জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৬২/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৬২

শ্যামল জানা


সাররিয়েলিজম্, অভিনব ক্যাটালগ

১৯৬০ সালের নভেম্বরের ২৮ থেকে ১৯৬১ সালের জানুয়ারির ১৪ পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক-এর ডি’আর্কি গ্যালারিতে(D'Arcy Galleries) সাররিয়েলিস্টরা একটি অদ্ভুত প্রদর্শনী করলেন৷ নাম দিলেন— কুহক-রাজ্যে সাররিয়েলিস্টদের অনধিকার প্রবেশ(Surrealist Intrusion in the Enchanters' Domain)৷ সংগঠনের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি এটাই সাররিয়েলিস্টদের শেষ আন্তর্জাতিক সাররিয়েল প্রদর্শনী৷ নামে চমক থাকলেও আগের সেই অভিনবত্ব প্রদর্শনীতে আর তেমন দেখা গেল না! ক্যাটালগও হল সাদামাটা৷ যদিও ক্যটালগটি প্রথম সংস্করণ হিসেবে চিহ্নিত হলেও দ্বিতীয় সংস্করণটি সম্ভবত বেরোয়নি৷ এই ক্যাটালগটিও যথারীতি আন্দ্রে ব্রেতোঁ ও মার্শেল দুশ্যাঁ, এই দুজনের দায়িত্বে প্রস্তুত হয়েছিল৷ এই ক্যাটালগটিতে সাররিয়েলিস্টদের ঐতিহ্য অনুযায়ী সেরকম কোনো চমক বা কোনো অভিনবত্ব ছিল না৷ আর, এতে যা কিছু ছাপা হয়েছিল, সবই ছিল সাদাকালোতে৷ কোনো রঙিন ব্যাপার ছিল না৷ কিন্তু তা সত্বেও এটি অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই কারণে যে, এটিকে বলা হত বিশ শতকের শিল্প-ইতিহাসের দলিল৷ এই ক্যাটালগে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, যা ক্যটালগের ইতিহাসে প্রথম বলা যায়৷ সেটি হল— প্রদর্শনীতে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের সম্পর্কে একটি সামগ্রিক পরিচিতি লিখিতভাবে ছাপা হয়েছিল৷

সাধারণভাবে একটি ক্যাটালগের যে মাপ থাকে, এই ক্যাটালগের মাপ একেবারে সেই প্রথার বাইরে করা হয়েছিল৷ এর মাপ ছিল আক্ষরিক অর্থে চৌকো৷ ৭ ইঞ্চি X ৭ ইঞ্চি(১৭.৮ X ১৭.৮ সেন্টিমিটার)৷ এবং সাধারণভাবে শক্ত পিচবোর্ডে যেরকম( Hard bound) বাঁধানো হয়, সেরকমও নয়, ছিল একটু শক্ত কাগজের মলাট, পেপারব্যাক যাকে বলে৷ ১২৪ পাতার এই ক্যাটালগে ৭০টি সাদাকালো ইলাস্ট্রেশন ছিল৷ সব ছিল ইংরাজি ভাষায় লেখা৷ সাররিয়েলিজম নিয়ে লিখেছিলেন— জ্যাকশন পোলক৷ গীতি-বিমূর্ততা( Lyric-Abstraction) নিয়ে লিখেছিলেন— যোসে পিয়েরে৷ এ ছাড়াও শিল্প-সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা ছিল, যেগুলি থেকে সাররিয়েলিজম-এর পুরো ইতিহাস পাওয়া যায়৷ লিখেছিলেন— এডোয়ার্ড জাগুয়ার, ভিনসেন্ট বউনউ৷ ফ্রেঞ্চ থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করা বেশ কিছু মূল্যবান লেখা ছিল৷ যেগুলির অনুবাদ করেছিলেন— জুলিয়েন লেভি৷ প্রচ্ছদ করেছিলেন মার্শেল দুশ্যাঁ৷ তিনি এক ধরনের ওঠাওঠা চকচকে এমবস করা শক্ত কাগজ( Claud Tarnaud embossed) দিয়ে প্রচ্ছদ করেছিলেন৷ এটি ছিল স্পষ্টতই অ্যাক্রেলিকে করা সংরক্ষণযোগ্য বইয়ের প্রচ্ছদ(ছবি-১)৷


যেহেতু সাররিয়েলিস্টদের সাংগঠনিকভাবে অফিসিয়ালি এটাই শেষ আন্তর্জাতিক সাররিয়েল প্রদর্শনী৷ এবং পাশাপাশি সেই প্রায় ১৯১৭ সাল থেকে আন্দ্রে ব্রেতোঁ (মার্শেল দুশ্যোঁ-র সাহায্য নিয়ে) বলতে গেলে প্রায় একক প্রচেষ্টায় প্রায় চল্লিশ বছরের অধিক এই কেন্দ্রীয় মূল প্যারিস সাররিয়েলিস্ট গ্রুপ-এর নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, সেই ব্রেতোঁ মারা গেলেন ১৯৬৬ সালে৷ তারপর স্বাভাবিকভাবেই বেশ নড়বড়ে হয়ে যায় এই গ্রুপ৷ ফলে, ১৯৬৯ সালে এই গ্রুপের সদস্য জাঁ স্চুস্টার ঘোষণা করলেন এই গ্রুপের অনস্তিত্ব৷ তাই, কিছু শিল্প-ইতিহাসবিদ মনে করেন এখানেই সাররিয়েলিজম-এর সমাপ্তি ঘটেছে৷

আসলে বিষয়টি এত সহজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নয়৷ এর পরেও আর একটি প্যারিসিয়ান সাররিয়েলিস্ট গ্রুপ তৈরি হয়েছিল৷ যা আজও বর্তমান৷ শুধু তাইই নয়, তাঁদের “Alcheringa” নামে একটি জার্নাল বেরল এই লক-ডাউনের কদিন আগে ১৯১৯ সালে(ছবি-২)৷


 মূল সাররিয়েলিস্ট গ্রুপের অনস্তিত্ব ঘোষণার পরে পরেই চেকোশ্লোভাকিয়ায় The Group of Czech-Slovak Surrealists তৈরি হয়েছিল৷ যা আজও পূর্ণ উদ্যমে বেঁচে আছে৷ শুধু তাইই নয়, সেই থেকে তাঁদের জার্নাল “Analogon” আজও অবিচ্ছিন্নভাবে নিয়মিতই বেরোচ্ছে৷ এই ১৯২১ সালেও তাঁদের ৯৪তম ভলিউম বেরিয়েছে(ছবি-৩)৷


এ ছাড়াও, শিল্পক্ষেত্রে যতগুলো দিক আছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাররিয়েলিজম প্রবেশ করেছিল পূর্ণমাত্রায়৷ সাহিত্যে, চিত্রশিল্পে, চলচ্চিত্রে, ফোটোগ্রাফিতে, থিয়েটারে, সংগীতে৷ এবং আজও কোনো ক্ষেত্রই সাররিয়েলিজম-এর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি৷

শুধু তাইই নয়, সাররিয়েলিজম-পরবর্তী শিল্পের বিভিন্ন শাখায় যে সব নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ    আন্দোলনের জন্ম হয়েছে, সেগুলোও সাররিয়েলিজম-এর প্রভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে৷ হয় প্রত্যক্ষ, না হলে পরোক্ষভাবে৷ বিশ শতকে সাহিত্যের ক্ষেত্রে একাধিক আন্দোলন হয়েছে৷ তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে “পোস্টমর্ডানিজম”৷ আমরা যদি একটু বিশ্লেষণ করে দেখি— পোস্টমর্ডানিজম-এর কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোনো একটি থিম বা প্রয়োগকৌশল নেই, যাকে সংজ্ঞার মতো করে বলা যায়, এই একে বলে পোস্টমর্ডানিজম৷ যে একাধিক থিম, দর্শন, বা প্রয়োগকৌশল পোস্টমর্ডানিজম-এর আছে, সেগুলি অধিকাংশই সাররিয়েলিজম-এর সাথে অভিন্ন৷    ধরা যাক নিউ ইয়র্ক-এ ১৯৪২ সালে যে অভিনব প্রদর্শনীটি হয়েছিল— “ফার্স্ট পেপারর্স অফ সাররিয়েলিজম্”৷ এই প্রদর্শনীতে যে অভিনব বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা বোঝাবার জন্য বলা হয়েছিল— “The fathers of surrealism in an exhibition”.৷ কারণ, ওই প্রদর্শনীতে “ইনস্টলেশন আর্ট” প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল, যা আঁভা-গার্দ আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিশাল লাফ(Monumental step) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ এই “ইনস্টলেশন আর্ট” আজ দৃশ্যশিল্পের ক্ষেত্রে নতুন স্বতন্ত্র সংযোজন হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে৷

    বিশ শতকের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে, যুদ্ধ-পরবর্তীকালে, আমেরিকায়, সাহিত্যে “বিট জেনারেশন” নামে যে শক্তিশালী আন্দোলনের সুত্রপাত ঘাটছিল, সে কথা আমরা জানি৷ তাঁরা সাহিত্যে ব্যবহৃত যে প্রচলিত উপাদান— যেমন বর্ণনামূলক বা ব্যাখ্যা করার ঝোঁক, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, প্রাচ্যধর্মের অন্বেষণ, অর্থনৈতিক বস্তুবাদের ব্যবহার, মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে তার নিটোল ছবি আঁকা, নেশাগ্রস্ত হওয়া মানুষকে নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অবাধ যৌনতার অনুসন্ধান ও তার ব্যবহার ইত্যাদি সমস্ত কিছুকে বাতিল করে দিয়েছিলেন৷ এই ভাবনাটা তাঁরা ভাবতে পেরেছিলেন সাররিয়েলিজম-এর দ্বারা সম্পূর্ণ প্রভাবিত ছিলেন বলেই৷ বিট সাহিত্যিক ফিলিপ ল্যামেন্তিয়া এবং টেড জোনস প্রায়শই তাঁদের লেখায় স্পষ্টতই উল্লেখ করে দিতেন— এই লেখাটি বিট, এই লেখাটি সাররিয়েল৷ আরও যে সব বিট-লেখক ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের লেখায় গুরুত্বপূর্ণভাবে সাররিয়েল-এর প্রভাব স্পষ্ট বোঝা যেত৷ বিশেষ করে উল্লেখ্য— বব কাউফম্যান, গ্রেগরি কোরসো, অ্যালেন গিনসবার্গ, কার্ল সলোমন ও লরেন্স ফার্লিংহেত্তি৷ একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট বোঝা যাবে৷ ১৯৩১ সালে আন্দ্রে ব্রেতোঁ “ফ্রি ইউনিয়ন” নামে একটি কবিতা লেখেন৷ বেশ বড়, ৭০ লাইনের৷ সম্পূর্ণভাবে সাররিয়েল, একাধিক জাক্সটাপজিশনের সার্থক প্রয়োগ আছে৷ এর ঠিক পঁচিশ বছর বাদে ১৯৫৭ সালে অ্যালেন গিনসবার্গ “কাড্ডিস” নামে একটি কবিতা লিখলেন৷ এটি আরও দীর্ঘ৷ A-4 মাপে প্রায় ১০পৃষ্ঠার অধিক৷ দুটি কবিতা একসাথে পাঠ করলে স্পষ্টই বোঝা যাবে গিনসবার্গ আন্দ্রে ব্রেতোঁর “ফ্রি ইউনিয়ন”-এর যে গঠন(Structure), তা অ্যালেন গিনসবার্গ পুরোপুরিই ব্যবহার করেছেন তাঁর দীর্ঘ কবিতা “কাড্ডিস”-এ৷ মজার ব্যাপার, গিনসবার্গ বা অন্যান্য বিট-লেখকরা এই যে প্রভাবিত হচ্ছেন, তা কিন্তু তাঁরা একটুও লুকোতেন না৷ প্রকাশ্যেই ঘোষণা করতেন— এই সাররিয়েলিস্টরা আমাদের গুরু৷ একটা ঘটনা বললে বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা যাবে৷ একবার কোনো একটি অনুষ্ঠানে ত্রিস্তান জারা, মার্শেল দুশ্যাঁ, ম্যান রে ও বেঞ্জামিন পিরে এসেছিলেন৷ এতজন হিরোকে একসাথে পাওয়া যাবে জেনে গিনসবার্গ ও কোরসো দেখা করতে গেছিলেন৷ যখন তাঁরা দেখা পেলেন, গিনসবার্গ আভূমি সাষ্টাঙ্গ গড় করে দুশ্যাঁ-র পায়ের পাতায় চুমু খেয়েছিলেন৷ আর, কোরসো দুশ্যাঁ-র টাই ছিঁড়ে নিয়েছিলেন স্মারক হিসেবে রাখবেন বলে৷

উইলিয়াম এস বুরোজ ছিলেন বিট জেনারেশন-এর মূল সদস্য এবং পোস্ট-মডার্ন ঔপন্যাসিক৷ তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস ত্রিস্তান জারা উদ্ভাবিত কাট-আপ টেকনিক-এ লেখা৷ এক্ষেত্রেও লুকোছাপার ব্যপার ছিল না৷ তাঁরা এই কাজকে মজা করে বলত— এটা চুরি নয়, একে বলে "Surrealist Lark" ৷ অর্থাৎ “পরাবাস্তব দুষ্টুমি”৷ আর, এ জন্য আমরা ত্রিস্তান জারা-র কাছে ঋণী৷

আমরা যদি ম্যাজিক রিয়েলিজম-এর কথা বলি, তাহলেও বলতে হয়— সাররিয়েলিজম তার উৎস৷ আমরা যদি কিংবদন্তী লাতিন আমেরিকান ম্যাজিক রিয়েলিস্ট গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর কথা বলি, তাঁর বিশ্বখ্যাত উপন্যাস “ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড”-এ যখন তিনি মানসিক টানা-পোড়েন-এর কথা, স্বপ্নের কথা বলেন, তখন তা পূর্ণ সাররিয়েল হয়ে ওঠে৷

আমাদের ভারতের মুম্বাইতে জন্মগ্রহণ করা মার্কেজ-এর থেকে কুড়ি বছরের ছোটো একেবারে এই সময়ের(৭৩ বছর বয়েসে এখনো বেঁচে আছেন) ব্রিটিশ-আমেরিকান ম্যাজিক রিয়েলিস্ট ঔপন্যাসিক শলমন রুশদি-কে কেউ যদি ম্যাজিক রিয়েলিস্ট বলে ডাকেন, তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দেন— আমাকে ওই নামে ডেকো না৷ তার বদলে আমাকে বলো— "Allied to surrealism"৷ বা “পরাবাস্তবের আত্মীয়”৷

এইভাবে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যায়৷ আমি সে পথে গেলাম না৷ আমার এত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য যে— সাররিয়েল এমনই এক মতবাদ যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে, ততদিন এর কখনো মৃত্যু ঘটতে পারে না৷ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সে থেকে যাবে৷ এর একটাই কারণ— এ জন্ম নেয় মানুষের অবচেতন মন থেকে, যা যে কোনো সৃষ্টির মূল চাবিকাঠি৷

লেখকের কথা

আমাদের এই “আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস” ৬২ পর্বে এসে শেষ হল৷ এই “আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস”-এর সময়কাল ১৮৬০ – ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত৷ ১৯৪৬ সাল থেকে শুরু হয়েছে “সমসাময়ি চিত্রশিল্পের ইতিহাস” বা History of Contemporary Art.৷ যার মধ্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম, পোস্ট মর্ডানিজম, ইনস্টলেশন আর্ট ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইজম-এর ইতিহাস থেকে গেছে৷ অনেকে এই ইজমগুলি কবে লিখব, তা নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন৷ দুঃখের বিষয় এগুলি আধুনিক চিত্রশিল্পের আওতায় পড়ে না৷ তাই লেখা সম্ভব হল না মার্জনা চাইছি৷ (সমাপ্ত)       

 

Post a Comment

0 Comments