দের দেখে দেয়নি। জেঠুর মনকে নিশ্চয়ই সহযোগিতা করেছে রাজীবকাকু আর রাকেশকাকু।
     তবুও ঋষভ চুপ থাকল আজ। আজ তাকে চুপ থাকতেই হবে।।বাবার অন্ত্যেষ্টি। তাই রাজীব,রাকেশ আর সজলের কাছে গিয়েও সেই একইরকম বিনীত অনুরোধ রাখল চয়নের বাইশ বছরের ছেলেটা। আর ওরা রূঢ় ভাষায় জবাব দিল,"যেখানে প্রভা কাকিমা থাকবে,আমরা যাব না। ওর ছায়াও মাড়াব না আমরা। এখন তুই ভেবে দেখ,কাকে নিয়ে কাজ করবি। কে তোর আপনজন।"
     সন্ধেবেলা কলকাতায় ফিরে এল ঋষভ। আসার সময় সারাটা রাস্তা গোপনে গোপনে কাঁদল সে। পাশে বসা মামা টেরও পেল না। এ সমাজনীতির বইটা পড়ার বড় ইচ্ছে রয়ে গেল তার। মানুষ কেন এমন করে? সম্পর্কের কেন এত স্তর? শুধু মুখোশ,মুখোশ আর মুখোশ। মুখোশের অন্তরালে রক্ত মাংসের ছোঁয়া পেতে জীবন কেটৈ যায়। এক জীবন থেকে থেকে আর এক জীবন। ছুটতেই থাকে মানুষ। পাথর পায়ে চলে। চলতে চলতে পাথর সরাতে চায়। পায়ের পাথর বুকে এসে লাগে।
     ঋষভের কাছে সব শুনে আঁচলে চোখ মুছলেন প্রভা। "আমার ওপর ওদের খুব রাগ বউমা। আমি এখানে থাকলে ওরা আসবে না। তুমি শুধু একবার বলো আমায় চলে যেতে,আমি চলে যাব। ওদেরকে নিয়েই তোমাদের থাকতে হবে। ঘাটকাজে ওরা আসুক।ঋষভের পাশে দাঁড়াক। চয়নের কাজ'টা ভালভাবে হোক।" বৈশাখীকে বললেন তিনি।
     বৈশাখী কী করে বলবে প্রভাকে চলে যেতে? বলা কি যায়? ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মা হয়ে ছুটে এসেছেন কাঁদতে কাঁদতে। বৈশাখী এখন কী করে বলে,প্রভার এখানে থেকে যাওয়াটা তাদের ভবিষ্যতের অন্তরায়?
     ঘাটকাজের দিন সকাল থেকে একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করল অয়নের। বড় অসহায় লাগল নিজেকে। ঋষভের পাশে গিয়ে একবার দাঁড়াতে ইচ্ছে করলেও পেছন থেকে যেন হাত টেনে রাখল মিলি। ভোরেই এসে রাজীব শুনিয়ে গেছে,"দাদা,ওদের সাথে সব সম্পর্ক আজ থেকে চুকিয়ে দাও। আমরা এতবার বলা সত্ত্বেও ওরা আমাদের কথা শোনেনি। প্রভা কাকিমা রয়েই গেছে। কখনও ভেবো না তুমি,তোমার মিলির ভালমন্দ খবর নিতে ঋষভ এখানে ছুটে আসবে। ওরা কলকাতায় থাকে। তোমার পাশে আমরা আছি। তোমার অবর্তমানে মিলিকে আমরাই দেখব। আমাদের ছেলেরা দেখবে মিলির মেয়েকে। এরপরও যদি তোমার মনে হয়,আজ ঋষভের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে,তাহলে তোমার সাথেও আমাদের সম্পর্ক শেষ।"
চয়নের মুখ'টা মনে পড়লেও তাই চুপ করে রইলেন অয়ন। মিলি বড় দুখী। বাবা হয়ে তিনি কি পারবেন মেয়েকে অসহযোগিতার দিকে ঠেলে দিতে? পারবেন না। নাড়ির টান। ভাইয়ের পরিবার রয়েছে। তার যে কেউ নেই! নিজের মনকে নিজেই বোঝালেন অয়ন। সে বোঝানোটা নিষ্ঠুরতাকে বুকে নিতে নিতে স্বস্তির সাথে সোহাগের মতো। 

     ঘাটের দিন দেশের থেকে কেউই এল না। পাড়া প্রতিবেশীরাই ঋষভের পাশে দাঁড়াল। দাঁড়াল সুখেন। দাঁড়ালেন প্রভা। দাঁড়ালেন তালুকদার,তাঁর স্ত্রী,চক্রবর্তী,ঘোষালবাবু আরও অনেকে। বাড়ি ভরে গেল। ক্ষৌরকর্ম থেকে অন্ত্যেষ্টির সমস্ত কাজ ঋষভ,ঐশী আর বৈশাখীর অভিভাবক হয়ে থাকলেন তাঁরা। 
     শ্রাদ্ধের দিন মুন্ডিত মস্তকে ব্রাহ্মণের সামনে বসে বাবাকে পিন্ডদান করার সময় খুব কাঁদল ঋষভ। তার চোখের জলের প্রতিটা ফোঁটায় লেগে রইল পৃথিবীর এক অন্য রূপ।

সমাপ্ত।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments