জ্বলদর্চি

দেবী ভাবনায় মা লক্ষ্মীর উৎস সন্ধান/প্রসূন কাঞ্জিলাল

দেবী ভাবনায় মা লক্ষ্মীর উৎস সন্ধান
প্রসূন কাঞ্জিলাল 

আজ বাংলা জুড়ে মানুষ মাতবেন দেবী লক্ষ্মীর আরাধনায়। সৌভাগ্য ও ধন সম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শ্রী শ্রী কোজাগরী লক্ষ্মী। ধনের দেবী লক্ষ্মী।

"এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে..."

এ প্রার্থনা বাংলার ঘরে ঘরে চিরন্তন । প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পুজো হয়ে থাকে। মহিষাসুরমর্দিনীর আগমনে আনন্দময় হয়ে উঠেছিল ধরনী। জীবনের জ্বালা ভুলে মানুষ মেতেছিল উৎসবের আনন্দে। চিন্ময়ীর বিদায়ের বার্তা ভুলে মানুষ আবার মেতে উঠছে লক্ষ্মী পুজোর উৎসব ও আনন্দে।

সনাতন হিন্দু ধর্মাবলমন্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব এটি। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে নগরীর ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। ধন সম্পদের দেবী হওয়ায় বিভিন্ন মন্দির ছাড়াও সনাতন ধর্মালম্বীদের ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গোৎসব শেষে চান্দ্র আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অর্থাৎ কোজাগরী পূর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়ে থাকে। এছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার সধবা স্ত্রীগণ লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন।

বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বণে লক্ষ্মী দেবী আসেন বারে বারে। অনেকেই সারা বছর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন | এছাড়া শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন পূর্ণিমা ও দীপাবলীতে লক্ষ্মীর পুজো হয় । লক্ষণীয় বিষয় হল-খারিফ শস্য ও রবি শস্য ঠিক যে সময় গৃহজাত হয় তখনই বাঙালি মেতে ওঠে লক্ষ্মীর আরাধনায় । তবে পুজোর উপচারে পরিবর্তন হয় মাস ভেদে । 

পুজোর মন্ত্র সেই একই-

" নমামি সর্বভূতানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে
যা গতিস্ত্বৎপ্রপন্নানাং সা মে ভূয়াৎ ত্বদর্চনাৎ "

অর্থাৎ 'হে হরিপ্রিয়ে,তুমি সকল প্রাণীকে বরদান করিয়া থাক, তোমাকে প্রণাম করি । যাহারা তোমার শরণাগত হয়, তাহাদের যে গতি, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয় । '

আজকাল গৃহস্থের সুবিধের জন্যই হোক বা পুরোহিতের স্বল্পতার জন্য, লক্ষ্মী পুজো (বারোমেসে পুজো বাদে) হচ্ছে সকাল থেকেই | কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর প্রকৃষ্ট সময় প্রদোষকাল । অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে দু ঘণ্টা পর্যন্ত যে সময় |

মনে রাখতে হবে প্রদোষ থেকে নিশীথ অবধি তিথি থাকলেও সেই প্রদোষেই পুজা বিহিত । কিন্তু পূর্বদিনের রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পুজো করা বিধেয় । আবার পূর্বদিন রাত্রে তিথি (পূর্ণিমা/অমাবস্যা) থাকলেও যদি পরদিন প্রদোষে তিথি না থাকে তাহলে পূর্বদিন প্রদোষেই পুজো করা কর্তব্য । 

রাজধানী কলকাতা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ঘরে লক্ষ্মীর আসন বিরাজমান । ধন-সম্পদ কে না চায়? সমাজে থাকতে গেলে অর্থের প্রয়োজন সকলেরই | ঈশ্বরী পাটনীর কামনা তাই চিরন্তন-আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে । তাই শুধু বাংলার নয়  ভারতের বিভিন্ন প্রদেশেই লক্ষ্মী পুজোর প্রচলন আছে । 

কিন্তু বাংলার বাইরে দেবী পূজিতা হন গৌণ চান্দ্র কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অর্থাৎ দীপান্বিতা অমাবস্যার রাত্রে। এই পূজা সাধারণত বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পুজোর পরেই হয়ে থাকে। লক্ষ্মীপূজা কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো নামেও পরিচিত।

এবার আসা যাক, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর কথায় । কোজাগরী শব্দটি এসেছে "কো জাগর্তি" থেকে, যার অর্থ 'কে জেগে আছো?'।এই পূর্ণিমার রাতে দেবী লক্ষ্মী বরদান করার উদ্দেশে জগৎ পরিক্রমা করে দেখেন, কে নারকেল জল পান করে সারারাত জেগে আছেন । 

কথিত, দেবী এও বলে থাকেন," আজ রাতে যে ব্যক্তি জেগে থেকে পাশাখেলা করবে তাকে আমি ধনবান করব |" তাই ভক্তিপূর্ণ চিত্তে এদিন লক্ষ্মীর পুজো করার পরে প্রথমে বালক, বৃদ্ধ ও আতুরদের আহার করাতে হয় । পরে ব্রাহ্মণ ও বন্ধুবান্ধবদের নারকেল জল ও চিঁড়ে আহার করিয়ে তবে তা নিজে গ্রহণ করতে হয় । 

বলা হয়, জগৎ শেঠ অল্প বয়সে বিদ্বান হয়ে উঠলে দিল্লীশ্বরের কানে তা পৌঁছয় । তিনি তাঁকে দেখতে চান । এরপর জগৎ শেঠ দিল্লি গেলে রাজা তাঁর কথাবার্তায় খুশি হয়ে তাঁকে দিল্লিতে থাকতে বলেন। জগৎ শেঠও দিল্লিতে থেকে যান । কিছুদিন পরে রাজা তাঁকে বলেন,তোমার উপর আমি অত্যন্ত প্রীত । তুমি যা চাইবে আমি দান করব । 

তখন জগৎ শেঠ বাড়ি ফিরে মাকে সব বলেন । বুদ্ধিমতী জননী পুত্রের মঙ্গলের জন্য বলেন, আগে রাজাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়ে নিয়ে তারপর জানাতে যে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে দিল্লিতে কোনও গৃহস্থ বাড়িতে যেন আলো না জ্বালায় । 

রাজার নির্দেশে ওই রাতে কেউ আলো জ্বালালো না । জগৎ শেঠের মা ঘি-এর প্রদীপ জ্বেলে ঘর আলো করে দরজা খুলে বসে থাকল । যথাসময়ে দেবী এলেন এবং বললেন, আমি খুব পরিশ্রান্ত ।আমাকে একটু আশ্রয় দেবে ?

জগৎ শেঠের মা দেবীর ছলনা বুঝতে পারলেন । তিনি দেবীকে ঘরে আশ্রয় দিলেন এবং বললেন, আমি নদীতে স্নান করতে যাচ্ছি । ফিরে না আসা অবধি আপনি এখানে থাকুন । দেবী তাতে রাজি হলেন । এবার জগৎ শেঠের মা নদীতে স্নান করতে গিয়ে প্রাণত্যাগ করলেন । ফলে সেদিন থেকে দেবী জগৎ শেঠের ঘরে থেকে গেলেন । 

আজও ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য গৃহস্থ বাড়িতে সারারাত ঘি-এর প্রদীপ জ্বালানো হয় ।  তবে ছেলেরা অনেকেই ওই রাতে জুয়া (পাশার পরিবর্তে) খেলে থাকেন । 

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন বাংলার ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বনি মুখরিত সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর আরাধনা হলেও ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে লক্ষ্মীপুজো হয় দীপাবলির সন্ধ্যায়। গবেষকদের মতে, বাংলার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে কৃষি সমাজের গভীর প্রভাব। অবশ্য তার প্রমাণও মেলে পুজোর উপকরণ আর আচার অনুষ্ঠানে।

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে আল্পনা। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ্মীপুজোর আলপনাতেও দেখা যায় আঞ্চলিকতার প্রভাব। এখনও গ্রামাঞ্চলে ঘরের দরজা থেকে দেবীর আসন, ধানের গোলা পর্যন্ত আলপনায় ছোট ছোট পায়ের ছাপ দেওয়া হয়।

পুজো হয় মূলত প্রতিমা, সরা, নবপত্রিকা কিংবা কলার পেটোর তৈরি নৌকায়। একে বলে বাণিজ্যের নৌকা কিংবা সপ্ততরী নৌকা। লক্ষ্মী সরাও হয় নানা রকম, যেমন ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি, সুরেশ্বরী এবং শান্তিপুরী সরা। নদিয়া জেলার তাহেরপুর, নবদ্বীপ এবং উত্তরচব্বিশ পরগনার বিভিন্ন স্থানে লক্ষ্মীসরা আঁকা হয়। তবে আঞ্চলিকতা ভেদে লক্ষ্মী সরায় তিন, পাঁচ, সাত পুতুল আঁকা হয়। এতে থাকে লক্ষ্মী, জয়া বিজয়া সহ লক্ষ্মী, রাধাকৃষ্ণ, সপরিবার দুর্গা ইত্যাদি। ফরিদপুরের সরায় দেবদেবীরা সাধারণত একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন। আবার সুরেশ্বরী সরায় উপরের অংশে মহিষমর্দিনী আঁকা হয় আর নীচের দিকে থাকেন সবাহন লক্ষ্মী।

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে তাঁর আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি। লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য। কোনও কোনও পরিবারে পুজোয় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পুজো স্থানটিকে। পুজোর উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব। কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে মেলা বসে। কোথাও বা নৌকাবাইচও অনুষ্ঠিত হয়।

এই উৎসবের অন্যদিক হল কোজাগরী পূর্ণিমায় চাঁদ ও পৃথিবী নাকি খুব কাছাকাছি আসে । আর চাঁদের আলোর বিশেষ গুণ হল শরীর ও মনকে পরিপুষ্ট করা (বিজ্ঞান তা স্বীকার নাও করতে পারে) । এ জন্য গুজরাতে ওই রাতে চাঁদের আলোয় ক্ষীর রেখে দেওয়া হয় । পরদিন তা খাওয়া হয় । গুজরাতিরা এই পার্বণে গরবা উৎসবও পালন করে । ওড়িশাবাসী মনে করে এই দিনটিতে কুমার কার্তিকের জন্ম । তাই তাদের কাছে এটি কুমার পূর্ণিমাও ।  মহারাষ্ট্রেও কোজাগরী পূর্ণিমায় ভক্তি সহকারে লক্ষ্মীপুজো করা হয় । 

লক্ষ্মী হিন্দুদের ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক ও পার্থিব উন্নতি, আলো, জ্ঞান, সৌভাগ্য, উর্বরতা, দানশীলতা, সাহস ও সৌন্দয্যের দেবী। বাঙালি হিন্দুদের বিশ্বাসে লক্ষ্মীদেবী দ্বিভূজা। তার বাহন হচ্ছে পেঁচা। অবশ্য বাংলার বাইরে লক্ষ্মীর চতুর্ভূজা কমলে-কামিনী মূর্তিই দেখা যায়।

লক্ষ্মী দেবীর ধ্যান মন্ত্রে বলা হয় " যাম্য করে পাশ , অক্ষমালা , সৌম্য করে পদ্ম ও অঙ্কুশ ধারিনী পদ্মাসনে উপবিষ্টা , শ্রী অর্থাৎ ঐশ্বর্য সম্পৎ ও সৌন্দর্য রুপিনী , ত্রিলোকের জননী , গৌরবর্ণা , সুন্দরী , সর্বা অলঙ্কার বিভূষিতা , ব্যগ্রহস্তে স্বর্ণ পদ্ম ধারিনী এবং দক্ষিণ হস্তে বরদানকারিনী দেবীকে ধ্যান করি ।

লক্ষ্মী স্ত্রোত্র এ বলা হয় -

"লক্ষ্মীঃ শ্রীঃ কমলা বিদ্যা মাতা বিষ্ণুপ্রিয়া সতী ।
পদ্মালয়া পদ্মহস্তা পদ্মাক্ষী পদ্মসুন্দরী ।।
ভূতানামীশ্বরী নিত্যা মতা সত্যাগতা শুভা ।
বিষ্ণুপত্নী মহাদেবী ক্ষীরোদতনয়া ক্ষমা ।।
অনন্তলোকলাভা চ ভূলীলা চ সুখপ্রদা ।
রুক্মিণী চ তথা সীতা মা বৈ বেদবতী শুভা ।।
এতানি পুন্যনামানি প্রাতরুথায় যঃ পঠেৎ ।
মহাশ্রিয়নবাপ্নোতি ধনধান্যকল্মষম্ ।।"

শ্রী , কমলা বিদ্যা , মাতা , বিষ্ণুপ্রিয়া , সতী , পদ্মালয়া পদ্মহস্তা পদ্মাক্ষী পদ্মসুন্দরী , ভূতগণের ঈশ্বরী , নিত্যা , সত্যাগতা , শুভা , বিষ্ণুপত্নী , ক্ষীরোদ - তনয়া , ক্ষমা স্বরূপা , অনন্তলোকলাভা , ভূলীলা , সুখপ্রদা , রুক্মিণী , সীতা , বেদবতী - দেবীর এ সকল নাম । প্রাতেঃ উত্থান কালে যারা দেবীর এই পুন্য নামাবলী পাঠ করেন তারা বিপুল ঐশ্বর্য পেয়ে ধনী হয়ে থাকেন ।

অগ্নি পুরাণ মতে শ্রী বা লক্ষ্মী হলেন যজ্ঞবিদ্যা ,
তিনিই আত্ম্যবিদ্যা , যাবতীয় গুহ্যবিদ্যা ও মহাবিদ্যা ও তিনি ।

"যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনা ।
আত্ম্যবিদ্যা চ দেবি বিমুক্তিফলদায়িনী ।।"

দেবী ভাগবত মতে যে স্বর্গে তিনিই স্বর্গ লক্ষ্মী , রাজগৃহে তিনি রাজলক্ষ্মী , গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী । তিনি শান্তা , দান্তা , সুশীলা , সর্ব মঙ্গলা , ষড়রিপু বর্জিতা ।

এক কথায় ধন , জ্ঞান , শীল - তিনেরই বিকাশ দেবী লক্ষ্মীর মধ্যে । কমলের মতো তিনি সুন্দরী , কমলাসনে তাঁর নিবাস । কমল বা পদ্ম হল বিকাশ বা অভ্যুদয়ের প্রতীক ।

শাস্ত্রে অষ্টলক্ষ্মীর কথা আছে । দেবীর লক্ষ্মীর আটটি রূপ এঁনারা ----- ৮ জন লক্ষ্মী হলেন- আদিলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী, ধান্যলক্ষ্মী, গজলক্ষ্মী, সন্তানলক্ষ্মী, বীরলক্ষ্মী, বিজয়ালক্ষ্মী ও বিদ্যালক্ষ্মী ।

১."আদিলক্ষ্মী" হলেন মহর্ষি ভৃগু মুনির কন্যা। আবার এঁনাকে কিছু পুরাণে সাগর কন্যা বলা হয়। সমুদ্র মন্থনের সময় ইনি প্রকটিত হয়ে ভগবান বিষ্ণুকে পতি রূপে বরণ করেন ।

২."ধনলক্ষ্মী" হলেন সোনাদানা, অর্থ ইত্যাদির প্রদায়িত্রী। ইনি প্রসন্না হলে সাধক কে অর্থ, ঐশ্বর্য এমনকি পারমার্থিক ধন সম্পত্তি ব্রহ্মবিদ্যা প্রদান করেন ।

৩."ধান্যলক্ষ্মী" হলেন চাল, ডাল, ধান, গম ইত্যাদি কৃষিজ ফসলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এঁনার কৃপায় কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে মাঠ ফসলে ভরে ওঠে। কৃষকেরা গৃহে ফসল তুলে লক্ষ্মীর মুখ দেখতে পান। মাঠ ভরা ধান, গম এই লক্ষ্মীর প্রতীক।

৪."গজলক্ষ্মী" হলেন পশু সম্পত্তি এমনকি পশু পালনের মারফৎ যে অর্থ আসে- তাঁর অধিষ্ঠাত্রী প্রদায়িনী দেবী। পশুপালনের দ্বারা সভ্যতার বিকাশ, লাঙল, রথ টানা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের বিকাশ হয়েছিলো । এই দেবীর কৃপায় দেবতাদের রাজা ইন্দ্র দেব ঐরাবত বাহন রূপে প্রাপ্ত করেন ।

৫."সন্তানলক্ষ্মী" হলেন সন্তান সন্ততি প্রদায়িনী দেবী। এঁনার কৃপায় সন্তান সুখ লাভ হয় ।

৬."বীরলক্ষ্মী" বলতে দেবী এই রূপে সাহস, উদ্যম প্রদান করেন। এঁনারা কৃপায় হতাশা, অলসতা আদি শত্রুর নিরাময় ঘটে । নিস্কাম সাধকের মনে ধর্ম ও অধর্মের মধ্যে যে সংগ্রাম হয়- তখন ইনি সাধক কে সাহস, উদ্যম, ক্ষমতা দিয়ে অধার্মিক রিপুগুলিকে ধ্বংস করবার শক্তি প্রদান করেন ।

৭."বিজয়ালক্ষ্মী" বলতে যুদ্ধের পর যে বিজয়শ্রী প্রাপ্ত করা হয় । সাধক যখন রিপুগুলিকে পরাজিত করে শুভশক্তির প্রকাশ ঘটান তখন তিনি যে পারমার্থিক সুখ লাভ করেন তা প্রদান করেন এই দেবী ।

৮."বিদ্যালক্ষ্মী" হলেন জ্ঞান রূপ ধন প্রদায়িনী। তিনি সাধককে সমস্ত রকম বিদ্যা রূপ ঐশ্বর্য প্রদান করেন ।

এছারা ঐশ্বর্যলক্ষ্মী( ঐশ্বর্য প্রদান করেন) , সৌভাগ্যলক্ষ্মী( সৌভাগ্য প্রদান করেন) ,
রাজ্যলক্ষ্মী( রাজগৃহে থাকেন, রাজসুখ প্রদায়িনী) ,
বরলক্ষ্মী ( সকল প্রকার শুভ আশীষ ও সৌন্দর্য দান করেন) দেবীর নাম শোনা যায় ।

পুরানে আছে সাগর মন্থন কালে দেবী লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে প্রকট হন । সাগর হল লক্ষ্মী দেবীর পিতা । সাগরেই মুক্তা , প্রবাল আদি রত্ন পাওয়া যায় । রত্ন হল ধন , যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী ।

তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া । তিনি শ্রী বিষ্ণুর সহধর্মিণী । তিনি সীতা , তিনি রাধা তথা রুক্মিণী । তিনি মহাপ্রভুর সহধর্মিণী লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী । তিনি ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের সহধর্মিণী মা সারদা । শরত ঋতু তে আমরা যে দুর্গাদেবীর পূজো করি তিনিও মহালক্ষ্মী স্বরূপা । দেবী লক্ষ্মী মহামায়া আদিশক্তির এক অংশ ।

দেবী লক্ষ্মী কে চঞ্চলা বলা হয় । কারণ লক্ষ্মী দেবী নাকি এক জায়গায় থাকেন না । ধন হস্তান্তর হয় । কুপাত্রের হাতে বিপুল ধন আসলে সে ধনের অসৎ প্রয়োগ করে লক্ষ্মী কে হারায় । রাবণ লক্ষ্মী সীতা দেবীকে অসৎ উপায়ে ভোগ করতে চেয়েছিলেন , এই কারনে গোটা লঙ্কা ধ্বংস হয়েছিল । রাবন নিহত হয়েছিলেন । এই থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি লক্ষ্মীর কৃপা সব সময় এ শুভ কাজেই ব্যবহার করা উচিৎ । এবং কখনো অসৎ উপায় অবলম্বন করে লক্ষ্মী প্রাপ্তির আশা করা উচিত নয় । না হলে রাবনের মতো আমাদেরও বিনাশ নিশ্চিত ।

দেবী লক্ষ্মীর নিবাস কোথায় ? তিনি কি খালি বৈকুন্ঠে শ্রী বিষ্ণুর পাদপদ্মে থাকেন ? যেখানে শীল ও সদাচার থাকে দেবী সেখানেই বাস করেন ।

ব্রহ্ম বৈবরত পুরানে দেবী নিজ পরিচয় দিয়েছেন -

" যে সকল গৃহে গুরু , ঈশ্বর , পিতামাতা , আত্মীয় , অতিথি , পিতৃলোক রুষ্ট হন , সে সকল গৃহে আমি কদাপি প্রবেশ করি না । আমি সে সকল গৃহে যেতে ঘৃনা বোধ করি , যে সকল ব্যাক্তি স্বভাবতঃ মিথ্যাবাদী , সর্বদা কেবল 'নাই' , 'নাই' করে , যারা দুর্বলচেতা এবং দুঃশীল । যারা সত্য হীন , মিথ্যা সাক্ষ্য দান করে , বিশ্বাসঘাতক , কৃতঘ্ন , যে সকল ব্যাক্তি সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত , ভয়গ্রস্ত , শত্রু গ্রস্ত , ঋণ গ্রস্ত , অতি কৃপণ , দীক্ষা হীন , শোকার্ত , মন্দঘ্নী , স্ত্রী বশীভূত , কুলটার পতি , দুর্বাক , কলহ পরায়ণ , যারা ভগবানের পূজো ও তাঁর নাম গুন কীর্তনে বিমুখ , যারা শয়নের পূর্বে পাদপ্রক্ষালন করে না , নগ্ন হয়ে শয়ন করে , বেশী ঘুমায় , প্রভাতে সন্ধ্যায় দিবসে নিদ্রা যায় , যাদের দন্ত অপরিচ্ছন্ন , বসন মলিন , মস্তক রুক্ষ , হাস্য বিকৃত , তাদের গৃহে আমি কদাপি গমন করি না । আমি সে সকল গৃহে বসতি করি , যে সকল গৃহ শ্বেত পারাবত অধুষ্যিত , যেখানে গৃহিণী উজ্জ্বল সুশ্রী , যেখানে কলহ নাই , ধান্য সকল সুবর্ণ সদৃশ , তণ্ডুল রজতোপম এবং অন্ন তুষহীন । যে গৃহস্থ পরিজনের মধ্যে ধন ভোগ্য বস্তুর সমান বিভাগ পূর্বক বিতরণ করেন , যিনি মিষ্টভাষী , বৃদ্ধপোসেবী , প্রিয়দর্শন , স্বল্পভাষী , অ দীর্ঘ সূত্রী , ধার্মিক , জিতেন্দ্রিয় , বিদ্যা বিনয়ী , অ গর্বিত , জনানুরাগী , পরপীড়ন বিমুখ , যিনি ধীরে স্নান করেন , চয়িত পুস্প আঘ্রাণ করেন না , সংযত এমন ব্যাক্তি আমার কৃপা পেয়ে থাকেন । "

শুধু অর্থ নয় , উন্নত চরিত্রও মানুষের অমূল্য সম্পদ । লক্ষ্মী দেবীর কৃপা তাঁরাই লাভ করেন যারা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী । লক্ষ্মী র কৃপা সব সময় সৎ কাজেই ব্যাবহার করা উচিত । মানুষ যদি লক্ষ্মী র অপপ্রয়োগ করেন ত অলক্ষ্মীর শাপে সে ধ্বংস হবেই । যে শুদ্ধ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী তাঁর গৃহে লক্ষ্মী অচলা হয়ে অবস্থান করেন । আর যারা ঠিক এর উল্টো তারা কর্মদোষে অলক্ষ্মীর আহ্বান করে ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয় । লক্ষ্মী হল 'শ্রী' । সকল নারীর মধ্যে যে শীল ও সদাচার আছে তার মাধ্যমেই তিনি প্রকাশিতা । তাই যেখানে নারী দের প্রতি অবমাননা হয় , বা যারা নারী দের ওপর নির্যাতন করেন - সেই সব জায়গায় কখনই দেবী লক্ষ্মীর কৃপা বর্ষণ হয় না ।

কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন - কে জেগে আছেন ? যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে , লক্ষ্মী তাঁকে ধন সম্পদ দান করেন ।

" নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ ।। "

অক্ষক্রীড়া শব্দের সাধারন অর্থ পাশা খেলা । এক শ্রেনীর লোক এই দিন পাশা খেলার মাধ্যমে টাকা পয়সা বাজি রেখে জুয়া খেলায় মেতে ওঠে । আবার কেউ কেউ এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে গাছপালা তছনছ করে । এই সব অর্থহীন কাজের মাধ্যমে তারা ভাবে যে লক্ষ্মী দেবী তাদের কৃপা করবেন ।

'অক্ষ' শব্দটির অনেক রকম মানে হয় । অক্ষ শব্দটির দ্বিতীয় অর্থ - ক্রয় বিক্রয় চিন্তা । যারা বৈশ্য তাঁরা এইদিন দেবীর আরাধনা করে ব্যবসা বাণিজ্যের চিন্তন করেন । দেবীর কৃপা পেলেই ত ব্যবসায় সফলতা আসবে । 'অক্ষ' শব্দটির আরেক ভাবে রুদ্রাক্ষ , জপমালা কেউ বোঝায় । যারা ভক্ত মানুষ - তাঁরা এই রাত্রে দেবীর কৃপা পাবার আশায় তাঁর নাম জপ করেন । ধন সম্পদ বলতে শুধু কি অর্থ , সোনা দানা ? বৈকুণ্ঠ ধাম , শ্রী বিষ্ণুর পাদপদ্ম পরম ধন । লক্ষ্মী পূজোর রাত্রে দেবী আসেন মর্ত্যলোকের দ্বারে দ্বারে । কিন্তু যে ঘুমিয়ে থাকে তার দ্বার থাকে লক্ষ্মী দেবী চলে যান । কিন্তু যিনি জেগে ভক্তি চিত্তে লক্ষ্মী জনার্দনের উপাসনা , নামস্মরণ করেন - দেবী তাঁকেই কৃপা করেন ।

পেঁচক মা লক্ষ্মীর বাহন । ধান হল লক্ষ্মীর প্রতীক । চাল , অন্ন , খাদ্যশস্য হল লক্ষ্মীর প্রতীক । তাই যারা খাদ্য অপচয় করেন , তাঁদের ওপর দেবী লক্ষ্মী কখনোই তুষ্ট হন না । ধানক্ষেতের আশেপাশে মূষিক এর বাস । এবং এরা ধানের ক্ষতি করে থাকে । পেঁচক এর আহার হল এই মূষিক । গোলাঘর কে লক্ষ্মীর প্রতীক বলা হয় । গোলাঘরের আশেপাশে মূষিক কূলের নিবাস । পেচক এই মূষিক দের ভক্ষণ করে খাদ্যশস্য কে রক্ষা করে । তাই এদিক থেকে পেঁচক মা লক্ষ্মীর বাহন হিসাবে যথার্থ মানানসই ।

পেঁচক দিনে অন্ধ । সে রাত্রে জাগে । তাই আমরা যেনো পরধন সমন্ধে তেমন অন্ধ হই । কখনো যেনো অন্যের ধন আত্মস্যাৎ করার ইচ্ছা মনে না জাগে ?

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন -

" যা নিশা সর্বভূতানাং সা নিশা জাগরতি সংযমী ।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশাতো মুনেঃ ।। "

অর্থাৎ সর্ব ভূতের যা রাত্রি , সংযমীর পক্ষে তা দিন । তাঁদের যা দিন , তাঁর তা রাত্রি । সকল প্রানী পরমার্থ বিষয়ে নিদ্রিত কিন্তু বিষয়ভোগে জাগ্রত । কিন্তু সংযমী সাধু যোগী পরমার্থ বিষয়ে জাগ্রত , বিষয়ভোগে নিদ্রিত । দেখা যায় দিবাকালে অন্য প্রাণীরা যখন জাগ্রত পেচক তখন নিদ্রিত । পেচক নিশাচর । নিশীথের নিস্তব্ধ পরিবেশ সাধুদের সাধনার অনুকূল । তাই পেচক আমেদের পরমার্থ চিন্তার আদর্শ সেখায় , যার মাধ্যমে আমরা দেবীর কৃপা পেতে পারি ।

লক্ষ্মীর আর এক নাম শ্রী, সম্পদ । তাই ছন্নছাড়া জীবনযাপনকারীকে লক্ষ্মীছাড়া বলা হয় । আবার সাজানো গোছানো বাড়ি-ঘর দেখে তবেই লোকে বাড়ির গৃহিণীকে লক্ষ্মীমন্ত বলেন । আর এর বিপরীত হলেই লক্ষ্মীছাড়া বা অলক্ষ্মী । এই অলক্ষ্মী ও লক্ষ্মীর সহাবস্থান কখনই সম্ভব নয় । তাই অলক্ষ্মী যাকে আশ্রয় করেন, লক্ষ্মী তাঁকে ত্যাগ করেন । এই জন্য দীপান্বিতায় যে লক্ষ্মী পুজো হয় তখন প্রথমে অলক্ষ্মীকে গোবর দিয়ে তৈরি করে বাড়ির বাইরে ফেলে আসা হয় । তারপর শুরু হয় লক্ষ্মীপুজো । একেই সাধারণভাবে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী পুজো বলে । 

ভারতে লক্ষ্মীপুজোর ইতিহাস বহু প্রাচীন। ঋগ্বেদে লক্ষ্মীর কোনও সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও শ্রী শব্দের উল্লেখ রয়েছে বেশ কয়েকবার। এখানে শ্রী অর্থে সৌন্দর্যের আধার। যদিও পরবর্তী কালে শ্রীসুক্তে অবশ্য উল্লেখ রয়েছে শ্রী নামক এক দেবীর, যিনি পদ্মের উপর দণ্ডায়মান। সেই আদি যুগ থেকেই লক্ষ্মীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে পদ্ম। তাই তিনি পদ্মাসনা, পদ্মালয়া। যুগ যুগ ধরে লক্ষ্মীকে বিভিন্ন রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শুক্ল যজুর্বেদে শ্রী তথা লক্ষ্মীকে আদিত্যের দুই পত্নী রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। অথর্ববেদে উল্লেখ মেলে পুণ্যালক্ষ্মী এবং পাপী লক্ষ্মীর। রামায়ণে সীতাকে লক্ষ্মী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি হল, সমুদ্রমন্থনের সময় লক্ষ্মীর আবির্ভাব।

তবে শুধু হিন্দু ধর্মে নয়, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেও উল্লেখ রয়েছে দেবী লক্ষ্মীর। যেমন বৌদ্ধ 'অভিধানপ্পদীপিকা'-তে তিনি সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী। তেমনই 'শালিকেদার' এবং 'সিরি-কালকন্নি' জাতকে তাঁকে সৌভাগ্য ও জ্ঞানের দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার বৌদ্ধতন্ত্রে তিনি বসুধারা নামে পূজিত হতেন। তিনি দেবী লক্ষ্মীর বৌদ্ধ প্রতিরূপ। অন্য দিকে জৈন ধর্মে তাঁর উল্লেখ রয়েছে মহাবীরের মাতা ত্রিশলা, যে রাতে জিনকে স্বপ্নে ধারণ করেছিলেন সেই রাতেই গজলক্ষ্মীকে স্বপ্নে দেখেছিলেন।

প্রাচীন ভারতের শিল্পকলায় এমনকী মুদ্রায় দেবী লক্ষ্মীর অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পকলায় ভারহুত, সাচী কিংবা অমরাবতীর ভাস্কর্যে লক্ষ্মীর সন্ধান মেলে। ভারতীয় সংগ্রহালয়ে রক্ষিত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের, বেসনগরের যে কল্পবৃক্ষ রয়েছে তাতে প্রচুর ধনসম্পদের সঙ্গে শঙ্খ ও পদ্মের চিহ্ন দেখা যায়। গবেষকদের মতে এই কল্পবৃক্ষের সঙ্গে কুবের অথবা লক্ষ্মীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রায় গজলক্ষ্মী কিংবা অভিষেক রত লক্ষ্মীর অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া যায়। লক্ষ্মী মূলত দ্বিভুজা অথবা চতুর্ভুজা হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিনি বহুভুজাও ।
                                   
‘‘লক্ষ্মী মানে শ্রী, সুরুচি। লক্ষ্মীসম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসেবে তাঁকে পূজা করা হত। তবে পরবর্তীকালে ধনশক্তির মূর্তি নারায়ণের সঙ্গে তাঁকে জুড়ে দেওয়া হয়’’ - বলছেন ‘নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী’। ‘ধন ও সৌভাগ্যের দেবী’ মা লক্ষ্মী। অবাঙালিদের মধ্যে লক্ষ্মীপূজার রেওয়াজ ‘কালীপূজা’ বা ‘দীপান্বিতা অমাবস্যার দিনে’। কিন্তু বাঙালির ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মী পূজিতা হন দেবীপক্ষের শেষের এই পূর্ণিমাতে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে ‘কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার চল’ রয়েছে। তবে রীতিতে ফারাক রয়েছে দুই বাংলায়। পশ্চিমবঙ্গে পূজা হয় মূলতঃ ‘মাটির প্রতিমায়’, কিন্তু বাংলাদেশে প্রধানত ‘সরায় এঁকে লক্ষ্মীর পূজা’ করা হয়। কিন্তু দেবী লক্ষীর ইতিহাস যতটা সরল ভাবা হয়, ততটা সরল নয়। লোকসাংস্কৃতিক ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে চমক। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র মতো প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে লক্ষ্মীপূজার উল্লেখ দেখে বোঝা যায়, সেকালে এই পূজার জনপ্রিয়তা কতটা ছিল। ‘নীহাররঞ্জন রায়’ তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস’-গ্রন্থে  লিখেছেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। ... আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচূর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা ...। বাঙালী হিন্দুর ঘরে ঘরে নারীসমাজে সে পুজা আজও অব্যাহত। বস্তুতঃ, দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।’’ লক্ষ্মীপূজা আমাদের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে কেবল টাকাকড়িই ধন নয়। ‘চরিত্রধন’ মানুষের ‘মহাধন’। যাঁর টাকাকড়ি নেই সে যেমন ‘লক্ষ্মীহীন’, যাঁর ‘চরিত্রধন’ নেই সে তেমনি ‘লক্ষ্মীছাড়া’। যাঁরা সাধক তাঁরা লক্ষ্মীর আরাধনা করেন ‘মুক্তিধন’ লাভের জন্য। কেউ কেউ বলেন, লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যাঁরা অপব্যবহার করে, তাঁদের কপালে লেখা আছে ‘যমের দণ্ড’ - এই কথা ঘোষণা করে লক্ষ্মীর বাহন। তাই কথায় বলে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। এছাড়া ধনসম্পত্তি, সে টাকাকড়ি হোক বা ‘সাধনধন’ই হোক, সদাজাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয়। রাতে সবাই যখন ঘুমায়, তখন পেঁচা জেগে থাকে। পেঁচাই সেই ধনসম্পদ পাহারা দেয়।

দেবী লক্ষ্মীর ইতিহাস খুঁজতে বহুবছর আগের আগের একটি ‘রোজনামচা’র কয়েকটি বাক্য দিয়ে ইতিহাসের পাতা উল্টানো যেতে পারে। 
                               
‘‘‌ও লক্ষ্মী! চেস্টনাটের ঘোড়াটা আমাকে পাইয়ে দাও, যাতে সে আমার আস্তাবলে বাধ্য হয়ে থাকে। আমাকে সৌভাগ্যের আনন্দে ভরিয়ে দাও।’‌’‌ - এই কথাগুলো যিনি লিখেছিলেন, তিনি ভারতীয়ই নন। একজন ইংরেজ মহিলা। তাঁর নাম ছিল নাম ‘ফ্যানি পার্কস’‌। তিনি ভারতে এসেছিলেন ১৮২২ সাল নাগাদ। ইংল্যান্ডের ‘ওয়েলস’‌ থেকে একেবারে ‘কলকাতা’‌য়। এ দেশে কাটিয়েছিলেন প্রায় ২৪ বছর। লিখেছিলেন তাঁর ‘রোজনামচা’। সেটা লণ্ডন থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল, ১৮৫০ সালে। বইটার নাম ছিল ‘ওয়ান্ডারিংস অফ আ পিলগ্রিম ইন সার্চ অফ দ্য পিকচারেস্ক’। শুধু ‘কলকাতায়’ নয়। তাঁর স্বামী চাকরিতে বদলি হয়ে ‘এলাহাবাদে’ও গিয়েছিলেন। স্বামীর সঙ্গে গিয়েছিলেন ‘ফ্যানি’ও। সেখানেও কাটিয়েছিলেন দীর্ঘ সময়। সেই ‘এলাহাবাদে’ থাকার সময়ই তিনি তাঁর ‘রোজনামচাতে’ লিখেছিলেন ওপরের কথাগুলো। এই কথাগুলোর পিছনে একটা ঘটনাও আছে। সেই সময় ‘এলাহাবাদে’ একটা লটারির আয়োজন করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল সেই লটারিতে বিজয়ী পাবেন একটা ঘোড়া। যে সে ঘোড়া নয়। একেবারে খাস বিলেত থেকে আমদানি করা ‘চেস্টনাট ঘোড়া’। সেই লটারির টিকিট কেটেছিলেন ‘ফ্যানি’ - রীতিমতো লক্ষ্মীদেবীকে স্মরণ করে। ‘শ্রী ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী’ - সে কথা ভালমতোই জানতেন বিদেশিনী ‘ফ্যানি’। তিনি আরও জানতেন, লক্ষ্মী দেবীর গায়ের রং হলুদ, জলপদ্মে তাঁর অধিষ্ঠান, হাতে থাকে তাঁর পদ্মফুল, হরিপ্রিয়া তিনি। এ সব কথাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের ‘রোজনামচায়’ লিখেছিলেন ‘ফ্যানি’। তাঁর সে লেখায় অবশ্য দেবীর আসন হল ‘ওয়াটার–লিলি’ আর লক্ষ্মীপতি হরির বানান হল ‘Huree’। তা তিনি তো বিদেশিনী, তাই তাঁর লেখায় একটু ভুল হতেই পারে। কিন্তু এক ‘অহিন্দু’, ‘অভারতীয়’ এক মহিলার এমন কম্ম যদি আপনাকে বিস্মিত করে, তবে জানবেন, অবাক করা কাণ্ডকারখানার এখানেই শেষ নয়। ‘লক্ষ্মীর সঙ্গে ভারতীয় সমাজ জীবনের সম্পর্কের কথা’ পুরোদস্তুর ওয়াকিবহাল ছিলেন ‘ফ্যানি’। এ’দেশের আমজনতার লক্ষ্মী বিষয়ক ধ্যানধারণা তাঁর কাছে ছিল পরিষ্কার। লোকের হাতে টাকাপয়সা এলে তাঁরা মনে করেন, ঘরে লক্ষ্মী এসেছেন। আর ‘দারিদ্র্য’ মানে ‘লক্ষ্মীছাড়া দশা’। এত বাহ্য! পুরাণে দেবীর আবির্ভাব নিয়ে যা বলা আছে, সে বিষয়ও ‘ফ্যানি’র অজানা ছিল না। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘‌বিষ্ণু এই সৌন্দর্যের দেবীকে তুলে আনেন সাগর থেকে। সেই তখন, যখন শুভ অশুভ আত্মারা অমৃতের জন্য সমুদ্র মন্থন করছিলেন। ভেনাসের মতো সৌন্দর্যময়ী এই নারী সফেন সাগর থেকে উঠে চলে যান স্বর্গের পথে।’‌’‌ তবে ‘ফ্যানির কলমে লক্ষ্মীর বর্ণনা’‌ শাস্ত্রে বর্ণিত ‘লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্র’‌কেও হার মানায়। ফ্যানি লিখেছিলেন, ‘‌‘এই দেবী অমিত সৌন্দর্যের অধিকারী। সদ্যসমাগত যৌবন তাঁকে মোহময়ী করেছে। নানা অলংকারে সেজেছেন তিনি। সব রকমের শুভচিহ্ন তাঁর শরীরজুড়ে। তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে মুকুট, হাতে ব্রেসলেট। কালো চুলের ঢেউয়ের বলয় তাঁর ভাসছে বাতাসে। গায়ের রং যেন গলানো সোনা, মুক্তোর গয়না তাঁর সর্বাঙ্গে। মুখে তাঁর অপরূপ বিভা।’‌’‌ আর নিজের রোজনামচার যে অধ্যায়ে এসব লিখেছিলেন ‘ফ্যানি’‌, সেটার শিরোনামটাও সরাসরি ‘লক্ষ্মী মাহাত্ম্য’‌ প্রচার করছে - ‘‘লছমি, দ্য গডেস অফ বিউটি’’; অর্থাৎ, ‘‘সৌন্দর্যের দেবী লক্ষ্মী’’।
  
সাগর পেরিয়ে আসা বিদেশিনী তাঁর রোজনামচায় কেবল ‘সমুদ্র–সম্ভূত লক্ষ্মী’র কথাই লিখেছিলেন। কিন্তু ‘পুরাণকথা থেকে পরানগাঁথা’, ‘বৈদিক সাহিত্য থেকে রামায়ণ–মহাভারতের পাতা’ ওল্টালে লক্ষ্মীর আরও অনেক ‘আবির্ভাব তত্ত্বের’ হদিশ মেলে। যেমন, ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’। সেখানে বলা হয়েছে, ‘রাধা আর লক্ষ্মীর উৎস’ অভিন্ন। তাঁদের দুজনেরই উৎস হলেন ‘কৃষ্ণ’। ‘রাসমণ্ডলে’ কৃষ্ণের বাঁদিক থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক নারী। তিনি ভগবানের ‘হ্লাদিনী শক্তি’, তাঁর ‘লীলাসঙ্গিনী’। আবির্ভাবের পর পরই কৃষ্ণের ইচ্ছেতে তিনি দু‌’ভাগ হয়েছিলেন। যে দু’জন তার ফলে সৃষ্টি হয়েছিলেন তাঁরা দু’জনেই ‘রূপে-গুণে’, ‘বসনে-বচনে’ একইরকম ছিলেন। মানে বিজ্ঞানের ভাষায় পরস্পরের ‘ক্লোন’ আর কী। তাঁদের একজন ‘রাধা’, অন্যজন ‘লক্ষ্মী’। তাঁদের দু’জনেই চেয়েছিলেন ‘কৃষ্ণ’কে। স্রষ্টাকে চেয়েছিল তাঁর সৃষ্টিরা। দু’জনকেই তুষ্ট করেছিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণ’। ‘দ্বিভুজ রূপে’ কৃষ্ণ ‘আরাধিকা রাধিকা’কে গ্রহণ করেছিলেন। আর ‘চতুর্ভুজ বিষ্ণু’ রূপে গ্রহণ করেছিলেন ‘শ্রীময়ী লক্ষ্মীদেবী’কে। ‘প্রেম’ আর ‘সম্পদ’, ‘মন’ আর ‘ধন’, দুই’ই রয়ে গেল তাঁর। তাই–ই যদি হবে, তবে লক্ষ্মী ‘সাগরসম্ভূতা’, ‘সিন্ধু–তনয়া’ হলেন কীভাবে? ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’ কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তরও ‘অমীমাংসিত’ রাখেনি।
                                 
‘দুর্বাসা’ ছিলেন মহারাগী এক মুনি। কথায় কথায়, পান থেকে চুন খসলেই ধেয়ে আসত তাঁর অভিশাপ। তাঁর অভিশাপের হাত থেকে রেহাই পেতেন না কেউ - তা সেটা ‘দ্যুলোকে’ দেবতার দল হোক বা মর্ত্যের সাধারণ মানুষজন। তাঁর অভিশাপে একবার সকলকেই ‘শ্রীভ্রষ্ট’ হতে হয়েছিল। আসলে, সেবার কামে উন্মত্ত ‘দেবরাজ ইন্দ্র’ দুর্বাসার কথা মন দিয়ে শোনেননি। তিনি ‘অপ্সরা রম্ভা’কে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কোনওরকমে মুনিকে প্রণাম করেছিলেন। মুনি তাঁকে ‘পারিজাত ফুলের মালা’ দিয়েছিলেন আশীর্বাদ হিসেবে। সেই সঙ্গে বলেছিলেন, মালাটা প্রথমে ‘শ্রীহরি’র পায়ে দিতে হবে, তারপর নিজের মাথায় ঠেকাতে হবে, না হলে স্বর্গ–মর্ত্য সব ‘শ্রীভ্রষ্ট’ হবে। ইন্দ্র তখন নিজের মধ্যে ছিলেন না। তাই অত কথা কানে নেননি। পারিজাত ফুলের মালাটা পরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের বাহন ‘ঐরাবতের শুঁড়ে’। ‘ঐরারত’ কি আর অতশত বোঝে! সে মালাটা মাটিতে আছড়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যস! যা হওয়ার তাই হয়েছিল। ‘শ্রী’ অর্থাৎ ‘লক্ষ্মীদেবী’ স্বর্গত্যাগ করেছিলেন, চলে গিয়েছিলেন ‘বৈকুণ্ঠে’। ‘ঐরাবত’ও ইন্দ্রকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। অবস্থা বেগতিক বুঝে ‘রম্ভা’ও ইন্দ্রকে ত্যাগ করেছিলেন। এরপরে ইন্দ্রের চমক ভেঙেছিল। ‘শ্রীহীন অমরাবতী’ দেখে তাঁর মনটা হু হু করে উঠেছিল। তখন তিনি ছুটেছিলেন ‘ব্রহ্মার কাছে’। সেখানে গিয়ে দেখেছিলেন, ‘পিতামহ ব্রহ্মা’ও তাঁর ওপর বেজায় খাপ্পা। ‘ইন্দ্র’ অনেক কেঁদেকেটে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, ‘ব্রহ্মা’ একটু নরম হয়েছিলেন। বলেছিলেন, যাও বিষ্ণুর কাছে। উনিই এ যাত্রায় তোমাকে বাঁচাতে পারেন। ‘ইন্দ্র’ আর কী করেন? ‘বিষ্ণুর করুণা’ পেতে শুরু করেছিলেন কঠোর তপস্যা। শেষে তাঁর তপস্যায় ‘বিষ্ণু’ সন্তুষ্ট হয়ে ‘লক্ষ্মী’কে বলেছিলেন, ‘সিন্ধুর কন্যা’ হয়ে জন্ম নিতে। সেই কথা মেনে ‘লক্ষ্মী’ সাগরে গিয়ে ‘সমুদ্র–কন্যা’ রূপে জন্ম নিয়েছিলেন। এরপরে ‘সমুদ্রমন্থনের সময়’, ‘কামধেনু’ থেকে ‘ঐরাবত’, ‘রম্ভা’ থেকে ‘মেনকা’, সবাইকে ফিরে পেয়েছিলেন ‘ইন্দ্র’। সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে এসেছিলেন ‘লক্ষ্মী’ও। তিনি পুনরায় ‘বিষ্ণুর বক্ষলগ্না’ হয়েছিলেন। ‘শ্রী’ ফিরে পেয়েছিল স্বর্গ, সাথে মর্ত্যও।  

অর্থাৎ ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের দৃষ্টিকোণ’ থেকে ‘শ্রী’ আর ‘লক্ষ্মী’ অভিন্ন। এই জায়গাটাতেই ‘রামায়ণ–মহাভারত’ আবার অন্য কথা বলছে। ‘শ্রী’ নাকি ‘লক্ষ্মী’ নন! তিনি আলাদা দেবী। তিনি ‘সাদা কাপড়’ পরে সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলেন। তাঁকে পাওয়া নিয়ে দেবতা আর অসুরদের মধ্যে যুদ্ধও হয়েছিল। এই ‘শ্রী’ ‘সুখ–সমৃদ্ধির দেবী’। ‘মহাভারত’ এক ধাপ এগিয়ে বলছে, এই ‘শ্রী’ ‘শ্রীকৃষ্ণর সহধর্মিণী রুক্মিণী’, ‘তিনিই প্রদ্যুম্নের মা’। সত্যি কথা বলতে কী, ‘বৈদিক সাহিত্যে’ লক্ষ্মীকে ‘সৌভাগ্য কিংবা ঋদ্ধিদায়িনী দেবী’ হিসেবে পাওয়া যায় না। ‘ঋগ্বেদে’ ‘শ্রীর উল্লেখ’ কম করে ৮১ বার আছে। কিন্তু সেখানে কোথাও ‘শ্রী’ ‘ধনদাত্রী সৌভাগ্যদায়িনী নন’। তিনি স্রেফ ‘সৌন্দর্যময়ী’। ‘লক্ষ্মী’ শব্দের উল্লেখও এই একই বেদে আছে। তবে সেখানে ‘লক্ষ্মী’র মানে, পণ্ডিতরা বলেন, ‘অন্য রূপ’। ‘‘তাঁদের রচিত বাক্যটিতে অন্যরকম অর্থ নিহিত আছে’’ - বোঝাতে ‘ঋগ্বেদে’ বলা হয়েছে, ‘‘ভদ্রৈষাং লক্ষ্মীর্নিহিতাদি বাচি’’।
                                
এসব পণ্ডিতি কচকচানি থেকে মুক্তি মিলবে ‘শতপথ ব্রাহ্মণের’ একটি কাহিনীতে। সেখানে ‘শ্রীর উদ্ভবের কথা’ বর্ণিত হয়েছে। ‘প্রজাপতি’ সৃষ্টির জন্য তপস্যা করছিলেন। তপস্যা করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। তখন ‘তাঁর মুখ’ থেকে জন্ম নিলেন ‘শ্রী’। ‘শ্রীর জ্যোতির্ময় রূপ’ দেখে দেবতাদের মধ্যে লোভ হল। তাঁরা চাইলেন, ‘শ্রী’কে হত্যা করে তাঁর সম্পদ নিজেরা নিয়ে নেবেন। বাদ সাধলেন ‘প্রজাপতি’। তিনি বললেন, পুরুষরা কখনও স্ত্রী হত্যা করে না। সুতরাং ‘শ্রী’কে না হত্যা করে দেবতারা বরং তাঁর সম্পদগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিক। সেই মতো ‘অগ্নি’ নিলেন ‘অন্ন’, ‘সোম’ পেলেন ‘রাজ্য’, ‘বরুণের’ ভাগে পড়ল ‘সাম্রাজ্য’, ‘মিত্র’ পেলেন ‘ক্ষত্র’, ‘ইন্দ্র’ পেলেন ‘বল’, ‘সরস্বতী’ পেলেন ‘পুষ্টি’, ‘ত্বষ্টা’ পেলেন ‘রূপ’, ইত্যাদি। সবাইকে সব দেওয়া–থোওয়া হয়ে গেলে ‘শ্রী’ ‘প্রজাপতি’কে বললেন, আমার তবে রইলটা কী? ‘প্রজাপতি’ বললেন, চিন্তা কোরো না, যজ্ঞের সময় তুমি সব ফেরত পাবে। ‘শ্রী’ আশ্বস্ত হলেন। এই গল্পের একটা ‘প্রতীকী তাৎপর্য’ আছে - একটু তলিয়ে দেখলেই তা বোঝা যায়। মানুষের যা যা চাই, তা সব আছে ‘শ্রী’–র। আর সেগুলোই ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন দেবতারা ‘নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী’। খাবার তৈরি করতে ‘আগুন’ লাগে, তাই অগ্নি পেয়েছিলেন ‘অন্ন’। ‘সোম’ অর্থ ‘চাঁদ’, তাঁর জন্য পৃথিবী ‘রাজ্য’। শুধু ‘জ্যোৎস্না’ ছড়াবার জন্য নয়। সে পৃথিবীর ‘উপগ্রহ’ও বটে। ‘সাম্রাজ্য’ রাজ্যের চেয়ে বড়। পৃথিবীতে ‘জলভাগ’ ভূভাগের চেয়ে বেশি। সেই হিসেবে ‘সাম্রাজ্য’ পেয়েছিলেন ‘জলের দেবতা বরুণ’। ‘সরস্বতী’ মানে ‘বিদ্যাবুদ্ধি’, যা থাকা মানে ‘প্রাণের পুষ্টি’। ‘ত্বষ্টা’ হলেন ‘কারিগর’, তাই তাঁর ‘রূপের দরকার’, ওই নিয়েই তো তাঁর কারবার। ‘মিত্র’ আর ‘ইন্দ্র’র শাসন ক্ষমতা সামলাতে প্রয়োজন ‘ক্ষাত্রতেজ’ আর ‘শক্তি’, তাঁরা সেটাই পেয়েছিলেন। পরিশেষে, আর একটি কথা। ‘যজ্ঞের আহুতিতে’ ‘সবার শ্রেষ্ঠ সামগ্রী দানের প্রথা’ আছে। তা ছাড়া ‘যজ্ঞ’ করলে ‘ঈপ্সিত বস্তু’ মিলবে এরকম বিশ্বাসও আছে। এই দুয়ের ইঙ্গিতপুর্ণ সমর্থন মেলে ‘প্রজাপতির আশ্বাসে’।

‘বাজসনীয় সংহিতা’ আর ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’ মোতাবেক, ‘শ্রী’ আর ‘লক্ষ্মী’ হলেন ‘আদিত্যের দুই স্ত্রী’। এর দীর্ঘকাল পর, ‘শ্রী সূক্তের সময়’ - ‘লক্ষ্মী’ আর ‘শ্রী’ মিলে গিয়েছিলেন। একে অপরের ‘গুণাবলি’ গ্রহণ করে এক হয়ে গিয়েছিলেন।
                                  
‘কৃত্যতত্তম-অষ্টবিংশতিতত্ত্বমে’ আছে - ‘‘পাশ, অক্ষমালা, পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনা, ত্রিলোকের মাতা, গৌরবর্ণা, সুরূপা, নানা অলঙ্কারে সজ্জিতা, বাম হস্তে স্বর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণ করে বরদানকারিণী দেবীকে ধ্যান করি।’’ ‘তন্ত্রসার’ অনুসারে দেবী চার হস্তে বরমুদ্রা, অভয়মুদ্রা ও দুইটি পদ্ম ধারণ করে আছেন। তাঁর পীনোন্নত স্তনে মুক্তার হার শোভা পাচ্ছে। তন্ত্রসারের অন্যত্র ‘গজলক্ষ্মী’র যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা এরকম- দেবীর দেহ স্বর্ণবর্ণের। চারটি হস্তি শুঁড় দ্বারা অমৃতপূর্ণ স্বর্ণ-কলস তুলে অমৃতবর্ষণ করে তাঁর অভিষেক করছে। তিনি ডানদিকের উপরের হস্তে পদ্ম ও নিচের হস্তে বরমুদ্রা এবং বামদিকের উপরের হস্তে পদ্ম ও নিচের হস্তে অভয়মুদ্রা ধারণ করেছেন। তাঁর মস্তকে রত্নমুকুট, পরিধানে পট্টবস্ত্র এবং তিনি পদ্মে উপবিষ্টা আছেন। ‘চণ্ডী’তে যে ‘মহালক্ষ্মী’র উল্লেখ আছে- তিনি অষ্টাদশ ভূজা। তিনি অষ্টাদশ হস্তে অক্ষমালা, পরশু, গদা, বাণ, বজ্র, পদ্ম, ধনু, কমণ্ডলু, দণ্ড, শক্তি, অসি, ঢাল, ঘণ্টা, শঙ্খ, সুরাপাত্র, শূল, পাশ ও সুদর্শন চক্র ধরে আছেন। ‘তন্ত্ররাজ গ্রন্থে’ এক ‘সিদ্ধলক্ষ্মী’র কথা আছে যাঁর কৃপায় যুদ্ধে জয়লাভ করা যায়। সে ‘সিদ্ধলক্ষ্মী’র একশত মুখ, দুইশত বাহু, প্রতিটি মুখ ত্রিনয়ন-বিশিষ্ট, ভয়ঙ্কর এবং সমান আকৃতি বিশিষ্ট শক্তি দ্বারা পরিবৃতা। লক্ষ্মী দেবীর রূপ বিশ্লেষণ করে ‘রজোগুণের’ই আধিক্য পাওয়া যায়। হিরণ্যবর্ণ, স্বর্ণমুকুট, নানা অলঙ্কার, হস্তিদের ছেটানো অমৃত-জলে স্নান প্রভৃতি বিষয়গুলো প্রকৃতির ‘রজোগুণ’কেই সূচিত করে। দেবীর হাতে ‘পদ্ম’ এবং তিনি পদ্মের উপর বসে থাকেন অর্থাৎ পদ্মের সাথে দেবীর একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ‘পদ্ম’ হল ‘সূর্যের প্রতীক’। আর ‘সূর্য’ হল ‘বিষ্ণু’রই এক রূপ। বিষ্ণুর হাতেও ‘পদ্ম’ রয়েছে। তাই ‘বিষ্ণুশক্তি’ হিসেবে লক্ষ্মীর হস্তে ‘পদ্ম’ থাকাটা স্বাভাবিক। আবার ‘পদ্ম ভক্তিরও প্রতীক’। দেবী ভক্তদের ভক্তি প্রদান করেন তাই ‘ভক্তিপদ্ম’ তাঁর হস্তে।

লক্ষ্মী দেবী বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে অধিষ্ঠান করেন। ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে’ আছে এই দেবী বৈকুণ্ঠে পরিপূর্ণতমা শ্রেষ্ঠা ‘মহালক্ষ্মী’, স্বর্গে ইন্দ্রের সম্পদরূপা ‘স্বর্গলক্ষ্মী’, পাতাল ও মর্ত্যে রাজাদের ‘রাজলক্ষ্মী’, গৃহে তিনি ‘গৃহলক্ষ্মী’ ও ‘অংশরূপে গৃহিনী’ এবং ‘গৃহিগণের সম্পদরূপিণী মঙ্গলকারিণী মঙ্গলা’। তিনি ‘গাভীদের জননী সুরভী’, ‘যজ্ঞের পত্নী দক্ষিণা’, তিনি ‘ক্ষীরোদ-সমুদ্রকন্যা’, ‘পদ্মফুলের সৌন্দর্যরূপিণী’, ‘চন্দ্রের শোভারূপা’, ‘সূর্যমণ্ডলের শোভারূপা’ এবং ‘অলঙ্কারে, রত্নে, ফলে, জলে, নৃপপত্নীতে, গৃহে, সকল শস্যে, বস্ত্রে ও পরিষ্কৃত স্থানে বিরাজমানা’। ‘অষ্টলক্ষ্মী’ হলেন সম্পদের ‘দেবী লক্ষ্মীর আটটি বিশেষ রূপ’। তাঁরা ‘সম্পদের আট উৎস’ তথা ‘লক্ষ্মীদেবীর শক্তির প্রতীক’। ‘অষ্টলক্ষ্মী’ লক্ষ্মীর ‘অপ্রধান রূপভেদ’। ‘অষ্টলক্ষ্মী সম্পদ’ কথাটির অর্থ হল ‘সমৃদ্ধি’, ‘সুস্বাস্থ্য’, ‘জ্ঞান’, ‘শক্তি’, ‘সন্তানাদি’ ও ‘ক্ষমতা’। মন্দিরে ‘অষ্টলক্ষ্মী’কে একযোগে পূজা করা হয়ে থাকে। ‘শ্রীঅষ্টলক্ষ্মীস্তোত্রম্’ অনুযায়ী ‘অষ্টলক্ষ্মী’ হলেন -

১) ‘আদিলক্ষ্মী’ বা ‘মহালক্ষ্মী’: লক্ষ্মীর আদিরূপ এবং ঋষি ভৃগুর কন্যারূপে লক্ষ্মীর অবতার।
২) ‘ধনলক্ষ্মী’: লক্ষ্মীর অর্থ ও স্বর্ণদাত্রী রূপ।
৩) ‘ধান্যলক্ষ্মী’: কৃষিসম্পদদাত্রী লক্ষ্মী।
৪) ‘গজলক্ষ্মী’: গবাদি পশু ও হস্তীরূপ সম্পদদাত্রী লক্ষ্মী। ‘স্বামী চিদানন্দের মতে’ গজলক্ষ্মী রাজক্ষমতা প্রদান করেন। পুরাণ অনুযায়ী, গজলক্ষ্মী দেবরাজ ইন্দ্রকে সমুদ্রগর্ভ থেকে তাঁর হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ‘বসুধা নারায়ণ’ ‘গজলক্ষ্মী’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন ‘‘গজ অর্থাৎ হাতিদের দ্বারা পূজিত লক্ষ্মী’’।
৫) ‘সন্তানলক্ষ্মী’: সন্তানপ্রদাত্রী লক্ষ্মী।
৬) ‘বীরলক্ষ্মী’ বা ‘ধৈর্যলক্ষ্মী’: যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব এবং জীবনের কঠিন সময়ে সাহস প্রদানকারী লক্ষ্মী।
৭) ‘বিজয়লক্ষ্মী’ বা ‘জয়লক্ষ্মী’: বিজয় প্রদানকারিনী লক্ষ্মী, কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয় বরং কঠিন সময়ে বাধাবিপত্তি জয় করে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রেও।
৮) ‘বিদ্যালক্ষ্মী’: কলা ও বিজ্ঞানের জ্ঞানপ্রদানকারিনী লক্ষ্মী।

কোনো কোনো ‘অষ্টলক্ষ্মী’ তালিকায় লক্ষ্মীর অন্যান্য কয়েকটি রূপও অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে -

১) ‘ঐশ্বর্যলক্ষ্মী’: ঐশ্বর্যপ্রদাত্রী লক্ষ্মী।
২) ‘সৌভাগ্যা’: সৌভাগ্য প্রদানকারিনী।
৩) ‘রাজ্যলক্ষ্মী’: যিনি শাসককে আশীর্বাদ করেন।
৪) ‘বরলক্ষ্মী’: যে দেবী সুন্দর বর প্রদান করেন।
                             
কিন্তু বাংলা ও বাঙালি ‘লক্ষ্মী’কে যেভাবে চিনেছে, মেনেছে, পুজো করেছে ও করছে, তার সঙ্গে এসব ‘বেদ–পুরাণ–মহাকাব্যের যোগ’ সামান্যই। বাঙালির কাছে ‘লক্ষ্মী’ হলেন ‘ঘরের মেয়ে’। তিনি যতটা না ‘ধনলক্ষ্মী’, তার চেয়ে ঢের বেশি ‘ধান্যলক্ষ্মী’। তাঁর কথা তাই আমাদের ‘পরান–কথা’ হয়ে গিয়েছে ‘বৃহস্পতিবারের পাঁচালিতে’। সেখানে দেবী ধরাধামে নেমে আসেন ‘ভাঙা সংসারকে জোড়া দেওয়ার জন্য’। ফিরিয়ে আনেন ‘বাড়বাড়ন্ত সংসার থেকে হারিয়ে যাওয়া ‘শান্তি–সুখ–সমৃদ্ধি’। নির্দেশ দেন,

‘‘‌যাও তুমি ঘরে গিয়া কর লক্ষ্মী ব্রত
সুখ শান্তি ফিরে পাবে পুনঃ পূর্ব মতো
গুরুবারে সন্ধ্যাবেলা মিলি বামাগণে
লক্ষ্মী পুজো কর সবে ভক্তিচিত মনে।।’‌’‌

এতে সন্তুষ্ট না হয়ে যাঁরা ‘বঙ্গলক্ষ্মী’‌র সঙ্গে ‘বেদ–পুরাণের যোগ’‌ খুঁজতে ব্যাকুল হবেন, তাঁদের জন্য একটি বিশেষ তথ্য ‘লক্ষ্মীদেবীর ছেলেপিলেদের সুলুকসন্ধান‌‌’‌। ‘বেদ–পুরাণ’‌ ঘাঁটলে ‘শ্রী–লক্ষ্মী’‌র দুই ছেলের সন্ধান মেলে - ‘চিক্লীত’ ও ‘কর্দম। ‘চিক্লীত’ মানে ‘আর্দ্রতা’ আর ‘কর্দম’ হল ‘কাদা’। দুটোই কৃষি সভ্যতার বিকাশের জন্য দরকার। তার ওপর ক্ষেতের ধানের শত্রু ‘ইঁদুর’। অন্ধকারে ইঁদুর মারে ‘প্যাঁচা’। তাই সে লক্ষ্মীদেবীর বাহন। লক্ষ্মীর সঙ্গে তার যোগাযোগ এতটাই ঘনিষ্ঠ যে দেবীর পূজা আমরা দিনের বেলায় করি না। রাতপাখির জন্যই দেবী আমাদের কাছে ‘সান্ধ্যকালে বন্দিতা’। এর পর নিশ্চয় বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না যে ‘লক্ষ্মী’ আর ‘কৃষি’ এ বঙ্গে একাকার। তাই তিনি এখানে ‘পট–মূর্তি’র পাশাপাশি ‘ধানে’ও পূজিতা। এই যে ‘ব্রতকথা’, তার সুতো ধরে ‘লক্ষ্মীর উৎস সন্ধান’, এটার একটা আলাদা ‘তাৎপর্য’ আছে। এবং সেই ‘তাৎপর্য’ কোনও এক অজানা কারণে এ বঙ্গের গবেষণার ধারায় ‘উপেক্ষিত’। চারিদিকে যখন হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ব দিয়ে আমাদের ‘মনন ও আচরণ’ ঘিরে ফেলার চেষ্টা চলছে, তখন এই গবেষণা সূত্রটি বিশেষভাবে সাধারণ হওয়ার দাবি রাখে।
                                
পণ্ডিতরা বলেন, মুখ্যত ‘নারী দেবতা’কে কেন্দ্র করে তাবৎ ‘ব্রতকথা ও পাঁচালির সূত্রপাত’ হয়েছিল এই ভারতে। ‘পুরুষ দেবতারা’ আগেভাগেই সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়ায় তাঁদের ‘মাহাত্ম্য’ প্রচারের জন্য আর ‘পাঁচালি’র দরকার পড়েনি। এই ‘পাঁচালি’গুলোর একটা চেনা ছক আছে। ‘কার পুজো’, ‘কেন পুজো’, ‘কীভাবে করতে হবে সেই পুজো’, ‘না করলে কী কী বিপত্তি দেখা দেবে’, ইত্যাদি নিয়ে গঠিত চেনা বিন্যাসেই এগুলো রচিত। ‘মঙ্গলকাব্য’ থেকে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’, সর্বত্র রয়েছে এই ‘পরিচিত বুনোট’। এই ‘পাঁচালিগুলোর কাহিনীর বীজ’ লুকিয়ে থাকে লোকসমাজের প্রয়োজনগুলোর ওপর।

এবার চোখ ফেরানো যাক ‘বাংলার ইতিহাসে’। ভারতবর্ষে ‘অস্ট্রিক জাতির’ প্রধান আশ্রয়ভূমি ছিল বঙ্গদেশ। আর্যরা যতদিন না এখানে পা রেখেছে, ততদিন ‘অস্ট্রিক সভ্যতা’ বাংলার সভ্যতাকে পুষ্টি দিয়েছিল। এই ‘অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী’ ভারতের কৃষি সভ্যতার বিকাশে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। এঁরা আর্যদের মতো ‘মানুষের মূর্তিতে দেবপূজায়’ বিশ্বাস করত না। সেজন্য তাঁরা ‘প্রাকৃতিক বস্তুকে’ পূজা করতেন। ‘ধান’ বা ‘ধানের ছরা’ বা ‘ধানের শিষ’ পূজা সেরকমই একটা বিষয়। ‘বাংলার মাটি ও জলবায়ু’ কৃষির উপযোগী। সেজন্য ‘বঙ্গনারী’ ঐহিক প্রাপ্তির আশায় ‘লক্ষ্মীপূজা’ করেন। ‘কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে’ বাঙালির পরিবারের ‘সুখশান্তি’ নির্ভর করে। তাই ‘বৃহস্পতিবার’ তাঁর কাছে হয়ে ওঠে ‘লক্ষ্মীবার’। মূলতঃ, ‘অব্রাহ্মণ্য প্রণোদনায়’ ‘গার্হস্থ্য সুখের জন্য’ মেয়েদের এই ‘ব্রত’। তাই এ পুজোয় ‘সধবা নারী’ স্নান সেরে ‘ধূপ–ধুনো–প্রদীপ জ্বালিয়ে’, ‘পান-সুপারি-সিঁদুর গোলা- আতপ চাল- ফল-মিষ্টি দিয়ে’ ‘শুদ্ধাচারে পূজা’ করলেই দেবী সন্তুষ্ট। ‘লক্ষ্মীপূজায়’ যে ‘পান-সুপারি-সিঁদুর গোলা-আতপ চাল’, এ ধরনের সাদামাঠা উপচার, এসবই, ‘সমাজতত্ত্ববিদ’ ও ‘নৃতত্ত্ববিদরা’ বলেন, ‘অস্ট্রিক সভ্যতার চিহ্ন’। এ জন্যই ‘বাংলার লক্ষ্মী’ বাদবাকি ভারতের লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে খাপ খান না। তিনি স্বতন্ত্র।
                                
ইতিহাসের পাতায় ‘মুদ্রা’ আর ‘মূর্তি’ খুঁজতে বসলে গোড়ায় ‘লক্ষ্মীদেবীর পেচক বাহন’ কিন্তু মিলবে না। একটু দেখে নেওয়া যাক। ‘খ্রীস্টপূর্ব ১৫০ থেকে ১০০ অব্দে’, ‘কুনিন্দরাজ’ ছিলেন ‘অমোঘভূতি’। হিমালয়ের বুকেছিল তাঁর রাজ্য। সে সময়ের যে ‘মুদ্রা’ পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় যে - ‘লক্ষ্মীদেবী’ বসে আছেন, আর তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ‘হরিণ’। লক্ষ্মী ‘চঞ্চলা’। ‘হরিণ’ও বড়ই ছটফটে। সে কথা মাথায় রাখলে ‘হরিণ’কেই তাঁর উপযুক্ত বাহন বলে মনে হয়। ৪১৪ থেকে ৪৫৫ খ্ৰীস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন ‘গুপ্ত বংশীয় সম্রাট কুমারগুপ্ত’। তাঁর আমলের যেসব ‘মুদ্রা’ পাওয়া গেছে, তাতে আবার ‘লক্ষ্মীদেবী’ একটা ‘ময়ূর’কে খাওয়াচ্ছেন বলে দেখা গেছে। হতেই পারে। কারণ সৌন্দর্যের বিচারে দু’জনেই অপরূপ সুন্দর। অন্য দুই ‘গুপ্ত রাজা’, ‘প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায়’, এমনকী ‘কুমারগুপ্তের’ কিছু কিছু ‘মুদ্রা’তে দেখা যায়, ‘লক্ষ্মীদেবী’ ‘সিংহের পিঠে’ চেপে বসেছেন। বসতেই পারেন। অনেকে বলেন - ‘দুর্গা’, ‘লক্ষ্মী’, ‘সরস্বতী’ আদতে একই। ‘সূর্যের তিনটি রূপের প্রকাশ’। প্রাতঃকালে সূর্য ‘ঊষা’। ‘সরস্বতী’ তারই প্রকাশ। মধ্যাহ্ন সূর্যর রং ‘অতসী ফুলের মত’। সেই রং ‘দুর্গা’র। তাই চালচিত্রের মধ্যিখানে থাকেন তিনি। আর ‘সায়ং সূর্য লক্ষ্মী’। তা যদি মেনে নিই তবে ‘দুর্গার বাহন’ লক্ষ্মীর হতেই পারে। বিশেষ করে যখন ‘সিংহের কেশরের’ চেহারায় বেশ একটা সূর্যের ছটার মতো ব্যাপার আছে। গুপ্তদের পর বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন ‘শশাঙ্ক’। তাঁর আমলের ‘মুদ্রা’য় লক্ষ্মীর বাহন হয়েছিল ‘হাঁস’। ‘দুর্গা–লক্ষ্মী–সরস্বতী’ একই শক্তির প্রকাশ হলে এতেও কোনও আপত্তির কারণ থাকতে পারে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁর বাহন হিসেবে ‘কচ্ছপ’কে দেখা গেছে। ‘কচ্ছপ বিষ্ণুর দ্বিতীয় অবতার’। সেই হিসেবে চলতে পারে। আবার কোনও সময় দেখা গেছে ‘বিষ্ণু বাহন গরুড়’ লক্ষ্মীদেবীরও বাহন। এটাও ওই বিষ্ণুর সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই স্বাভাবিক পছন্দ।

কিন্তু শেষমেশ তাঁর বাহন হল প্যাঁচা হল কীভাবে? উত্তরটা খোঁজা যাক। ‘গ্রিক দেবী এথেনা’ আর ‘রোমানদের দেবী মিনার্ভা’, এঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল ‘প্যাঁচা’র। তাঁরা ছিলেন ‘জ্ঞানের দেবী’, ধনের নন। ‘জ্ঞান’ না থাকলে ‘ধন’ অর্জিত হলেও রক্ষা করা মুশকিল। সেই বিচারেই ‘প্যাঁচা’ লক্ষ্মীর পায়ের তলায় উড়ে বসল কিনা, সেটা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়। ‘গিরিবালা দেবী’র ‘রায়বাড়ি’ উপন্যাসে একটা ‘ভূত তাড়ানোর মন্ত্র’ আছে -

‘‘‌প্যাঁচায় চড়ে লক্ষ্মী আসেন ঘরে, ভূত পালায় ডরে।
লক্ষ্মীর হাতে ধানের বালা, মাথায় সোনার ছাতি,
ভূত পালাল, জ্বালা তোরা হাজার সোনার বাতি।’‌’‌

‘ভূত’‌ মানে যদি ‘দারিদ্র্য’‌ হয়, ‘ইঁদুর’‌ হয়, ‘ক্ষেতের শস্য নষ্টকারী পোকামাকড়’‌ হয়, তবে ‘প্যাঁচায় চড়ে লক্ষ্মীর আগমনের তাৎপর্য’‌ স্পষ্ট বোঝা যায়। আমরা স্থির বিশ্বাসে বলতে পারি, বলতেই পারি, ‘ধানের শত্রু ইঁদুর’দের মেরে যে ‘শস্যরক্ষার ব্রত’ পালন করেছে, আবার যাঁকে অন্য সভ্যতাও ‘পরমার্থ চিন্তার প্রতীক’ হিসেবে মেনেছে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ আমাদের ‘ধন অর্জন ও রক্ষার দায়িত্ব’ পেতে পারতেন না। তাই ‘লক্ষ্মীদেবী’ শেষ পর্যন্ত ‘দুর্গাকে সিংহ’, ‘সরস্বতীকে হাঁস’, ‘কার্তিককে ময়ূর’ দিয়ে, ‘কূর্মকে বিষ্ণুর অবতার’ আর ‘গরুড়কে বিষ্ণুর বাহন’ হিসেবে ছেড়ে দিয়ে, ‘প্যাঁচা’কে নিজের কাছে রেখে ভালই করেছেন। সে অন্ধকারেও দেখতে পায়। এমনিতে চুপচাপ। কিন্তু লুঠেরা ইঁদুর এলে ঠোঁট আর নখ নিয়ে মারাত্মক। হিংস্র রাতগুলোতে ‘জীবনের সম্পদ’ বাঁচাবার জন্য আমাদের এরকম একটা ‘বিচক্ষণ পাহারাদার’ দরকার। 
                               
‘বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজা’ দু’বার হয় - ‘কোজাগরী’ ও ‘দীপান্বিতা’। একটা পূজা ‘পূর্ণিমা’য়। আর একটা ‘অমাবস্যা’য়। লক্ষণীয়, লক্ষ্মীদেবীর দুটো পূজাই হয় রাতের বেলায়। পূর্ণিমায় জ্যোৎস্নাভরা রাতে লক্ষ্মীপুজো হলে কোনও জিজ্ঞাসা জাগে না, কারণ ওটা স্বাভাবিক। লক্ষ্মীর লক্ষ্মীমন্ত রূপের সঙ্গে পূর্ণিমার স্নিগ্ধতা, এ দুয়ের ভেতর একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। ‘বেদ–পুরাণের কালে’ও এই সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্কটা আড়াল হয়নি। ‘ঋক সূক্তে’ রয়েছে ‘রাকার কথা’। ‘রাকা’ - ‘পূর্ণিমার অধিষ্ঠাত্রী দেবী’। তিনি যেমন ‘সুন্দরী’ তেমনই ‘ঐশ্বর্যশালিনী’। এমন দেবীর সঙ্গে ‘পূর্ণ সঙ্গতি’ আছে যাঁর, তিনি অবশ্যই ‘লক্ষ্মী’। সুতরাং ‘কোজাগরী পূর্ণিমা’য় লক্ষ্মীর পুজো করা যেতেই পারে। কিন্তু ‘দীপান্বিতা অমানিশায়’ কেন? ‘কার্তিক মাস’ ছাড়া অন্য কোনও মাসের অমাবস্যায় তো ‘লক্ষ্মীপূজার বিধান’ নেই। ‘ব্রতকথা’ বলছে, একবার কোন এক রাজার আদেশে সারা দেশে কার্তিকি অমাবস্যায় গোটা রাজ্য ছিল অন্ধকার। মা লক্ষ্মী প্যাঁচার পিঠে চড়ে রাজ্য পরিক্রমায় বেরিয়ে দেখেন, চরাচরে কেবল মিশমিশে আঁধার। শুধু এক দুঃখিনী রাজকন্যা বনের ভেতর তাঁর কুটিরে প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল। মা লক্ষ্মী সেখানেই নামলেন। প্রসন্ন হয়ে বর দিলেন কন্যেকে। তার দুঃখ ঘুচল। প্রচার পেল ‘দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর কথা’। ওদিনই আবার ‘অলক্ষ্মীর পূজা’। ঘরের বাইরে ‘কৃষ্ণ পুষ্প’ দিয়ে ‘চালের গুঁড়ো’ কিংবা ‘গোবর’ দিয়ে গড়া ‘অলক্ষ্মী পুতুলের পূজা’। পূজা শেষ হলে ‘কুলোর বাদ্য’ বাজিয়ে বলা হয়, ‘‌‘অলক্ষ্মী দূর হ, মা লক্ষ্মী ঘরে এসো।’‌’‌ তাই ওইদিন ‘‌অলক্ষ্মী বিদায়ের পর’‌ লক্ষ্মীপুজোর আয়োজন। তবে এই কোজাগরী পূর্ণিমায় বাংলার ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পূজিত হওয়া নিয়েও একটা কাহিনী আছে। অনেকটা একটু আগে উল্লেখিত ‘দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর কথা’র মতন। তবে এক্ষেত্রে কাহিনীর চরিত্ররা আলাদা। বাংলার বাইরে লক্ষ্মী পূজিত হন ‘গৌণ চান্দ্র কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথি’তে অর্থাৎ ‘দীপান্বিতা অমাবস্যার রাত্রে’। কিন্তু এ বঙ্গে বেশিরভাগ ঘরে তিনি পূজিত হন ‘কোজগরী পূর্ণিমার রাতে’। কথিত, বাংলায় এই পূজা ঘরে ঘরে শুরু হওয়ার পিছনে রয়েছেন বণিক ‘জগৎ শেঠ’। তখন জগৎ শেঠের অল্প বয়সে নামডাক হয়েছিল। তাঁর নাম ‘দিল্লীশ্বরের কানে’ও পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এরপর জগৎ শেঠ দিল্লি গেলে বাদশাহ তাঁর কথাবার্তায় খুশি হয়ে তাঁকে দিল্লিতে থাকতে বলেছিলেন। জগৎ শেঠও দিল্লিতে থেকে গিয়েছিলেন। তাঁর কাজকর্মে দিন দিন বাদশাহ তাঁর ওপর ‘প্রীত’ হতে শুরু করেছিলেন। শেষে একদিন বাদশাহ তাঁকে ইচ্ছেমতো কিছু চাইতে বলেছিলেন। তখন জগৎ শেঠ বাড়ি ফিরে নিজের মাকে সব বলেছিলেন। বুদ্ধিমতী জননী তাঁর পুত্রের মঙ্গলের জন্য পুত্রের মাধ্যমে বাদশাহের কাছে এক অদ্ভুত এক দাবি রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে দিল্লিতে (মতান্তরে বঙ্গের) কোনও গৃহস্থ বাড়িতে যেন আলো না জ্বলে, বাদশাহকে সেই নির্দেশ দিতে হবে। বাদশাহের নির্দেশে সেই নির্দিষ্ট রাতে গোটা দিল্লিতে (মতান্তরে গোটা বাংলায়) কেউ আলো জ্বালায় নি। কিন্তু জগৎ শেঠের মা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে ঘর আলো করে দরজা খুলে বসে ছিলেন। যথাসময়ে দেবী তাঁর দরজায় এসেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘‌‘‌আমি খুব পরিশ্রান্ত, আমাকে একটু আশ্রয় দেবে?’‌’‌ জগৎ শেঠের মা দেবীর ‘‌ছলনা’‌ বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি দেবীকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, তিনি নদীতে স্নান করতে যাচ্ছেন, ফিরে না আসা পর্যন্ত দেবী যেন সেখানেই থাকেন। দেবী তাতে রাজি হয়েছিলেন। তারপরে জগৎ শেঠের মা নদীতে স্নান করতে গিয়ে সেখানেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন। ফলে সেদিন থেকে দেবী জগৎ শেঠের ঘরে থেকে গিয়েছিলেন। সেই থেকে নাকি ‘কোজাগরী পূর্ণিমার দিন’ বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয়েছিল ‘লক্ষ্মী বন্দনা’‌। আজও ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য গৃহস্থ বাড়িতে সারারাত ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়। দোর খুলে বসে থাকেন গৃহিনীরা। গোটা কাহিনীটাই কথিত। তাই সত্য-মিথ্যা নিরূপণের কোন উপায় নেই।

বাংলায় ‘কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো’‌ অনেকেই ‘সরা’‌য় করেন। এটা বাংলার লোকসংস্কৃতির একটা বিশেষত্ব। আগে ‘১৩ রকমের সরা’‌ তৈরি হত। এখন তা ‘৬ রকমে’‌ এসে ঠেকেছে। ‘একলক্ষ্মী সরা’‌য় থাকে লক্ষ্মীর দু’‌পাশে ‘পদ্ম’‌, নীচে ‘প্যাঁচা’‌ - সে আবার উড়ছে। ‘তিন পুতুল সরা’‌তে ‘লক্ষ্মীর দুপাশে দুজন সখী’‌ থাকে। এটাতেও নীচে থাকে ‘প্যাঁচা’‌। ‘ঢাকাই সরা’‌ নানা রকমের হয়। কোনওটাতে ‘জোড়া লক্ষ্মী’‌ থাকে, কোনওটাতে ‘পাঁচ লক্ষ্মী’‌, কোনওটাতে আবার ‘লক্ষ্মীর সঙ্গে থাকেন চার সখী কিংবা রাধাকৃষ্ণ’‌। ‘দুর্গা সরা’‌কে আড়াআড়ি দুভাগে ভাগ করা হয়। ওপরে ‘সপরিবারে মা দুর্গা’‌, তার ওপরে ‘শিবের মুখ’‌, নীচে ‘প্যাঁচা–সহ লক্ষ্মী’‌, আলাদা করে। এই ‘দুর্গা সরা’র আর একটি রকম বা প্রকার হল ‘গণকা বা আচার্যি সরা’। ‘সুরেশ্বরী সরা’য় আবার ‘দুর্গার পরিবারের প্রত্যেকের ছবি’ আলাদা আলাদা করে আঁকা থাকে। এখন কথা হল, কেন এই সরায় পুজো? সম্ভাব্য কারণ দুটো। এক, ‘সরা’ - ‘গর্ভবতী নারীর প্রতীক’। এর সঙ্গে ‘উৎপাদনশীলতা’ আর ‘সমৃদ্ধির যোগ’ আছে। দুই, ‘সরা’ হল ‘পৃথিবীর পিঠ’। ‘বসুন্ধরার পূজা’ই ‘লক্ষ্মীপূজা’, সেজন্যও এই আয়োজন। আজকের রাত কোজাগরীর রাত। এ রাতে নাকি ‘নিদ্রা নিষিদ্ধ’। দেবী নাকি ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞেস করবেন, ‘‘কো জাগর?’’ অর্থাৎ, ‘‘কে জাগে?’’ না জাগলে রুষ্ট হবেন তিনি। ‘‘নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ কো জাগর্তীতি ভাষিণী’’। ‘স্মার্ত রঘুনন্দন’ আরও জানাচ্ছেন, দেবী নাকি বলবেন আজ রাতে, ‘‘তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ’’। অর্থাৎ, ‘‘আজ রাতে যে পাশা খেলবে, জুয়োর দানে রাত জাগবে, দেবী নাকি তাকেই বিত্ত দেবেন।’’ সত্যিই কি তাই? ‘মহাত্মারা’ কিন্তু অন্য কথা বলেন। তাঁদের মতে, শ্লোকে যে ‘অক্ষের কথা’ বলা আছে, সেটা মোটেই ‘একার্থবাচী শব্দ’ নয়। এর অনেক অর্থ। এক, অবশ্যই ‘পাশা খেলা’; দুই, ‘কেনাবেচার চিন্তা’; তিন, ‘রুদ্রাক্ষ’। ‘জকের রাতে’ তাই ‘জুয়াড়িরা পাশার দান দেবেন’। ‘ব্যবসায়ী’ ‘ব্যবসার কথা ভেবে রাত কাটিয়ে দেবেন’। আর ‘যোগীর’ হাতে থাকবে ‘জপমালা’, ‘তাঁর রাত কাটবে জপ করে’। আত্মার প্রকৃতি অনুযায়ী দেবী ‘বর’ দেবেন। যে যেমন সে তেমন ফল পাবে।‌‌

দুর্গাপূজা যেমন মূলত বারোয়ারী, লক্ষ্মীপূজা গৃহস্থের পূজা। যে রাতে লক্ষ্মীর পূজা হয়, সেটি হলো ‘কোজাগরী পূর্ণিমা’। ‘কো জাগতী’ – অর্থাৎ ‘কে জেগে আছ’ – কথাটি থেকে ‘কোজাগরী’। ‘কোজাগর’ মানে, ‘কে জাগে?’ যাঁর নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে। যাঁর প্রচুর আছে সে হারানোর ভয়ে জাগে! ভক্তদের বিশ্বাস, পূজার পর ওই রাতেই নাকি মা ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন কে জেগে আছে। আর যে জেগে থাকে, তাঁর হাতেই ধরিয়ে দেন ধন সম্পদে পরিপূর্ণ ঝাঁপিখানি। লক্ষ্মীপুজোয় যে আল্পনা দেওয়া হয়, তাতে মায়ের পায়ের ছাপও আঁকা হয়। বিশ্বাস ওই পথেই মা ঢুকবেন গৃহস্থের ঘরে। লক্ষ্মী ‘চঞ্চলা’। তবে ক্রোধী দেবী নন। তাই যেকোনও গৃহস্থই ‘লক্ষ্মীর ঝাঁপি’ করে ‘লক্ষ্মীর পিঁড়ি’ পাতেন গৃহকোণে। স্থানাভাবে একটি মাত্র ঘরের কুলুঙ্গিতে। উপাচার তো সামান্যই। প্রতি বৃহস্পতিবারে (‘লক্ষ্মীবার’ শব্দটি ব্যবহৃত) সামান্য ফুল-বাতাসা আর ধোয়া পিঁড়িতে চাল পিটুলির আলপনা। সেটাই একটু বড় আকারের এই কোজাগরীর রাতে। আসলে লক্ষ্মী হলো বাঙালির দেবী। ‘লৈকিক দেবী’। আগে আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামে ‘দুর্গাপূজা’ নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং ‘কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা’ই ছিল বড় উৎসব। কোজাগরীর রকমফের ছিল দেখার মতো। ছড়া কেটেই মা লক্ষ্মীকে আবাহন করতেন গৃহস্থ। করজোড়ে বাড়ির নারীরা একসঙ্গে বলতেন,

‘‘আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি।
দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি।
আঁকি মাগো আল্পনা, এই পূজা এই বন্দনা।’’

সব ছড়ার মধ্যেই থাকে বাসনা, অভিমান এবং আকাঙ্ক্ষা। পেঁচা, কড়ি, ধানের গোলা আঁকার সঙ্গে সঙ্গে তাই ছড়া কাটা হত,

‘‘আমি আঁকি পিটুলির গোলা, আমার হোক ধানের গোলা।
আমি আঁকি পিটুলির বালা, আমার হোক সোনার বালা।’’

সেই সঙ্গে থাকে মন শুদ্ধ করার বার্তাও -

‘‘আঁকিলাম আল্পনা, দূরে ফেলি আবর্জনা।
শুভ-শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।’’
                      
তথ্যসূত্র:---

১- Wanderings of a Pilgrim: In Search of the Picturesque During 24 Years in the East, Fanny Parkes, Munshiram Manoharlal Publishers; Reprint of Pelham Richardson 1850 edn edition (১৯৯৯)।

২- বাংলার ব্রত ও অন্যান্য ব্রত কথা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীপায়ন (২০১২)।

৩- বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়, দে’জ পাবলিশিং (২০১৪)।

৪- শ্রী শ্রী কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা পদ্ধতি, বুক চয়েস।

৫- বাংলার লোকসংস্কৃতি, ড. আদিত্য মুখোপাধ্যায়, অমর ভারতী (২০০৯)।

৬- বাংলার লোকসংস্কৃতি, দেবলীনা দেবনাথ, পরম্পরা (২০১৪)।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments