জ্বলদর্চি

তিনটি অণুগল্প/(উৎসব ১৪২৮)/অর্ণব মিত্র

তিনটি অণুগল্প

অর্ণব মিত্র 


হার-জিত

সেদিন বাড়ি থেকে বেরতে একটু দেরী হয়ে গেল। বাবা আমার আগেই বেরল।বলল ব্যাঙ্কে যাবে।আসতে একটু দেরী হতে পারে।বাজার আমাকেই করতে হবে।
বাবা অবসর নিয়েছে। এখন বাবার বয়স সত্তরের ওপর।
বাবা সারাজীবন সাইকেল চালিয়েছে।এখনও এই বয়সেও সাইকেল চালায়।আমিও বাবার এই অভ্যাস পেয়েছি।সাইকেল চালানোর।মনে আছে ছোটবেলায় সাইকেল চালানো শেখা গ্রামের রাস্তায়।বাবার সাহায্যে।বাবা সাইকেলের সিটটা ধরে রাখত।আর আমি সাইকেলের দুই হাতল ধরে পা-গলিয়ে প্যডেলে চাপ দিতাম,ও সামনে এগিয়ে যেতাম।সেই আনন্দ ভোলার নয়। 
আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা এগোলেই পীরবাবা মসজিদ।মসজিদের কাছে জায়গাটা উঁচু।তাই ওখানে রাস্তাটা ধীরে ধীরে উচু হয়েগেছে।আমি বাবার দশ মিনিট পরে বেরলেও পীরবাবা মসজিদের জায়গাটা পৌছাতে দেখলাম বাবা সাইকেল থেকে নেমে ধীরে ধীরে উচু জায়গাটা উঠছে।আমি বাবার পাশদিয়ে বেশ জোরে সাইকেল চালিয়ে উঁচু জায়গাটা উঠেগেলাম।
আমি কি বাবাকে হারিয়ে দিলাম !!
বাবাকে ছাড়িয়ে কিছুটা যাওয়ার পর আমার সাইকেলের চেন পড়েগেছে বা কিছু একটা হয়েছে এমন ভানকরে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম ও সাইকেলের প্যাডেলের কাছে বসে সাইকেল ঠিক করার ভাব করলাম।
বাবা ধীরে ধীরে এসে আমাকে পেরিয়ে চলেগেল ও পেরিয়ে যাওয়ার সময় উদ্বিগ্ন হয়ে বকার সুরে বলল ‘আবার কি হল !
কেন যে বার বার তোর সাইকেল খারাপ হয় ভগবানিই জানে!!’
বাবা এগিয়ে গেল।উঁচু জায়গাটা পার করার পর আবার সাইকেলে চাপল। আমি ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম ও ইচ্ছে করে আমি বাবার পিছনেই থেকে গেলাম।
আমার মনেহল আমি জিতে গেছি।


বিপদ 

(অভিক ও পায়েল। শান্তনু ও সোমা। স্বামী স্ত্রী। তাদের মেয়েদের নাম মাম্মাম ও সোনাই। একটি আবাসনের দুটি আলাদা ব্লক –এ থাকে তারা। রবিবার অভিক-এর ফ্ল্যাট-এ শান্তনু্রা এসেছে)
পায়েল – একটা কোথাও চলো, একটা কোথাও..।
সোমা – হ্যাঁ, চল না ...এখন তো আর রোজ লকডাউন নেই।
পায়েল – হ্যাঁ,তাইতো। 
অভিক – চল বললেই হল!
পায়েল – সত্যি, তোমরা ছেলেরা না।
অভিক – হ্যাঁ, তোমরা মেয়েরা তো !!। 
পায়েল - ..বড্ড ভীতু।
অভিক - শুধু কথা! একবার বাড়ি থেকে বেরও..বুঝবে।
পায়েল – কেন,ওই যে তানিয়া বলছিল ওরা বকখালি ঘুরে এলো। 
সোমা – কে তানিয়া!!
পায়েল – এতোটাই হাফিয়ে উঠেছিল এই কয়মাসে যে ..(তারপর সোমা্র দিকে মুখ ফিরিয়ে ইসারায় নিচু গলায় বলল ‘ফেসবুক এর তানিয়া ’)  
অভিক – এখন কোথাও যাওয়া যাবেনা।
পায়েল – আরে ..মাম্মাম আর সোনাই এর কথা তো ভাবো !! একবার! ওরা বাচ্চা !লকডাউন – এর কি বোঝে।পার্কে যেতে পারছেনা। 
সোমা –খেলতে পারছেনা। স্কুলে যেতে পারছেনা।কবে স্কুল খুলবে তার কোন ঠিকাছে! 
পায়েল – হ্যাঁ, একভাবে ঘরের মধ্যে ঘুরছে। মাসের পর মাস। 
অভিক – কেন ছাদে যাও, এতো বড়ো ছাদ নেই! 
পায়েল – ছাদে যেতে ভালো লাগেনা। এতো লোকে পায়চারি করে। ওই যে সেকেন্ড ফ্লোর– এর সরকারদা, আর মৌসুমি –র বাবা, 
সোমা –ভর্তি লোক, আমাদেরও তাই।বুড়ো লোকগুলো।সারাদিন বাড়ি বসে।বিকেলে তো হাটবেই। যাবেটা কোথায়।আর কাল টিভি-তে দেখনি! 
পায়েল – কি! 
সোমা – একটা লোক ছাদের ধারে তার মেয়েকে লুফোলুফি করছিল। মেয়েটা চার বছরের।সামলাতে পারেনি। একদম মেয়েসুদ্ধ নীচে পড়েগেছে। এখন দুজনই হাসপাতালে বেচারা। 
পায়েল – সেকি !!


আশ্রয়

ঝড়ের খবর শুনলেই অন্তরার চিন্তা বেড়েযায়।
গতবছর ‘আমপান’ ঝড় যখন ঘোষণা হয়েছিল তখনও সে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল।কারণ হল পায়রাদুটো।গতবারের আমপানের তাণ্ডব চলার পর সেই পায়রাদুটোকে আর দেখাযায়নি। 
ওরা যে কোথায় হারিয়ে গেল!!।
ঝড়ের সময় হাওয়ার গতিবেগে ও প্রবল বৃষ্টিতে পশুপাখিদের মৃত্যুর খবরও সে কাগজে দেখেছে।টিভিতে কয়েকদিন ধরে ঝড়ের তাণ্ডবে মৃত পশুপাখিদের ছবিও সে দেখেছে।এমনকি তাদের চারতলা ফ্ল্যাট-এর   পাকিং-এর আসেপাশে ঝড়ের পর কিছু পায়রা ও শালিক-কে মরে থাকতে দেখেছে।তাই এবার খবরের কাগজে ‘ইয়াস’ ঝড়ের ঘোষণা শুনে মন চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
কারণ গতবারের ঝড়ে পায়রাদুটো উধাও হয়ে যাওয়ার পর আবার দুটো পায়রা এসেছে তার চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ির রেলিং দেওয়া জানলার কার্নিশে।
ওঁর বর শান্তনুর অবশ্য এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই।
গত বছর আমপান ঝড়ের সময় ওদের বৃষ্টি-ভেজা ভয়ার্ত চেহারা এখনও মনে আছে।ঝড়ের প্রবল হাওয়ার বেগ ও বৃষ্টির ঝাপটা থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য ওদের মরিয়া চেষ্টা ভোলার নয়।কাচের  জানলার পাশে ওদের জড়সড় হয়ে থাকা ও ভয়ে-ভরা চোখ দেখে করুণ লেগেছিল অন্তরার।

১ 
অন্তরার ভাললাগে মেঘলা দুপুরে ওদের জড়সড় হয়ে বসেথাকা ও একে-অপরকে আদর করা, আর ওই সুরকরে বকম-বকম আওয়াজ।আর ভাললাগে কাঠি, পেরেক ও পাখির পাখনা ইত্যাদি নিয়েএসে জানলার কার্নিশে ওদের বাসা-বানানোর চেষ্টা।অন্তরার ফ্ল্যাটটা পিছনের দিকে।সূর্যের আলো খুব একটা পৌছায়না।সারাদিন ছায়ায় ঢাকা এই জায়গাটা তাই ওদের জন্য নিরাপদ ও আরামের।
ওদের এই নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়টুকু থাকবেনা আর!! তাই আসন্ন ‘ইয়াস’ ঝড়ের সতর্কতার ঘোষণা শুনে অন্তরার চিন্তা বেড়ে গেছে ।গতবারে আশ্রয় নেওয়া পায়রাদুটো আমপান ঝড়ে হারিয়ে গেছিল।  
টিভির খবরে বলেছে আজ মধ্যরাতে ঝড় আছড়ে পড়বে।
তাই সে স্থির করল কিছু একটা করতেই হবে।
জানলার কার্নিশের বাইরে লোহার রেলিং।অন্তরা গামছা ও কিছু কাপড়-মেলার ক্লিপ নিয়ে এল।রেলিং-এর উপর থেকে নিচ অবধি মুড়ে দিলো গামছা ও অন্য কাপড় দিয়ে।গামছা ও কাপড়ের প্রান্তগুলো ভাল করে ক্লিপ-দিয়ে আটকে দিল। শুধু পায়রাদুটোর ঢুকবার জন্য একটু জায়গা খালি রাখল।
এবার সে টিভি চালু করল।
আসুক ঝড়।

চিত্র- লেখক।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments