জ্বলদর্চি

বিশ্ববোধ -- একটা ভাবনা/তড়িৎ ভট্টাচার্য


বিশ্ববোধ -- একটা ভাবনা

তড়িৎ ভট্টাচার্য 


বাইরের বারান্দায় বসে একটা বই পড়ছিলাম তখন, দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছিলো। হেমন্তর বিকেল এক অসাধারণ মায়াবী পরিবেশ তৈরী করে দেয়। আমি বই থেকে মুখ তুলে একটু বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমরা কত ভাগ্যবান। ছটা ঋতুকে আমরা সম্পূর্ণ আলাদাভাবে উপভোগ করতে পারি যা পৃথিবীর আর অন্য কোন দেশের মানুষ পারে না। হালকা হিমেল হাওয়ার খুব পাতলা কুয়াশার আস্তরণ একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে, একটু অন্যমনস্ক হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম একদম ছোটবেলায় আমাদের খেলার মাঠের পরিবেশে ঠিক এমনি সময় কেউ যেন আমায় ডাকলো তাকিয়ে দেখি ক্যুরিয়ার সার্ভিসের এক ভদ্রলোক আমায় ডাকছেন, তার হাতে একটা প্যাকেট। সই করে সেটা নিয়ে খুলে দেখি জ্বলদর্চি'র বিভিন্ন সংখ্যা। “বিশ্ববোধ” নামে একটি পত্রিকা। বিশ্ববোধ আকর্ষণই আগে অনুভব করলাম। পাতা উল্টে দেখি রবীন্দ্রনাথ সহ আরও কয়েকজনের কিছু লেখা যা আগে ছাপানো হয়েছে তারই পুনর্মুদ্রণ আর বেশ কিছু চিন্তাশীল মানুষের অনুভূতি। কিছু পড়ে ফেললাম। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে তাই ঘরে এসে ভাল করে বসে আবার পাতা উল্টোতে লাগলাম। আসলে যে কারণে এত আগ্রহ তা হল ঐ বিশ্ববোধ নামটি। কেমন যেন পুরোনো, প্রাচীন, প্রাগঐতিহাসিক গন্ধ । বিশ্বতো বুঝলাম কিন্তু “বোধ”?  মনে উদয় হলো বোধিসত্ত্বের কথা আর বোধিবৃক্ষের কথা। যে বৃক্ষের তলায় বসে তপস্যার মাধ্যমে তিনি বোধিলাভ করেছিলেন। বোধি অর্থাৎ জ্ঞান – যে জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি বুঝেছিলেন এই প্রপঞ্চময় পৃথিবীর কোন কিছু স্থায়ী নয়, কোন কিছুতেই সুখ নেই, সুতরাং এর প্রতি আসক্তি অবান্তর। সত্য জ্ঞান সত্য বোধিলাভ। আজ তাই বিশ্ববোধ বইটা হাতে নিয়ে আমার সেই অনুভূতিই হলো। কতটুকু জানি আমরা এই বিশ্বের? শুধু মানুষ আর জীবন্ত প্রাণীজগৎ ছাড়া আর কারোও দিকে কি আমাদের নজর পড়ে?  এই যে বিশাল অরণ্যরাজী, মাথার উপর ঘন নীল আকাশ গভীর থেকে গভীরতর। মহাসাগরের জলোচ্ছ্বাস আর পর্যায়ক্রমে ঋতুচক্রের পরিবর্তন একি আমাদের বোধের মধ্যে আছে? আসলে আমরা নিজেরা নিজেদেরই চিনি না। আমরা কি চাই তাই জানি না। আমরা ছুটে মরি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর প্রান্তে। শুধু খেয়ালের বশে আমরা কি বলবো বিশ্বের কথা, যা বিশ্ববোধের বিশেষণে ভূষিত করা যায়। যা লিখি তা কিছুটা কল্পিত ভাবনার প্রতিফলন। আপনি বলতেই পারেন তা যদি না হয় তা হলে লিখবো কি? এটাই তো কথা। নিজেকে তো আগে তৈরী করতে হবে, বুঝতে হবে অপরের ব্যথা বেদনা, দুঃখ কষ্ট যা শুধু মনুষ্যেতর জীবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একটা গাছ যে আপন আনন্দে বেড়ে উঠছে আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকে যখন হত্যা করি তখন কি বুঝি তার কষ্টটা কিংবা কি অধিকার আছে আমার তাকে হত্যা করার – এই তো চলছে বিশ্বজুড়ে। আমার ভেতরে সে বোধই জাগ্রত হয়নি কি করলাম আমি, অথচ কি সুন্দর নাম বিশ্ববোধ – আর তাতে কল্পনার রং তুলি দিয়ে আমি ছবি আঁকার চেষ্টা করছি। কি আশ্চর্য ? এই শরীরটা খুব সুন্দর জায়গা এর মধ্যে দুটো জিনিষ আছে। দুটো মন চেতন মন আর অবচেতন মন। যা দেখছি যা শুনছি সব চেতন মনে আর এর মধ্যে যা সত্যিকারের মনে রাখার মতো তা অবচেতন মনের জাদুঘরে জমা পড়ে। জাদুঘর বললাম তার কারণ সেগুলি নিয়ে আমরা নাড়াচাড়া করি না। কিন্তু তাই বলে সেগুলো হারিয়ে যায় না। বহুদিনের সঞ্চিত অসাধারণ সব তথ্য এক হয়ে সৃষ্টি হয় বোধ আর তখনই এই বিশ্বকে নিয়ে কিছু বলা যায় কিংবা লেখা যায়। তার আগে যা বেরুবে তা কাল্পনিক তাই বিশ্ববোধ নিয়ে লেখার ব্যাপারে সম্পাদক সবার সামনে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। সেটা কি আমরা বুঝতে পেরেছি ? বিশাল এ পৃথিবীর কতটুকু জানি ? তার বিরাটত্বের কাছে আমি নেহাৎই অতি ক্ষুদ্র। কিন্তু ঐ বোধই আমাদের বুঝতে সাহায্য করে আর তখনই ঐ বিরাট পৃথিবী আমার কাছে ধরা দেয়। ধরা দেয় তার রূপ মাধুর্য নিয়ে, তার সুখ দুঃখ নিয়ে, তার প্রেম ভালবাসা নিয়ে, তার আকাশের দিকে মাথা তুলে বেড়ে ওঠা নিয়ে আর তখনই যেন একাত্ম হয়ে যাই তার সঙ্গে। মহাসমুদ্রের তীর ধরে হেঁটে চলেছি এক অজানা পথে, গায়ে লাগছে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস, জানি না কোথায় তার শেষ। যদি ফিরে আসতে পারি তখন তোমাদের শোনাবো বিশ্ববোধের কথা – আজ আর নয়।


তড়িৎ ভট্টাচার্য
১৯৪১ সালে ৮ই জুলাই জন্ম। ন’জন ভাইবোনের মধ্যে সপ্তমজন হিসাবে জন্মগ্রহণ। বাবা বিষ্ণুপদ ভট্টাচাৰ্য্য উচ্চ শিক্ষিত এবং অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। ভাই বোনেরা সবাই সরস্বতীর বরপুত্র ছিলেন। তড়িৎ ভট্টাচার্য্যের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন ছিল। স্নাতক হওয়ার পর পরই পিতৃবিয়োগ হওয়াতে তাকে কর্মস্থলে প্রবেশ করতে হয়। ইচ্ছা ছিল বিভূতিভূষণের ওপর গবেষণা করে বাংলায় অধ্যাপনা করার কিন্তু তা হয়নি। তবু লেখার অভ্যেসটা তারই হাত ধরে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে স্ত্রী বিয়োগের পর। পুত্র, পুত্রবধু এবং নাতনী নিয়ে এখন বাকি পথ চলা। সর্বক্ষণের সাথী লেখা। দিনের অনেকটা সময় কাটে লেখা নিয়ে এবং মনের মতো মানুষ পেলে তার সঙ্গে কথা বলে আনন্দ আহরণ করতে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments